ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: স্রোতের বিপরীতে হাঁটা "যশুরে কই"
সূ র্য কা ন্ত মা হা তো
"যশুরে কই" হল অধুনা বাংলাদেশের যশোহর অঞ্চলের 'কই' মাছ। এই ধরনের মাছের আকারগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাদের এক সহপাঠীর অসম্ভব রকমের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। শীর্ণ ও খর্ব শরীরের তুলনায় সহপাঠীর মাথাটা ছিল বেশ বড়। তার ওপর একটি বড় ছাতা মাথায় ধরে যেভাবে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসতেন, তাঁর সঙ্গে কই মাছের তুলনা টেনে তাঁকে খ্যাপানোর জন্য ডাকতেন "যশুরে কই" বলে। আরও একটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বিকৃত করে বলতেন, "কসুরে জই"। এই "যশুরে কই" আর কেউ নন, তিনি হলেন, স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর(১৮২০-১৮৯১)। বরাবর স্রোতের বিপরীতে হাঁটা দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, সঙ্গে কঠিন মানসিকতার এক অপরাজেয় পৌরুষ।
নিতান্তই ছা-পোষা জীবন বা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর মতো স্বভাব বিদ্যাসাগরের একেবারেই না-পছন্দ। ছোটবেলা থেকেই এমন ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। ভাই শম্ভুচন্দ্র তো বলেইছেন, পিতা যে যে নির্দেশ দিতেন,বিদ্যাসাগর ছোটবেলা থেকেই ঠিক তার বিপরীত কাজটাই করতেন। যেমন ভালো কাপড় পরতে বললে, ময়লা পরার বায়না করতেন। তার বাবা স্নান করত বললে, বিদ্যাসাগর বাবার হাতে মার খেয়েও স্নান করায় অনিচ্ছা প্রকাশ করতেন। স্রোতের বিপরীতে চলার এই অদম্য বাসনাই তাঁকে পরবর্তী জীবনে মহান মহান কর্মসম্পাদনে উৎসাহ জুগিয়েছিল।
কেবল গামছা পরে নিজের পরিধেয় বস্ত্র অন্যদের হাতে তুলে দিতে, এবং ধার করে পরোপকার করার চরম দুঃসাধ্য আমরা ক'জন দেখাতে পারব, তা একবার নিজেদের প্রশ্ন করলেই বুঝতে পারব সেটা কতটা কঠিন। অথচ এটাই তিনি জীবনভর করে গেছেন। নিজে দয়ার পাত্র হয়েও অন্যকে দয়া করার মতো তার বিরল মানসিকতার জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "তাঁহার চরিত্র সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করিয়াছে।"
দেশের সবাই যখন পদমর্যাদা লাভে ইংরেজদের অনুগ্রহ লাভ করার জন্য পিপাসিত, তখন বিদ্যাসাগর আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে সম্মান কেনাকে আত্ম অবমাননা বা ধৃষ্টতা বলে মনে করেছেন। তাইতো হিন্দু কলেজের প্রিন্সিপালের সামনে চটি জুতো পরে টেবিলে দুই পা তোলার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছেন। শুধু কি তাই! একটি চাকরি পাওয়ার জন্য সবাই যখন মরিয়া, তখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় তিনি ইস্তফা দেওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে দুবার ভাবেননি। এই কঠিন ব্যক্তিত্ব ছিল বলেই আত্মীয়দের মুখের উপর জবাব দিয়েছেন, "আলু পটোল বেচিয়া, মুদির দোকান করিয়া দিন চালাইব।" তবুও যেখানে তার মতামতের গুরুত্ব নেই, সেখানে তিনি কোনোও রকমের আপস করেননি। স্রোতের বিপরীতে হাঁটার এমন ইস্পাত কঠিন মন না থাকলে, এমন কথা কি আর বলা সম্ভব?
সামাজিক অনুশাসনের তোয়াক্কা না করে, সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করা তো দূরের কথা, কথা বলার দুঃসাহসও তখন কারও ছিল না। কিন্তু মা ভগবতী দেবীর সন্তান কে করা একটি প্রশ্ন, " তুই এতদিন এত শাস্ত্র পড়িলি, তাহাতে বিধবার কি কোনো উপায় নাই?" এই প্রশ্নই বিদ্যাসাগরকে এমন ভাবিত করে তুলেছিলেন যে, ব্যাস, অমনি তার উত্তর খুঁজে প্রত্যুত্তর দিতে বিধবা বিবাহের প্রচলনে একরকম উঠেপড়ে লাগলেন। জয় তো হল, কিন্তু তার ফলাফল? প্রত্যাশা মতোই মুশলধারে শুরু হল শাস্ত্র ও গালিগালাজ বর্ষণ। বজ্রপাতের মতো নামল হুমকি। অন্য কেউ হলে হয়তো হাল ছেড়ে দিতেন। কিন্তু তার অসীম ধৈর্য আর জেদের কাছে সব কিছুই খড় কুটোর মতোই ভেসে গেল। তাই বলে কি ক্ষোভ জন্মায়নি? দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষোভ উগরে দিয়ে লিখেছেন, "আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে, আমি কখনই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।"
নারীর নিজস্ব অনিষ্টের সঙ্গে দেশ ও সমাজেরও অনিষ্টের একমাত্র ভয়াবহ কারণ হল---বহুবিবাহ প্রথা। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এমন প্রচলিত কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে যখন বিদ্যাসাগর কলমকে হাতিয়ার বানালেন, তখনও এলিট সমাজের বিদ্রুপ ও হুমকি থেকে রেহাই পেলেন না। এটা শাস্ত্র বিরোধী এবং এতে হিন্দুদের ধর্মের বিলোপ ঘটবে--- এমন পাল্টা সুর তুলে বিরোধীরাও ক্রমশ সুর চড়াতে লাগলেন। তবুও তাকে প্রতিরোধ করতে পারলেন না। জয় হাসিল করেই ছাড়লেন। তবে সমালোচকদের বিষয়ে তিনি এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা লাভ করলেন। তাই তাঁদের সম্পর্কে বলেন, "ঈদৃশ ব্যক্তিরা সামাজিক দোষ সংশোধনের বিষম বিপক্ষ।...নিজেও কিছু করিবেন না, অন্যকেও কিছু করিতে দিবেন না।" তাই তাদের জবাব দিতে,অসার যুক্তি খণ্ডন করতে ফের একবার কলম একই বিষয়ে কলম ধরতে হয়েছিল।
সংস্কৃত কলেজে দিনের পর দিন ব্রাহ্মণেরাই একছত্র ভাবে সংস্কৃত শিক্ষায় প্রাধান্য বিস্তার করে আসছিলেন। অন্যদিকে প্রশিক্ষিত শূদ্ররা সংস্কৃত পাঠে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছিলেন। তাই এই প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে শূদ্রদের হয়ে ফের একবার লড়াইয়ে নামলেন। ব্রাহ্মণদের কঠিন বাধাকে অতিক্রম করে অবশেষে শূদ্রদের সংস্কৃত শিক্ষার অধিকার দান করলেন। এও এক প্রচলিত লড়াইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই।
সমস্ত পিতা তার সন্তানের দোষ ত্রুটিকে হজম করেন, নয়তো আপস করেন। এমনটাই ঘটে থাকে। কিন্তু বিদ্যাসাগর এক ব্যতিক্রমী মানুষ। সন্তানের অনৈতিক কুকর্ম তার কাছে নীতিগত মনে হয়নি বলে একবাক্যে প্রিয় সন্তানকে পর্যন্ত ত্যাজ্যপুত্র করে দিতে দুবার ভাবেননি।
বিদ্যাসাগরের আদর্শই ছিল যুক্তিবাদ। তার কাছে ঈশ্বরের সংজ্ঞাই ছিল ভিন্ন। তাই নাস্তিক বলে আপবাদও শুনতে হয়েছে। আধুনিক মনস্ক এই মানুষটি চিরকাল আত্মীয় কুটুম্ব কিংবা লোকে কি ভাববে, সেকথাকে পাত্তা না দিয়ে বরং নিজে যেটা ভালো মনে করছেন, সেটাই করে গেছেন জীবনভর।
সবকিছু না হয় বাদই দিলাম। তারপরেও ভেবে দেখুন তো কারমাটার স্টেশনে সদিচ্ছায় কুলিগিরির ঘটনাটা। কতজন মানুষ খ্যাতির মধ্য গগনে থেকেও এমন ব্যতিক্রমী কাজ করার দুঃসাহস দেখাতে পারবেন! তিনি পেরেছেন। কারণ তার যে যশুরে কই মাছের মতোই জীবনী শক্তি ও জীবন দর্শন ছিল।
আমাদের এই ব্যর্থ সমাজ, আমাদের অপদার্থতা, মিথ্যা অহংকার, চাটুকারিতা, বাচালতা, অযোগ্যতা, হৃদয়হীনতা, কর্মহীনতা, তার্কিকতা সর্বোপরি আত্মত্যাগের প্রচণ্ড অভাবকে কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই এই সমাজ আর একের পর এক বিরোধিতায় বিরক্ত হয়ে অবশেষে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়ে নিলেন সুদূর সাঁওতাল পরগনায়। এটা আমাদের কাছে এই দুশো বছর পরেও চরম লজ্জার।
1 Comments
লেখাটি পড়ে খুশি হলাম|
ReplyDelete