জ্বলদর্চি

সন্দীপ কাঞ্জিলাল || পর্ব - ৩


অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল || 
পর্ব - ৩

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল  

আঁতেল দেবতা মুনি ঋষি! 
 
বায়ুপুরাণের ৫৫নং শ্লোক, " মানুষস্য শরীরস্য সন্নিবেশস্তু যাদৃশঃ।/  তল্লক্ষণং তু দেবানাং দৃশ্যতে তত্ত্বদর্শনাৎ"। পুরাণ বিশারদ 'নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী' এর অর্থ করেছেন, "দেবতাদের সমস্ত লক্ষ্মণ যেখানে মানুষের মত, সেখানে ভগবানকে শুধু মানুষের মত দেখতে হবে - এইটুকুই নয়, তাদের আচার-ব্যবহার মানুষের মত হবে এটাই স্বাভাবিক। অতএব আমাদের মানুষের মধ্যে যেমন সবাই আঁতেল নয়, তেমনি দেবতাদের মধ্যেও সবাই জ্ঞানী নয়।
প্রথমেই যদি ধরি, আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত কথা 'ন্যাকা চৈতন্য'। কেন বলে? একটু ভাবলে আমরা পাই, মানুষ যখন বিপদে পড়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর কাছে যেতেন, তখন তিনি বলতেন,  "কৃষ্ণের শরণাগত হও উনি তোমাদের রক্ষা করবেন।" আশ্চর্য আপনি মুখে বলছেন বড় বড় জ্ঞানের কথা, অথচ বিপদে পড়লে কৃষ্ণ দেখাচ্ছেন। এটাকে আঁতলামি ছাড়া কি বলবো বলুন। এই কৃষ্ণের কথায় আসি। সকলেই জানি কৃষ্ণের ছোটবেলায় নাম ছিল 'গোপাল'। যখন সেই ছোটবেলা থেকে এই 'গোপাল' পরের বাড়ির মেয়েদের সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলো, তখন অভিযোগ এলেও মা যশোমতী বলে যাচ্ছেন, 'দুগ্ধমুখ গোপাল'।  একথা শুনে ব্রজের যুবতীরা মুচকি মুচকি হাসছে।  আর আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর' মহাশয় এসব শুনে লিখলেন,  "গোপাল অতি সুবোধ বালক।" 

আবার দেখুন ব্রহ্মা! যিনি সৃষ্টির আধার! তিনি তার কন্যা সরস্বতীকে জন্ম দিয়েই, তার রূপে মোহিত হয়ে তার সঙ্গেই মিলন সম্পূর্ণ করলেন। আবার মিলনের পর, মিলনের দেবতা 'কামদেব' কে অভিশাপ দিচ্ছেন - শিবের চোখের আগুনে ভস্ম হওয়ার জন্য।  ব্রহ্মা জ্ঞানী দেবতা! অথচ তাঁর এই বেচারা 'কামদেব'কে শাপ দেওয়া আঁতলামি ছাড়া আর কি-বা বলবো! 

এবার 'গীতা'প্রসঙ্গে আসি! গীতার প্রথম কথা প্রশ্ন করা চলবে না! প্রশ্ন বা সন্দেহ করলে নরক আপনার অতি অবশ্যই। আবার ভেবে দেখুন যখন শয়ে শয়ে মৃত মানুষ আর আত্মীয় স্বজনদের মরতে দেখে, অর্জুন-মানুষ, যুদ্ধ করবে না বলছে,  অথচ কৃষ্ণ ভগবান ইনিয়ে বিনিয়ে যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে বলছে, যুদ্ধই শেষ কথা। এবার গীতা আমাদের শ্রেণীকক্ষে পড়ানো হবে। সেখান থেকে জানতে পারবো কোনও প্রশ্ন নয়। যুদ্ধই হচ্ছে সারাৎসার, এসময় যুদ্ধ লাগলে কেমন হবে বলুন তো? 

দেবতাদের আরও অনেক আঁতলামি যা বলে শেষ করা যাবে না। মোট কথা যত ধম্ম কম্ম পাপ পূণ্য এই দু'পেয়েদের বেলায়। এবার আসি ব্রাহ্মণ চূড়ামণি ঋষিদের আঁতলামিতে।
সাধারণ মানুষের ধৈর্যচ্যুতিতে কোনও মহিলাকে ধর্ষণ করলে পাপ শুধু নয় দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু ঋষির বেলায় এটা সাময়িক ধৈর্যচ্যুতি। তাই পরাশর-সত্যবতী বা বশিষ্ঠ-অক্ষমালার দোষ ধরা যাবে না। অর্থাৎ নিজের জন্য যেটা নৈতিক অন্যের জন্য সেটা অনৈতিক বানানোর মতো কূটকৌশল এদের থেকে বেশি আর কেই-বা জানে?  আমরা পুরাণ খুললেই দেখবো ব্রাহ্মণ গুরুর একাধিক স্ত্রী। স্ত্রী বলা ভুল।  স্ত্রী একজন আর বাকিরা তারা শুধু ব্রাহ্মণ মহাশয়ের মনোরঞ্জনের জন্য। অবশ্য এ বিষয়ে 'মনু'র অনুমোদন ছিল। অনেক সময় ব্রহ্মচারী শিষ্যও উপবাসিনী গুরুপত্নীদের উপবাস ভাঙাতো। আবার এই মুনি ঋষিরা মানুষকে বলছে খুব সাবধান, নারী 'নরকের দ্বার'। এরা অনেক 'ছলা কলা' জানে। আগেকার দিনে এখনকার মতো সেক্স-চেঞ্জ ও হতো। মহাদেব শিব নাকি নিয়ম করেছিলেন তার বিহারস্থানে পুরুষ ঢুকলেই সে মেয়ে হয়ে যাবে। 'মনু'র ছেলে ইল রাজা সেখানে ঢুকে আবার মেয়ে হয়ে গেল।  তার নাম হল 'ইলা"।
আবার দেখুন, যদুবংশের কুমার শাম্ব ব্রাহ্মণ মশাইয়ের সঙ্গে একটু ঠাট্টা ইয়ার্কি করেছিলেন। বাচ্চা ছেলেরা কেন? আমরাও মাঝে মধ্যে করে থাকি! তাই বলে অভিশাপ? বংশধ্বংসের অভিশাপ দিতে হবে।?  'কৃষ্ণ ' 'ভগবান' ছিলেন, তিনি ইচ্ছে করলে এ অভিশাপ ব্যর্থ করে দিতে পারতেন। তিনি করলেন না, কারণ ব্রাহ্মণের অভিশাপ সত্য করতেই হবে। মোটামুটি বামুন মহাশয় যদি রাগেন, বা অভিশাপও দেন কিংবা কাউকে হত্যাও করেন, তবু তাকে প্রণাম করতেই হবে। এটা আঁতলামি ছাড়া আর কি? 

সবশেষে মনে পড়ে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ' কামু'র " দ্য প্লেগ" উপন্যাসের একটি বাক্য- " সন্ন্যাসী না হতে পেরে তারা ডাক্তার হয়েছিল"। অর্থাৎ এই সব দেবতা মুনি ঋষি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেও পারেনি। তাই ওদের মানুষ হতে না পারার জন্য যে যন্ত্রণা তা থেকে ওদের আঁতলামি, আমরা ক্ষমা সুন্দরদৃষ্টিতে দেখবো। কারণ ওরা দেবতা! মুনি! ঋষি। আমরা মানুষ।

Post a Comment

0 Comments