জ্বলদর্চি

এমিল এডওয়ার্ড চার্লস এন্টোনি জোলা(Emile Edward Charles Antoine Zola)/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

Emile Edward Charles Antoine Zola

"If you ask me what I came into this life todo,
I will tell you : I will came to live out loud." 


এমিল এডওয়ার্ড চার্লস এন্টোনি জোলা
(০২/০৪/১৮৪০ - ২৯/০৯/১৯০২)

স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল


ভোরের আলো তখনো মাটি ছেড়ে দাঁড়ায়নি। সবেমাত্র হামাগুড়ি দিচ্ছে। প্যারিসের একটি মর্গ। সেখানে একজন খুঁজে বেড়াচ্ছে একটা লাশ। যাকে সে নিজের হাতে খুন করেছে। কারণ তার প্রেমিকার স্বামী সে। তাকে না সরালে সে তাঁর প্রেমিকাকে আপন করে পাবে না। সে তাকে নদীতে স্নানের ছলে জলে ডুবিয়ে মেরেছে। মরেছে, কি না? --তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে গেছে মর্গে, দেখতে। সেখানে গিয়ে সে দেখতে পায় ঐ লাশের পাশে শোয়ানো আর একটি যুবতী মেয়ের লাশ। মারা গেছে প্রেমের কারণে গলায় ফাঁস দিয়ে। মৃত মেয়েটির শরীর উলঙ্গ। লোকটি তার অনাবৃত বক্ষযুগল আর শরীর দেখে কামনার আগুনে অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটির সর্বাঙ্গ চোখ দিয়ে লেহন করছে। 

না, এটা বাস্তবে নয়! এটি একটি উপন্যাস। নাম- 'তেরেসা রেকুইন' (Theresa Rquin)- 1867. লেখক 'এমিল জোলা'। পুরো নাম - এমিল এডওয়ার্ড চার্লস এন্টোনি জোলা' (Emile Edward Charles Antoine Zola)।

‌১৮৪০ সালের ২ এপ্রিল ফ্রান্সের প্যারিসে এমিল জোলার জন্ম। তাঁর বাবা ফ্রাঙ্কোয়িজ জোলা ছিলেন ইতালিয়ান প্রকৌশলী এবং মা ফ্রান্সের মেয়ে এমিলি অবার্ট। ১৮৪৭ সালের জোলার বয়স যখন মাত্র সাত, তখন তাঁর বাবা মারা যান। এরপর তিনি বড় হতে থাকেন মায়ের কাছেই। বাবার মৃত্যুর পর ১৮৫৮ সালে জোলার পরিবার চলে আসে ফ্রান্সে। একই বছর পড়াশোনার জন্য জোলা পাড়ি জমান প্যারিসে। সেখানে বন্ধু হিসেবে পান বিখ্যাত চিত্রকর পল সেজানকে। এ সময় তিনি লেখালেখি শুরু করেন রোমান্টিক ধাঁচে। জোলার মায়ের পরিকল্পনা ছিল ছেলেকে আইন পড়াবেন এবং আইনেই ছেলের কেরিয়ার গড়বেন। কিন্তু মায়ের সেই আশার গুড়ে বালি। লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায়  লরিয়েট পরীক্ষায় (সে দেশে মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা) অকৃতকার্য হন জোলা। পরবর্তী সময়ে আর তাঁর আইন পড়া ও লেখালেখি। শুরুতে জোলা লেখেন ছোটগল্প ও গদ্য, চারটি নাটক ও তিনটি উপন্যাস। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৮৬৪ সালে। ১৮৬৫ সালে তাঁর জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি পুলিশের তোপের মুখে পড়েন। লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার আগে তিনি বিপণনকেন্দ্র এবং জাহাজ কোম্পানির কেরানির কাজ করতেন। তখনো তিনি পত্রিকায় সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনা লিখতেন সাংবাদিকদের মতো। শুরুতে তিনি ছিলেন ফরাসি শুল্ক বিভাগের একজন কেরানি। 

জোলার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল- 
1.'জারমিনাল'(Germinal)- 1885.
2.'লা তেরা' (La Terre)- 1887.
3.'লা মিরর' (La Mirror)- 1895.
4.'দ্য আর্থ' (The Earth)- 1888.
5.'দ্য জারমিনাল' (The Germinal)- 1885.

'লে রুগুনমাকা'(la Rougan Macqart)-1871-93 হলো তাঁর ২০টি উপন্যাসের সংকলনের নাম। ১৮৫২ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় ফরাসি সাম্রাজ্যের একটি কল্পিত পরিবারের দুটি শাখার সদস্যদের জীবনকথা নিয়ে তৈরি হয়েছে উপন্যাসগুলোর কাহিনি। ২০টি উপন্যাসে তিন শতাধিক প্রধান চরিত্র তৈরি করেছেন তিনি। পরিবারের দুটি শাখা থেকে তাদের বংশগতি হওয়ার কারণে এরা সবাই একে অন্যের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত। মানুষে মানুষে সংঘর্ষ, মাদকের প্রভাব এবং শিল্পবিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপে বেড়ে ওঠা পতিতাবৃত্তি মানুষের জীবনে কী কী ভয়াবহ প্রভাব ফেলে, তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এসব কাহিনীতে। 

নয়া সাংবাদিকতার সৃষ্টির সঙ্গে উলফ, কাপোতে, টমসন, মেইলার, ডিডিওনসহ যেসব লেখকের নাম জড়িয়ে আছে, তাদের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে জোলার। টম উলফ বলেন, তার কথাসাহিত্য লেখার পেছনে উৎসাহের মতো কাজ করেছে জন স্টাইনবেক, চার্লস ডিকেন্স এবং এমিল জোলার মতো করে সমসাময়িক সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার বাসনা। আসলে জোলা নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসে বাস্তব সমাজের নিরাবেগ চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি মনে করতেন, প্রতিটি উপন্যাসের ভিত্তি হবে বাস্তবতার তথ্যাবলি। ১৮৮৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি উত্তর ফ্রান্সের আঁজিনে যান সেখানকার বাস্তব অবস্থা দেখার জন্য। তখন সেখানে ধর্মঘট চলছিল। 'লা তেরে'(La Terre)-1887- র জন্য বিউচে যান; 'লা দেবাকল'(La Debacle)-র জন্য যান সেদান এবং আন্দেনেসে। প্যারিস এবং লা হাভ্রের মাঝের রেললাইন ভ্রমণ করেন 'লা বেতে হিউমাইন'(La Bete Humaine) নিয়ে গবেষণা করার সময়। 

জোলা মনে করেন, তার উপন্যাসে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থাকবে। তবে জর্জ লুকাসের মতো কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন, জোলার সৃষ্ট চরিত্রগুলো বালজাক কিংবা ডিকেন্সের চরিত্রদের মতো জীবনঘনিষ্ঠ ও স্মরণীয় হয়নি। মানুষের গণ-অবস্থার চিত্র বেশ ভালোভাবে তুলে ধরতে পারলেও ব্যক্তিক চরিত্র স্মরণীয় হয়নি বলে মনে করেন তারা। অন্য দিকে জোলা মনে করতেন, কোনো চরিত্র যেন বাস্তবজীবনের চেয়ে বড় না হয়ে যায়। যদিও তিনি বৈজ্ঞানিকভাবে এবং শৈল্পিক দিক থেকে কোনো চরিত্রকে জীবনের চেয়ে বড় করে দেখানো উচিত নয় বলেই মনে করেন, তবু তার কিছু চরিত্র বাস্তব অবস্থাকে ছড়িয়ে গেছে। 

'লা তেরে'(La Terre) উপন্যাসে ফ্রান্সের মধ্যাঞ্চলের পল্লী এলাকার প্রাকৃতিক চলমানতার চিত্র যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, সেখানে বীজ বপনের সময়, ফসল তোলার সময়, মৃত্যু ইত্যাদির মাধ্যমে মানব প্রবৃত্তিকে এক মহান প্রাণশক্তি দেওয়া হয়েছে, যেটা মানবীয় নয়; বরং জীবনেরই মৌলিক শক্তি। 

'এমিল জোলা' কে বলা হয়, উপন্যাসে যৌনতার স্রষ্টা। গল্প-উপন্যাস বা নাটক-সিনেমায় কি যৌনদৃশ্য বর্ণনা বা প্রচার করা যাবে না? কেন যাবে না? অবশ্যই যাবে। গল্প-উপন্যাস নাটক-সিনেমা এসব শিল্পমাধ্যম তো বায়বীয় কিছু নয়। এগুলো আকাশ থেকে পড়ে না, এর সকল উপাদান এ মাটিতেই। এসব শিল্পমাধ্যম তো মানবজীবনেরই নান্দনিক উপস্থাপনা, জীবনেরই প্রতিসরণ। এসব লেখা ও দৃশ্যমাধ্যম মানবজীবনেরই কথা বলে। এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মানুষ, মানুষের জীবন; যে জীবন শুধু কাব্যিক নয়, যে জীবন কেবল দ্বন্দ্বময় নয়, যার রূপ শুধু দৃশ্যময় নয়। জীবন সর্বব্যাপ্ত, তাই শিল্প ও সর্বপ্রসারী। যৌনতা এই সর্বপ্রসারিতার বাইরের কিছু নয়। যৌনতা বায়বীয় কিছু নয়, এটি বাস্তব মানুষেরই প্রবৃত্তি, বাস্তব মানুষেরই অধিকার। শুধু অন্ন- বস্ত্র- শিক্ষা- চিকিৎসা- বাসস্থান নয়, যৌনতাও মানুষের অধিকার। গল্প-উপন্যাস বা নাটক-সিনেমা যেহেতু মানবজীবনেরই কথা বলে, সেহেতু এসবে যৌনতা থাকবে, থাকাটাই স্বাভাবিক। নইলে এসব শিল্পমাধ্যম মানবজীবনের সর্বব্যাপ্ততাকে ধরতে পারবে না। 

কথাশিল্পী ডিএইচ লরেন্স মনে করতেন মানবীয় সম্পর্কের আসল ভিত্তি দেহ এবং সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহের অস্তিত্ব ভুলে মানুষ জগতকে দুঃস্থ ও দুর্নীতিময় করে তুলেছে। তাঁর 'লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার' উপন্যাসে দেহধর্মের আদিম কামনার জয় ঘোষিত হয়েছে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত পুরুষত্বহীন শিল্পপতি স্যার ক্লিফোর্ডকে পরিত্যাগ করে লেডি চ্যাটার্লি মুক্ত অরণ্যভূমিতে, মৃত্তিকায়, বর্ষাধারায় আদিম নারীর মতো স্বামীর 'গেম কিপার' বা শিকার-রক্ষক নিন্মরুচির অথচ স্বাস্থ্যের আদিম রক্তে তাজা মেলরস এর কাছে দেহ সমর্পণে ও যৌনসঙ্গমে আত্মার মুক্তি খুঁজে পেয়েছে।

এমিল জোলার জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো- "ড্রাইফাস মামলা।" ঘটনার স্থল ফ্রান্স! চিঠি লেখক ফরাসি ঔপন্যাসিক নাট্যকার 'এমিল জোলা' বিশ্বের প্রথম বুদ্ধিজীবী! চিঠি দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতিকে 'ড্রাইফাস' মামলায় মাননীয়  বিচারপতি রাষ্ট্রের চক্রান্তে অন্যায় অর্ডার দেওয়ার জন্য। 

অগ্রগণ্য ভাষাতত্ত্ববিদ, দার্শনিক 'নোয়াম চমস্কি' এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'বুদ্ধিজীবী' নিয়ে ধারণাটি খুবই কৌতূহল জাগায়। 'ড্রাইফাস' মামলার আগে পর্যন্ত শব্দটির ব্যবহার ছিল না, ড্রাইফাসপন্থীদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। আদতে তীব্রভাবে নিন্দা জানানো হয়েছিল তাদের, যারা এইসব লেখক শিল্পীরা, রাষ্ট্রের সম্রাট ও এর প্রতিষ্ঠান সমূহকে আঘাত করার জন্য উদ্যত হয়েছিল। দার্শনিক 'নোয়াম চমস্কি' র কথায়, বিশ্বের প্রথম বুদ্ধিজীবী হল লেখক ও সাহিত্যিক। অথচ আজকের লেখক সাহিত্যিক অধিকাংশ চাঁদ ফুল নদী লতা পাতা আর নারী নিয়ে দিন কাটিয়ে দিল। সেই শূন্যস্থানে উঠে আসছে একদল এঁচোড় পাকা স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী! 

এখন আলোচ্য বিষয় 'ড্রাইফাস' মামলা কী?  
ফ্রান্সের একটি দৈনিক খবরের কাগজ 'ভোর' যার প্রত্যেকদিন কপি বিক্রির সংখ্যা ত্রিশ হাজার। সেই কাগজটির বিক্রির সংখ্যা রাতারাতি বেড়ে হয়ে গেল তিন লাখ। সেই কাগজে কী ছিল? ছিল ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি 'ফেলিক্স ফোর' কে লেখা একটি চিঠি। যার প্রথমেই ছিল "আমি অভিযোগ করছি" (I accuse...)। লিখছেন ফরাসি বাস্তববাদী ঔপন্যাসিক, 'জেরমিনাল' উপন্যাসের স্রষ্টা 'এমিল জোলা' এই চিঠিটি লেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই পাঁচ পয়সার দামের কাগজ 'ভোর' ঢুকে গেল ইতিহাসের পৃষ্ঠায়।'এমিল জোলা' র কলম ছিল খাপ খোলা ধারালো ইস্পাতের তরবারী! যার দ্যুতি ঠিকরে পড়েছে ফ্রান্সের মানুষের চোখে মুখে। তিনি ঘুরছেন ন্যায় ও সত্যের সন্ধানে। যা পরে হয়ে দাঁড়াবে তার মৃত্যুর কারণ। 
ঘটনার সূত্রপাত ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বর। ফরাসি বিপ্লবের একশো বছর পরে। 'আলফ্রেড ড্রাইফাস' যিনি ফ্রান্সের আলজাসের এক নগণ্য ইহুদি আর্টিলারি অফিসার। ফরাসি সেনাবাহিনী অভিযোগ আনে, ফ্রান্সের সামরিক তথ্য জার্মান দূতাবাসে পাচার করেছেন তিনি। তাঁর এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাকে পাঠানো হয় ফ্রান্সের গায়নার "শয়তানের দ্বীপ" এ। যেখানে সে পাঁচ বছর এক নির্জন দ্বীপে শাস্তি ভোগ করে। এর ঠিক দু'বছরের মাথায় ১৮৯৬ সালে ফ্রান্সের গুপ্তচর বিরোধী কমিশনের প্রধান "জর্জ পিকার" নিরপেক্ষ অনুসন্ধান করে জানতে পারে। "ড্রাইফাস" দোষী নয়, মূল অপরাধী 'এস্তেরাজি' নামে এক খৃষ্টান ফরাসী সেনাপতি। সেনাবাহিনীর কর্ণধারেরা আসল কাগজপত্র লুকিয়ে দুদিনের বিচারের প্রহসনের পর তাঁকে খালাস করে দেয়। আবার নতুন করে কাগজপত্র সাজানো হয় "ড্রাইফাসে"র বিরুদ্ধে। 

এই সত্য ঘটনা চাপা দেওয়ার খবর দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়লো ফ্রান্সের বন থেকে বনান্তরে। প্রত্যেকটি অবলা প্রাণীর মুখে সেই খবর। আর তা বলতে না পারার জন্য তারা ছটফট করছে। আকাশ বাতাস সমুদ্র নদী প্রান্তর দিগন্ত বলতে না পারার জন্য মন মরা। ফ্রান্সের কথা বলা প্রাণীর ও কানে কানে এই খবর পৌঁছে গেছে। কিন্তু কারোর মুখ থেকে কথা ফুটছে না। প্রত্যেকেই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। নিজের সংসার স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে। কিন্তু যার কলম তরবারী হয়ে ঝলকাচ্ছে, যার একমাত্র প্রতিজ্ঞা অন্যায়ের নিধন, তিনি চুপ করবেন কেন? ইতিহাস যাকে আমন্ত্রণ জানায়, তিনি কি আর চুপ থাকতে পারেন? তাই তিনি ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতিকে খোলা চিঠি দেন, আপনি অপরাধী। আর সেনাবাহিনীর জেনারেল 'পেলিও' কে লেখেন, "আপনি তলোয়ার চালান, আমি কলম। ইতিহাস বিচার করবে কার জয় হবে।" হ্যাঁ, ইতিহাস বিচার করেছে। তার ন্যায়ের তুলাদণ্ডে নিক্তি মেপে বিচার করেছে। ইতিহাস তার মাথায় পরিয়ে দিল নতুন মুকুট - বিশ্বের প্রথম "বুদ্ধিজীবী"। তখন পাখিদের ছটফটানি বন্ধ, সমুদ্রের ঢেউ শান্ত, বাতাসের মৃদু মন্দ বিচরণ, দিনের আকাশে স্মিত সূর্যের কিরণ আর রাতে চাঁদের মুখে সেকি প্রশান্তি! দূরে দিগন্ত আর মাটির লুটোপুটি! প্রান্তর ও বা চুপ করে বসে থাকবে কেন? সে ও ফুটিয়েছে অবাক করা ফুল। 

এই ঘটনা সমগ্র ফ্রান্সকে দ্বিখণ্ডিত করে দিল। এমিল জোলার সাথে যোগ দেন বিজ্ঞানী এমিল দুক্লো, চিত্রশিল্পী ক্লোদ মনে, সাহিত্যিক জুল ব্যনার, ঐতিহাসিক গাব্রিয়েল মনো, আরও অনেক প্রথিতযশা মানুষ। আর এর মুখ্য ভূমিকায় সংবাদপত্র এবং সাহিত্যিক 'এমিল জোলা'। যে ঘটনা ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় অবিচারের এক প্রতীক হয়ে উঠবে, তা বারো বছর ধরে, ফ্রান্সের ভূগর্ভ থেকে টেনে আনবে তপ্ত ম্যাগমা। যা লাভা হয়ে ছড়িয়ে পড়বে গোটা ফ্রান্সের প্রান্তরে। 

২০শা জানুয়ারী ১৮৯৮ দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ নেতা "আলব্যের দ্য মুন" জোলার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন সংসদে এবং তাঁর শাস্তির দাবি করেন। ২৩শা জানুয়ারী "জর্জ ক্লেমাঁসো" এই ড্রাইফাস কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম- "অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল" (ইন্টেলেকচুয়াল) শব্দটি প্রয়োগ করেন। এই 'এমিল জোলা'র পথ ধরে মুক্ত চিন্তক প্রজাতন্ত্রীরা সরকারের উপর চাপ দিতে শুরু করলো। উলঙ্গ হয়ে যায় সমাজের লুকিয়ে থাকা সব ক্ষত, আর শিল্পী সাহিত্যিকদের সামনে এঁকে দেয় প্রশ্নচিহ্ন, কারা তোষণ করবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে? কারা ব্যস্ত থাকবে তারা নদী ফুল গাছ নিয়ে? আর কে বা কারা এসব প্রত্যাখ্যান করে তৈরি করবে মানুষের প্রকৃত ইতিহাস? 

জোলার পথ ধরে 'ড্রাইফাসপন্থী' মুক্ত চিন্তকের দল সরকারের উপর চাপ দিতে শুরু করে পুনর্বিচারের জন্য। অন্যদিকে 'ড্রাইফাসপন্থী'দের বিরুদ্ধে ইহুদিবিরোধী মুখপত্র 'মুক্তকথা' য় ক্রমাগত বিষবর্ষণ। সরকারপন্থীরা তথাকথিত প্রতিরক্ষা, সমাজ সংরক্ষণ ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের কথা বলে চিহ্নিত করলো 'এমিল জোলা' ও তার সম্প্রদায় রাষ্ট্রদোহী। ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীরা দ্বিখণ্ডিত হলেন। সরকারের পক্ষ থেকে এবং সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে 'এমিল জোলা' দের জন্য সংগঠিত হতে লাগলো চক্রান্ত। তখনই ফ্রান্স জুড়ে এক নতুন শক্তির জন্ম হল-'বুদ্ধিজীবী'। একদিকে নতুন বিচারের দাবি, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী নেতা "মরিস বারেস" এর মতে, "ওই আভিজাত্যেরা জনতাকে ঘৃণা করে, জনগণ  থেকে আলাদা শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত হতে চায়।" 

যখনই "জোলা" র বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলো, তখনই "ড্রাইফাসপন্থী" মুক্ত চিন্তার মানুষেরা, ২৬১ জন শিক্ষক, ২৩০ জন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, রাষ্ট্রের কাছে আবেদন করে পুনর্বিচারের। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রান্সের সমাজে রাজনীতি এবং দর্শন বিষাক্ত হয়ে উঠে। একদিকে মাত্র কয়েকজনের স্বাধীন চিন্তার সাম্প্রদায়িকতাহীন মানুষের  লড়াই। অন্যদিকে জার্মান বিদ্বেষ, ইহুদিদের প্রতি অসম্ভব ঘৃণা জাতীয়তাবাদকে উসকে দেয়। তাদের পিছনে ফ্রান্সের অধিকাংশ মানুষ। চারদিকে আওয়াজ উঠে "ড্রাইফাসপন্থী" মানে রাষ্ট্রদ্রোহী। একদিকে ন্যায় বিচারের জন্য গুটিকতক মানুষের লড়াই, অন্যদিকে দেশের জাতীয়তাবাদীর জিগির তুলে জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা। এইসময় জাতীয়তাবাদী নেতা "মারেস বারেস" এর সেই কুখ্যাত উক্তি, "যুক্তি দিয়ে হবে না, এসময় দরকার আবেগের শক্তি, জাতীয়তাবাদ মানে আত্ম পূজা।" 
শুরু হলো নতুন লড়াই মুক্ত চিন্তা বনাম জাতীয়তাবাদ। এরপর ফ্রান্সের সরকার ব্যাস্ত হয়ে উঠলো "জোলা" কে এদেশ থেকে তাড়ানোর। প্রমাণ করতে সচেষ্ট হল, "জোলা" নাকি বহিরাগত। তিনি নাকি "ভেনিসীয়", তার বাবা ইতালীয়। তিনি আদপেই ফরাসি না। তাই তার দেশের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার নেই। "রম্যাঁ রলাঁ" প্রথমদিকে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও, শেষ পর্যন্ত সবকিছু বুঝে শুনে 'জোলা'র পাশে দাঁড়ান। মুক্তমনকে এভাবে ভয় দেখানো যায়? যে 'জোলা' সাহস রাখেন এক দেহোপজীবিনীকে জীবন সঙ্গিনী বানাবার, তৃতীয় নেপোলিয়নের চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মত বা চিরপ্রতিবাদী ভিকতর য়ুগ্যোর শোক মিছিলে লাল গোলাপে পথ হাঁটার মানসিকতা। তাই তো তাকে ফ্রান্সের সরকার ১৮৯৮ সালে একবছরের জন্য কারাদণ্ড দেয়। তিনি সেই শাস্তি এড়াবার জন্য লন্ডনে চলে যান। তিন মাস পরে জনমতের চাপে বাধ্য হয় সরকার তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে। ১৯০১ এবং ১৯০২ সালে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরষ্কারে মনোনীত হওয়ার পরেও তাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি। 

'জোলা' যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তার উত্তাপে বাধ্য হয় ফ্রান্সের সরকার ১৯০৬ সালে "ড্রাইফাস" কে মুক্তি দিতে এবং তাকে সসম্মানে মেজর পদে উন্নীত করে পুনর্বহাল করতে। 

কিন্তু "ড্রাইফাস" এর মুক্তির চার বছর আগে ১৯০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হঠাৎ রাত্রে জোলার ঘরে চিমনি বন্ধ। ঘর ভর্তি হয়ে গেল কার্বন মনোক্সাইডে। মারা গেল জোলা সপরিবারে। "জোলা" র বাড়ির ঝাড়ুদার পরে  জানায়, সে নিজে রাত্রে চিমনি বন্ধ করে দিয়েছিল। কার নির্দেশ ছিল? রাষ্ট্র? 

তবু 'জোলা'র শেষ কৃত্যে যোগ দিতে এসেছেন হাজার হাজার মানুষ। শাসক কি বাধ্য করতে পারে ইতিহাসকে নিজের পথে চালাতে? পারেনা! তাইতো যেখানে অন্যায়, যেখানে 'ড্রাইফাস', সেখানে দাঁড়িয়ে একটি কলম যা খোলা তরবারির মতো ধারালো, তাই হাতে প্রথম বুদ্ধিজীবী 'এমিল জোলা', যিনি সরকারের যাবতীয় পুরস্কারকে দ্বিধাহীন ভাবেই প্রত্যাখ্যান করবেন -- এ আর আশ্চর্যের কী!
--------------------------------------------------------------
প্রিয় পাঠক, এই ধরনের লেখা কেমন লাগছে  -- জানতে পারলে আমাদেরও কাজের সুবিধা হয়। 
মেল - jaladarchi@yahoo.in  

Post a Comment

1 Comments

  1. আগাগোড়া মন সংযোগ করে পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। অনেককিছু জানলাম। এই ধরণের লেখাকে প্রাধান্য দিলে ভালো হয়। আরো নতুন কিছু পড়ার আশায় রইলাম। সন্দীপ বাবুকে অশেষ ধন্যবাদ।

    ReplyDelete