জ্বলদর্চি

রাজর্ষি রায় / হেমন্ত মুখোপাধ্যায়


রা জ র্ষি  রা য় 


হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯২০-১৯৮৯)

যে কয়েকজন মানুষের নাম উচ্চারণে বাঙালির বাঙালিয়ানা বিচ্ছুরিত হয় তাঁদের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অন্যতম। গানের জগতে তিনি একজন শিল্পী, একজন গায়ক, একজন সুরকার কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি অনেক বড় মাপের ব্যক্তি ছিলেন। ১৯২০ সালের ১৬ই জুন বারাণসীতে মামাবাড়িতে তাঁর জন্ম। কালিদাস মুখোপাধ্যায় এবং কিরণমালা দেবীর দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন হেমন্ত। তাঁর আদি বাড়ি ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বহুরু গ্রামে। ১৫ বছর বয়সে তিনি ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হন। প্রথম জীবনে তিনি স্বপ্ন দেখতেন সাহিত্যিক হবেন। 'আলেয়া' পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয়েছিল এবং ১৭বছর বয়সে 'দেশ' পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। এই সময় তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন পরিমল সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সন্তোষ কুমার ঘোষ, সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিগণ। তিনি তাঁর গানের প্রথম পার্ট নিয়েছিলেন মাসতুতো বোন লীলাদির কাছে এবং তার দাদা কালীকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। পরে আকাশবাণীর বাণীকুমার, শৈলেন দাশগুপ্ত ও হরিপ্রসন্ন দাসের কাছেও কিছু পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। স্কুলের টিফিনের সময় হেমন্তকে ঘিরে বসত শচীন দেব বর্মন ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের গানের আসর। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৫ বছরের হেমন্তকে পৌঁছে দেন রেডিওর দোরগোড়ায়। হেমন্ত অডিশনে উত্তীর্ণ হন সফলভাবেই। প্রথম গান সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'আমার গানেতে এলে নবরূপে 'এবং 'আকাশের আরশিতে ভাই'। তখন তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৩৭-৩৮ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন প্রথম বিভাগে। পরবর্তীকালে তিনি যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমাতে ভর্তি হন। গানের জগতে তাঁর পদার্পণ বাবা মেনে নিতে চাননি কিন্তু মায়ের উৎসাহে এবং সহযোগিতায়  গানের জগতে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেন। প্রথম রেকর্ড বাবদ পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন কুড়ি টাকা তাছাড়া গানের টিউশানিও করতেন। প্রথম পারিশ্রমিকের টাকায় তিনি কেনেন হারমোনিয়াম। চাকরির সুযোগ পেয়েও তিনি তা করেননি, ততদিনে গানকেই জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান করেছিলেন। একইসঙ্গে রেকর্ড কোম্পানি এবং স্টুডিওপাড়ায় ঘুরে ঘুরে ১৯৪০-এ 'নিমাই সন্ন্যাস' ছবিতে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ আসে। ছবি বিশ্বাসের লিপে হরিপ্রসন্ন দাশের সুরে তাঁর প্রথম প্লে-ব্যাক।১৯৪৪-এ প্রথম হিন্দি 'ইরাদা' ছবিতে কণ্ঠদান।
রাতারাতি তিনি সঙ্গীত জগতের তারকা হয়ে যাননি। তাঁর জন্য তাঁকে প্রায় এক দশক ধরে পায়ের নিচে শক্তজমি তৈরি করতে হয়েছিল। পরবর্তী চার দশক জুড়ে তিনি যে বাংলা ও হিন্দি গানের সুউচ্চশিখরে বিরাজ করেছিলেন তার প্রস্তুতিপর্ব চলেছিল সেসময়ে। একদিকে আর্থিক অভাব-অনটন অন্যদিকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই-- তাঁকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার রসদ জুগিয়েছিলো। তাঁর প্রথম বাংলা গান 'কথা কোয়ো না গো শুধু শোনো'। 'পূর্বরাগ' ছবিতে প্রথম বেলা মুখোপাধ্যায় ও হেমন্তের প্রথম ডুয়েট  ছিল 'ওগো দখিন হাওয়া'। ১৯৪৫ সালে বিনতা রায়ের সঙ্গে গেয়েছিলেন প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত 'মধুগন্ধে ভরা'।
হেমন্ত ১৯৪২-৪৩ সালে সেযুগের যুবকদের মতোই আই পি টি এ -তে যোগ দিয়েছিলেন। যার বাংলা নাম ছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। সেই সূত্রেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিনয় রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিজন ভট্টাচার্য, দেবব্রত বিশ্বাস ও সলিল চৌধুরীর মতো পরবর্তীকালের দিকপাল শিল্পীদের সঙ্গে। এই দলে তিনি কিছুদিন উজ্জীবনের গান গেয়ে বেড়িয়েছিলেন। পরে হেমন্ত- সলিল অমর জুটির সূত্রপাত ঘটে এই সূত্রেই। সলিল চৌধুরী তখন কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন চব্বিশ পরগনায়। তারই ফাঁকে তিনি লিখেছিলেন 'কোন এক গাঁয়ের বধূ' গানটি। সুরকারের অনুপস্থিতিতেই হেমন্ত  গানটি তুলেছিলেন নিজের কন্ঠে। ১৯৪৮-৪৯ তখন। তারপর এই জুটিতে তৈরি হয় একের পর এক কালজয়ী বাংলা গান--
অবাক পৃথিবী ,রানার, বিদ্রোহ আজ, পালকির গান , ঠিকানা প্রভৃতি।
এই সময় থেকে আর হেমন্তকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক সাফল্য তাঁর সামনে এসে হাজির হয়। ১৯৪৫-এ তিনি গায়িকা বেলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। বিয়ের পরও কিছুদিন অভাব-অনটনে কাটে নতুন বাড়িতে। তারপরই আসে সুখের দিন।
১৯৪২সালেই পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গীত পরিচালনায় মীনাক্ষী ছবির হিন্দি ভার্সনে প্রথম গান করেন। ইরাদা'র পরের ছবি বনফুল  ও হামরাহ। বোম্বাইতে কাজ শুরু করার আগেই তিনি বিন্দিয়া, জমিন আসমান, ফয়সালা ,বাবুল, শাজা, আন, আধিয়ার মতো ১৫ টি হিন্দিছবিতে গান গেয়ে ফেলেন। এর ফাঁকে নন-ফিল্মি হিন্দি গানও রেকর্ড করেছেন একের পর এক। রবিশঙ্করের সুরে দুটি দেশাত্মবোধক গান- সারে জা৺ হাসে আচ্ছা এবং জাগা দেশ হামারা রেকর্ড করেন। বাংলা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার আগেই বোম্বেতে ডাক পেয়েছিলেন হেমন্ত। ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে মাসে দেড় হাজার টাকা মাইনেতে তিনি সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব নেন। ১৯৫২ সালে তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি 'আনন্দমঠ'।চুয়ান্ন সালে হেমন্তকুমারের সংগীত পরিচালনায় মুক্তি পায় ছটি ছবি--সম্রাট, শর্ত ,ডাকু কি লড়কি, ফেরি প্রভৃতি। কিন্তু ছবিগুলি ব্যর্থতার ফলে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে প্রদীপ কুমার- বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত 'নাগিন' ছবি মুক্তির কয়েক সপ্তাহ পরেই বোম্বাইতে হেমন্তের ভাগ্য খুলে যায়। তাঁর গাওয়া 'মন ডোলে মেরা তন ডোলে'তে দুলে ওঠে ভারতবর্ষের মন। সেই সঙ্গে 'তেরে দ্বার খাড়া এক যোগী', 'মেরে দিল ইয়ে পুকারে আজা', 'শুন রসিয়া মন বসিয়া,' 'ওহ জিন্দেগি কে দেনেওয়ালে'- প্রভৃতি মন মাতানো গান হেমন্তকুমারকে বোম্বেতে স্থায়ী আসন করে দেয়। হিন্দিতে 'আনারকলি' ছবি থেকেই লতা মঙ্গেশকর ও হেমন্ত জুটির আবির্ভাব ঘটে। ১৯৫৫ সালে বাংলা ছবির প্লে-ব্যাকের জন্যও তিনি ডাক পান। এই সময় বাংলা 'শাপমোচন' ছবি থেকেই শুরু হয় হেমন্ত- উত্তমকুমার জুটির সফল কালজয়ী পর্ব। শুরু হয় বাংলা ও হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে একই সঙ্গে হেমন্তের উজান-ভাঙ্গা গানের পালা। তখন তাঁকে কলকাতা-বোম্বে করতে হত একদিন অন্তর। তখন ছিল প্রপেলারের হাত ধরা ডাকোটা বিমানের যুগ। সারাদিন হয়তো বোম্বেতে রেকর্ডিং করার পর তাঁকে রাতে ফিরে আসতে হত কলকাতায়। এয়ার ইন্ডিয়া থেকে তাই তাঁকে 'ডেইলি প্যাসেঞ্জার' বলা হত। সেই কারণে একবার সেরা যাত্রীর পুরস্কার হিসেবে কোম্পানি থেকে হেমন্ত- বেলা দম্পতিকে ফ্রি টিকিট উপহার দেওয়া হয়েছিল।
মূলত বাংলা গানের তিনটি ধারায় আজীবন সক্রিয় ছিলেন হেমন্ত-- বেসিক গান, সিনেমার গান, এবং রবীন্দ্রসংগীত। একইসঙ্গে পালকির গান ,ধিতাং ধিতাং বলে, পথে এবার নামো সাথী, ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম প্রভৃতি গানের সঙ্গে লাজবতী নূপুরের রিনিঝিনিঝিনি, এই মেঘলা দিনে একলা প্রভৃতি তাঁর গাওয়া অসংখ্য গানে ভরে উঠেছে বাংলা গানের ভাণ্ডার। সলিল চৌধুরী বলেছিলেন-- "হেমন্ত বা লতা  আমার গানের শিল্পী হলে স্কাই ইজ মাই লিমিট।"
দেশি গানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হেমন্ত গেয়েছেন একের পর এক ছায়াছবির গান। আটান্ন সালে 'লুকোচুরি' ছবিতে হেমন্তের সুরে কিশোর কুমারের গাওয়া- শিং নেই তবু নাম তার সিংহ, এক পলকের একটু দেখা, শুধু একটুখানি চাওয়া, এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় ...রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল। এছাড়াও তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ, পথের ক্লান্তি ভুলে, নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী ,ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস,  আজ দুজনার দুটি পথ ওগো, ও নদীরে প্রভৃতি গান বাঙালির মণিকোঠায় অম্লান হয়ে আছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, উত্তম-হেমন্ত জুটির রসায়ন ও সাফল্যের পিছনে ছিল তাঁদের দুজনের কণ্ঠের টোনাল মিল। গান গাওয়া ছাড়াও তিনি অনেকগুলি ছবির প্রযোজনা করেছিলেন, হেমন্ত-বেলা প্রোডাকশন নাম দিয়ে। তাদের মধ্যে নীল আকাশের নীচে, বিশ সাল বাদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সব থেকে বেশি কাজ করেছেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে। এছাড়া নচিকেতা ঘোষ, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বহু গান তিনি গেয়েছেন ও সুর দিয়েছেন।
মডার্ন গান যদি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নেশা এবং পেশা হয় তবে তাঁর প্রাণের গান ছিল রবীন্দ্রসংগীত। পঙ্কজ মল্লিকের পর রবীন্দ্রসংগীতকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও দেবব্রত(জর্জ) বিশ্বাস। একই সঙ্গে তিনি সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গান করেছেন। তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতগুলির মধ্যে- আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, দিনের শেষে ঘুমের দেশে, মোর ভাবনারে কি হাওয়ায়, পুরনো সেই দিনের কথা, আমি চঞ্চল হে -প্রভৃতি গান মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
বাংলা ও হিন্দি গানের পাশাপাশি হেমন্ত গুজরাটি, অসমীয়া, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, মারাঠি, তামিল ভাষায়ও গান করেছেন। পাঁচ দশক ধরে গানের জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।শহর থেকে মফস্বল -- দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিদেশে তিনি অসংখ্য কনসার্ট করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। একসঙ্গে এককুড়ি গান না গিয়ে তিনি মঞ্চ থেকে নামতেন না। টাকা নেওয়ার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সহৃদয়। তিনি সারা জীবন গোপনে অনেককেই টাকা  দিয়ে সাহায্য করতেন যাঁরা তাঁর খুব প্রিয় ছিলেন।
আসলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়কি ছিল বিশ্লেষণের বদলে অনুভবের। ঝরনার মত তাঁর গান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তাঁর সাহিত্যবোধ থেকেই এসেছে গানে ছবি আঁকার মানসিকতা। তাঁর জীবনযাপনের মত সারল্য ছিল তাঁর গানের চলন বৈশিষ্ট্য। জীবনভর তিনি গানেই আনন্দ খুঁজেছেন এবং লক্ষ প্রাণে ছড়িয়েছেন আনন্দ। ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি অসুস্থ ছিলেন। ১৯৮৯ তে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে শেষ সম্মান পান 'মধুসূদন দত্ত স্মৃতি পুরস্কার'। এছাড়াও তিনি লাভ করেছিলেন নানা সম্মান ও পুরস্কার। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছিলেন ডি লিট, আলাউদ্দিন পুরস্কার, বৈতালিক প্রদত্ত সঙ্গীতাচার্য খেতাব, লালন ফকির ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রভৃতি।
তিনি ২৩ শে সেপ্টেম্বর১৯৮৯তে কলামন্দিরে শেষ অনুষ্ঠান করেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার তিনি তাঁর অগণিত শ্রোতা ও সংগীত প্রেমিকদের ভালোবাসা এড়িয়ে সুরলোকে যাত্রা করেন।

আজ ১৬ই জুন, আজকের দিনেই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন--এই মর্তলোকে, এক ভারতীয় সঙ্গীতসাধক হিসেবে--এটাই আমাদের গর্ব।

------

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব সুন্দর পোস্ট

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর লেখা।

    ReplyDelete
  3. সুন্দর স্মৃতি চিত্র ও জীবনেতিহাস। লেখককে অভিনন্দন। শিল্পীকে জন্মদিনে প্রণাম।

    ReplyDelete