জ্বলদর্চি

গুলাবো সিতাবো : ক্ষয়িষ্ণু সময়ের ব্ল্যাক কমেডি


গুলাবো সিতাবো : ক্ষয়িষ্ণু সময়ের ব্ল্যাক কমেডি

পরিচালক – সুজিত সরকার
অভিনয়ে – অমিতাভ বচ্চন, আয়ুষ্মান খুরানা, বিজয়রাজ, বিজেন্দ্রকালা, সৃষ্টি শ্রীবাস্তব। 
মুক্তি -  ১২ জুন,২০২০। অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও। 
রেটিং – 3/5

লক্ষ্ণৌ শহরের কথ্য চরিত্র গুলাবো আর সিতাবো, তারা কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ে না। তাদের এই আপাত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে হাস্যরসের সাথেই লুকিয়ে থাকে এক অব্যক্ত বিপন্নবোধ। উত্তর ভারতীয় এই লোকগাথার আদলে এক অন্য জীবনধারার গল্প তুলে ধরেছেন পরিচালক সুজিত সরকার। এই ছবি পিছুটানের গল্প বলে। আমরা বাঁচতে বাঁচতে ইতিহাস ভুলে যাই, আলগা হয়ে যায় আমাদের শিকড়। ‘মির্জা’ (অমিতাভ বচ্চন) যে পুরনো বাড়ি আঁকড়ে তার ভাড়াটে ‘বাঁকে’র (আয়ুষ্মান খুরানা) সঙ্গে নিত্যদিন ঝগড়া করে, সেই ‘ফতিমা মহল’ আসলে এখানে যেন একটা জীবন্ত রূপক। যুবক মির্জা এই বাড়ির লোভে বয়সে বড় ফতিমা বেগমকে বিয়ে করেছিল। একদিন এই সম্পত্তি তার একার হবে এই লোভে যক্ষের ধনের মতো সেই বাড়ির উঠোন কামড়ে পড়ে থাকে। এটা লোভ না কি শেষ বয়সের অসহায়তা, সেটা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সময়ের সাথে যৌবন চলে যায়, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, বেঁচে থাকে বাড়ির প্রতি পিছুটান। পুরো গল্পের মধ্যমণি ফতিমা মহল। তাই নিয়েই দড়ি টানাটানি বাড়ির মালকিনের স্বামী মির্জা (অমিতাভ বচ্চন) ও ভাড়াটে বাংকি রাস্তোগি (আয়ুষ্মান খুরানা)-র মধ্যে। এই টানাটানির মধ্যে বেশ কয়েকজন জড়িত যারা নিজেদের লাভের জন্য নানা ফন্দি করছে। ৭৮ বছরের বৃদ্ধ মির্জার জীবনে একটাই সখ, এই মহলের আইনসম্মত মালিক হবেন সে এবং  মুফত্‌খোর ভাড়াটেদের তাড়িয়ে সুখে-শান্তিতে বাস করবে সেখানে। কিন্তু এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর ভাড়াটে বাঁকে কমন বাথরুমের দেওয়াল ভেঙে ফেলে। এরপরই বাঁধে সবচেয়ে বড় গোল। পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন মির্জা। মির্জা কিংবা তার ভাড়াটে বাঁকে– এরা কেউ খারাপ মানুষ নয়। এদের চাওয়াগুলো যে আকাশছোঁয়া এমনটা নয়। কিন্তু এই ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে মানুষের নৈতিক বোধগুলো যেন একটু একটু করে ক্ষয়ে যায়। সুজিত সরকার এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ের নানা দিক ‘গুলাবো সিতাবো’ ছবির কমিক এবং স্যারটায়ারিকাল মেজাজের মাধ্য মে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। কিপটে বদমেজাজি মির্জা কিংবা মিথ্যুক ভাড়াটের নানা ফন্দি দেখতে দেখতে মজা পেলেও, তার ভিতরে যেন লুকিয়ে আছে এক করুণ কাহিনি। ছবির শেষে বদমেজাজি মির্জা এবং ঝগড়ুটে বাঁকের জন্য খারাপ লাগে। গল্পকার এবং চিত্রনাট্যেকার জুহি চতুর্বেদী এই দুটো চরিত্রের নানা স্তর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা প্রশংসাযোগ্যা। আপাতভাবে মির্জা এবং বাঁকেকে এক বদমাইশ বুড়ো এবং তার কুচক্রী ভাড়াটে মনে হলেও দিনের শেষে ওদের খুব সাধারণ মানুষ বলেই মনে হবে। যাদের চাওয়া-পাওয়ার চৌহদ্দি মাথার উপর একটা ছাদ। 
আয়ুষ্মান অনেকদিন আগেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তার ডি-গ্ল্যাম লুক এবং সংলাপ বলার সময় একটা জড়তা এনে দারুণ এফেক্ট তৈরি করেছে। বিজয়রাজ, বিজেন্দ্রকালা দক্ষ অভিনেতা, এদের অভিনয় সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে আমাকে চমকে দিয়েছে আয়ুষ্মানের বোনের চরিত্রে সৃষ্টি শ্রীবাস্তবের অভিনয়। ইউটিউবের পর্দা থেকে সিনে পর্দায় তার অভিনয় যথেষ্ট সাবলীল। ছবির ডায়ালগ বুদ্ধিদীপ্ত। মির্জার স্ত্রী ফতিমা বেগম (ফারুক জাফর)-এর সঙ্গে ১৫ বছরের বিবাহ বিচ্ছেদ মির্জার। তাঁদের বিয়ের একটা দারুণ মজার ফ্ল্যাশব্যাকও রয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফার অভীক মুখোপাধ্যায়কে সাধুবাদ জানাতেই হয় লখনউয়ের নবাবি মেজাজ, অলি-গলি এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য। জুহি ও সুজিতের আগের ছবিগুলির মতো এই ছবিও দর্শকের মন জয় করেছে। তবে অধিকাংশ দর্শকের একে 'ওয়ান টাইম ওয়াচ' বলেই মনে হবে। তবে ছবির ক্লাইম্যাক্সে রয়েছে চমক। ছবির ঘরানা কালো অথচ মজাদার। করোনা অতিমারির কারণে প্রেক্ষাগৃহের পরিবর্তে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া প্রথম ভারতীয় ছবি হিসেবেও এই ছবি স্পেশাল বইকি ! 

রেটিং
5 অসাধারণ 
4 বেশ ভালো 
3 ভালো 
2 দেখতে পারেন
1 না দেখলেও চলবে


Post a Comment

0 Comments