জ্বলদর্চি

বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন / সন্দীপ কাঞ্জিলাল


স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল  


বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন 

ভাষা আর সাহিত্যের অবিরাম স্রোত জাতির উত্তরণ অস্তিত্বের পরিচায়ক ! অসমে অসমিয়া আর বাঙালির সম্পর্ক তিক্ত মধুর! "আসাম শাসন বিবরণী"(১৮৭৫-৭৬) শ্রী হট্ট কাছাড় জেলার সঙ্গে গোয়ালপাড়া জেলাও বাংলা ভাষী হিসাবে বলা হয়েছে। ব্রিটিশ শাসন কালে বর্তমানের দুই বাংলা থেকে প্রচুর বাংলাভাষী শ্রমিককে আনা হয়েছিল বর্তমান নগাঁও তে। বসবাসের জন্য তাদের জমি দেওয়া হয়েছিল। শ্রমিক কৃষকের সঙ্গে অনেক শিক্ষিত বাঙালিকেও আনা হয়েছিল সরকারি কার্য পরিচালনার জন্য। ব্রিটিশ সরকার এনেছিল। ব্রিটিশের আগে ও অসমে বাঙালিদের বসবাসের সুযোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন রাজা রুদ্রসিংহ। হলিরাম ঢেকিয়াল ফুকন তার 'আসাম বুরুঞ্জি'তে লেখেন  "বঙ্গদেশ ও হিন্দুস্তান প্রভৃতি নানা দেশ লোক প্রেরণ করিয়া নৃত্যগীত বাদ্য ও অন্য তদেশীয় উৎকৃষ্ট দ্রব্য আনাইলেন। " ১৮২৬-৭৪ সাল পর্যন্ত অসম বাংলা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময় রেভিনিউ কমিশনার জেনকিনস বলেছিলেন যে অসমে বাংলা ভাষার প্রচলনের সিদ্ধান্ত তার ছিল। প্রসেনজিৎ চৌধুরী, শিবনাথ বর্মনের মতো মননশীল প্রগতিবাদী লেখকরা এই যুক্তিকে পরে বিরোধিতা করে। 

লক্ষীনাথ বেজবরুয়া ' জোনাকী ' পত্রিকায় লেখেন, " সরকার অসমিয়া ভাষাকে কোণঠাসা করে বাংলা ভাষাকে অসমের ভাষা করতে চিরকাল লড়াই করেছিল,..... অসম সরকারের বাংলা ভাষার ওপর অশেষ মায়া।" মাতৃভাষার অবলুপ্তি কোনো সমাজ মানতে পারে না। অন্যদিকে খৃষ্টান পাদ্রীরা তাদের ধর্ম প্রচারের জন্য অসমীয়া ভাষাকে গুরুত্ব দেয়।  শেষে ১৮৭২ সালে অসমের স্কুল থেকে বাংলা ভাষা সরিয়ে অসমীয়া ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ 'ভাষা বিচ্ছেদ' প্রবন্ধে আশা প্রকাশ করলেন যে, সাযুজ্য বশত অসমিয়া ও ওড়িয়া ভাষা বাংলা ভাষার সাথে একদিন মিশে যাবে, কিন্তু  লক্ষীনাথ বেজবরুয়া এই কথার বিরোধিতা করেন।
বাংলা ভাষার প্রচলন বিস্তর প্রভাব  ফেলেছিল অসমের অর্থনীতিতে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অসমের যুব সম্প্রদায় চাকুরী পাওয়ার ক্ষেত্রে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবলো বাঙালি চাকুরী প্রার্থীদের। 'ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামত অসমর অবদান ' গ্রন্থে লক্ষীনাথ তামুলী লেখেন, "বাঙালি বিদ্বেষে ভাষার স্বাতন্ত্র্য হারানোর আশঙ্কার চেয়ে বেশি ছিল আর্থিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিতে ধ্বস নামার চিন্তা।" 

এবার শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯১৬ সালে 'অসম ছাত্র সাহিত্য সম্মেলনী' প্রতিষ্ঠা হয়। অসমিয়া জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব দিল এই সম্মিলনি। জাতি জনগোষ্ঠীর বিভেদ সংঘাত অসমের জনজীবনকে অস্থির করে তুললো। অসমের বাংলা ভাষী মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হল। দেশভাগের পর বাংলাদেশ থেকে অনেক বাঙালি আসায় সংকট আরও ঘনীভূত হল। এই আন্দোলনের ফলে বাঙালিরা নিজের ভূমিতে উদ্বাস্তু রূপে পরিগণিত হলো। 

বিশেষ করে আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে বাঙালি এলাকায় এর প্রভাব পড়ে।  এমতাবস্থায়  ১৯৫০ সালে অসমে গড়ে ওঠে " বাঙালি খেদাও " অভিযান। ১৯৬০ সালের ৩রা মার্চ অসমের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা বিধানসভায় অসমিয়াকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা ঘোষণা করে। এর প্রতিবাদে ১৯৬০ সালের ১৬ ই এপ্রিল শিলচরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা এক নাগরিক সভা আহ্বান করে। ঐ সভায় অধ্যাপক শরৎচন্দ্র নাথের নেতৃত্বে সরকারি ভাষা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কমিটি হয়।

তাছাড়া শিলচরে ২ ও ৩ জুলাই চপলাকান্তের সভাপতিত্বে " নিখিল আসাম বাঙলা ভাষা  সম্মেলন " নামে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতদসত্ত্বেও ১৯৬০ সালের ১০ ই অক্টোবর আসাম রাজ্যের সর্বত্র অসমিয়া ভাষা প্রয়োগের জন্য বিধানসভায় ভাষা বিল উত্থাপন ও পাশ হয়। এভাবে আসামের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ লক্ষ লক্ষ বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে সরকারি ভাষা করার মৌলিক অধিকারের দাবি অগ্রাহ্য করে। এই আইনের প্রতিবাদে রাজমোহন নাথের সভাপতিত্বে ১৮, ১৯ ও ২০ নভেম্বর শিলচরে অনুষ্ঠিত হয় "সংগ্রাম পরিষদ" এর এক বিশাল সম্মেলন। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় "যদি আইন করে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার সমমর্যাদা দেয়া না হয় তবে বাঙালী  সমাজের মৌলিক অধিকার ও মাতৃভাষা রক্ষার্থে আসামের বাংলা ভাষা অধ্যুষিত অঞ্চল গুলো বৃহত্তর আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়ে পড়বে।" 

অবশেষে আসে ১৯ মে। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। উত্তেজিত জনতার প্রতিরোধে সরকারের বাহিনী ট্রেন চালাতে ব্যর্থ হন। ১৯ মে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ এদের অনেককেই গাড়িতে তুলে
অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। বিভিন্ন দফায় লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাসের ব্যবহার করা হয়।বেলা আড়াইটার দিকে রেলস্টেশনে কর্তব্যরত বি এস এফ এর সদস্যরা হঠাৎ গেরিলার ভঙ্গিতে গুলিবর্ষণ আরম্ভ করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষনাৎ শহীদ হন ৯ জন। তারা হলেন - সুনীল সরকার, সুকমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরনী দেবনাথ,  হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কমলা ভট্টাচার্য,  কানাই নিয়োগী। পরদিন স্টেশনের পুকুর থেকে সত্যেন্দনাথ দেবের বুলেটবিক্ষত দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেন্দ্র সূত্রধর। মোট ভাষাশহিদদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ জন।

১৯ মে পুরো দিনটি ছিল উত্তাল ও ঘটনা বহুল। প্রশাসন এর কার্ফু জারি করে,  গ্রেফতার করা হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। কিন্তু এতেও ক্ষান্ত হননি আন্দোলনকারীরা। তাদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ওই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে কতৃপক্ষ বাধ্য  হয়। ১১ জন ভাষা শহীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর দেওয়া নির্দেশের উপর ভিত্তি করে গৃহীত সংশোধনী আইনে  কাছাড় জেলায় বাংলাভাষা ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। এভাবেই আসাম রাজ্যে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধানসভায় স্বীকৃতি পায়।

ভাষা আন্দোলন ইতিহাসে ১৯মে র ঘটনা  একটি স্মরণীয় অধ্যায় হওয়া সত্ত্বেও আমরা  অনেকেই এ ব্যাপারে জানি না। ২০০৩ সাল থেকে  ভাষা- আন্দোলন  স্মৃতিরক্ষা পরিষদ এই দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতি বছর  ১৯ মে কেন্দ্রীয় শহীদ  মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে  এবং আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে। এইভাবে আসামের বরাক উপত্যকায় বেঁচে থাকলো "মোদের গরব,মোদের আশা,আ মরি বাংলা ভাষা।"

Post a Comment

2 Comments

  1. ধন্যবাদ। ভালো উদ্যোগ। অজানা কে জানানোর মহান দয়িত্ব।

    ReplyDelete
  2. খুবই তথ্যবহুল আর প্রয়োজনীয় লেখা। লেখককে অভিনন্দন। ১৯ এর ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা।

    ReplyDelete