জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস - ১৩ / শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১৩

শ্যা ম ল  জা না

এক্সপ্রেশনিজম (দ্বিতীয় অংশ)—

এই এক্সপ্রেশনিজম, স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিল, যে, এরা আগের ইজমগুলি থেকে সর্ব অর্থে স্বতন্ত্র৷ প্রথমত এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা সাবজেক্টিভ দৃষ্টিকোণ থেকে ক্যানভাসে ছবি আঁকতে শুরু করলেন, যা আগের কোনো ইজমের শিল্পীরা করেননি৷ দ্বিতীয়ত, ছবিতে আবেগ-অনুভূতির প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তাঁরা স্বাতন্ত্র আনলেন৷
আমরা যদি খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণ থেকে ছবিতে আবেগ-অনুভূতির প্রয়োগকে লক্ষ করি, তাহলে, দেখতে পাব— পোস্ট-ইম্প্রেশেনিজম-এর একেবারে বিপরীতে অবস্থান করছে এক্সপ্রেশনিজম৷ আমরা পর্ব-৬-তে ভ্যান গখ-এর ছবি আঁকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম— “তিনি যখন কোনো ছবির বিষয় দেখতেন, চোখ দিয়ে দেখতেন না৷ তাঁর চোখ শুধুমাত্র দৃশ্যের প্রবেশপথ(Gateway)হিসেবে ব্যবহৃত হত৷ আসলে তিনি দেখতেন হৃদয় দিয়ে৷ আর সেই দেখাকে তিনি জারিত করতেন, তাঁর সেই অসম্ভব তীব্র আবেগমথিত অনুভূতি দিয়ে!” অর্থাৎ, ভ্যান গখ যখন পোস্ট-ইম্প্রেশেনিস্ট শিল্পী, তখন ছবি আঁকার সময় তিনি ছবিতে নিজের আবেগ-অনুভূতিকে ব্যবহার করছেন৷
আবার, পরবর্তীকালে তিনি যখন এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী, তখন, তিনি ক্যানভাসে যে কল্পিত মানুষটিকে আঁকছেন, সেই কল্পিত মানুষটির অভিব্যক্তি সেই মানুষটিরই মনের গহীনে থাকা আবেগ-অনুভূতি থেকে তুলে আনছেন৷ নিজের আবেগ-অনুভূতি ব্যবহার করছেন না! কারণ, এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা ছবিতে আবেগ-অনুভূতিকে সবচেয়ে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য মানুষের তাৎক্ষণিক মেজাজকে(Mood) সবচেয়ে গুরুত্ব দিলেন৷ আর, এই মেজাজকে একশো শতাংশ ধরতে গিয়ে তাঁরা মানুষের বাস্তব রূপকে প্রয়োজন অনুযায়ী আমূল বিকৃত করতেও পিছপা হলেন না! কারণ, মানুষের যে বাহ্যিক রূপ, বাইরে থেকে যা আমরা চোখে দেখি, তাকে নয়, তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের যে তাৎক্ষণিক মেজাজ, তার মাধ্যমে তার মনের গহীনে যে উৎপন্ন আবেগ-অনুভূতি, তাকে পূর্ণরূপে ধরা! কারণ তাৎক্ষণিকভাবে হঠাৎ মানুষের যখন মেজাজ পাল্টায়, তখন নিশ্চিতভাবেই সেই মুহূর্তে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো একটি বাস্তব কারণ থাকে৷ ধরা যাক হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করে উঠল৷ এই হঠাৎ চিৎকারের একটি নিশ্চিত বাস্তব কারণ থাকবে৷ কিন্তু এই চিৎকারকে উপলক্ষ্য করে আমরা যদি তার মনের গহীনে ঠিকমতো অনুসন্ধান করি, তাহলে, অনেক না জানা আবেগ-অনুভূতির সন্ধান পাব, যা আমাদের অনেক না পাওয়া প্রশ্নের উত্তর পেতে সাহায্য করবে৷ এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা ক্যানভাসে ওই চিৎকারের যে বাহ্যিক রূপটি আঁকছেন, তা উপলক্ষ্য মাত্র৷ তাঁদের আসল উদ্দৈশ্য হল— ওই বাহ্যিক রূপটিকে কেন্দ্র করে ওর সাথে ওই না জানা আবেগ-অনুভূতিটিকে যুক্ত করা(একদম শীর্ষে এডভর্ড মুঙ্খ-এর আঁকা “দ্য স্ক্রীম” ছবিটি দেখতে অনুরোধ করছি)৷ এখানে নিশ্চিতভাবে একটি প্রশ্ন আসবে৷ যা স্বাভাবিক৷ সেটি হল— ক্যানভাসে যে ছবিটি আমি আঁকছি সে তো রক্ত-মাংসের মানুষ নয়, শুধু ছবি, তাহলে, তার মনের গহীনে থাকা ওই না জানা আবেগ-অনুভূতিটির অনুসন্ধান বিষয়টিই তো তৈরি হয় না! তাহলে?
আসলে, ক্যানভাসের যে মানুষটি, সে শিল্পীর অভিজ্ঞতায় থাকা বাস্তবেরই কোনো একটি চরিত্র, বা একাধিক চরিত্র, যাকে বা যাদের তিনি ক্যানভাসে একটি অবয়বে ধরেছেন৷ এই চরিত্রটি ক্যানভাসের ছবি হিসেবে, শিল্পীর বার্তা(Message)বাহক হিসেবে, দর্শক বা মানুষের চোখে ধরা পড়ছে৷ অর্থাৎ, এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের এই পদ্ধতিতে ছবি আঁকার পিছনে আসল ও মহৎ উদ্দেশ্যটি হল— বিশ্বের তৎকালীন সময়কে চিহ্নিত করা(ছবি-১)৷ 

আমি, আগের পর্বের লেখার একটি অংশ পুনর্বার ব্যবহার করতে চাইছি— “ঠিক যখন বিশ শতক শুরু হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে তখন আধুনিকতার পাশাপাশি শোষণেরও পাকাপাকি ব্যবস্থা শুরু হচ্ছে৷ আর, বিশৃংঙ্খলায় ভরে গেছিল বিশ্ব! সারা পৃথিবী জুড়ে মানবতার সংকট দেখা দিয়েছিল৷ দেশে দেশে মানুষে মানুষে বিভিন্ন ধরনের বিবাদ ক্রমশ বাড়ছিল৷ সেই সঙ্গে দ্রুত বিস্তার লাভ করছিল সততা ও মনের বিশুদ্ধতার(Spirituality) সংকট৷ তৈরি হচ্ছিল যুদ্ধ পরিস্থিতি৷ ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা ভীষণভাবে বেড়ে যাচ্ছিল! ঠিক এই সময়েই, ঐতিহাসিক কারণেই, পরিস্থিতি(Condition) জন্ম দিল এক্সপ্রেশনিজম-এর”! আর, এই কারণেই ইয়োরোপের বিভিন্ন শহর থেকে একসঙ্গে জন্ম নিয়েছিল এই এক্সপ্রেশনিজম৷ আগের পর্বের আরও একটুখানি অংশ এখানে পুনরুল্লেখ করতে চাইছি— “সেই সময়ের ইয়োরোপের সাধারণ মানুষ একে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেছিলেন৷ কারণ, তাঁরা স্পষ্ট বুঝেছিলেন— এই চিত্রশিল্পীরা তাদের সংকটের কথাই ক্যানভাসে তুলে ধরছে৷”
শুধু তাইই নয়, এক্সপ্রেশনিজম-এর সুদূরপ্রসারী গভীর প্রভাবের জন্য অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রেও একই সাথে এর সূত্রপাত ঘটেছিল৷ তৎকালীন সৃষ্টিশীল দিকপালেরা এই আন্দোলনের সঙ্গে একেবারে প্রথম থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন শুধু তাইই নয়, তাঁদের সৃষ্টিতেও তাঁরা এক্সপ্রেশনিজমকে হাতিয়ার করেছিলেন৷ সব মিলিয়ে পথ প্রদর্শক যাঁরা, তাঁদের নাম ও সৃষ্টির কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়— জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটসে ও তাঁর দার্শনিক উপন্যাস—“দাস স্পোক জরাথ্রুষ্ট”র কথা৷ বলতে হয়— বিশ্ববিখ্যাত সুইডিস নাটককার অগুস্ত স্ট্রিনবার্গ ও তাঁর ট্রিলজি— “টু দামাস্কাস”, “এ ড্রিম প্লে, দ্য ঘোস্ট সোনাটা৷ আর ছিলেন— ফ্র্যাঙ্ক ওয়েডকাইন্ড, বিশেষ করে তাঁর “লুলু”৷ নাটকের মধ্যে—“আর্থ স্পিরিট” ও “প্যান্ডোরা’স বক্স৷ আসবে নোবেল পুরস্কারজয়ী আমেরিকার কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান, বিশেষ করে তাঁর কবিতার বই—“লিভস অফ গ্র্যাস”৷ রাশিয়ার কিংবদন্তী ঔপন্যাসিক— ফিওদর দস্তয়েভস্কি৷ নরওয়ের চিত্রকর— এডভার্ড মুঙ্খ৷ ডাচ চিত্রকর ভিনসেন্ট ভ্যান গখ৷ বেলজিয়ান চিত্রকর— জেমস এনসোর৷ আর, যাঁর চিন্তা থেকে এই এক্সপ্রেশনিজম-এর সূত্রপাত করলেন এতজন মানুষ মিলে, সেই পাইওনীয়ারের পাইওনীয়ার, মনঃসমীক্ষণ(Psycho-analysis)- এর স্রষ্টা— সিগমুন্ড ফ্রয়েড৷ (ক্রমশ)
                           

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব দরকারী রচনা | ধন্যবাদ জানাই |

    ReplyDelete
  2. অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ছেলে গেল মন। পোস্ট-এক্সপ্রেশনিজম আর এক্সপ্রেশনিজম এর মাঝে বিবর্তনের যে ভাঙা গড়া আর সময় ও সংকট
    ধরে রাখতে ঔপন্যাসিক/কবি/মনোবিদ/শিল্পী একীভূত। সবার লক্ষ্য এক্সপ্রেশনিজম-পদ্ধতিতে সৃষ্টিকে মানবিক আবেদনের শীর্ষে
    নিয়ে যাওয়া। যাতে তৎকালীন সময়,
    সমাজ,মানুষ ও তাদের অভিব্যক্তির সম্যক প্রকাশ ঘটে এবং তা জনগনকে আচ্ছন্ন করতে পারে।
    এই লেখাটি পাঠ করতে করতে মনে হচ্ছে এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে আগামী প্রজন্মের কাছে।লেখককে শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
  3. পোস্ট ইমপ্রশেনিজম আর এক্সপ্রেশনিজম----হবে কথাটি।
    ভুল হওয়াতে শুধরে দিলাম।

    ReplyDelete