জ্বলদর্চি

সেই হাওয়া /মানসী মিশ্র হালদার

ফোটোগ্রাফি - সৈয়দ স্নেহাংশু


সেই হাওয়া

মা ন সী  মি শ্র হা ল দা র


শরতের আকাশ আজ বড়ো উদাস। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আবার প্রখর রোদ। বাগানের গাছগুলোও মানিয়ে নিয়েছে পরিবর্তনের হাওয়া।
আজ সকাল থেকে মনটা বড়ো খারাপ অনুভা দেবীর।সবে এক বছর হয়েছে অনুভা দেবী রিটায়ার্ড করেছেন। ছেলে -বৌমা ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। 
পূর্ব মেদিনীপুরের এই গ্রামের বাড়ি অনুভা দেবীর কাছে স্বর্গ সমান। তাই ছেলে -বৌমার ডাকে সাড়া না দিয়ে এই বাড়িকেই করেছেন শেষ আশ্রয়।
      দোতলার খোলা বারান্দা অনুভা দেবীর কাছে এক মুক্তির আহ্বান। সারাদিনের মন খারাপ এক নিমেষেই দূর হয়ে যায় বিকেলের বারান্দায়।
অনুভা দেবীর বাড়ির চারপাশে ছোট্ট প্রাচীর। প্রাচীরের ভেতরে ফল ও ফুলের বাহার। অন্যদিকে প্রাচীরের বাইরে খোলা মাঠে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের হুল্লোড়।
সমস্ত একাকীত্ব মুছে যেত এই শিশুদের কলরোলে।কিন্তু মহামারীর প্রবল ভয়ঙ্করতায় শিশুদের খেলা বন্ধ। কেউ বাইরে আসেনা। এখন প্রতিটি দিন হতাশার বিকেল।
বাগানের গাছগুলো অনুভাদেবীর কষ্ট অনুভব করে।তাই পাতা দুলিয়ে ভালোবাসার ছোঁয়া দেয় ওরা।বাগানের ফুলগুলোই এখন সান্ত্বনার হাওয়া।
আজকের বিকেল বড়ো ক্লান্ত বিকেল। বারান্দার চেয়ারে বসে বসে দু'চোখে ধোঁয়াসা নেমে আসে।
মনে হয় চেয়ার বুঝি নড়ছে।
অনুভা দেবীর মন ভেসে যায় কুড়ি বছর আগে।সমর্পনের বয়স তখন প্রায় পনের।

একদিন অফিস থেকে ফিরে অনুপম বলল,অনুভা,আমি এক সপ্তাহের জন্য দিল্লি যাব। সব গোছাতে হবে।
-------হঠাৎ এখন দিল্লি?
প্রায় বিরক্ত হয়ে অনুপম বলল, অফিস থেকে পাঠাচ্ছে। আমি কি করব? তুমি সব ব্যাপারে বড্ড বাড়াবাড়ি কর।আমি তো তোমার ব্যাপারে কিছু বলি না!
--------আমি কি এমন বললাম তোমায়!
-------কিছুই বলনি অথচ অনেক কিছু বলেছো।
পারোও তুমি ।একেবারে অসহ্য।
অনুভার চোখ জলে ভরে এলো।সমর্পণ এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। যেন এক নীরব পৃথিবীর সাক্ষী সে।
সন্ধেবেলা সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিল অনুপম।কারো সাথে কোন কথা বললনা।
রাতে খেতে দেওয়ার সময় অনুভা বলল, সব ঠিক করে গুছিয়ে নিয়েছো?
------হ্যাঁ।
------এক সপ্তাহ পরে আসবে?
-------বলতে পারছিনা। ওরকম কথা আছে।
অনুভা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে ।সেই রাতে আর কোন কথা হোলনা। সকালে  ঘুম ভাঙতেই অনুভা ছুটে যায় অনুপমের ঘরে। অনুপম তখন ছুটে চলেছে ট্রেনে ।অনুভার বুকে এসে বিঁধছে ট্রেনের ঝিক্ ঝিক্ শব্দ। এক সময় হারিয়ে গেল আওয়াজ। ফুরিয়ে গেল একের পর এক সপ্তাহ। ফিরে এলো না অনুপম।

হঠাৎ ছোটদের কলরোলে চমকে ওঠেন অনুভা দেবী।বাচ্চারা মাঠে এসেছে! কেন এলো?
অনুভা দেবীর ঝাপসা দৃষ্টি ক্রমশ প্রখর হোল।ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা মুখে মাস্ক পরে দূরত্ব বজায় রেখে খেলছে। মাঝে মাঝে হাত স্যানিটাইজ করছে ।অনুভা দেবীর বুক আনন্দে ভরে উঠল। মনে হোল আবার বুঝি ফিরে এলো সেই হাওয়া।
অনুভা দেবী দু'চোখ মেলে দেখতে লাগলেন ছোটদের খুশি। যেন পুজো পুজো সাজ ফুটে উঠেছে ওদের চোখে মুখে। শরৎ আকাশ মেলে দিয়েছে তার পাখনা।বুঝি বা এই প্রচন্ড মহামারীকেও হার মানিয়ে দেবে ওরা।
      সন্ধে হয়ে এলো। বাড়ি চলে গেল ছোটরা।পাখিরাও ফিরছে বাসায়। গোধূলির আকাশ জানিয়ে দিচ্ছে নতুন হাওয়ার আগমন বার্তা।
         অনুভা দেবী সন্ধে দেখিয়ে এক কাপ চা বানালেন ।এমন সময় ফোন এলো।
ফোন রিসিভ করে অনুভা দেবী বললেন,
হ্যালো বাবু, ভালো আছিস তো?
--------হ্যাঁ মা ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো?
-------হ্যাঁরে বাবু,ভালো আছি।
-------ট্রেন স্বাভাবিক হলে আমরা বাড়ি যাব। কতদিন লকডাউনের জন্য যেতে পারিনি। যেভাবেই হোক এবারে চাকরি ট্রান্সফার কোরবই মা। তোমাকে আর একা থাকতে দেবনা। অলকা মাসি কাজে আসে তো মা?
--------হ্যাঁরে আসে। রান্না বান্না  সব করে দিয়ে যায়।
-------ঠিক আছে। তুমি সাবধানে থাকবে।
-------তোরাও সাবধানে থাকিস।
-------ওকে মা, রাখছি তাহলে।
--------হ্যাঁ বাবু, রাখ।
সমর্পনের সঙ্গে কথা বলে অনেক হাল্কা লাগল অনুভা দেবীর। মনে হচ্ছে সমস্ত পুরোনো সুর ফিরে আসছে নতুন কোন বার্তাবহ হয়ে।
         অনুভা দেবী বিছানার এক কোনে বালিশে ঠেস দিয়ে বসেন। হাতে রবি ঠাকুরের সঞ্চয়িতা। জীবনের সমস্ত সমাধান রবি ঠাকুর। মনে হয় সঞ্চয়িতা ছুঁয়ে থাকলেই পাওয়া যায় সব শান্তি। বারে বারে ফিরে আসে সেই হাওয়া যা পরম তৃপ্তির, পরম প্রাপ্তির।

Post a Comment

1 Comments