জ্বলদর্চি

সুভান


সু ভা ন


আমার বুকের গভীরে কোন লালন বসে কাঁদে

এই ভাবে একদিন আমি 
মাটি খননের কাজ নিয়ে গ্রামছাড়া হবো।
তোমার সোনাশরীরের গ্রাম থেকে
আমাদের ফলনের দেহজমিন থেকে
দূরে চলে যাবো তুমি টেরও পাবেনা।

এই পদবীহীন কবিজন্ম আমার
জাতের কী নাম তাও লোকে সন্দেহে ডাকে।
অক্ষরের কাছে কিন্তু তুমি আমাকে আর কোনওদিন 
জলের মতো জড়িয়ে ধরতে পারবে না।

গ্রাম ছিঁড়তে ছিঁড়তে তোমার ঘ্রাণ ছিঁড়তে ছিঁড়তে
আমি এমন একটা কাঁটাতার হয়ে যাবো, যেন 
বাংলাভাষার জীর্ণ পতাকা বুকে জড়িয়ে নিয়ে 
তোমার এক পুরনো প্রেমিক; তোমার শাড়ির আঁচলপুর থেকে 
নিখোঁজ হয়ে যাবো কেউ জানবেনা।

সারাগ্রাম জুড়ে সন্ধে হবে, শহরেও খুব সন্দেহ হবে
হঠাৎ কি হল আমাদের, এই শ্যামঅঙ্গ ছেড়ে
তুমিও কি শেষে সেবাদাসী হবে বৃন্দাবনে রাই?
মাটি খনন আসলে নিজের কাছে নিজেকেই খোঁড়া
আমি নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে কত গভীরে
ডুবে যাচ্ছি তুমি জানো?

দেখতে দেখতে গ্রামে মেলা আসবে
চড়ক, গাজন, শিবের মেলা, মৃৎশিল্পীর মেলা
রাই, গ্রামে মৃতশিল্পীর মেলা আসেনা কোথাও?

পোড়ামাটির গয়নায় তোমাকে অপরূপ লাগতো
গ্রামের সব প্রেমিকগাছেরা দিওয়ান হত, জানি
আমিও কেমন মাটিপোড়া অপরূপ শ্মশান হয়ে
ঝিলিম পারের গ্রাম আঁকতাম আমাদের। 
ছাই-ছাই আর অন্ধ-অন্ধ, হিম আর নিচু কুয়াশায়।

নতুন গ্রামে এখন আমি সুভাষ নামে বনবাদারে ঘুরি
কৃষ্ণশাবকদের দলে এখনও বাঁশি বাজাই বিকেলবেলা।
আমার নামের কলহ ও কলঙ্ক ; কালরাত্রি ও ভৈরব
সমস্তটাই নদী জানে। পাড়া ও পড়শিহীন আশিক।

রাইকিশোরী, 
তুমি কেন একটিবার 
বিষণ্ণ মাটি সরিয়ে দেখলে না।

আমার বুকের গভীরে কোন লালন বসে কাঁদে...
ভাটিয়ালি

শূন্যতার দেহ থেকে বিষাদ নামিয়ে রাখি, 
ধ্বনিবিরাম নেয় ; শব্দহীন সন্ধে কেটে যায়
আলোসাক্ষাতে, আঙুলের দিকে ক্রমশ নীল
অভিমান তীব্র ঘামে কাতর হচ্ছে নিদ্রাহীন উপসর্গে
কোথায় ভাঙছো নিজেকে পুনরায়? চোখের জল...
যেভাবে তুমি ধারন করেছ মাটি, জলের বিন্যাস। 
দেহমলিন হল, পূর্নতা ঘুরতে ঘুরতে দু পায়ে
রাত্রি জাগে, যেন আদরঘুঙুরে জড়িয়ে নিচ্ছ চাঁদ
এভাবে গ্রহন পরাভূত হয়; আত্মপীড়ার নিচে কাঁদে
কিশোরীরাগ, সীমানা আঁকে কথার কুয়াশাঘেরা মেঘ
কাছে টেনে ধরে কোমল গান্ধার, বুকে সুনিদ্রা হাসে
বৃষ্টিসংলাপ বাজে দুঠোঁটে তোমার___
শরীরে ভাটিয়ালি ভাসে।  


রাই

কথার শরীর ফুরিয়ে এলে 
যে কৃষ্ণহীন রঙ লাগে
             রাই-অঙ্গে তোমার,
ইচ্ছের ঘরে বিষাদ প্রহেলিকা
তবুও রুহানি আলো এসে ঠিকরায়,
     কাচে।

বুকের গন্ধে নাচে বিকল শ্রাবণ
         এত ভ্রম 
         দুদিকে সরিয়ে রাখা
আল ধরে নেমে যেতে থাকে...
খালি হাত,
         অন্ধবেগ
                  মুঠো নিভৃতে ভরি
ঈষৎ হাওয়া খেলে যায় চোখে
যেন উন্মাদ ঝরনার নিচে
শিলায় লিপিতে মিশে থাকি...

সুখ আর অসুখী আবহে
এই বিলম্বকাল পার হয়ে আসা
একাই শূন্যে কথা বলি, 
একাই আগুনে রাখি মাথা

তুমিও অঙ্গে রাখো রাই...
সে আগুনে ঘর জ্বলে ওঠে,
শ্যামদেহ পুড়ে ছাই ...
কবি

মাঝবরাবর রাস্তা কেটে দিয়ে গেছে যে মিছিল, 
তাদের চোখে অন্ধ, আর দুর্গন্ধের চটিবিপ্লব। 
মাথা খুঁড়ে রাখা এক একটা জলন্ত শ্বাসরোধে
আজ আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
 

তবু তীব্রতা বাঁক নিচ্ছে সন্ধের পর আমাদের ক্ষততে,
অথবা শাসনযোনিতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে রাখছে নির্বেদ আঙুল।
 
যে যন্ত্রনার কোনো আক্ষেপ নেই, হাহাকার নেই,
শুধু মৃত্যুর দিকে ছুটে যাওয়া
পাথরের টুকরো আছে। 
সেখানে আকাশে বিষের বিষণ্ণতা।

বুকের ভেতর যে দহন পোড়ে তার নীচেই 
আমাদের কাঁচা আর আধপোড়া নাভির দাগ... 
যদি খুঁটে খায় খিদের পাগল,
বাক্যের শেষে আজ কবিতাও দেহ হারাচ্ছে,
যেভাবে গণিকার চোখে পুরুষ হারিয়ে যায়... 
শুধু গায়ে লেগে থাকে মাংস আর ঘামের কালো ছাপ। 

কিছুদূর পরপর ধর্মপাগল জমায়েত। 
কিছুদূর পরপর আগুনের ধ্বজা।

দেখি জমির পর জমি শুধু অসুখের 
লাশ সাজানো মাঠে
নির্বস্ত্র, নির্লিপ্ত, নির্বাক কবি হাঁটে...


রাধিকানগর

অনেক দূরের লীলাবতী গ্রাম সে আমার, 
নাম সোহাগচন্দ্রপুর! 

শহরের খাই আমি শহরে কামাই করি রুজি আর
সৎকার করা পোড়ামাটি ; কাঠ, টিন, বালি আর মাটি আর ঘরোয়া মাচান। তিনকোণা গৃহঋণ... 

তবু মন পড়ে থাকে লীলাবতী গ্রামে।
রূপসা নদীর জলে। 

সবই কাল্পনিক। 
আসলে কিছুই তো নেই। 
ফাঁকা ও উলটে রাখা কুঁজো।

শ্রীরাধা হেঁটে যায় নদীপারে,  
আমি ও নাগর 
শহর পেরিয়ে বদরাগী শুখা জমিন পেরিয়ে
স্নানের দৃশ্য দেখি, অপরূপ সে লীলাবতী স্নান

ছায়া ভেসে যায়, 
কার পীড়া বুকে নিয়ে রাখালিয়া সন্ধে শ্মশান 
পোড়ে দাউ দাউ পোড়ে ক্ষীণ।

আমার তো তিনকোণা গৃহঋন...
বারোমাস্যা শাওনসময় ঝরে পরে
আমার শহরঘেঁষা শুখা মাঠ ও ঘাটায়...
রাধারাই হেঁটে যায়, 
দূরে তার শ্রীধর প্রেমিক। লাঠিয়াল। 

তারও অনেকটা দূরে লীলাবতী গ্রাম সে আমার। 
আমি ডাকি সোহাগী চন্দ্র নূর...
আমি ভাবি রাধিকানগর...

-------



Post a Comment

0 Comments