জ্বলদর্চি

দিগন্তরেখা / সুব্রত দাস

    ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু    


দিগন্তরেখা


সু ব্র ত  দা স 

আজ অবকাশে তোমাকে নিয়ে খুঁজতে বসলাম, অনেকদিন পর আজ সম্পূর্ণ একা এতোটা সময় পেলাম তবে তুমি একথা ভেবোনা অন্য সময় তোমাকে খুঁজিনা, ভীড়ের মধ্যে কাজের চাপেও তোমাকে খুঁজতে হয়না তুমিতো সব সময় অন্তরের অন্তস্থলে বিরাজ করছো কিন্তু আজ একটু অন্য রকম।

আজ রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে কখনো এক চিলতে রোদ উঁকি মারছে জানালা দিয়ে ঠিক তোমার মতো, যখন তুমি গুমোট ভ'রা মনে এক ঝলক দেখা দিতে, মিষ্টি হেসে তারপর ঘন মেঘের মতো সবকিছু কালো, সেই কতো কাল আগের বই-এর পাতায় তুমি ভেসে উঠলে যখন তোমাকে নিয়ে অন্তরে প্রথম লেখা শুরু হয়েছিল।

মনে হলোনা এর আগে বহুবার পড়া হয়ে গ্যাছে এখনো অক্ষরগুলো সদ্যফোটা ফুলের গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে আর আমি প্রাণ ভ'রে শ্বাস নিচ্ছি, তোমার মায়া ভ'রা চোখদুটি এখনো কাজলনয়না হরিণীর মতো কথা বলছে, দুলছে তোমার বেণী, কানের দুটি দুল যেন ঠিক একফালি বাঁকা চাঁদ, কুসুমেকুসুমে ঢেকেছো পরনের এমনি জামা, তোমার সুন্দর তনু যেন সদ্য পাঁপড়ি মেলা একটা লাল গোলাপ।

তখন তুমি আর কত বড়-জোর পনেরো কি ষোলো, কিশোরী মনের চঞ্চলতা তোমার আনাচেকানাচে।
পৃথিবীর রঙে তুমি তখন প্রজাপতির মতো রঙিন ডানা মেলে উড়ছো ঘাসেঘাসে ফুলেফুলে, কখনো আসছো আমার জানালার কাছে, আমি আলতোভাবে ধরার চেষ্টা করছি বারবার, তোমার ডানার স্পর্শ পেয়ে হাত বের করি জানালার বাইরে, তোমার সম্মোহনে সম্মোহিত হয়ে আমি অপলকে চেয়ে থাকতাম তোমার আসার অপেক্ষায়।

তারপর চলে কিছুদিন যাওয়া আর আসা জানালার বাইরে, দুচোখ মেলে দ্যাখো বিশ্বাস করা যায় কি না, আমার ভয় হতো কারণ তোমার সঙ্গে আমার তুলনা হয়না তথাপি তোমার হৃদয়ের ভীরু কম্পন বাতাসে মিশে ছুঁয়ে যেত আমাকে আর সেই কম্পন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে তোমাকে জানান দিত আমার মনের গভীরতা, তুমি বিশ্বাস করতে শিখলে এখানে ভয় নেই তোমার। অবশেষে ধরা দিলে তোমার সমস্ত অস্থিরতা কাটিয়ে, তুমি শান্ত হলে, প্রগাঢ় বিশ্বাস নিয়ে সম্পূর্ণ ধরা দিলে। তোমার তুলতুলে নরম শরীরটা পরম যত্নে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম, লজ্জায় তোমার দুচোখ বন্ধ হলো, লজ্জাবতী পাতায় হাত দিলে যেমন হয় ঠিক তেমনি। 

সেই সমর্পণে তুমি তোমার মনের সমস্ত ফুলের রেণু মাখিয়ে দিলে, আমি এঁকে দিলাম তোমার কপালে একটা চুম্বন। এক অনাস্বাদিত অনুভবের আবেশে আমরা হারিয়ে গেছিলাম এক মুহুর্ত কাল সেই এদোন উদ্যানে অপাপ জীবনের আদম ইভের মতো। সেই অনুভবের ছোঁয়া আজও অনুভূত হচ্ছে স্মৃতি বিজড়িত জানালার ধারে।

তারপরও কয়েক বছর আমরা একাত্ব হয়ে মিশেছিলাম আশেপাশের নদীনালা সমুদ্রে পাহাড়ে জঙ্গলে, ধানের ক্ষেতে পূবালী হাওয়া মেখে বসে থাকতাম নীল আকাশের নীচে কোনো আলের আড়ালে বা কখনো নিরিবিলি কোনো কুঞ্জ ছাওয়ায়। গোধুলী বেলায় ফিরে আসতাম মেঠোপথ বেয়ে নিজ নিজ ঘরে, মায়াভরা স্বপ্নঘোর রাত্রি কেটে আসত স্বর্ণালী সকাল।

প্রেম নিরবে এসেছিল দুটি হৃদয়ের মাঝে গেঁথেছিল আলোকমালা দিয়ে দিগন্ত, প্রতিধ্বনি হোতো দিগন্ত থেকে দিগন্তে, সেই ধ্বনি অনুভূত হয়ে প্রবেশ করতো দুটি হৃদয়ে, আমরা ছিলাম আমরা আছি আমরা থাকবো। আমরা একদিন চলে যাবো মৃত্যু নদীর ওপারে তবুও আমাদের প্রেম থাকবে মৃত্যুহীন হয়ে। পার্থিব প্রেমের ছেদ হয়তো আসবে জীবনে কিন্তু স্বর্গীয় প্রেম বিরাজ করবে দুটি অন্তরে আমৃত্যু রক্তমাংসের শরীরে।

একদিন আমি তোমাকে বলেছিলাম কারো কারো জীবনে প্রেমের মৃত্যু আসে বারবার, তুমি বলেছিলে কেন! আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম - তুমি জাননা? তুমি বলেছিলে না। তখন বলেছিলাম শরীরে যেমন রোগ বাসা বেঁধে শরীর নষ্ট করে দ্যায় তেমনি প্রেমেও নানা রোগ প্রবেশ করে প্রেমকে ধ্বংস করে দ্যায়। রোগগুলি কি জান - অবিশ্বাস, অসহিষ্ণুতা, বিশ্বাসঘাতকতা, আত্ম অহংকার অবাধ্যতা এমন আরও অনেক কিছু।

তারপর আমরা কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন নীরব হয়ে গেছিলাম।  নীরবতা ভেঙ্গে তুমি বললে তারচেয়ে চলো আমরা ঐ দিগন্ত রেখায় হারিয়ে যাই। আমি বললাম দিগন্তরেখা কি ছোঁওয়া যায়! বললাম নিজেকে ভালো করে চেয়ে দ্যাখো আমরা তো দিগন্তরেখাতেই দাঁড়িয়ে আছি, দুই স্বত্বা মিলে কেমন এক স্বত্বা হয়েগেছি। অতদূরে কি আছে কে জানে! তুমি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বললে বাস্তব বড়ই কঠিন - না!

    ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু    

Post a Comment

2 Comments