জ্বলদর্চি

পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল শ্রদ্ধা ও স্মরণে / বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল শ্রদ্ধা ও স্মরণে  
In honor and remembrance of Parthapratim Kanjilal
 
(জন্ম ২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৯ --মৃত্যু ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)

বি প্ল ব  গ ঙ্গো পা ধ্যা য় 

শাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ  এবং শব্দের সৌরভ 

প্রিয় কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল  চলে গেলেন  না ফেরার দেশে।  ফেসবুকে একটার পর একটা পোস্ট পড়ছি আর মন  ভারি হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। যেন শক্ত পাথর জমাট বেঁধে আছে  বুকে। একটির পর একটি  মৃত্যু সংবাদ এভাবেই  তছনছ  দিচ্ছে আমাদের সমস্ত চেতনা।  কোন কিছু  লেখার  মতো অবস্থায় নেই এই বিধ্বস্ত  মন। বস্তুত গুছিয়ে  লিখতেও পারব না তেমন কিছু। যতখানি নৈকট্য থাকলে পার্থদা বলে ডাকা যায় তেমন সম্পর্ক ছিল না ব্যক্তি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের সাথে। কিন্তু তাঁর কবিতা যা তাঁকে ব্যক্তিগত সমীকরণের চেয়েও গভীর  সম্পর্কে বেঁধে রেখেছে দীর্ঘ সময় ধরে। যা তাঁকে প্রাণের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে, স্পর্শের অধিক এক আত্মীয়তা দিয়েছে। সেই অনুভূতি যদি আলোড়িত করে আমার সত্তাকে তাহলে সেই আলোড়নচিহ্ন তো লিখতেই হবে হোক না তা  বেদনাগ্রস্ত অগোছালো ভাষায় । 
সত্তরের দশকে গ্রাম  দিয়ে  শহর ঘিরে ফেলার  অগ্নিবর্ণ  আহ্বানের ভেতর দিয়ে যখন কবিতার মানচিত্র উথালপাথাল হয়ে উঠছে ।বন্দুকের নলের পাশাপাশি  কলমের বজ্রনির্ঘোষ ধ্বনি  যখন হয়ে উঠছে অন্যতম শক্তিকেন্দ্র। সেই দুর্নিবার  ঝড় ও  উন্মাদনার  নিউক্লিয়াসে  দাঁড়িয়েও  কবিতায় ভিন্ন প্রকরণের সন্ধান পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতাকে অন্য এক দীপ্তি দিয়েছে। অথচ সময়কে সুন্দরভাবে স্পর্শ করেছে  তাঁর কবিতার নতুন স্বরায়ন।  

" তোমার ও রক্তবর্ণ  আনন ফেরাও,
হে দারুণা তুমি খড়্গ তোলো
অস্ত্র উপাচারে  তুমি পুজা করো  এই রোগগ্রস্ত মানুষের "

১৯৭০ সালে " দেবী "  প্রকাশের মধ্য দিয়ে  তাঁর কবিতার স্থাপত্যে এই সিগনেচার নতুন এক যুগের ইতিহাস  রচনা করে। তৎসম শব্দের গাঁথুনি দিয়ে কবিতার ভেতর এক দৃঢ় এবং সুগঠিত বলয় নির্মাণে তাঁর সচেতন কুশলতা এবং প্রায়োগিক দক্ষতায় মিশে যায় ভিন্ন এক টেক্সচার। সঙ্খবদ্ধ কোলাহলের বাইরে দাঁড়িয়ে  কবিতাকে নির্জন অন্তরীপে বন্দি করার যে তত্ব এই তত্বের প্রতি চিরকাল অসন্তোষ পুষে এসেছেন তিনি।  আবার সম্মিলিত স্বরের ভেতর নিজেকে বিন্দুমাত্র  প্রোথিত না করে  নিজস্ব দর্শনের  ভিন্নতাকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন জীবনে ও শিল্পে। যশ খ্যাতি এবং পুরস্কারের  বিপরীতে দাঁড়িয়ে  কবিতার অন্তর্বয়নে এবং চিন্তার সম্পন্নতায়  যে দাঢ্য তিনি রেখেছেন তা চিরকালীন আদর্শের এবং অনুসরণের নির্ভুল দৃষ্টান্ত । তিনি বলেছেন " প্রচারের আলোর নীচে ঘুরঘুর করতে থাকা মৎস্য মস্তিষ্কের কবিতা লেখকদের কবিতা না লিখে বিজ্ঞাপন বিভাগে যাওয়া উচিত "। 

      প্রচুর কবিতা লিখতেন না বলে  দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটির পর একটি কাব্যগ্রন্থ। এই অন্তর্বতী সময়  যেমন তীক্ষ্ণ  প্রাগভীর করেছে  বৌদ্ধিক ঔজ্জ্বল্যে শানিত করেছে তাঁর সৃষ্টিকে  ঠিক সেরকমই তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ হয়ে উঠেছে  সময়ের  দিকচিহ্ন । ১৯৭০ এ দেবী প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ   "রাত্রি চতুর্দশী"। এর অব্যবহিত পরে ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় "টেবিল, দূরের সন্ধ্যা "।  অনেক পরে শাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ।  

"সকল মূঢ়তার সব রিপুভয়   বজ্রাঘাতে মৃত, জীর্ণ হোক "  এই বিশ্বাস তাঁর কবিতাকে সজীব সতেজ প্রাণবন্ত ও বেগবান করেছে। ছুটিয়ে নিয়ে গেছে  ট্রেনের মতো দূরন্ত গতিতে। বারবার বিতর্কের ছোঁয়া লেগেছে তাঁর কবিতায়। সনেটের প্রচল ছকের ভেতর থেকে নিংড়ে এনেছেন নিজস্ব নির্যাস। 

"যশোর, সবুজ ট্রেন, তুমি কি এখন
অন্য কোনো বালকের মর্মে এসে পড়ো?
যখের গহনা আগলায় আজ এই
উত্তর-বালক, জড়-স্মৃতি করে জড়ো
অপারগ আচার্যের আঙুলের উন্মন
উপবীত যেন, যার ব্যবহার নেই।"

কিংবা আমরা যখন পড়ি তাঁর নিচের কবিতাটি  তন্ময় হয়ে যাই  তৎসম  শব্দের প্রয়োগে। শব্দ ব্যবহারে  তাঁর যে নিয়ন্ত্রণ  এবং  ধ্বনির অন্বেষা তা শুধু মুগ্ধ করে না পাঠকের স্নায়ুকোষে অদ্ভুত এক রূপান্তর ঘটায় । চেতনা এবং অবচেতনার আশ্রয়ে  স্বপ্ন এবং অকথিত বার্তার নৈঃশব্দ্য তাঁর কাব্যকৃতির উজ্জ্বল স্মারক। এই বিশিষ্টতাই কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের  বিশ্লেষনী স্বচ্ছতা  এবং বাকবৈদগ্ধতার নির্ণায়ক শক্তি। 

"শৈশব, সবুজ ট্রেন, ট্রেনের সতত
শৈলজল অগ্নিশব্দ, তমসাজীবিতা…
যত্নে স্বচ্ছ হলো আজ, তবু পথ-ক্ষত
যশোরেশ্বরীর ভূমে শয়ান কবিতা
আমাকে জানায় কীর্তিনাশা-দূরদেশে
আর্ত পারাপার আজো। ইন্দ্রিয়সঙ্কুল
অতীতে। সবুজ ট্রেন, তরুর অমূল
অন্য বালকের ঘুমে, চুলে ওঠে ভেসে।"

তাঁর ইতিহাসচেতনা, পুরাণের নিবিড়পাঠ, ফলিত জ্যোতিষের বিভিন্ন  পরিসর  এমনকি শক্তিসাধনার বহুমাত্রিক স্তর অধিকাংশ  কবিতার ভেতর  বিশেষত রাত্রি চতুর্দশী  কাব্যগ্রন্থে  অন্যতম উপাদান হয়ে এসেছে। পরাবাস্তবতার নানান আধার জৈব দিব্যস্তর  এসবও তাঁর কবিতায় আছে যা আমার বোধের অতীত বলে আমি তা থেকে দূরে সরে থেকেছি। কবিতার সঞ্চারপথে ফাঁপা আওয়াজসর্বস্ব বাকভঙ্গি বা শূন্যগর্ভ শব্দের কোন আয়োজন নেই। 

"সাত নয়, সাতলক্ষ কান্ড রামায়ণ 
অনেক লক্ষ্মণরেখা , অনেক রাবণ 
নরশিরে জড়ো হওয়া মানচিত্রকূটে
আজ জট পাকিয়েছে , সেই জটাজূটে
কোথাও কি মেঘগঙ্গা আছে দুর্বিনীতা ?
যার স্পর্ধা পেলে এক ন যযৌ ন তস্থৌ সীতা 
অল্প হেসে রাবণের রথে উঠে যেত ?
... জল চুপ!স্নানার্থীরা ঘাটে, সমবেত" (বল্মীক )

অথবা "মা বাবা "কবিতায় যখন মগ্ন হই তখন আমরা  দেখতে পাই ফাঁকা বাড়ির যেভাবে  মিতকথনে  উঠে এসেছে । শব্দ নয় বরং এক অকথিত নীরবতার আবর্তে কীভাবে গড়ে উঠে কবিতাশরীর তা অবাক করে। আমরা ছবির ভেতর সেই বাড়িটিকে দেখি। 

"শ্বশুরের ভিটে আঁকড়ে  পড়ে আছে  রোগা পাতলা গায়ের তসর,
সলতে পাকানো - ও বাড়িতে আর কেউ নেই
জমজমাট সংসার থেকে এইমাত্র বেরিয়ে যাচ্ছে পুরোনো সুটকেস 
ও বাড়িতে একজনও  নেই "( মা বাবা )

কেতকী পত্রিকার সাথে  তাঁর সম্পর্ক ছিল সত্তরের দশকের সুচনাবিন্দু থেকেই। তাঁর অনেক মূল্যবান কবিতা ছাপা হয়েছে কেতকীর পাতায়। সেই সমস্ত কবিতার ভেতরেই  আমি প্রথম  খুঁজে পেয়েছি কবিকে। আচ্ছন্ন হয়েছি,  ভাবনায় জর্জরিত   হয়েছে অজস্র জিজ্ঞাসা। সেই জিজ্ঞাসার সদুত্তর খোঁজার জন্য একসময় তাঁর  কবিতাই হয়ে ওঠে  আমার বাসভূমি । " চাল ফুটবার মুগ্ধ শব্দের" দিকে তাকিয়ে থেকেছি প্রেমে ও প্রসন্নতায়। 
শাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ যখন পড়ি। আবিষ্কার করি নতুন এক কবিকে। নিরন্তর এক ভাঙচুরের ভেতর নিজেকে নির্মাণ করেছেন তিনি। স্বাদু গদ্যের দেহকোষে  কবিতার আত্মাকে প্রতিস্থাপিত করার যে রসায়ন তিনি এখানে তুলে এনেছেন  গদ্যশরীরে এরকম লাবণ্যসঞ্চারের উদাহরণ খুব বেশি নেই। 
চোখ চশমা চায়, কিন্তু নয়ন , নেত্র, লোচন বা আঁখি ঐ পরকলা চায় না। চাঁদ  ৮৪র মেঘে ডুবিয়া যায়। মেঘ সংস্কৃত জানে না। আঁখিকেও কি মেঘ জানে না ? তখনি বিদ্যুৎ দেখি, যাহা এক আঁখিহীন কটাক্ষ। 
কী হইলে নিজেকে সফল মনে করিতে পারিতাম ? এমন কোনো সাফল্য কি রহিয়াছে যাহা হইলে বাকি জীবন নিজেকে নিশ্চিন্ত মনে সফল বলিয়া ধারণা করা যায় ? ঈশ্বরের মুহূর্ত জানিয়াছি, ক্ষুধার মুহূর্ত জানিয়াছি। ত্রাস , প্রেম , সন্তানসুখ , বৃদ্ধ বৃদ্ধার মুখের মুহূর্ত । কিন্তু সকলই মুহূর্তমাত্র। 
সব বৃক্ষে কি ফল ধরে ? তবে কেন তুমি বলিলে ফলেই বৃক্ষের পরিচয়?  যেখানে গাছে একটি পাতা না থাকিলেও তুমি গাছকে গাছ বলিয়া চেনো ?

দুর্বোধ্যতার সমস্ত বেড়াজাল ভেঙে এক পরিশীলিত গদ্যের বাতাবরণে কবিতা এখানে মুক্ত স্বাধীন। 
আবহমান কালচেতনাকে সাথে নিয়ে কাব্যিক অনুভাবনা উৎকীর্ণ হয়েছে সংযত  উচ্চারণের আশ্চর্য আয়ুধে। 
শাদা পাথরের গোলাপগুচ্ছ  বাক্যের নিজস্ব মহিমায় কীভাবে ছড়িয়ে দিয়ে শব্দের সৌরভ তা এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় স্বাক্ষর রেখেছে। পাথরের গোলাপগুচ্ছ প্রাণের স্পন্দন নিয়ে ফুটে উঠেছে শাদা পাতায়। 

"রাঙা মেঘ যায় বহুদিন বাদে হয়তো বিকালে, হয়তো বারান্দায়
যেন ভ্রমণের স্পর্শ সে রাখে  নিজের গভীরে নিজেরই  শূন্যতায়
চোখ রাখি তাই আপন চোখের  দৃষ্টিকে  ফিরে নিতে 
দৃষ্টি এল না  কেবল স্পর্শ এসেছে অতর্কিতে 
স্পর্শের মতো আয়ু চলে যায় 
কখনও বা দ্রুত  কখনও  বিলম্বিতে "

পাঠকের স্পর্শ এইসব চির আয়ুষ্মান  কবিতার গায়ে লেগে থাকবে  অনন্ত সময়।

Post a Comment

4 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। প্রিয়জন প্রাণের মানুষ পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল বাংলা কবিতায় একটা শূন্যতা রেখে গেলেন। তার অভিঘাত বহুদিন আমাদের বিচলিত করবে।

    ReplyDelete
  2. বড় সুন্দর আলোচনা করেছেন বিপ্লববাবু পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতার ওপর ।‌ সময়কে ধরে ছুঁয়েও পার্থপ্রতিম অসাধারণ ধ্রুপদী কাব্যভাষা অর্জন করেছিলেন । আমার অন্যতম প্রিয় প্রধান কবি । জ্বলদর্চিকে ভালোবাসা, বিপ্লববাবুকে আন্তরিক অভিনন্দন ।

    ReplyDelete
  3. বড় সুন্দর আলোচনায়

    ReplyDelete
  4. কি অসামান্য পড়াশুনো বিপ্লব তোমার! পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের ওপর তোমার লেখাটি পড়তে পড়তে এই বোধ হল যে সুগভীর পাঠের ফলেই এমন লেখা ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব।

    ReplyDelete