জ্বলদর্চি

তুলসীদাস মাইতি || পর্ব - ৬

               চিত্র- তুলসীদাস মাইতি  

হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব- ৬

তু ল সী দা স  মা ই তি


বাংলা কীর্তন গান : পদাবলীকীর্তন, সংকীর্তন ও অন্যান্য 

"সাহিত্যের ভূমিতে ওর উৎপত্তি, তার মধ্যেই ওর শিকড়, কিন্তু ও শাখায় প্রশাখায় ফলে ফুলে পল্লবে সংগীতের আকাশে স্বকীয় মহিমা অধিকার করেছে" দিলীপ কুমার রায়কে লেখা বাংলা কীর্তন গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক এমনটি বলেছিলেন। সংগীতচিন্তা গ্রন্থে তিনি বলেছেন "বাংলাদেশে কীর্তন গানের উৎপত্তির আদিতে আছে একটি অত্যন্ত সত্যমুলক গভীর এবং দূরব্যাপী হৃদয়াবেগ। এই সত্যকার উদ্দাম বেদনা হিন্দুস্থানী গানের পিঞ্জরের মধ্যে বন্ধন স্বীকার করতে পারলে না…...। অথচ হিন্দুস্থানী সংগীতের রাগ রাগিনীর উপাদান সে বর্জন করেনি, সে সমস্ত নিয়ে সে আপন নূতন সংগীতালোক সৃষ্টি করেছে।" এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ তার লেখার নানা সূত্রে বাংলা কীর্তন গানের নিজস্ব রূপটিকে প্রকাশ করেছেন। তার সাথে বাংলা গানের স্বতন্ত্র পরিসরে কীর্তন গানের গুরুত্বটিও বুঝতে সহজ হয়।

বাংলা কীর্তন অনেক বড়ো একটি ক্ষেত্র। তার ইতিহাস, বিবর্তন ও নানাবিধ শাখা-প্রশাখা নিয়ে তার ব্যাপ্তি। অল্প পরিসরে তাকে তুলে ধরা খুব দূরূহ কাজ। ভারতীয় সংগীতের বিশেষ এক পরম্পরা থেকেই বাংলা কীর্তনের জন্ম। কিন্তু বাংলার সাংস্কৃতিক সামাজিক মানসিক আবহেই সে একটা স্বতন্ত্র সংগীতধারা হয়ে উঠতে পেরেছে, এবং বাংলা সংগীতের জনপ্রিয়তম পর্যায় হয়ে আজও স্বমহিমায় টিকে রয়েছে। কীর্তন, সংকীর্তন, নামকীর্তন, লীলাকীর্তন, রসকীর্তন পদকীর্তন এমন নানা নামে তার বিস্তৃতি। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা জরুরি --সাধারণত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক বিশেষ গায়নরীতিযুক্ত সংগীত কীর্তন হলেও শিব কীর্তন, কালী কীর্তন বা অন্যান্য দেবদেবী বিষয়ক মহিমা প্রকাশকেও কীর্তন বলা যায়। তবে  একটা সময় থেকে রাধাকৃষ্ণবিয়ক গুণ মহিমা প্রকাশ করার জন্য সংগীতকেই  কীর্তন বলা হয়ে থাকে। পণ্ডিতরা বলে থাকেন "সুরে তালে এবং করতাল অথবা করতাল ও মৃদঙ্গ সহযোগে ভগবানের নাম অথবা কীর্তি গান- আবৃত্তি অর্থে কীর্তনগান প্রচলিত রয়েছে।"  চৈতন্যের সময় থেকে তার রূপ অনেকটাই বদলে যায়। এবং কীর্তনের সর্বজনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে অনেকটাই। পুরাণেও কীর্তনের  নানান প্রসঙ্গ  আছে । কালিদাসের মেঘদূতে শিবের মহিমা কীর্তনের প্রসঙ্গ আছে। বাংলা ভাষার  উদ্ভব কালে হিন্দুধর্মের প্রাবল্য ছিল। তুর্কি আক্রমণের পর বাংলায় যখন হিন্দুধর্ম বিপন্ন হতে পারে এই সূত্রেই ভাগবতের অনুবাদ শুরু হল। মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় ও অন্যান্য কৃষ্ণমঙ্গল গ্রন্থের রস সঞ্চারিত হতে থাকল বাঙালি মানসে। চৈতন্যপূর্ব যুগে  বাঙালি মননে পদাবলীকীর্তন গানের রসাস্বাদন শুরু এই আবহেই। জয়দেব বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস তো তখন বাঙালির প্রাণের মানুষ। বাংলা ও ব্রজবুলি ভাষায় পদাবলীকীর্তন জনপ্রিয়তা পেলো। বলা বাহুল্য,শুধু বাংলায় নয়, শুধু ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বেই পদাবলীসংগীত এক মনোরম ব্যতিক্রমী সংগীত হয়ে মর্যাদা  পেলো। দক্ষিণ ভারতেও 'কীর্তনম' এর প্রচলন ছিল খুব। তবে গায়নরীতির তফাৎ ছিল। বাঙালি পদাবলী কীর্তনের ভাব ভাষা ছন্দ ছিল মন কেড়েনেওয়া। তেমনই পার্থিব অপার্থিব অনুভূতির মিশ্রনে শুধু ভক্তি নয়, মানবীয় মননের তরঙ্গ ছিল এসমস্ত সংগীতের গভীরে।

পণ্ডিতগণ দেখিয়েছেন রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক, গৌর বিষয়ক ভজন বিষয়ক ও রাগাত্মিকা -এই চার ধরনের পদাবলী ভারতীয় সংগীতের মর্মকে সঙ্গে নিয়েই বাঙালির অন্তরে স্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পদাবলী সংগীতের যে সংকলন গুলি আছে তাতেই বোঝা যায় কীভাবে বঙ্গভূমি জুড়ে এই সংগীতধারা প্রভাব বিস্তার করেছিল। গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন ১৫৪ জন পদাবলী রচয়িতার নাম উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে ১১ জন মুসলমান ও কয়েকজন মহিলা গীতিকার এর ও নাম রয়েছে। পদকল্পতরু, পদসমুদ্র, পদকল্পলতিকা, রসমঞ্জরী, গীতচিন্তা মনি প্রভৃতি সংকলন গ্রন্থে গ্রন্থিত পদাবলীতে নানান রাগ রাগিনীর উল্লেখ আছে। কামোদ, বেহাগ,শ্রীরাগ,কানাড়া, পটমঞ্জরী,গৌরী ,ভীমপলশ্রী সহ নানান রাগরাগিনী। এই সমস্ত পদাবলী গানে রাধাকৃষ্ণ প্রেম একটা বিজ্ঞান অনুসারী শৃঙ্খলায় বিধিবদ্ধ ছিল। ভালোবাসার এমন  মহিমান্বিত রহস্য এবং গূঢ়তা পৃথিবীর আর কোনো দেশে দেখা যায় না। রাধার কৃষ্ণকে ঘিরে আকুলতা ও ধাপে ধাপে অনুভবের পূর্ণতা তা সবাইকে স্পর্শ করে যায়। বাসকসজ্জা, বিপ্রলব্ধ, মানিনী, খণ্ডিতা, রোষস্ফীতা, প্রোষিতভর্তৃকা --রাধার নানা রূপের অপূর্ব প্রকাশ রয়েছে। পঞ্চরসের মধ্যে মধুর রসের প্রাধান্য বেশি। প্রেমের নানান পর্যায় গুলির মধ্যে মাথুর তথা বিরহেই সৌন্দর্যের প্রকাশ অধিক ছিল। সব ক্ষেত্রেই লীলাময় ভক্তিভাব স্বর্গীয় ভালোবাসার উপাদান। বাঙালির এই গানে ভাবনার গতি ঊর্ধ্বগামী ও নিষ্কাম আবেগপূর্ণ। বিলাসকলা থেকে স্বতন্ত্র।

চৈতন্যের পর বা সময় থেকেই কীর্তন সংগীত আরো বিবর্তিত হয়। এই সময় হতে মধুর রসের মর্যাদা বৃদ্ধি পেল।  আদিরস মুক্ত করার চেষ্টা দেখা গেল। রূপ সনাতন শ্রীজীব গোস্বামী নিয়মকে বাঁধলেন। রাধাকৃষ্ণের মহিমাকে উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভক্তিরসামৃত সিন্ধু ও উজ্জ্বলনীলমণি গ্রন্থ দুটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলো।
নরহরি চক্রবর্তীর গ্রন্থগুলিতে বৈষ্ণবগানের অভূতপূর্ব রস প্রকাশ পেল। গীতসংগ্রহসার, ভক্তি রত্নাকর,গীতচন্দ্রোদয়, প্রভৃতি গ্রন্থে ভারতীয় সংগীতের মর্মে বৈষ্ণব লীলার নানান আঙ্গিক প্রকাশ পেল। তাছাড়াও সংগীতমাধব, নরোত্তমবিলাস, সারাবলী, অনুরাগবল্লী, কৃষ্ণকর্ণামৃত ইত্যাদি গ্রন্থে বৈষ্ণব রস ও সংগীত রীতির নানান কথা বিস্তৃত আছে। রাগসহ তালেরও নানান উল্লেখ আছে। কীর্তন গানের তালগুলিও অনন্য। ধামালি, দাসপ্যারী, কাটাধরা, চঞ্চপুট, লোফা, জপ, একতালি, পঞ্চম, দশকোশী, এককোশী, ত্রিপুট তেওট, রূপক, বীরবিক্রম, শশীশেখর, ইত্যাদি ১০৮ টি তালের উল্লেখ আছে। তালের ক্ষেত্রে দুটি অঙ্গ পদ্ধতি ছিল ছুট ও জোড়া। বিলম্বিত তালকে বলা হতো 'বড়'। এই সব তাল যোগে গাওয়া গানে আমরা দেশি লোকগানের অন্তরাত্মাকে খুঁজে পাই।

বাংলা কীর্তন গানের সবচেযে বিশেষ তাৎপর্য হল তার আখর সংযোজন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ক্ষেত্রে যেমন তান যোগ করে রাগের বিস্তার করা হয় তেমন ই বাংলা কীর্তনে কথার মায়াজাল বিস্তার করে অনুষঙ্গকে প্রাণময় করে তোলার রীতি বাঙালির নিজস্বতা। আসলে  বাঙালি বাণীকে ভালবেসেছে চিরকাল। অক্ষর অর্থাৎ কীর্তনেও আখর যোগ তারই উদাহরণ। মহাপ্রভু বাংলা কীর্তনকে মুক্তি দিয়ে সবার করে তুলেছিলেন। শুধু গায়ক বা গীতিকারের মধ্যেই আবদ্ধ থাকলো না। নাম সংকীর্তন,নগর কীর্তন টহল কীর্তন নানান নাম নিয়ে আরো জনমুখী সংগীতের রূপ নিতে শুরু করলো। সংকীর্তনের দল ও সম্প্রদায় হলো। গৌরগীত গুলির সহজসুর হৃদয় স্পর্শ করতে লাগলো।  স্বাভাবিক ভাষা ও প্রাণস্পর্শী আবেগ নিয়ে গ্রাম্যসংকীর্তনগুলি বাঙালির ঘরের গান হয়ে আছে আজো। চব্বিশ প্রহর,অষ্টম প্রহর, নবরাত্রি --ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ভিন্ন রীতি এলেও মূল সুর একই থেকে যায়।  আসলে এ গানে যোগ দেবার অধিকার সবার আছে। বৃন্দাবনের  সাথে বাংলা এক সরল রেখায় যুক্ত হলো। আসলে বৃন্দাবন লীলা প্রাধান্য পায় চৈতন্যের সময় থেকেই। বঙ্গভূমির নানান প্রান্তে বিশেষ করে শ্রীখণ্ড, কুলীনগ্রাম, শান্তিপুর পরে পরে খেতুরি বিষ্ণুপুর, রানীহাটি, জাজিগ্রাম, গরানহাটি, সহ সর্বত্র  ছড়িয়ে পড়লো। নরোত্তম দাস  বাংলা কীর্তন গানের যে রীতির প্রবর্তন করেন সেই অপূর্ব বিলাস রীতি আজও চলে আসছে।

একটি  কথা এ প্রসঙ্গে বলা জরুরি। কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে কৃষ্ণতত্ব, রাধাতত্ব, গোপীতত্ব ও অচিন্ত্যভেদাভেদতত্বের যে গুরুত্ব বাংলা সহ ভ্যারতীয় সংস্কৃতিতে প্রভাব তৈরি করে তাতেই বাংলা কীর্তন গান অনেকটাই  রীতিমুখী হয়। বৃন্দাবন ও নীলাচল সহ  সর্বত্র রাসলীলা ও তার  মহিমার প্রকাশ ঘটে। এই মহিমাকে শিল্পীরা তুলি দিয়ে এঁকেছে, কবিরা কাব্যে প্রকাশ করেছে বহুকাল ধরে। বিষ্ণুপুরের শ্যামরায়  মন্দিরের বাইরে ও ভেতরে দেওয়ালে গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্বের অপরূপ সব টেরাকোটার চিত্র প্রকাশিত  হয়ে আছে। যেমন বাংলাদেশের পাহাড়পুর মন্দিরের দেওয়ালে কৃষ্ণলীলার নানান প্রকাশ রয়েছে  আজও উজ্জ্বল হয়ে।

দশকে দশকে বাংলা কীর্তন গান নিজেকে সাজিয়েছে নিজের মতো করে । তবুও বঙ্গভূমির  অন্তর্ভুমিতে কীর্তনের এক অনন্যসাধারণ মর্যাদা আছে। তার 'জাত্সুর' আজও মনকে আপ্লুত করে।  পরবর্তী কালের অনেক সংগীতের ভেতর কীর্তন প্রভাব তৈরি করেছে। আজও করছে। রবি ঠাকুরের কীর্তনাঙ্গের গান আমাদের কাছে প্রিয়। তাঁর কথাতেই শেষ করি।
"..... স্বাধীনতার গান।  তাহা  জাতি মানে না, কুল মানে না। অথচ এই উচ্ছৃঙ্খলতা সৌন্দর্যবন্ধনে হৃদয়বন্ধনে নিয়মিত। তাহা অন্ধ ইন্দ্রিয়ের উদভ্রান্ত উন্মত্ততা নয়।"(চলবে)
-----

Post a Comment

0 Comments