জ্বলদর্চি

বিদ্যাসাগর ও সমকালীন বাঙালি ব্যক্তিত্ব:সম্পর্কের টানাপোড়েন

Ishwar Chandra Vidyasagar and contemporary Bengali personalities

বিদ্যাসাগর ও সমকালীন বাঙালি ব্যক্তিত্ব:
সম্পর্কের টানাপোড়েন

তু ল সী দা স   মা ই তি


"বিদ্যাসাগর আচারের দুর্গকে আক্রমণ করেছিলেন,
এই তাঁর আধুনিকতার একমাত্র পরিচয় নয়। যেখানে তিনি পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যবিদ্যার মধ্যে সম্মিলনের সেতুস্বরূপ হয়েছিলেন সেখানেও তাঁর বুদ্ধির ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যা-কিছু পাশ্চাত্য তাকে অশুচি বলে অপমান করেন নি। তিনি জানতেন বিদ্যার মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের দিগবিরোধ নেই। তিনি নিজে সংস্কৃতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।  তিনিই বর্তমান য়ুরোপীয় বিদ্যার অভিমুখে ছাত্রদের অগ্রসর করবার প্রধান উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং উৎসাহ ও চেষ্টায় পাশ্চাত্য বিদ্যা আয়ত্ত করে করেছিলেন।"
কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের। ১৩২৯ সালের ১৭ শ্রাবণ  ব্রাহ্মসমাজ আয়োজিত বিদ্যাসাগর-স্মরণ সভায় তিনি একথা বলেছিলেন। এই কথাগুলি থেকে 'আধুনিকতম মানুষ বিদ্যাসাগর'- এই প্রসঙ্গের একটা আভাস পাই। বলা বাহুল্য, সমকালীন বঙ্গভূমির সামাজিক ইতিহাসে যে সমস্ত শিক্ষিত মেধাবী মনীষীগণের পরিচয় পাই তাঁদের সাথে বিদ্যাসাগরের মননগত মিল বা অমিল কতখানি তাও এই নিরিখেই করতে চাই। 

একটা আধুনিক ভারতবর্ষ গড়ার প্রত্যয় তৈরি হচ্ছিল 
উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই। রামমোহন রায় থেকে এ পর্যায়ের সূচনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে তার পূর্ণতা। এ   সময়কালে এক ঝাঁক মেধাবী ও চিন্তাশীল মানুষ বাংলার সংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণ করেছেন। ব্রিটিশ ভারতের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার যে পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন তাঁর জন্মের দুশো বছর পরেও যা সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর আগে পরে জন্মগ্রহণ করে দেশের বিদ্যাচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রগুলিকে যারা সমৃদ্ধ করে গেছেন তাঁদের মধ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী, ঈশ্বর গুপ্ত মধুসূদন দত্ত, মদনমোহন তর্কালংকার, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,প্যারিচরণ সরকার, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রামকৃষ্ণ, মাহেন্দ্রলাল সরকার,বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ  প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এঁদের সবাই যেহেতু স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে  যুক্ত ছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যাসাগরের তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই সম্পর্কের যে রসায়ন তার বহুরৈখিক তাৎপর্য রয়েছে। আছে ইতিবাচক ও নেতিবাচক নানান টানাপোড়েন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই এই বিস্তৃত বিষয়ের আলোচনা সম্ভবপর নয়। তবে বিদ্যাসাগরের জীবনের জীবন ও কর্মের মধ্যে 
যাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে তাঁদের কয়েকজনের কথা বলতে চাই।
 রামমোহন রায় এর যখন মৃত্যু হয় তখন বিদ্যাসাগর ছাত্র। কিন্তু রামমোহনের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের রূপ
বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন। ডিরোজিও যে পথে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন  রামমোহন তার থেকে ভিন্ন পথেই গেলেন। সমাজসংস্কারের জন্য তিনি ধর্মকে হাতিয়ার করেছেন। পিছিয়ে  পড়া দেশের মানুষকে শিক্ষিত করতে তিনি ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন। বিদ্যাসাগর সমাজসংস্কার আন্দোলনের কাজ করতে এসে ধর্মকে সম্পুর্ণরূপেই বাদ দিলেন। আমরা জানি, উনিশ শতকের নবজাগরণের ইতিহাসে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের নাম এক সাথে উচ্চারিত হয়।  সমাজ ভাবনার ক্ষেত্রে তাঁদের দুজনের একটা আত্মিক যোগ ছিল। একথা ঠিক, দুজনেই সমাজসংস্কার আন্দোলনের কাজে ধর্মশাস্ত্র ব্যাবহার করেছেন। কিন্তু দুজনের আদর্শের মধ্যে বড়ো পার্থক্য ছিল। ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে ভীষণ ভাবে পড়েছিল। রামমোহনের এই ধর্ম ভারতের সর্বত্র একটা আলোড়ন তোলে। সেই তরঙ্গে প্রভাবিত হয়  জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সকলে,বাদ যাননি শিবনাথ শাস্ত্রী, কেশবচন্দ্র  সেন, অক্ষয়কুমার দত্ত, সহ অনেকেই।  কিন্তু বিদ্যাসাগর সব দেখেও  কখনোই ধর্মান্দোলনের পথকে উৎদাহ দেননি। শুধু ব্রাহ্ম ধর্ম নয় তৎকালে মধুসূদন দত্ত সহ অনেক বিদ্বান ব্যক্তি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করছেন দেখেও তিনি চুপ থেকেছেন। রামমোহনকে তিনি 'মান্যপুপুরুষ' বলে স্বীকার করেও স্বতন্ত্র থেকেছেন নিজের ভেতরের আদর্শগত শক্তি দ্বারা। সমাজ থেকে কুসংস্কার ও কু-প্রথা দূর করতে ধর্মকে ব্যবহার করেননি তাঁর কারণ তিনি বুঝেছিলেন ধর্মমোহকে মানুষ সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায়। এক  কুসংস্কার থেকে অন্য কোনো কুসংস্কারে জড়িয়ে যায়। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ধর্মকে আশ্রয় করে নয়,মানুষকে আশ্রয় করেই কাজ করে গেছেন।

বিদ্যাসাগর আস্তিক না নাস্তিক ছিলেন এই আলোচনা বিস্তর হয়েছে। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর  সম্পর্ক সংক্রান্ত আলোচনায় বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়। রামকৃষ্ণ বয়সে বিদ্যাসাগরের চেয়ে ছোটো ছিলেন। দুজনেই মানুষের জন্য কর্ম করেছেন। কিন্তু দুজনের পথ সম্পূর্ণ ভাবেই ভিন্ন। বিদ্যাসাগর নিজের আদর্শকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় বেঁধে রেখেছিলেন। এই বাঁধন আলগা হয়নি কখনো। শুধু ধর্ম নয়, ঈশ্বর সম্পর্কেও তিনি কখনো উৎসাহ দেখাননি। রামকৃষ্ণ নিজে তাঁর সাথে দেখা করেছেন। রামকৃষ্ণের কাছে বিদ্যাসাগরের ধর্ম সম্পর্কে ও ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো জিজ্ঞাসা ছিল না। এমনকি রামকৃষ্ণ সেদিন অনেক বেশি কথা বলেছিলেন। আতিথ্য, আপ্যায়ন, রাসিকতা- সব ছিল কিন্তু ঈশ্বরের প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়েছেন। বরং রামকৃষ্ণ কে তিনি পরোক্ষে বুঝিয়েছেন তিনি ইহবাদী। ইহকাল, ইহলোক-এসবের মধ্যেই তিনি থাকতে চান। পরকাল সম্পর্কে তিনি কোনোভাবেই উৎসুক নন। এই সাক্ষাৎকারের একবছর পরে কোনো একজন ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন- '" বিদ্যাসাগরের পান্ডিত্য আছে,...... অন্তরে সোনা চাপা আছে, যদি সে সোনার সন্ধান পেত, এত বাহিরের কাজ যা কচ্ছে, সে সব কম পড়ে যেত। শেষে একেবারে ত্যাগ হয়ে যেত।" 
পণ্ডিতগণ মনে করেন বিদ্যসাগর ও  রামকৃষ্ণের জীবনদর্শন সমান্তরাল রেখায় অবস্থান করেছে।

বিবেকানন্দের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একই কথাই খাটে। তবে বিবেকানন্দ বয়সে বিদ্যাসাগরের থেকে অনেকটাই ছোটো। সন্ন্যাসীজীবনের আগে বিবেকানন্দ বিদ্যাসাগরের  মেট্রোপলিটন স্কুলের বৌবাজার শাখায় প্রধান শিক্ষকের পদে চাকরি নিয়েছিলেন। কোনো একটি কারণে এই চাকরি তিনি ছাড়তে বাধ্য হন। বিবেকানন্দ সহ অনেকের ধারণা এই কাজে বিদ্যাসাগরের হাত ছিল। এই ঘটনা সংক্রান্ত একটা অভিমান তো ছিলই, সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ঈশ্বর সম্পর্কে অনীহা বিবেকানন্দ ভালো চোখে দেখেননি। অনেক সময় বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গকে বিবেকানন্দ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। 

বিদ্যাসাগরকে করুণাসাগর আখ্যা দিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর বীরাঙ্গনা কাব্যটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্যসাগরকেই। 'বঙ্গকুলচুড়া' সম্বোধনে একটি সুন্দর উৎসর্গপত্র লিখেছিলেন। বিদ্যাসাগর মধুসূদনকে নানাভাবেই সাহায্য করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অপার। কিন্তু তাঁর  অনেক কাজই বিদ্যাসাগরের ভালো লাগেনি। ধর্ম সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র উৎসাহী ছিলেন না বলে মহাকবির ধর্ম পরিবর্তনেও তিনি প্রতিক্রিয়াহীন ছিলেন। কিন্তু বিশৃঙ্খল জীবন ও অমিতব্যয়ী জীবনযাত্রাকে তিনি পছন্দ করতেন না। এই সব সূত্র ধরেই দুজনের সম্পর্কের একটা টানপোড়েন তৈরি হয়েছে। আসলে নিজের আদর্শ- পরিপন্থী চিন্তাকে তিনি কখনোই প্রশ্রয় দেননি।

বিদ্যাসাগরের বহুবিধ কাজের প্রধানত তিনটি  দিক।   এক. ধর্ম বাদ দিয়ে সমাজসংস্কার আন্দোলন। বিধবাবিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ প্রথার বিলোপ ইত্যাদি এই শ্রেণির কাজের মধ্যে পড়ে।
দুই, শিক্ষাসংস্কার আন্দোলন। নতুন নতুন  বিদ্যালয় স্থাপন , নারী শিক্ষার নানান আয়োজন ইত্যাদি।
তিন. গ্রন্থ রচনা।
সমাজসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সঙ্গী হিসেবে কম জনকেই পেয়েছেন। বরং এই লড়াই এর ক্ষেত্রে তিনি অনেক সময় ই একা হয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষা আন্দোলনের লড়াইও অনেকটা তাই। তবে সমাজের এক শ্রেণির সাধারণ মানুষ  তাঁকে প্রভূত সাহায্য করেছেন। গ্রন্থ রচনার কাজে অবশ্য কিছু মানুষের উৎসাহ পেয়েছিলেন।

 তাঁর বিধবাবিবাহ প্রচলনের মতো মহতী কাজকে  যারা  পূর্ণভাবে সমর্থন করতে পারেননি তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরগুপ্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কবি,সাংবাদিক ও সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)বিদ্যাসাগরের চেয়ে কিছুটা বড়ো। কলিকাতায় কিছুটা কাছাকাছি পাড়ায় দুজনে থাকতেন। কবিগান  ভালোবাসার সূত্রে দুজনের আলাপ ছিল। এই বিস্তৃত কাহিনির মধ্যে না গিয়েই দুজনের বিরোধ প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে। বিধবাদের আবার বিয়ে দেওয়ার কাজটি ঈশ্বর গুপ্তের পছন্দ ছিল না। তিনি ব্যঙ্গ করে, বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ঢাকঢোল পিটিয়ে  কবিতাও লিখেছিলেন --

   সাগর যদ্যপি করে সীমার লঙ্ঘন ।
     তবে বুঝি হতে পারে ,বিবাহ ঘটন।।
     নচেৎ না দেখি কোনো সম্ভাবনা আর।
      অকারণে হই হই, উপহাস সার।।

বিদ্যাসাগর অবশ্য কবিতাটিকে ইতিবাচক অর্থেই ধরেছিলেন। পরে অবশ্য কবি ঈশ্বরগুপ্ত  সংবাদ প্রভাকরে বিধবাদের গাওয়া একটি গান প্রকাশ করেছিলেন তাঁর মর্মার্থ বিদ্যসাগরকেই সমর্থন করে মনে করা হয়। গদ্যে লেখা 'শকুন্তলা' (১৮৫৪) প্রকাশিত হলে বিদ্যাসাগরের গদ্য লেখার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। কেও কেউ বঙ্গভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক বলতে চেয়েছিলেন। গুপ্তকবি বিষয়টি ভালো ভাবে নেননি। তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় গদ্যশিল্পী হিসেবে বিদ্যসাগরকে কটাক্ষ করে কবিতা লেখেন। "সাগর  ডাগর নাম বিহীন রতন। / এমন সাগরে  আমি, করিনে যতন।।" অনেকে মনে করেন কবিগানের রচয়িতা বিদ্যাসাগরের প্রতি এইসব কটাক্ষ আসলে ব্যজস্তুতি। আসলে বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্যের প্রতি তাঁর  শ্রদ্ধাই ছিল।

বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়ে থাকে। ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্মের সীমাবদ্ধতার কথা কিছু সময় বলেছেন। বিধবাবিবাহ কে তিনি কতটা সমর্থন করতেন সে বিষয়ে স্পষ্ট জানা যায়না। তবে বলা হয়ে থাকে তিনি এর বিরোধীই ছিলেন।' বিষবৃক্ষ' উপন্যাসে  তিনি কুন্দনন্দিনীর সাথে নগেন্দ্ন্দ্রের বিবাহ দিয়েছেন স্ত্রী সূর্যমুখী থাকা সত্ত্বেও।  অর্থাৎ বহুবিবাহকে সমর্থক করেছেন। সূর্যমুখীর মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ' যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয় সে যদি পণ্ডিত তবে মূর্খ কে'- এখানে বিদ্যসাগরকেই ইঙ্গিত করে হয়েছে। যদিও অনেকে মনে করেন  বঙ্কিমের বিদ্যাসাগর বিরোধিতা যতটা প্রচারিত ঠিক ততখানি নয়। 
বিদ্যাসাগরের বহু কাজের সমর্থক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুজনের সাথেই আলাপ 'তত্ববোধিনী' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। ১৮৩৯ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 'তত্ববোধিনী সভা' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৪৩ সালে এই পত্রিকার মুখপত্র হিসেবে 'তত্ববোধিনী' পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার 'পেপার কমিটি'-তে ছিলেন বিদ্যাসাগর। পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। অক্ষয়কুমার দত্ত বিদ্যাসাগরের সমবয়সী ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ  তিন বছরের বড়ো।  একটি আকর পত্রিকা 'তত্ববোধিনী'। সমকালের সমস্ত বড়ো লেখকের লেখা প্রকাশিত হতো। বিদ্যাসাগরের সাথে অক্ষয়কুমার দত্তের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
দেবেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার দত্ত দুজনেই ব্রাহ্ম সমাজের মানুষ ছিলেন। কিন্তু বিদ্যসাগরের সমাজসংস্কার আন্দোলনকে তাঁরা নানাভাবেই সমর্থন করতেন। 'তত্ববোধিনী'তে বহু বিবাহের বিরুদ্ধে  অক্ষয়কুমার দত্ত কলম ধরেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 'তত্ববোধিনী' সভাকে ধর্মান্দোলনের পক্ষে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। অক্ষয়কুমার দত্ত ও বিদ্যাসাগর সমর্থন করেন নি। ১৮৫৯ এ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর  পত্রিকার সমস্ত দায়িত্ব ভার তুলে দেন ব্রাহ্মসমাজের হাতে। বিদ্যাসাগর পত্রিকা থেকে বেরিয়ে আসেন। এই সময় পর্বে বিদ্যাসাগরের সাথে অক্ষয়কুমার দত্তের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো তা অত্যন্ত গভীর। দুজনেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বিজ্ঞান, ভূগোল, গণিত-  নানা  বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত তার 'ভূগোল' গ্রন্থের গদ্য অনেকে মনে  করেন বিদ্যাসাগরেরও আগে লেখা শিল্পীত গদ্য। তাঁরা বলেন বিদ্যাসাগরের যতটা প্রচার বা প্রসার হয়েছিল অক্ষয়কুনার দত্তের ততটা হয়নি। তাঁরা মনে করেন এর জন্য অনেকটাই দায়ী রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের গদ্য সম্পর্কে বিভিন্ন ভাবে বক্তৃতায় বলেছেন। অক্ষয়কুমার দত্ত সেই প্রচার না পাওয়ায় তাঁর লেখাগুলি বাঙালির কাছে পেয়েছে উদাসীনতা ও অবহেলা। যদিও এই বলাতে কিছুই যায় আসে না। বাংলা ভাষায় এই দুই ব্যক্তিত্বের সঙ্গ শুধু ঐতিহাসিক নয়, যুগান্তকারীও। এ প্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন -
"বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম যুগে যে দুইজন শিল্পীর সাধনায় বাংলা ভাষা সাহিত্য-রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল, তাঁহাদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অন্যজন অক্ষয়কুমার দত্ত। ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি সাহিত্য-পুস্তককে আদর্শ করিয়া যে কার্য করিয়াছিলেন, অক্ষয়কুমার ইংরেজি বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক গ্রন্থের আদর্শে ঠিক সেই কার্যই করিয়া গিয়াছেন, একজন রসসাহিত্যমূলক, অন্যজন বিজ্ঞান ও যুক্তিমূলক ভাষার সাহায্যে একই কালে মাতৃভাষার সাহিত্যসম্পদ বৃদ্ধি করিয়া গিয়াছেন...যতদিন বাংলা ভাষা জীবিত থাকিবে ততদিন ঈশ্বরচন্দ্র ও অক্ষয়কুমারকে স্মরণ রাখিতে হইবে।"
বলাবাহুল্য, এবছর দুই ব্যক্তিত্বেরই দুশো বছর পূর্তি।

 দীর্ঘ ও বৈচিত্রময় জীবনে বিদ্যাসাগর  আরো বহু মেধাবী ব্যক্তির সঙ্গ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রাজেন্দ্রলাল মিত্র , মদনমোহন তর্কলংকার, প্যারিচরণ সরকার প্রমুখ। বিদ্যাসাগরের জীবনে প্রত্যেকের অবদান আছে। সে সমস্ত কথা বাকি রেখেই বলতে পারি বিদ্যাসাগর তাঁর মহত্ব দিয়েই এই সম্পর্কগুলো গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তাঁর সুউচ্চ ব্যক্তিত্বই অনেকের মধ্যে থেকে তাঁকে স্বতন্ত্র মহিমা দিয়েছে।

Post a Comment

0 Comments