জ্বলদর্চি

সুদর্শন নন্দী || পর্ব- ২


সু দ র্শ ন  ন ন্দী  


হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা  || (পর্ব-২) 

নমঃনমঃনমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।

গ্রাম মানেই আল খাল বিল মেঠো পথ ধরে ছোটা। বন বাদাড়ের সাথে প্রাণের দেওয়া নেওয়া।  মাটির ঘর, খড়ের চাল। ঘরে ঘরে গোয়াল, গোয়ালের  টিপিক্যাল গন্ধ। সেই গোয়াল থেকে গোবরকুড়ে গোবর ফেলতে হাত লাগাতাম। সেই গোবর সার হয়ে জমিতে যেত গোরুর গাড়ি চেপে।  

প্রায় আটটি গরু ছিল। বাবা বলতেন আমার সময় সতেরটি গরু ছিল, পাঁচটি মোষ। দাদুর আবার কয়েকটা ঘোড়া ছিল, সে কথাও বলতেন।  হাঁস ছিল অনেক। পাশের পুকুরে নিজেরাই প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে চলে যেত। ঘর ঢুকত সন্ধের আগে। সেনাদের মতো বড্ড শৃঙ্খলাপরায়ণ এরা। প্যারেড করে যাওয়া থেকে লাইন ধরে সাঁতার কাটা --সেনাদেরও বিস্ময়ের। বেচারারা সাতে নেই, পাঁচেও নেই কিন্তু বারোতে আছে। পরপর দশ এগারো বারো ডিম দিতে ভোলে না। তবে ভাম, কটাস, শেয়াল থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হত। রাখাল ছেলের সাথে জঙ্গলে গরু চরাতে যাওয়াও ছিল বেশ রোমাঞ্চের। গ্রামের স্কুলে ভর্তি হইনি তখনও। জানতাম না এ গ্রামের স্কুল আমাকে নেবে না। গরু চরাতে গিয়ে টোটো করে ঘুরে বেড়ানো, ঝোপঝাড়ে খরগোশ লুকিয়ে আছে কিনা খোঁজা, শেয়ালের পিছন পিছন তাড়া করা। কখনো ভামের মুখ থেকে হাঁস ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস।  আম গাছে আম, জাম গাছে উঠে জাম পাড়া। কখনো গাছে উঠে, কখনো গাছের ডাং (ফাঁপড় বলতাম)ছুঁড়ে পাড়তাম সেসব। গামছার কোঁচে বাঁধা থাকত নুন লঙ্কা। আজকের ভাষায় বলা যায় সে স্বাদের ভাগ হবে না। মোষের পিঠে চড়ে ঘোড়ায় চাপার স্বাদ মেটাতাম। হাওয়াতেই কখনো লাগাম টানি, কখনো ছাড়ি। আবার গরুর গা ধোয়াতে গিয়ে গামছায় চুনো মাছ ধরা --আনন্দে হারিয়ে যাওয়া থেকে কম কিছু ছিল না। এটা কুড়িয়ে আনা ওটা কুড়িয়ে আনা পর্ব শুরু হত ভোর থেকে। আকাশ সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে কজন মিলে  ছুটতাম কেন্দফল গাছের তলায়। কমলা রঙের গোল গোল ফলগুলির অমৃত-স্বাদ আজও অনুভবে পাই জিভে।  বেলতলায় বেল, কয়েৎবেল গাছতলায় কয়েৎ, খেজুরের সময় খেজুর আর আম জামের সময় আম জাম সব গাছের নীচে সারা রাত পড়ে ছড়িয়ে থাকত। সেই কুড়নোর আনন্দ ছিল খাওয়ার থেকে অনেক অনেক বেশি। সারাদিনের টো টো’র পর  বিকেল হলে শুরু হত লুকোচুরি খেলা। খামারের ধানের পালুই থেকে এর ওর বাড়ির গোয়ালে লুকানোর মজাই ছিল আলাদা। অন্ধকার ঘন হয়ে এলে বাঁশ ঝাড় থেকে আসত ঝিঁঝি পোকার সেই না ভোলা ডাক। জোনাকি পোকার  পিট পিট আলো দেখলে মনে হত রাতের আকাশ তারাদের নিয়ে বাঁশ বাগানে বেড়াতে এসেছে। বেশির ভাগ ঘরই মাটির তৈরি। খড়ের ছাউনি। দু এক বছর ছাড়া ছাড়া খড় ছাইতে হত। রান্নাঘরকে খুন্দি ঘর বলা হত। বাইরের আঙনকে  বলা হত বাখুল। একেবারে বাইরের দরজা ( লাজদুয়ার) ঘেঁসে থাকত গোয়াল। 
বর্ষায় রাস্তা বলে কিছু থাকত না। আর এভাবেই চলত জীবন। ঘরে বিদ্যুতের কোন  প্রশ্নই ছিল না। ঘরে ঘরে লন্ঠনের চলই বেশি ছিল। ছোট্ট রথের আদলে তৈরি চার দিকে কাঁচে ঢাকা কেরোসিনে জ্বলত। বিষ্ণুপুর ছিল লন্ঠন শিল্পের পাইওনিয়ার। সস্তায় কিনতে পাওয়া যেত।   রান্নাঘরে জ্বলত লম্ফ।  ছোট্ট একটা ডাব্বা বা কৌটো মতো সাইজে তেল ভরে সলতে দিয়ে জালাতে হত। আলোর সাথে ধোঁয়া ফ্রি। কারো কারো ঘরে হ্যারিকেন ছিল। আটচালায় উৎসবের সময় অথবা বিয়েবাড়ির সময় শুভ্র হ্যাজাগ লাইট ছিল ভরসা। গ্রামে প্রাথমিক স্কুল ছিল। হাইস্কুল পাঁচ কিলোমিটার দূরে। হেঁটে স্কুল যেতে ঘণ্টা খানেক লেগে যেত। বৃষ্টি হলে দুর্দশার শেষ ছিল না।(চলবে)

-----

Post a Comment

0 Comments