জ্বলদর্চি

প্রাচ্যের হিফিস্টাস, হেস্টিয়া, ডিডালাস ও আমাদের বিশ্বকর্মা


প্রাচ্যের হিফিস্টাস, হেস্টিয়া, ডিডালাস ও আমাদের বিশ্বকর্মা


ভা স্ক র ব্র ত  প তি

বিশ্বকর্মা হলেন সৃষ্টি শক্তির অনন্য রূপ। বিশ্বদ্রষ্টা, প্রজাপতি এবং ধাতা। সর্বজ্ঞ। দেবতাদের নামদাতা।মর্ত্যজীবের অনধিগম্য। ইনি আসলে বাচস্পতি, বদান্য, কল্যানকর্মা, বিধাতা এবং মনোজব।

ইনি পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। বৃহস্পতির বােন যােগসিদ্ধা এঁর মা। অষ্টম বসু প্রভাস হলেন বাবা। আমরা চিনি দেবশিল্পী হিসেবে। ইনি যাবতীয় শিল্প সমূহের রচয়িতা এবং অলঙ্কারের স্রষ্টা। দেবতাদের বিমান নির্মাতা। দশাননের লঙ্কানগরীর প্রতিষ্ঠাতা ইনিই আমাদের দেবশিল্পী 'বিশ্বকর্মা'। 

আমাদের হিন্দু ধর্মের বিশ্বকর্মার মতােই স্থাপত্যবিদ্যায় পটু দেবতার খোঁজ মেলে বিদেশেও। গ্রীকপুরাণ অনুসারে হিফিস্টাস, দেবী হেস্টিয়া, ডিডালাসরা ছিলেন ভাস্কর্য, স্থাপত্যবিদ্যা, ধাতুশিল্প সহ নানা শিল্পকৃতির মুখ্য কারিগর। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা এই বিশ্বকর্মা স্বভাবতঃই হয়ে উঠেছেন বিশ্বতচক্ষুর, বিশ্বতস্মা, বিশ্বতােমুখ এবং বিশ্বতোবাহু।

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বকর্মা সম্পর্কে লিখেছেন, —“ইহারই কৃপায় মানুষের শিল্পকলায় জীবিকা অর্জন করে। ইনি লঙ্কার নির্মাতা এবং সেতুকারক নলের পিতা। ইনি উপবেদ স্থাপত্যবেদের প্রকাশক চতুঃষষ্ঠিকলার অধিষ্ঠাতা, সুতরাং শিল্পীর অর্চনা। বাঙলায় মঙ্গলকাব্যে ইনি চণ্ডীর আজ্ঞায় দেউল নির্মান কাঁচুলি লেখন নগরনির্মান ও নৌকাগঠনের শিল্পী। শূণ্যপুরাণে জন্মস্থান নির্মান ও ধান্যচ্ছেদনার্থ সোনার কাস্তিয়া গড়ার ইনিই কর্ম্মী। অন্নদামঙ্গলে শিবের সিদ্ধির ঘােটনা কুঁড়া, অন্নপূর্ণার রত্নহাতা রত্নমুকুট পানপাত্র ভূষণ কাঁচুলি শাড়ী, উড়নি, ইনিই যােগাইয়া ছিলেন। বিশ্বেশ্বরের দেউল ও অন্নপূর্ণা পুরীর ইনিই নির্মাতা। শিবায়ন, চাষি চাষের নিমিত্ত লাঙ্গলফাল কোদাল দা উখুন পাশী জোয়াল মই ইত্যাদির কর্ম্মকারকরূপে ইনিই শাল বসাইয়া ছিলেন।”

বিশ্ব কর্ম যাঁহার > বিশ্বকর্মা (বহুব্রীহি সমাস)

রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের লেখায় পাই- 'তুমি বিশ্ব গড়, ... তাই বিশ্বকর্মা নাম'। ঋগ্বেদ অনুসারে বিশ্বকর্মা হলেন সর্বদর্শী ভগবান। সর্বমেধ যজ্ঞে বিশ্বকর্মা নিজেকে নিজের কাছে বলিদান করেন। স্বর্ণ সৃষ্টি করেছিলেন ইনি। মহাভারত অনুসারে বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পের শ্রেষ্ঠ কর্তা। অজস্র শিল্পের মূল নির্মাতা। বিশ্বের যাবতীয় শিল্পকর্মের মূল কারুকার্য ইনিই বানিয়েছিলেন। আবার রামায়ণ অনুসারে লঙ্কাপুরীর নির্মাতা বিশ্বকৰ্মাই। যখন রামচন্দ্রের লঙ্কায় যাওয়ার জন্য সেতুবন্ধ নির্মানের প্রয়ােজন দেখা দেয়, তখন এই বিশ্বকর্মাই সৃষ্টি করেন নলবানরদের। যাঁরা সেতুবন্ধ করতে মূল সহায়ক হয়ে উঠেছিলেন। 

শুধু দেবশিল্পী নন তিনি। বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র নির্মানেও তার পটুত্ব অবিসংবাদিত। যাবতীয় আগ্নেয়াস্ত্রের মুখ্য কারিগর তিনিই। শিবের ত্রিশূল, কার্তিকের শক্তি, কুবেরের অস্ত্র, নারায়নের সুদর্শনচক্র সহ অন্যান্য দেবতাদের নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র তৈরির মূল ব্যক্তি তথা কারিগর ছিলেন দেবতা বিশ্বকর্মা। 

এগুলি তিনি নির্মান করেছিলেন সূর্যকে শানচক্রে স্থাপন করে তাঁর উজ্জ্বলতার আট ভাগের এক ভাগ কেটে। এভাবে কেটেছিলেন একটা অন্য কারনে। বিশ্বকর্মা তাঁর মেয়ে সজ্ঞাকে বিয়ে দিয়েছিলেন সুর্যের সাথে। কিন্তু সূর্যের প্রখর তাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না সজ্ঞার। তখন বিশ্বকর্মা সূর্যের উজ্জ্বলতার অষ্টমাংশ কেটে দিতেন। সেই কাটা অংশ পৃথিবীতে পড়লে তা দিয়ে এইসব অস্ত্রশস্ত্র বানিয়েছিলেন দেবতাদের জন্য। 

বিশ্বকর্মা বিয়ে করেছিলেন ব্রহ্মার কন্যা বিশ্বকলাকে। বিশ্বকর্মার পাঁচ ছেলে। এঁরা হলেন ঠাটের (যারা পাথরের কাজ করেন), সোনার (স্বর্ণকার বা স্যাকরা), বারহাই (ছুতার), মকান (কারিগর বা রাজমিস্ত্রী) এবং কুমহার (কুম্ভকার বা কুমাের)। তবে অন্যান্য সুত্রে উল্লেখ রয়েছে, বিশ্বকর্মার পাঁচ ছেলে হল লােহার, কায়াই, সালট, গুর্জুর এবং সাইভেস্ত। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় যে, 'লােহার' নাকি বিশ্বকর্মার ছেলে নয়। আসলে বিশ্বকর্মা নিজেই নাকি 'লােহার'। তিনি উপবীত ধারণ করেন। 

কোথাও কোথাও অবশ্য বিশ্বকর্মার নয় পুত্রের কথা পাওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুসারে বিশ্বকর্মার ঔরসে ঘৃতাচারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শঙ্কর, মালাকার, সূত্রধার, কর্মকার, কংসকার, স্বর্ণকার, কুকার, চিত্রকর এবং তন্তুবায়। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে বিশ্বকর্মার পুত্র শিল্পী ত্বষ্টা। কোনো কোনো পুরাণ মতে তিনি এই ত্বষ্টার কর্মশক্তিও আত্মসাৎ করেছিলেন। তবে পদ্মাপুরাণ অনুসারে বিশ্বকর্মার পুত্র দৈত্যশিল্পী ময়দানব। আবার রামায়ণ অনুসারে বানরশিল্পী নল হলেন বিশ্বকর্মার পুত্র। সত্যিই অবাক হতে হয়।

এই বিশ্বকর্মার হাতেই সাঁতালী পর্বতে তৈরি হয়েছিল লােহার বাসরঘর। বেহুলা লখীন্দরের সেই কাহিনী মেলে মনসামঙ্গলে। দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের বারাে যোজন লম্বা সুরম্য অট্টালিকার তিনিই নির্মাতা। কুবেরের অলকাপুরী, অগ্যস্ত্যের ভবনও তিনিই নির্মান করেন। কুবেরের পুষ্পকরথের নির্মাতা বিশ্বকর্মাই। 
দধিচির হাড় থেকেই দেবরাজ ইন্দ্রের জন্য বজ্র অস্ত্র নির্মান করেছিলেন তিনি। যা দিয়ে বৃত্তাসুরকে বধ করা হয়েছিল। বিশ্বকর্মার হাতে তৈরি ধনুক দিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব হত্যা করেন ত্রিপুরাসুরকে। এই বিশ্বকর্মার নিজের হাতে তৈরি অস্ত্র নিয়ে পরশুরাম ২১ বার পৃথিবীকে নিক্ষত্ৰীয় করেছিলেন। সুন্দ ও উপসুন্দকে বধ করার জন্য স্বয়ং বিশ্বকর্মা তিল তিল করে সুন্দরী অপ্সরা 'তিলোত্তমা'কে বানিয়েছিলেন।

সাধারণত দু'ধরনের বিশ্বকর্মার পূজা হয়। 'তাঁত বিশ্বকর্মা' ও 'লােহা বিশ্বকর্মা'। শারদীয়ার আগে পূজা করা হয় লােহা বিশ্বকর্মাকে। এই বিশ্বকর্মা চতুর্ভূজ এবং বাহন হাতি। আর তাঁত বিশ্বকর্মার পূজো হয় শারদীয়া মহানবমীর নব্বুই দিনের মাথায়। এই তাঁত বিশ্বকর্মার দুটি হাত মাত্র। তবে এঁর বাহন ঘােড়া। এক হাতে তাঁতের মাকু ও লাটাই এবং অন্যহাতে চাবুক। আসলে বিশ্বকর্মার হাতে থাকে মানদণ্ড। কিন্তু স্কন্ধপুরাণ অনুসারে বিশ্বকর্মার দশটি হাত এবং পাঁচটি মুখ। এই পাঁচটি মুখ হল তৎপুরুষ, ঈশান, সদ্যোজাত, অঘাের এবং বামদেব। এই দশহাতি বিশ্বকর্মার বাহন অবশ্য হাঁস।

বিশ্বকর্মা পূজো এলেই বাংলার আকাশ বাতাস মেতে ওঠে রঙবেরঙের ঘুড়িতে। তখন অবশ্য ভােকাট্টা চিৎকারে হারিয়ে যায় বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানার শ্রমিকদের অস্ফুট গােঙানি। লক আউট, কর্মী ছাঁটাই সহ নেতাদের অকথ্য দাদাগিরিও উবে যায় আকাশে। হয়তো এইদিনে পেটকাটি, চাঁদিয়ালরা দাপায় আকাশ। কিন্তু সারা বছর এঁদের প্রতিনিধি হয়ে এক শ্রেনীর লোক দাপিয়ে বেড়ায় অলিন্দে অলিন্দে।

কারখানায় শ্রমিকদের যন্ত্রণার একশেষ। নতুন কারখানা হচ্ছে না। বেকারত্ব, শ্রমিক ছাঁটাই, মন্দা ব্যবসা, শ্রমিক অসন্তোষ আর কাজ হারানাের মিলিত আক্রমণে মনে হয় কারিগরি বিদ্যার মহাবীর্যশালী বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বকর্মা কি শীতঘুমে আচ্ছন্ন? কিংবা বিরক্ত? 

দা হাতুড়ি নেহাইগুলাে কি এখন বােবা কান্না কাঁদছে তাঁদের স্রষ্টা বিশ্বকর্মার উদাসীনতা লক্ষ্য করে? হয়তাে হ্যাঁ! কিন্তু জবাব চাইলেও সেই জবাবের উত্তর দেওয়ার বুকের পাটা বা সাহস আজ ক'জনের আছে?

Post a Comment

0 Comments