সু ব্র ত গু হ
লক্ষ্মীমন্ত
এই ঘাটেতেই ছোট্ট সোনা বউ
খিড়কি দুয়ার পেরলো এক সাঁঝে,
সন্ধ্যাতারা ডাকলো তাকে কাছে......
নামতে নামতে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে
যেখানে ধাপ তলিয়ে গেছে
নিতল কালো নীরে,
সোনা মেয়ে শান্তি পেল
সেই অতলে শুয়ে।
সতীলক্ষ্মী গৃহবধূ, আহা!
সিঁদুর নিয়ে মরলো সতী হয়ে!
দেখলো সবাই চেয়ে
হায় অভাগী, নিঃস্ব নারী তুই
আর জনমে জাদুকরী হয়ে আসিস ফিরে
নইলে, আর এ মুখো হোসনারে
তোর জন্য এ পোড়া দেশ শুধু
বিষের আবাদ করে।।
বিনির ফাগুন
বিনি, জানো, ভীষণ কাজের মেয়ে।
ও আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে।
বসার ঘর, শোবার ঘর, দাওয়া
চাতাল , রান্নাঘর, সবই সে ধুয়ে মুছে
আয়না করে রাখে।
ফুরসৎ নেই অথৈ কাজের ডাকে।
রান্নার স্বাদ এমন তার
তাকে ছাড়া অন্ধকার।
কেবল জাতে নীচু বলে
মায়ের ঠাকুর ঘরে, তার যাওয়া মানা।
শীতের শেষে দখিন হাওয়া
বনকে যেমন মাতাল করে
তেমনি সে বিনির শরীর জুড়ে
ইশারা যায় রেখে।
অপুষ্টি আর অনাদর আর শেষ
না হওয়া শ্রম, লাবন্যহীন যৌবন
দেয় তাকে।
অশোকে শিমূলে কৃষ্ণচূড়ায় বনে বনে
আর পথে পথে যবে ফুলেল তুফান আনে
যুবতী বিনি ঘরের কাজে অবসর খুঁজে মরে।
থেকে থেকে তার মন কেমন করে।
শরীরে তার, বেঁধেছে বাসা
স্পর্শ পাবার নাছোর নেশা,
সেই তাকে লুকিয়ে পাগল করে।
তখন মেয়ে মনেই কেঁদে মরে
ব্যস্ত বিনি আকাশে চোখ রাখে।
সেখানে তখন বনের ফাঁকে আকাশ করে খেলা
ফাগুন সারা বেলা।
বিনির ফাগুন ঢাকে শ্রাবন ছায়া।
বোকা বিনি শ্রাবনধারায়
ফাগুন খুঁজে মরে।
সেদিন দুহাত ভরে রক্ত পলাশ
কুড়িয়ে এনে দিলাম হাত ভরে।
শূন্য ওর বিবর্ণ চোখ দুটো কেমন যেন
অবাক হয়ে থাকে। সে হাসে।
আবার কাজের ফরমাস আসে
বলতো এফুল কী নামে বিখ্যাত।
কাজে এমন দক্ষ বিনি কেবল চেয়ে থেকে
খুব কষ্টে মৃদু মাথা নাড়ে।
এটা পলাশ - - - হবে বোধহয়।
আমার শুধু মানুষ হয়ে বাঁচার তেষ্টা বুকে।
পলাশ শিমূল কৃষ্ণচূড়া বেরঙ আমার চোখে।
তারায় ভরা আকাশ আর মাটিতে রঙ নিয়ে,
বিনিরা সেই কবে থেকে পথ চলে ভয়ে ভয়ে
ওদের জীবন জুড়ে শুধুই কালো মেঘের খেলা
বিনি যখন সাত, তখন শ্রাবন মাস,
যখন সে তেরো, সেই মেঘ সন্ত্রাস।
এখনও বিনি ফাগুন দিনে ফাগুন খুঁজে
হেরে যাওয়া মেয়ে।
বিনি আজও শুধুই কাজের মেয়ে।।
অন্য ঘর
দক্ষিণ খোলা এই ঘর
আমার খুব পছন্দ হয়েছে, খোকা।
ভাড়া বাড়িতে গুমোট গরমের দিনে
তোর মা বুল্টি আর তোকে দক্ষিণের
হাওয়ায় শুতে দিতো।
সারারাত হাওয়া করতো। বৌমা যেদিন
আমাদের পাখাটা মিস্ত্রি ডেকে ওর ঘরে
লাগিয়ে নিলো, বৈশাখের সেই ভ্যাপসা
গরমের রাতে তোর মা কেঁদে বলেছিল,
চলো, এবার আমরা ছুটি নিই।
পাখার হাওয়া নয়, বেনজির অবহেলা
আর অপমানে তোর মা কেঁদেছিলো।
তারপর আজ চিরশান্তির দেশে দশ
বছর হলো। তোদের ভীষণ অসুবিধা করে
আমি আজও বাঁচি।
এবার তুই বিদেশ যাবার সুযোগটা
হাতছাড়া করিস না। আমার চিন্তা থাক।
জীবনের বাকি দিন কেটে যাবে
এই বৃদ্ধাশ্রমে। নামটা বেশ সুন্দর। শেষ ঘুম।
আজকাল মাঝরাত পেরলেই তন্দ্রা ছুটি চায়।
উষার আলো, পাখির কিচিরমিচিরের জন্য উন্মুখ
হয়ে বসে থাকি। ভাবি আরও একটা দিন আমার
পৃথিবীর সাথে থাকা হলো।
তখনই অজান্তে আকাশের দিকে দুহাত জোড়
করি। তখন "কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন"
আর সম্মতি দেয় না। তখন আমার সত্ত্বা ছেয়ে
আমি আর সসাগরা এই পৃথিবী। বাকি সম্পর্কগুলো
মিথ্যে মনে হয়। চলে আসা পথের কিছু অচেনা
মাইলস্টোন। থেমেছিলাম কিন্তু ঠাহর করতে
পারিনি। অশীতিপর প্রবীনতায় জানতে
পেরেছি আমার সাথে শুধু আমিই আছি।
বন্ধুহীন, বড় একা। পিছন থেকে ডাকার
কেউ নেই। কেউ থাকেনা।
আমরা তখন, আমরা এখন
আমরা তখন নেশায় মাতাল
দূর আকাশের, ঘর ভোলা সব যতো।
আমরা তখন জানার ঝোঁকে
বল্গাহীন ছুটছি অবিরত।
আমরা তখন প্রাপ্ত কিশোর
আমরা তখন সদ্য কূঁড়ি পলাশ
আমরা তখন পাড়ার মোড়ে মোড়ে
পত্রিকাতে করছি পদ্য চাষ
আমরা তখন নিরালা ছাদের ঘর।
পড়ার ছলে প্রেমিকার পত্তর।
পাড়ায় পাড়ায় আনাচ কানাচ জুড়ে
বড় অচেনা আগুনে এক কাল
আমরা তখন দেখছি হতবাক
দিনবদলে আনকোরা নকশাল।
আমরা তখন সদ্য পলাশ ফুল
কফি হাউসে আড্ডায় মশগুল
আমরা তখন একাডেমী চত্বরে
রাত জেগে থাকি একটা টিকিট চাই
অনেক দিনের অভিমানের শেষে
শম্ভু মিত্র স্টেজে ফিরছেন তাই।
আমরা তখন অয়েদিপাউস,
চার অধ্যায়, টিনের তলোয়ার।
বাড়ি তখন মস্ত সরাইখানা
নাটক আর জীবন একাকার।
আমরা তখন কোমল ছোঁয়া চাই
পাড়ার রমা ছুঁলেই স্বর্গ পাই। আমরা তখন দিনেও স্বপ্ন দেখি
আমরা তখন সবুজ মাঠ উদার
আমরা তখন আকাশ ভরা তারা
আমরা তখন ভুল করি এন্তার।
বয়স হচ্ছে আমরা সব বেকার
ঘনিয়ে আসছে বাবার অবসর
আমরা তখন মরিয়া অস্থির
ডুবছে জীবন বৈশাখী এক ঝড়।
আমরা এখন শীতের শান্ত নদী
আমরা এখন গৃহ অন্ত প্রাণ
আমরা এখন বোঝাপড়া করে বাঁচি
আমরা এখন ঝরা পলাশের গান।।
মুক্তি
যদি দেখিস খাঁচার আগল খোলা
অমনি ডানা মেলবি আকাশ পথে,
নয়তো কোনো নচ্ছার হাত এসে
খাঁচার দরজা দেবে আবার কষে
আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে থেকে
বিকল ডানা ঝটপটিয়ে মরিস
সত্যি যদি মুক্তি ধরা দেয়
চিনতে তাকে পারবি নে যে হায়
ওই যে রাঙা বউটি তোর সই
সকাল সাঁঝে আদর করে তোকে,
বিয়ের পর সেই যে এলো ঘরে
এখন সেও মুক্তি খুঁজে মরে।
বুকেতে তার ওড়ার নেশা খুব
মরচে ডানা মনের গতি খোঁজে
মায়ার কপট বাঁধনগুলো যত
পায়ে পায়ে জড়ায় অবিরত
মুক্তি কী কেউ সত্যি খুঁজে পায়
মুক্তি থাকে মনের গোপন ঘরে
বন্ধ তালা, কোথায় খুঁজিস চাবি
হয়তো পাবি সত্যি শেষের পরে।।
......
0 Comments