জ্বলদর্চি

বুদ্ধিজীবী ও গণিকাবৃত্তি- ৩ / সন্দীপ কাঞ্জিলাল

     অলংকরণ প্রান্তিকা মাইতি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল

পর্ব--১৮

বুদ্ধিজীবী ও গণিকাবৃত্তি -৩

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল

বিদ্যাসাগর মানবহিতৈষী রূপে যা কাজ করেছেন, সেই কাজে তাঁকে সাহায্য করার লোকও তখন ছিল না। তাই শেষ জীবনে আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। যদি এখনকার মতো এত বুদ্ধিজীবী বা বিদ্বজ্জন তখন থাকতো, তবুও বিদ্যাসাগরকে শেষ জীবন সাঁওতালদের মধ্যে কাটাতে হতো। কারণ আমাদের চারপাশে যারা বুদ্ধিজীবী বা বিদ্বজ্জন রূপে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদের মধ্যে যদি প্রকৃত বুদ্ধিজীবী বাছতে হয়, তবে দেখা যাবে ভেড়ার লোম বাছতে বাছতে কম্বল উধাও। কিন্তু সমাজে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না কেন? তাঁর অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ প্রকৃত শিক্ষার অভাব। উচ্চশিক্ষা বলতে বুঝি একটার পর একটা ডিগ্রী! এই উচ্চশিক্ষা শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব ছাড়া অন্য কিছু তৈরি করে না। এখনকার  উচ্চশিক্ষা হচ্ছে দুর্ধর্ষভাবে অর্থ উপার্জনের শিক্ষা। একটি তরকারি যেমন অনেক মশলা দিয়ে তৈরি হয়, তেমনি একজন প্রকৃত মানুষ তৈরি হতে গেলে অনেক মশলার মধ্যে হিউম্যানিটিজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু এই হিউম্যানিটিজ কিভাবে মানুষের মধ্যে ঢোকাতে হবে সেটাই জানা আগে জরুরি! হিউম্যানিটিজের মূল কথা হচ্ছে অপরের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করা। এটা কিন্তু সহজ নয়। একজন শিক্ষকের মধ্যে যদি এই হিউম্যানিটিজ না থাকে, যদি শুধু মাত্র পয়সা কামানোর বিদ্যা থাকে তবে প্রকৃত উচ্চশিক্ষা ছাত্রছাত্রীরা পাবে কি করে? তার উপর আবার পয়সার জোরে নিম্ন মেধার মানুষও শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন। সরকার যেমন দায়ী, তেমনি যারা চাকরি পাচ্ছেন তারা ও সমান অপরাধী। সরকার যেমন দেশের ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন না, তেমনি যারা চাকরি পাচ্ছেন, তাঁরা ও জানেন তাঁদের মেধার বহর। উভয়ের কৃতকর্মে দেশ যাচ্ছে রসাতলে। তার উপর যারা চাকরি দিয়ে অর্থ কামাচ্ছেন, সেই অর্থ যদি অসৎ ব্যক্তির হস্তগত হয় তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা হয়। প্রতিটি অসৎ অর্থের মালিকই ভয়ংকর মানসিক রোগী এবং এক ধরনের আত্মঘাতী অপরাধী হিসেবে সমাজ সংসারে ক্রমাগত অশান্তির সৃষ্টি করে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। তার দায়ও ঐ চাকরীপ্রার্থীরা অস্বীকার করতে পারে না। 
এরফলে সমাজ, মানুষ, রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষুদ্রতা ও অনৈক্যের বীজ যেভাবে বাড়ছে, যেভাবে লাভ, লোভ ও আত্মস্বার্থতা চারদিকে মাথাচাড়া দিচ্ছে, এতে ব্যক্তি বিশেষের লাভ হলেও সমষ্টির ক্ষতির আশঙ্কাই ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য হলো সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এবং অধঃপতন ও ক্ষুদ্রতার বীজ উৎপাটনে তৎপর হওয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাই বিভেদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। উস্কানি ও বিভ্রান্তির পাণ্ডা হয়ে কাজ করছেন। এতে মানুষ পথ পাওয়ার বদলে আরও বেপথু হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতির বদলে অবনতি হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের ভ্রান্তির কারণে। 
আমাদের অতীত কালের সম্মানীয় বুদ্ধিজীবীগণ আর যা-ই করুন, নিজস্ব ব্যক্তিগত স্বার্থের কর্মীতে রুপান্তরিত হননি। বর্তমানে অনেকেই অতি সাধারণ স্বার্থবাদী মানুষের মতো হয়ে গেছেন। ক্ষুদ্র স্বার্থের পক্ষ নিতে গিয়ে বৃহত্তর জনতাকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করছেন। এই ধারা বন্ধ না করা গেলে অধঃপতন, অনৈক্য, ক্ষুদ্রতা ও খণ্ডতার অবসান ঘটবে না। পরিস্থিতি ক্রমে ক্রমে খারাপের দিকেই যাবে। বিভিন্ন ইস্যুতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণই নানা বিভক্ত কাঠামোয় জনতাকেও আরও বিভক্ত করে ছাড়বেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজন বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি ও উদার মন এবং সঙ্কীর্ণতার অবসান। কাউকে না কাউকে বড় চিন্তা নিয়ে এগিয়ে আসতেই হবে। আগামীর দিকে তাকাতেই হবে।
মিশেল ফুকো বলতেন, আমি বুদ্ধিজীবীদের সচরাচর চিনতে পারি না। সত্যি বলতে কি বুদ্ধিজীবীদের চেনাটাও খুব মুশকিল। কাকে ঠিক বুদ্ধিজীবী বলবো বুঝতে পারি না। নিজের জীবনে, কাজ-কর্মে এমন মানুষ দেখেছি যারা উপন্যাস লেখেন, ছবি আঁকেন, চিকিৎসা করেন, ব্রিজ তৈরি করেন, ইলেকট্রনিক সংগীত রচনা করেন, আবার এমন অনেক মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে যাঁরা শিক্ষক, কবি প্রকাশক, সাংবাদিক,সম্পাদক-- কিন্তু বুদ্ধিজীবী ঠিক কে? টেলিভিশনে, খবরের কাগজে এবং মানুষের মুখে অবশ্য এই 'বুদ্ধিজীবী' কথাটা অনবরত শুনছি। কথাবার্তা শুনে এই 'জীবটি' সম্পর্কে যা বুঝেছি প্রথমে সেটা বলি, বুদ্ধিজীবী হলেন গিলটি (guilty), অপরাধী। সব ব্যাপারেই তিনি কম বেশি অপরাধ করেছেন, তিনি অপরাধী কথা বলার জন্য, চুপ করে থাকার জন্য, প্রতিবাদ করার জন্য, প্রতিবাদের সময় বাড়িতে বসে থাকার জন্য, কিছু লোকের সঙ্গে মেশামেশার জন্য এবং মেলামেশা না করার জন্য। 
আগের অধ্যায়ে পর্বে যে ব্যক্তি জনগণকে 'গণ' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, কিন্তু মুশকিল হলো ঐ ব্যক্তিকে চিনে ওঠা আমার পক্ষে একটু কষ্টকর হয়ে উঠেছে।। যিনি আবার পোষ্ট এডিটোরিয়ালে লেখেন, 'লেঠেল দিয়ে দেশপ্রেম হয় না' এমন কথা। যিনি বলেন, "নাগরিকের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো, দেশের ভুল দেখলে, তা নিয়ে সরব হওয়া।" বলেন, "দেশপ্রেম মানে স্তাবকতা নয়। ফেল করা ছেলেকে যে লোক পিঠ চাপড়ে 'বহুত আচ্ছা' বলে, সে তার উন্নতি চায় না, অধঃপাতের রাস্তাটাই সুগম করে।" এমন সব বক্তব্যের সাথে 'গণ' কে নিন্দা করা যায় কীভাবে, কেমন করে যায়, তার পাঠ বোঝা সত্যিসত্যিই কষ্টকর৷ মানুষের বক্তব্য তখনই স্ববিরোধী হয়ে উঠে, যখন সে নাম বা পয়সা কামাতে চায়। এমন উদাহরণ অনেকেই আছে। প্রথা কি, না জেনেই অনেকে প্রথাবিরোধী হয়ে উঠেন, এটাও স্রেফ নাম কামানোর জন্য। আর নাম কামানোটা হল ইনভেস্টমেন্ট, যা থেকে পয়সা কামানোর রাস্তা খুলে যায়।
গাধা লিখতে দুটো অক্ষর আর মানুষ লিখতে লাগে তিনটা। মানুষের চেয়ে গাধার দুটি পা বেশি, কানও অনেক বড়ো। সংখ্যা ও মাপে দুয়ের কাউকেও বড় ছোট ভেবে নেওয়া হয় না। গাধার লেজ আছে, মানুষের নেই বলে মানুষ উন্নত, তা নয়। সৃষ্টির সময় সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন বেশি বেশি, সে জন্যই মানুষ বড়, উন্নত, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। 

গাধা গাধাই, তার মধ্যে মানুষের উপাদান নেই। সে মানুষ হতে চায় কিনা জানা নেই, চাইলেও তার পক্ষে তা অসম্ভব। গাধা মানুষ হতে পারবে না। অন্য দিকে গাধা হওয়া মানুষের পছন্দ নয়, তবু মানুষ অহরহ গাধা হয়, হচ্ছে। আকৃতির বদল নয়, শুধু বেচারা প্রাণীটার কল্পিত স্বভাব ভর করে মনুষ্যচরিত্রে। গাধাদের খুব বোকা ভাবা হয়, আর কোনো মানুষ বেশি মাত্রায় বোকামো করে ফেললে বলা হয়ে থাকে গাধামো। মানুষের মানানসই যোগ্যতা হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা, কিন্তু প্রিয় চর্চার বিষয় চালাকি। জন্তু জানোয়ারের বুদ্ধিমত্তায় মানুষেরা বিস্মিত হয়, কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই নিজ স্বার্থ বা বিশেষ গৌরব অর্জনের জন্য বুদ্ধিমত্তার চেয়ে চালাকির চর্চা শ্রেয়তর মনে করে থাকে। 
অনেক মানুষ নিজ ধ্যান-জ্ঞানের দোর্দণ্ড প্রতাপে ধরাকে সরা জ্ঞান করে জানান দিয়ে যাবে বাহাদুরি। সে আত্মতুষ্টিতে সমাজ, সংসার ও অন্য মানুষদের জীবন রসাতলে গেলেও তারা থাকবে তোয়াক্কাহীন। তোয়াক্কাহীন এসব মানুষ চেনে শুধু নিজেকে, নিজ স্বার্থ, নিজ গোষ্ঠীকে। মানুষ তার গোষ্ঠী নয়, নিজের বিবেচনা ধ্যান-জ্ঞান যে বা যাদের সঙ্গে মিলে যায়, সে বা তারাই আপন, নিজ গোষ্ঠীভুক্ত, দরকারি তারা। প্রয়োজন তাদেরই শুধু। তারাই যোগ্যতর, ভালো, কৃতী। কেবল তাদেরই ভালো থাকার অধিকার, ভালো জোটার অধিকার। 
গাধা ও মানুষের মধ্যে ব্যাপক তফাৎ। মানুষেরা গাধা হতে চায় না, গাধা বানাতে চায়। অন্যদের বানাতে গিয়ে নিজেরাই গাধা বনে যায়, তা টের পায় না। অন্যের মধ্যে গাধামো আবিষ্কার করতে পারে মানুষ। অন্যজনের গাধামোতে অধিক পরিমাণে আনন্দিত হয়। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ পরিচয়ের মানুষ অন্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে আত্ম-আবিষ্কারের সাধ্য হারিয়ে ফেলে। আত্মতুষ্টির ঘোর তাদের করে রাখে আহ্লাদে আটখানা। তা গাধামোর বিশেষ আর এক ধরন।
টেলিভিশন ক্যামেরা নানা উদ্যাপনের বেলায় মানুষ ধরে ধরে এই দিন কেন, অমুক দিনের তাৎপর্য কী, এসব প্রশ্ন করে সাধারণের গাধামো আবিষ্কার করে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা দেখে কমবেশি দুঃখিত, মর্মাহত হয় অনেক মানুষ। বড় বড় মানুষের বড় বড় গাধামো দিব্যি হজম করা হচ্ছে নিত্যদিন। আর কৌতুকের ইচ্ছা জাগে সামান্যদের গাধামো ফলাও করে দেখিয়ে। কেন এই গাধামো? ভেবে দেখা হয়ে ওঠে না। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কর্তব্য জ্ঞানহীন আচরণ প্রায় প্রত্যহের ঘটনা। তা সানন্দে মেনে চলার রীতি একটা ফাঁপা সমাজ রচনা করে চলেছে। 
সত্যের দশা করুণ, মিথ্যা দাপুটে। সচেতনতার জ্ঞান ডিঙিয়ে অজ্ঞানতা ও অসচেতনতা যদি ঘাড়ে উঠে বসার সুযোগ পায়, তা হজমের অভ্যাস ও মানুষকে রপ্ত করে নিতে হয়। এমন অস্বাভাবিক কাণ্ডে যদি নতুন প্রজন্মের একটা অংশ অসম্পূর্ণতায় বেড়ে ওঠে, সে দোষ শুধু সেই সাধারণের নয়। অসচেতনতা অজ্ঞানতার প্রকাশ ঘটিয়ে এক শ্রেণির মানুষের সামান্য মর্যাদাহানি ঘটে না। দায়িত্বশীল পরিচয় অটুট থাকে। ঘাড়-মাথা বেঁকিয়ে, কুঁজো হয়ে তেমন দায়িত্ববানদের যদি মেনে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে যায়, সাধারণের মনের বৃদ্ধি সঠিক ঘটবে, তেমন আশা দুরাশাই। টেলিভিশনের পর্দায় আলাদা করে সামান্যজনদের অজ্ঞতা প্রচার করলে তা বিনোদনের বিষয় হয়ে উঠে, হতাশাও বাড়ায়। ব্যক্তিবিশেষের অজ্ঞানতা, বোকামো বা গাধামো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার নিশ্চয়ই পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। মানুষ একটা কালের অংশ, তা-ও অস্বীকার করা যায় না।

Post a Comment

1 Comments

  1. অপ্রিয় সত্য কথা লিখার জন্য ধন্যবাদ

    ReplyDelete