জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস - ১৪/ শ্যামল জানা

History of modern painting


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১৪


শ্যা ম ল  জা না

এক্সপ্রেশনিজম (তৃতীয় অংশ)—

এই এক্সপ্রেশনিজম কথাটির উৎস প্রসঙ্গে দুটি মত চালু আছে৷ প্রথম মত— ১৯০১ সালে জুলিয়ন আগস্ট হার্ভে নামের এক অখ্যাত শিল্পী তাঁর চিত্র প্রদর্শনীতে প্রথম এক্সপ্রেশনিজম কথাটি ব্যবহার করেন৷ কিন্তু তিনি যেহেতু অখ্যাত, তাই বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি৷ সবচেয়ে মান্যতা পাওয়া দ্বিতীয় মতটি হল— বিশ্ববিখ্যাত চেক শিল্প-ইতিহাসবিদ অ্যান্তোনিন মেটজ্সেক ১৯১০ সালে ইম্প্রেশনিজম-এর বিপরীত অর্থে এক্সপ্রেশনিজম কথাটি ব্যবহার করেন৷
তবে, শুধু ইম্প্রেশনিজম নয়, এর আগে যত ইজম এসেছে, এই এক্সপ্রেশনিজম সর্ব অর্থে এদের থেকে আলাদা৷ অভিনব৷ বিশেষ করে—

১. আগের ইজমগুলি তাঁদের পূর্বসূরি শিল্পীদের গতানুগতিকতা ও গোঁড়ামিকে ভাঙতে চেয়েছিলেন৷ তাই তাঁদের ছবিগুলি ছিল অবজেক্টিভ দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকা৷
কিন্তু এক্সপ্রেশনিজম-এর উদ্দেশ্য ছিল সেই সময়কে চিহ্নিত করা৷ তখন যে বিশৃংঙ্খলা চলছিল, দেশে দেশে মানুষে মানুষে যে হানাহানি, মানবতার সংকট, তা থেকে উদ্ভুত যে হতাশা, উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তা ইত্যাদি অভিব্যক্তিগুলিকেই প্রতিবাদ-স্বরূপ তাঁরা ক্যানভাসে রং-তুলির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন৷ তাই, তাঁদের ছবিগুলি ছিল সাবজেক্টিভ দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকা৷

২. এক্সপ্রেশনিজম যত না শিল্পকেন্দ্রিক, তার চেয়েও অনেক বেশি ছিল মানবতার সংকটের প্রতি প্রতিবাদ৷ তাই ইয়োরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একসাথে অনেকগুলি উত্থান ঘটেছিল এই এক্সপ্রেশনিজম-এর৷ যা আগের কোনো ইজম-এর ক্ষেত্রে ঘটেনি৷ প্রথমে জার্মনির একটি অংশে এর সুত্রপাত ঘটে৷ তার পরে পরেই অষ্ট্রিয়ায়৷ ওখান থেকে ছড়াল ফ্রান্স-এ৷ নরওয়েতে৷ এভাবেই খুব দ্রুত সারা বিশ্বে৷

৩. শুধু একসাথে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উত্থান ঘটাই নয়, চিত্রশিল্প ছাড়াও ভাস্কর্য, কবিতা, সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, স্থাপত্য, ইত্যাদি বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমেও একই সাথে এই এক্সপ্রেশনিজম-এর সূত্রপাত ঘটেছিল প্রতিবাদ-স্বরূপ৷

৪. তাই, ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন চিত্রশিল্পীর উদ্যোগে নয়, বিশেষ কোনো গোষ্ঠী থেকে এর উত্থান ঘটল৷ এবং শুধু একটি নয়, কমপক্ষে তিনটি গোষ্ঠীর আমরা উল্লেখ করতে পারি এক্সপ্রেশনিজম-এর পথিকৃত হিসেবে৷ এঁরা হলেন— Die Brucke(ইংরাজিতে— The Bridge), Der Blaue Reiter(ইংরাজিতে— The Blue Rider) এবং Die Neue Sachlichkeit(ইংরাজিতে— New Objectivity)৷

    ১৯০৫ সালে মাত্র চারজন চিত্রশিল্পী(এর্নস্ট লুডউইগ কির্চনার, ফ্রিটজ্ ব্লেইল, এরিখ হেকেল ও কার্ল শ্চিমিডট্ রোটলাফ)ড্রেসডেন শহরে “দ্য ব্রিজ”-এর প্রতিষ্ঠা করেন এর্নস্ট লুডউইগ কির্চনার-এর নেতৃত্বে৷ পরবর্তীকালে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন— এমিল নোলডে, ম্যাক্স পেশ্চেসটেইন ও ওটো মুলার৷ এখান থেকেই এক্সপ্রেশনিজম-এর সূত্রপাত ধরা হয়৷ অথচ, এঁরা নিজেদেরকে এক্সপ্রেশনিস্ট হিসেবে ঘোষণা করেননি৷ “দ্য ব্রিজ”-এর শিল্পীরা মূলত ফ্রান্সের পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন৷
জার্মান সমাজে যাঁদেরকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে অধঃপাতিত করে রাখা হয়েছিল, সেইসব অবহেলিত শহুরে নাগরিক, দেহপসারিনী, নাইটক্লাবে বা শহরের রাস্তায় নাচ দেখিয়ে যাঁরা রোজগার করতেন, এইসব অচ্যুত শ্রেণীর দুর্দশার অভিব্যক্তিই এঁরা সাধারণত ছবিতে ফুটিয়ে তুলতেন৷ এঁরা ছবির দর্শকদের আবেগকে যথাসম্ভব প্রভাবিত করার জন্য ছবিতে দেহের গঠনকে বিকৃত করতেন, অবাস্তব ও দৃষ্টিকটু চড়া রং ব্যবহার করতেন(ছবি-১)৷

১৯০৬ সালে “দ্য ব্রিজ” প্রথম একটি চিত্রপ্রদর্শনী করল(ছবি-২)৷

সেই চিত্রপ্রদর্শনীতে তাঁরা বড় বড় কাগজে এই ধরনের ছবির কাঠ-খোদাই-এর ছাপচিত্র(গ্রাফিক)-র সংকলন প্রকাশ করেছিলেন৷ সংকলনটির নাম দিয়েছিলেন— “প্রোগ্রাম”৷ এই সংকলনে যে ছবিগুলি ছিল, তাদের যৌবনের উদ্দামতার মতো সৌন্দর্য গোটা জার্মানি তথা ইয়োরোপের ছবির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে তছনছ করে দিল! আর, অবজেক্টিভিটি থেকে সরে প্রথম সাবজেক্টিভ দৃষ্টিকোণ এল ছবিতে৷ প্রতিবাদস্বরূপ অধিকাংশ ছবির বিষয়বস্তু হল মানুষের নেতিবাচক অভিব্যক্তি(ছবি-৩)৷ 

যেমন— নৈরাশ্য, উদ্বেগ বা দুঃশ্চিন্তা, বিরক্তি, অসন্তোষ, হিংস্রতা, অতিশয় ধর্মান্ধতার কদর্যতা, বিনা কারণে অন্যকে অভদ্রভাবে হেয় করা, এবং এই আধুনিক জীবনের জন্য যে নির্ধারিত সম্ভাবনা এবং অসঙ্গতি সেইসবও তাঁরা ছবিতে স্পষ্ট করলেন৷ ফলে, এই ছবিগুলো এত দিনের যে কেতাবি ঐতিহ্য তার থেকে একেবারে মুক্ত হওয়ার ডাক দিল! এইভাবে, একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে, জার্মান এক্সপ্রেশনিজম-এর সূত্রপাত ঘটল, যাকে আমরা শুধু এক্সপ্রেশনিজম হিসেবেও চিহ্নিত করতে পারি৷ (ক্রমশ)
________________________________
এই ধারাবাহিকটি প্রতি রবিবার প্রকাশিত হচ্ছে। 
অভিমত জানাতে পারেন।         

Post a Comment

1 Comments

  1. এক্সপ্রেশনিজম এর বিবর্তনে কিভাবে অবজেকটিভ থেকে
    সাবজেকটিভে এসেছে তার
    আনুপূর্বিক বর্ণনা মুগ্ধ হয়ে
    পড়ার মতো।
    সাবজেকটিভে এসে কেতাবি
    ছবির মুক্তির পিছনে তৎকালীন
    সমাজ,সমাজবদ্ধ মানুষ এবং
    তাদের জীবনের নানা ঘাত
    প্রতিঘাত কিভাবে ছবির বিষয়
    হয়ে উঠেছিল,তা বিস্ময় সৃষ্টি
    করে।
    দুর্দান্ত হচ্ছে।

    ReplyDelete