জ্বলদর্চি

শম্ভু রক্ষিত স্মরণে শুভঙ্কর দাস


শু ভ ঙ্ক র  দা স 

কবি শম্ভু রক্ষিত শ্রদ্ধা ও স্মরণে  
মাটির পৃথিবীতে যিনি শুধু কবিতার দরজা খুলেছিলেন, মহাপৃথিবী হয়ে উঠবেন বলে!


"আমি ইন্দ্রিয়ের করতালি শুনতে পাই না
কেবল শব্দের,কেবল ভাষার ভাষাহীনতায় রিক্ত চতুর্দিক
কেবল শব্দ,কেবল ভাষার জন্য সব চিহ্ন অর্থহীন নিরন্তর দুয়ার
বন্য বরাহের মত ঈশ্বরের পৃথিবীতে কোন লোভ দম্ভ নেই আমার"

কবিতার জন্য এমন পবিত্র  আগুনে উচ্চারণ একমাত্র কবি শম্ভু রক্ষিত করতে পারেন। তিনি কবিতার ভেতর চাল-ডাল আলু-তরকারী, মাথার ওপর ছাদ আর লজ্জা ঢাকবার কৌপিনটুকু সংগ্রহ করতেন। আর তাও যদি না সংগ্রহ করতে পারতেন, তখন নিজের নামের যে সুগভীর অর্থ, তাতেই সুস্থিত থাকতে পারতেন। অর্থাৎ  'শম্ভু'র অাভিধানিক 'শম্' মানে শান্তি, চিত্তের স্থিরতা আর 'ভূ' হল ভূমি বা ভূমা। তাতেই আত্মস্থ থাকা। এই আত্মস্থ হওয়ার মন্ত্র বা মন্দির কী? তা হল কবিতা।
কবিতাই কবি শম্ভু রক্ষিতের রক্ষাকবচ। কর্ণ যেমন হস্তে তা পরিধান করেছিলেন তেমনই শম্ভু রক্ষিত নিজের অন্তরে তা বেঁধে রেখেছিলেন। আমৃত্যু কোনো প্রলোভনে বা প্রচারের লালসায় তা খুলেননি! সেই রক্ষাকবচের দরুন এমন এক বলয় নির্মাণ করেছিলেন যে, সমাজ, সভ্যতা সংসার তার অষ্টপাশের কঠিনবন্ধন দিয়ে নিঃষ্পেশন করতে পারেনি! নষ্ট   করতে পারেনি বা পুড়িয়ে ছারখার করতে পারেননি!
যে কবি লেখেন, শুধু লেখেন নয়, বিশ্বাস করেন--- "আমার কবিতা অন্তরের স্বর্গীয় ভাবধারার আবিষ্কার। কবিতা ছাড়া অন্য কোনো পবিত্রতায় আমার বিশ্বাস নেই।"
এই বিশ্বাসের জন্ম হল কী করে? মাটির পৃথিবীতে কিসের জন্য মহাপৃথিবীর দরজা খুলতে তিনি ব্যাকুল ছিলেন! তার একটি মাত্র কারণ, নারীর প্রেম। এবং সেই প্রেমে ব্যর্থতা।
কবি শম্ভু রক্ষিত নিজেই সেকথা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন---
"আমি ভাই ইমারজেন্সির আগে একজন নারীর প্রেমে পড়েছিলাম। প্রেমের শক্তিতেই আমি এই কাজ করেছিলাম" তাই এমনভাবে লিখতে পারেন কবিতায়---
" তুমি ঈশ্বরকন্যা, তুমি আমাকে বিশুদ্ধ কবির জনক হতে সেদিন শেখালে/ব্যক্তিগত মৌলিক দৃশ্য থেকে বিষয় নিয়ে আমি, ব্যক্ত অব্যক্তের/ অবাস্তব মুহূর্তের স্বতন্ত্র আমি, আমার গভীরতর সাম্রাজ্যে তুমি আছো"
এই ধরনের প্রেমিকাস্তুতি বাংলা কাব্যধারায় আনকোরা এবং আশ্চর্য। 
শম্ভু রক্ষিতের ব্যক্তিজীবন যেমন দুঃসাহসিক এবং দুর্বোধ্য, তাঁর কবিতাও তেমনি! এই ধরনের অভিযোগ সুদীর্ঘকাল চলে আসছে। বাতাসে বলাবলি হয়,শম্ভু রক্ষিত অক্ষরে অক্ষরে এমন পাথর সাজান, যা দেবমূর্তিনন্দিত মন্দির না রাক্ষসের গুহা বোঝা যায় না! এত কবিতায় দুর্বোধ্যতার দুর্বাসাোচিত ক্রোধ ও কাঠিন্য বাস করে যে, পড়তে পড়তে নিজেকেই হয়তো অভিশপ্ত করে ফেলবে! এত সূর্যকরোজ্জ্বলহীন জঙ্গল যে, একবার ঢুকলে, আর রক্ষা নেই, একেবারে কোনো হিংস্র বন্যজন্তুর মুখের খাদ্য হতে পারে! এমন ভুরি ভুরি অনুযোগ পাঠক-কবি পরম্পরায় চলেছে। এমনকি কিংবদন্তি কবি শঙ্খ ঘোষ পর্যন্ত বললেন, এক একজন কবির কবিতা তাঁর সমকালের পাঠকেরা সেভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও আগামী দিনের পাঠকেরা তার সঠিক মূল্যায়ণ হয়তো করতে পারবে--- কারণ শম্ভু বর্তমান সময়ের এক শক্তিশালী কবি।"
এই মতামতের মধ্যে "সঠিক মূল্যায়ণ হয়তো" --এই হয়তো এত বিস্তৃতিহীন এবং প্রভাববিস্তারকারী যে, এই সময়ের কবি-পাঠক তাঁর কবিতা পড়েন না! যদিও পড়েন, বোঝেন না! তাই কবি শম্ভু রক্ষিতকে প্রকাশ করার একটা সহজ পন্থা আবিষ্কার করে ফেলল সমসময়, কবিতা নয়, তাঁর জীবন নিয়েই যত আলোচনা চলতে লাগল। যত বিচারবোধ তাঁর আচার-আচরণ ও উন্মাদদশাকে নিয়ে! কবি শম্ভু রক্ষিতের কাব্য-আলোচনা করতে উঠে, বক্তা( যিনি নিজেও কবিতা লেখেন এবং কাব্যজীবন নিয়েই বলতে উঠেছেন) বলতেন, কবি শম্ভু রক্ষিত কবে মঞ্চে উঠে পশ্চাদমুখী হয়ে বসেছিলেন! কবে গঙ্গার ধারে কাকভোরে চিলচিৎকার করেছিলেন! বইমেলার মাঠে দুটো ইট রেখে কীভাবে ভাত রান্না করেছিলেন! শেষ লোকাল ট্রেনে কিভাবে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বাড়ি ফিরতেন! কোনো নবীন কবি না কি তাঁর কাছে "কবিতায় এত জটিলতা আর দুর্বোধ্যতা কেন!"--এই সুরে অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন, তখন নাকি শম্ভু রক্ষিত রেগে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, দোর্ ভাগ, শিশুকে কি শেখাব রমণের আনন্দ!
এই সব। কবিতার অধিক কবির গল্প ছড়াতে লাগল। অথচ যাঁর কবিতা পড়ে মলয় রায় চৌধুরী বলেছিলেন--" কবিতা লেখার জন্য যতগুলি পুরস্কার পাওয়া সম্ভব তার সবকটি দেওয়া উচিৎ ছিল শম্ভু রক্ষিতকে।"
জ্যোতির্ময় দাশ বলেছিলেন---" চর্যাপদ থেকে এতাবৎ বাংলা ভাষায় রচিত যদি উল্লেখযোগ্য দশটি কাব্যগ্রন্থের একটি তালিকা তৈরি করা হয়,তাহলে "প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না" তার মধ্যে স্থান পাবে।"
তাহলে নিশ্চয় কবিতায় এক এমন হাজাদুয়ারী আলোর দরজা যা আছে, যা ভেদ করলেই পথ, সহস্র পথ পাওয়া সম্ভব।পড়তে গিয়ে দেখলাম, সামনে যেটা দুর্গম পাহাড়ের গুহা মনে হয়েছিল, আসলে তাতে সিঁড়ি আছে, ভেতরে আলো আছে এবং স্থাপত্যসুন্দর আপ্যায়নও আছে। যেটাকে অন্ধকার জঙ্গল মনে হয়েছিল,তা যেন দর্শনীয় ফুলের উদ্যান। একজন কবি মাত্র তেইশ বছর বয়সে তাঁর প্রেমিকাকে জানাচ্ছেন, 
"তোমার যৌনাঙ্গকে আমার প্রণতি/তোমার উন্মুখ স্তনে মুখ দিয়ে আমি ব্যবধানহীন বেঁচে রয়েছি"
এরকম আত্মোন্নয়নের প্রেমের  কবিতা আগে লক্ষ্য করা যায়নি! যে দেশে আট থেকে সত্তর বছরের স্ত্রীলিঙ্গ ধর্ষণের করাতে চিরে যাচ্ছে, সেখানে একজন কবির নারীর প্রতি এই বিশুদ্ধ প্রেমার্তি অবাক করে তোলে। প্রেমিকাকে কবি জানাচ্ছেন, "সব মানুষ জন্মকাল থেকে সমান" এমন ভাবনাও নিজেকে শুধু প্রেমিক রূপে  উৎসর্গ করা নয়, মানুষ হিসেবে প্রেমিকার সামনে তুলে ধরে।
আবার প্রতিবাদের ভাষা ব্যবহার যখন করছেন, তা হয়ে উঠছে আশ্চর্য রকম চাঁদধোয়া ছুরি, তিনি যখন বলেন---"আমি আমার শত্রুদের জন্য আমার তেজ ত্রিধা বিভক্ত করেছি/ এবং আমার হৃদয়ে বায়ুদ্বারা বর্ধিত হয়ে/তাদের সঙ্গে এখন বীরের  মত যুদ্ধ করছে"
আবার যখন বলেন---
"রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক রাজধানীতে বাস করে/রাজনীতিবিদরা এক বিভবশালী বিবুধের দ্বারে বসে প্রেরণাপূর্ণ নরক সৃষ্টি করে"
তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই চাবুকটা কাদের জন্য অক্ষরে অক্ষরে শানানো!এখানে 'বিবুধ' শব্দটা দেখে অনেকেই মাথা চুলকোবেন! কিন্তু এটি একটি অর্থপূর্ণ শব্দ।বিবুধ মানে পণ্ডিত। সেইসব পণ্ডিতের কথা বলছেন কবি, যাঁদের কথা আমরা কথামৃত এ পাই।তারা শকুনোচিত পাণ্ড্যিত্যের অনেক অনেক উঁচু আকাশে ওড়েন, কিন্তু যেই ভাগাড়ে পশু পড়ে, অমনি নেমে আসেন ভাগবাঁটোয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে!
নিজের কবিতা নিয়ে নিজেই যেভাবে বলেছেন, সেইরকম আর কেউ বলতে পারবেন না, তিনি সুস্পষ্টভাবে জানান, 'আমার কবিতা তো কেবল সাম্প্রতিককাল নিয়ে নয়, তেরোকোটি বছর আগের পৃথিবী নিয়েও আমি চিন্তাভাবনা করি"
এবং তেরো কোটি বছর পরের পৃথিবী নিয়েও বোধহয় তিনি ভেবে রাখেন। তাই এমন কথা শোনান---
"মীন ও সমুদ্র হয়ে এখানে স্বপ্নময় ইয়ারকি কর তুমি!/ তোমার আড়ালে জ্যোতির মত সূর্য,জ্বলন্ত /তুমি যেন স্বপ্নে এখনো আবৃত।তুমি সূর্য, অনুভাবক, আমি নির্বিকার।/পৃথিবীর আত্মরাশ্রমের ভিতরে তুমি নিরুদ্দেশ, তুমি দৃশ্যমান"
এই কোটি কোটি বছরের পর বেঁচে থাকার আয়ুস্কাল নিয়ে যে কবি জেগে, তিনি ১৬ আগস্ট, ১৯৪৮ সালে হাওড়ার কদমতলার দিদিমার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নন্দলাল রক্ষিতের সিন্দুকের ব্যবসা ছিল। মা রাধারাণি দেবী সেকালের সাধারণ গৃহবধূ। শম্ভু রক্ষিতের শৈশব  অতিবাহিত হয় পূর্ব মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়ায়।লেখালেখি শুরু করেন ৬৪-৬৫সালে। সাহিত্য জীবন শুরু করেন 'মা' নামে হাতে লেখা পত্রিকা দিয়ে। শম্ভু রক্ষিতের প্রথম ছাপা কবিতা "আমি বাঁচতে চাই" প্রকাশ হয় স্কুল পত্রিকায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ" প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। ষাটের দশকে মাঝামাঝি 'যুগান্তর' পত্রিকায় সপ্তাহে একটি-দুটি লেখা ছাপা হলে পেতেন ১৫ টাকা। সেই টাকা জমিয়েই প্রকাশ করেন কাব্যগ্রন্থ " প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না" যা একটি মাইলস্টোন হিসেবে ধরা হয়। তখন শম্ভু রক্ষিতের বসয় মাত্র তেইশ। বিয়াল্লিশ বছর ধরে প্রায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা "মহাপৃথিবী"। যে পত্রিকা অসংখ্য বিখ্যাত কবিতা এবং কবির জন্ম দিয়েছে। আবার নিজের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল -- রাজনীতি(১৯৬৭),পাঠক অক্ষরগুলি(১৯৮২),স্বরাহত নিষাদ(১৯৯০), আমার বংশধরেরা(১৯৯৭),আমি করর না অসুর(২০০৪),ঝাড় বেলুনের জোট(২০১৩)ইত্যাদি। 
অথচ সারাটা জীবন কবিকে দারিদ্র্য এবং অবহেলা কুরে কুরে খেয়েছে। যাঁকে অার্থিক সহযোগিতা করার জন্য চল্লিশজন শিল্পী ছবি এঁকে প্রদর্শনী করেছেন, যাঁকে জরুরি অবস্থায় জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছে, যাঁকে তাঁর সমসাময়িক কবি এবং দিকপাল কবিগণ শক্তশালী কবি বলে বরণ করে নিয়েছিলেন, তাঁকেই অভাবে, অন্ধকারে, অপ্রচারে তিলে তিলে শেষ হতে হয়েছে।কোনো সরকারি বা বেসরকারি পুরস্কার সেভাবে তাঁর কপালে জোটেনি! যাঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে জ্যোতির্ময় দত্ত বলেছিলেন--" এই বুনো অসামাজিক শব্দ আবিষ্কারক ও নির্মাতা হাতে একটা পেন মাত্র সম্বল করে বেরিয়েছে বিশাল জগতের সঙ্গে টক্কর দিতে"
সেই টক্কর যেন কোনোদিন শেষ হল না! লড়াই চলতে লাগল আজীবন!
তাঁর প্রতিটি অক্ষরের মতো তাঁর কালো কালো কবিতার জীবন কৃষ্ণবর্ণ হয়েছে তবুও তিনি কবিতার ভেতর সেই আশ্চর্য রঙা পালক নির্মাণ করেছিলেন, যার কোনো ভার নেই, ভীতি নেই এবং ভয়ংকর ধ্বংস নেই।
আছে শুধু এক স্বরবর্ণ কবির ভালোবাসা।যার কবিতার জন্য কোনো হসন্ত লাগে না, তিনি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই যেন বলতে চেয়েছিলেন, "ফিরে যাব আমি" কবিতায়---
এখানে আনন্দ নেই, নিখাদ অন্ধকার,আলোর/ ক্ষীণতম আভাস নেই/ফিরে যাব/ আমি নদীর শরীরে রূপালি আলোর খেলা দেখব/ এবং ঝকঝকে রঙিন সোনালি মাছ"
সেই আদিম পৃথিবীতে কবি শম্ভু রক্ষিত ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। ২৯,মে ২০২০ তে এই লকডাউনের মধ্যে, এই করোনাকরাগারের মধ্যে তিনি মহাপৃথিবীর পথে পাড়ি দিয়েছেন, কারণ তিনি নিজেই বলেছেন---
"আমি পাথরচাপা রহস্য বই কিছুই নয়/ স্বপ্ন বানাবার কারিগর হওয়ার মতোও নয়/ কেননা আমার হাতে জুন ঘাস/ ভেষজ শিকড়বাকড়/ কেননা আমার জিভের ডগায় শান্ত এক নীল চাদর"।
-------------

Post a Comment

2 Comments

  1. সুন্দর স্মরণ-শ্রদ্ধা। কবিতাটিও সুন্দর লেখা। এ পৃথিবীর কবি হয়েও কবি শম্ভু রক্ষিত মহাপৃথিবীর পথে হেঁটেছিলেন। পায়ে কাঁটা ফুটেছে অজস্র, তবু যাত্রা থামাননি।

    ReplyDelete
  2. কবি শম্ভু রক্ষিত শ্রদ্ধা ও স্মরণে লেখাটি খুব ভালো লাগল।
    তাঁর সম্পর্কে কিছু অজানা কথা জানলাম।

    ReplyDelete