জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন -১৪ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

Sign of Lord in Science

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন
 
পূ র্ণ চ ন্দ্র  ভূ ঞ্যা  

পর্ব ― ১৪

কালো দৈত্যের ক্ষমতা :
এ হেন সমীকরণটি বিখ্যাত একটি বিকিরণের সমীকরণ হিসাবে। স্রষ্টার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাঁর সমাধির ওপর স্বর্ণাক্ষরে এখনও জ্বল জ্বল করছে লেখাটি। শুধু এই সমীকরণ নয়, জীবনের পর তাঁর "এপিটাফ" (সমাধিস্তম্ভ-লিপি) যেন মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে সদর্পে ঘোষণা করছে, "অবশেষে তুমি আমাকে অধিকার করেছ, হারাতে পারনি!"

তাঁর এ হেন ঘোষণায় স্পষ্ট, মৃত্যু তাকে এখনও গ্রাস করতে পারেনি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, "বিগত ৪৯ বছর ধরে আমি অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা নিয়ে বেঁচে আছি। আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত নই।"

তিনি আরও বলেন, "আবার মৃত্যুর ব্যাপারে আমার কোনও তাড়া নেই। আমার আরও অনেক কাজ আছে যেগুলো আমি করতে চাই।" তাই মৃত্যু নয়, আসলে মানুষটি যেন 'কৃষ্ণগহ্বর' নামক গোপন জায়গায় এখন আত্মগোপন করে আছেন। 
জীবনের অধিকাংশ সময় সে-স্থানের ভাবনায় আচ্ছন্ন থেকে শেষমেশ হয়তো সশরীরে তার কেতা ঘটনা সরেজমিনে অনুসন্ধানহেতু সেখানে গমন করেছেন ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ তারিখে। মৃত্যুদূতকে ভুল প্রমাণিত করে আবার হয়তো কখনও ফিরবেন তাঁর সাধের মেদিনীতে। তখন তিনি নবজীবন লাভ করে বিরল 'অমর' উপাধির অধিকারী হবেন। আর কেউ নন, তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী স্টিফেন হকিং। সাক্ষাৎ মৃত্যুরূপী দুরারোগ্য মোটর নিউরন ডিজিজের একটি জটিল ধরন অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস (এ এল এস) অসুখও তাঁর মনন, চিন্তন, গবেষণার পথে অন্তরায় হতে পারেনি। এখানেই তাঁর অমরত্ব।

                               (দুই)
আড়াই মিনিটের এক সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 'দ্য ব্ল্যাকহোল'। বাংলা তর্জমায় 'কৃষ্ণগহ্বর'। এ হেন মুভিতে দেখা যায়, বহুজাতিক অফিসের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এক কক্ষে জেরক্স মেশিনের হৃদয় বিদীর্ণ করে একটি বড় সাদা কাগজ বের হয়। চারকোনা পৃষ্ঠার মাঝখানে একটি ঘন কালো গোলাকার অংশ। এই কালো অঞ্চলটি কৃষ্ণগহ্বর।এর মধ্যে পড়লে জলের গ্লাস, মানুষের হাত, মায় এক জলজ্যান্ত গোটা মানুষ স্বচ্ছন্দে হাপিস হয়ে যায়, বের হতে পারে না কখনও। অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই সাধারণের মন জিতে নেয় মুভিটি।
কৃষ্ণগহ্বর শূন্যস্থানের এমন এক অঞ্চল যা গিলে খায় তার আশপাশে থাকা সবকিছু– কলাটা, মুলোটা, গাছপালা, পাহাড়, পর্বত, গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, এমনকি তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ তথা আলো। সেই সঙ্গে অনেকগুলো কৌতূহলী প্রশ্নের উদ্রেকও ঘটায় মুভিটি। ব্ল্যাকহোল কী? ব্রম্ভাণ্ডে তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে কি? যদি থাকে, কোন ধারণার ভিত্তিতে পণ্ডিতদের মনে প্রথম এমন ঘটনার উদ্রেক হয়? যদি সবকিছু আস্ত গিলে খায় সে, কোনকিছু ফেরায় না; তবে কীভাবে তার অস্তিত্ব বিজ্ঞানীদের গোচরে আসে? এমন হাজারো প্রশ্নে ফালা ফালা হয়ে যায় অনুসন্ধিৎসু সাধারণ মন।

                           (তিন)
ইতিহাস:
কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত ধারণার আবির্ভাব অনেক কাল আগে। ১৭৮৩ সালে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মিশেল তার গবেষণাপত্রে প্রথম প্রকাশ করলেন যে একটি তারকার যদি যথেষ্ট ভর ও ঘনত্ব থাকে, তাহলে তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত শক্তিশালী হবে যে আলোক তরঙ্গ সেখান থেকে নির্গত হতে পারবে না। তারকার পৃষ্ঠ থেকে নিঃসৃত বিকিরণ বেশি দূর যাওয়ার আগে তার মহাকর্ষজনিত আকর্ষণ আলোটিকে পেছনে টেনে ধরে তারকার গর্ভে অন্তর্লীন করবে। আসলে এটাই ছিল কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে সর্বপ্রথম সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী। যদিও তখন তার নামকরণ 'ব্ল্যাকহোল' হয়নি। ১৯৬৭ সালে বিজ্ঞানী জন হুইলার 'ব্ল্যাকহোল' নামকরণ করেন।

পরবর্তী সময়ে ১৯১৫-তে সাধারণ অপেক্ষবাদ আবিষ্কারের এক বছর পর কার্ল শোয়ার্জসচাইল্ড-এর শূন্যস্থানে গোলীয় প্রতিসম বস্তুর সমাধানের সূত্র ধরে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কালোগহ্বরের অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তার অপেক্ষবাদ তত্ত্বের গানিতিক ক্যালকুলেসনে উঠে আসে 'সিঙ্গুলারিটি' প্রসঙ্গ। সেখান থেকে জন্ম নেয় ব্ল্যাকহোল সম্পর্কিত ধারণা। অবশ্য কিছু কিছু সময় বিক্ষিপ্তভাবে ব্রম্ভাণ্ডে তার প্রভাব চোখে পড়ে পণ্ডিতদেরও। 

কিন্তু তার প্রত্যক্ষ দর্শণ তখনও অধরা। অবশেষে ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল 'ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ' (EHT)-এর স্থির আলোকচিত্রে ধরা পড়ে সে। ক্যামেরার স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মেসিয়ার-৮৭ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এক অতিকায় কৃষ্ণগহ্বরের ইমেজ। ঐ গ্যালাক্সি পৃথিবী থেকে ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে, 'ভিরগো গ্যালাক্সি ক্লাসটার'-এ অবস্থিত সে। 

যদিও এর আগে ১৯৬৪ সালে মহাকাশে হংসমণ্ডল নক্ষত্রমণ্ডলী (Cygnus)-তে একটা শক্তিশালী এক্স রশ্মির সন্ধান পাওয়া যায়। এই এক্স রশ্মির উৎস কৃষ্ণগহ্বর কি-না ১৯৭৫-এ এমন বাজি ধরে ১৯৯০-তে ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিট্যিট অব টেকনোলজি'র কিপ থর্ন-এর কাছে হেরে যান স্টিফেন হকিং। যদিও তিনি ৯৫ শতাংশ নিশ্চিত ছিলেন যে ওটা একটা কৃষ্ণগহ্বর। আসলে ইচ্ছে করেই বাজি হেরেছিলেন তিনি।

                              (চার)

তারকা থেকে ব্ল্যাকহোলে উত্তরণ:
ব্রম্ভাণ্ডে কীভাবে গঠিত হয় এ হেন কালো দৈত্য? ― এমন কৌতুহলী প্রশ্ন আপামর জনসাধারণের। আর কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টির অতীত জানতে হলে প্রথমে একটি তারকার জীবন-চক্র বোঝা দরকার। বৃহৎ পরিমাণে গ্যাসীয় পদার্থ তার মধ্যে ক্রিয়ারত মহাকর্ষের জন্য চুপসে গিয়ে একটি তারকার জন্ম দেয়। এ হেন তারকার অভ্যন্তরে দু'রকম বল সর্বদা কাজ করে। মহাকর্ষজনিত আকর্ষণ এবং পাউলি'র অপবর্জন নীতিভিত্তিক বিকর্ষণ। এই দুই বলের মধ্যে ভারসাম্যের উপর একটি নক্ষত্রের তারকা থেকে কৃষ্ণগহ্বরে উত্তোরণ নির্ভর করে।
মহাকর্ষজনিত ক্রমবর্ধমান আকর্ষণের দরুন তারকা যত সংকুচিত হবে, তত তার মধ্যেকার বায়বীয় উপকরণ পদার্থের ঘনত্ব ও পারস্পরিক সংঘর্ষ বাড়তে থাকবে। ফলে আরও বেশি উত্তপ্ত হবে সে। শেষ পর্যন্ত এত গরম হবে যে তারার জ্বালানি হাইড্রোজেন পরমাণুগুলি সংঘর্ষের পর দূরে ছিটকে না গিয়ে সংযুক্ত হয়ে হিলিয়াম অণু গঠন করে। এ হেন বিক্রিয়ায় মুক্ত তাপ তারকা থেকে আলোক হিসাবে বিকিরিত হয়। কিন্তু কতদিন চলবে এমন ঘটনা? যতক্ষণ একটি তারকার গর্ভে তার উপাদান হাইড্রোজেন পরমাণু বর্তমান, ততদিন নক্ষত্র আলোক বিকিরণে সক্ষম। জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে ঘন আঁধার নেমে আসবে তারকার জীবনে। অবশ্য জোর দিয়ে বলা যায় না সে-কথা। হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হলে তারাটি শীতল হবে এবং সেজন্য বিকিরণজনিত চাপ উপেক্ষা করে শুধুমাত্র মহাকর্ষীয় আকর্ষণের জন্য সেটি সংকুচিত হবে।

ক্রমাগত সংকোচনের ফলে তারকাটি ক্ষুদ্র হলে পদার্থের কণাগুলি খুব কাছাকাছি আসে। তখন পাউলি'র অপবর্জন নীতি অনুসারে কণাগুলি ভিন্ন ধরনের গতি প্রাপ্ত হয়, যা তাদের পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে দেয় ও তারকার প্রসারণের ঝোঁক দেখা যায়। তবে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ ও অপবর্জন নীতিভিত্তিক বিকর্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত হলে তারকাটি তার নিজস্ব স্থির ব্যাসার্ধ অপরিবর্তিত রাখতে সমর্থ হয়।

তবে সে আশায় গুড়ে বালি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত তরুণ বিজ্ঞানী সুব্রক্ষণ্যন চন্দ্রশেখর ১৯২৮ সালে উপলব্ধি করেন অপবর্জন নীতিভিত্তিক বিকর্ষণের একটি ঊর্ধ্বসীমা আছে, এর বেশি বিকর্ষণ আর বাড়ে না। তিনি হিসাব কষে বললেন একটি শীতল তারকার ভর সূর্যের ভরের দেড় গুণের চেয়ে বেশি হলে সে নিজের মহাকর্ষ থেকে রক্ষা পাবে না, ধীরে ধীরে একটু একটু করে কৃষ্ণগহ্বরে পা বাড়াবে। ভরের এই ঊর্ধ্বসীমা 'চন্দ্রশেখর লিমিট' নামে খ্যাত। এ হেন আবিষ্কারের পুরস্কার স্বরূপ, অনেক পরে ১৯৮৩ সালে তিনি 'নোবেল' সম্মাননায় ভূষিত হন।

এখন যদি একটি তারকার ওজন চন্দ্রশেখর সীমার চেয়ে কম হয়, তবে সংকোচন বন্ধ করে সে-টি সম্ভাব্য অন্তিম দশা 'শ্বেত বামন' (White Dwarf)-এ পরিনত হবে।

আবার তারকার ভর সূর্যের ভরের প্রায় এক কিংবা দুই গুণ হলে এরা আকারে শ্বেত বামনের চেয়েও ছোট হয়। তখন তার মধ্যে আন্তঃইলেকট্রন বিকর্ষণ বলের চাইতে নিউট্রন ও প্রোটনের অন্তর্বর্তী অপবর্জন নীতিজনিত বিকর্ষণ বল-ই তারকার অস্তিত্ব রক্ষা করে। সেজন্য এদের 'নিউট্রন তারা' (Neutron Star) বলা হয়। পালসার-১৯১৩+১৬ হল এমনই এক নিউট্রন স্টার, যা থেকে নিয়মিত বেতার তরঙ্গ স্পন্দিত হয়।

অন্যদিকে, যে সব তারকার ভর চন্দ্রশেখর সীমার চাইতে অনেক বেশি, তাদের ক্ষেত্রে কী ঘটবে? চন্দ্রশেখর-এর মতে, অপবর্জন নীতি অত্যন্ত ভারী নক্ষত্রের সংকোচন বন্ধ করতে পারে না। সংকুচিত হলে কেমন হবে সে-তারকার অন্তিম দশা? ১৯৩৯ সালে তরুণ আমেরিকান বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার-এর গবেষণা-লব্ধ ফলাফল তেমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি পরমাণু বোমা প্রকল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে তার গবেষণার সূত্র ধরে আমরা জানতে পারি― নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র স্থান-কালে আলোক রশ্মির গতিপথ পরিবর্তন করে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে সূর্যগ্রহণের সময় দূরস্থিত তারার আলোকপথের বঙ্কিমতার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অবশ্য অনেক আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন ১৯১৯ সালের২৯ শে মে'র পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের ছবি তুলে বিশ্লেষণ করে দেখেন আইনস্টাইনের হিসাব একদম ঠিক।

সুতরাং সংকোচনের ফলে ক্রমবর্ধমান মহাকর্ষের জন্য তারকাটি একটি ক্রান্তিক ব্যাসার্ধ (Critical Radius) প্রাপ্ত হয়, যখন তারকার পৃষ্ঠের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রপ্রাবল্য এত শক্তিশালী মানে পৌঁছয় যে তার পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা ঘটনাসমূহ, এমনকি আলোকও তার বাইরে বের হতে পারে না। স্থান-কালের এমন অঞ্চলকে পণ্ডিতগণ 'কৃষ্ণগহ্বর' নামে আখ্যায়িত করেছেন। এ হেন কৃষ্ণগহ্বরের বাইরে চারপাশের আলোকোজ্জ্বল গোলাকার সীমান্ত অঞ্চল 'ঘটনা দিগন্ত' (Event Horizon) নামে পরিচিত।
১৯১৬ সালে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জসচাইল্ড এই ঘটনা দিগন্তের ন্যুনতম ব্যাসার্ধের মান গণনার রাশিমালা প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যাসার্ধের এই মান 'শোয়ার্জসচাইল্ড ব্যাসার্ধ' নামে খ্যাত। ব্যাসার্ধের (R) সমীকরণটি নিম্নরূপ:–
     
           R = (2GM÷C)^0.5
                যেখানে, G= মহাকর্ষ ধ্রুবক
                             M= কৃষ্ণগহ্বর ভর
                             C= শূন্যস্থানে আলোর বেগ

নীচে পৃথিবী ও সূর্যের কৃষ্ণগহ্বরে রূপান্তরিত হলে কত হবে তাদের শোয়ার্জসচাইল্ড ব্যাসার্ধ, তার একটি চিত্র দেওয়া হল।
ব্যাসার্ধের ক্রান্তিক মানের পরে ব্ল্যাকহোলের আর কোন দশা থাকতে পারে কি? ব্যাপক অপেক্ষবাদ মতে, কৃষ্ণগহ্বরে অসীম ঘনত্বের অনন্যতা বা সিঙ্গুলারিটি থাকতেই হবে এবং তার জন্য স্থান-কালে অনন্ত বক্রতা অনিবার্য।

একটি তারকার অন্তিম দশা শুধুমাত্র তার ভর ও ঘূর্ণনের হারের ওপর নির্ভর করে না, বরং নানা অংশের ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্ব ও অভ্যন্তরস্থ বায়বীয় পদার্থগুলির  জটিল গণিতের উপর নির্ভর করে।

১৯৬৭ সালে কানাডিয়ান বৈজ্ঞানিক ওয়ার্নার ইস্রায়েল, পরে রজার পেনরোজ ও  জন হুইলার দেখান অঘূর্ণ কৃষ্ণগহ্বরগুলি, ব্যাপক অপেক্ষবাদ অনুসারে, মহাকর্ষীয় সংকোচন শেষে নিঁখুতভাবে গোলকাকার হয়; তাদের আয়তন নির্ভর করে শুধুমাত্র তাদের ভরের উপর।

                              (পাঁচ)
অস্তিত্বের প্রমাণ:
এক্ষণে স্থান-কালের অসীম বক্রতা ও অনন্ত মহাকর্ষের জন্য কৃষ্ণগহ্বরের মুক্তিবেগ শূন্যস্থানে আলোর বেগের চাইতে অনেক বেশি হয়। তাই সমস্ত পদার্থ ও আলোককে ব্ল্যাকহোল গিলে খায়। তাহলে পণ্ডিতগণ ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব টের পেলেন কেমন করে?

শূন্য থেকে নিদেনপক্ষে এক ছটাক আলো আপনার চক্ষুতে পৌঁছলে, যে বস্তু থেকে আলোটি নির্গত হচ্ছে তার অস্তিত্ব আপনার কাছে প্রতীয়মান হবে। ব্ল্যাকহোল যদি ন্যুনতম কোন আলো বিকিরণ না করে, তাহলে আকাশে তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে একশো শতাংশ নিশ্চিত হই কী করে?
বিশ্বে ব্ল্যাকহোলের উপস্থিতি যাচাই করতে এখানে চারটি কারণ উল্লেখ করব, প্রিয় পাঠক।

প্রথমত কৃষ্ণগহ্বর সবকিছু গিলে খেলেও শূন্যস্থানে তার অসীম বক্রতা ও অনন্ত মহাকর্ষীয় টান নিকটবর্তী বস্তুরাজি উপেক্ষা করতে পারে না। এর প্রভাব পরিলক্ষিত হবেই হবে। ধরুন, অদৃশ্য সঙ্গীকে কেন্দ্র করে একটি তারকা প্রদক্ষিণ করছে। এখন প্রশ্ন হল, ঐ অচেনা সঙ্গীটি কে? সে যদি বড় কোন স্বল্পপ্রভ তারকা হত, ব্রম্ভাণ্ডের বয়স এমন কিছু হয়নি যে তার ভেতর সব জ্বালানি এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল আর সে স্বল্পপ্রভ তারকা বনে গেল। আবার ছোট তারকার পক্ষে অপর একটি বড় তারকাকে পরিক্রমণ করানোর সে-ক্ষমতা নেই। তাই সে অদৃশ্য সঙ্গী ব্ল্যাকহোল না হয়ে যায় না।

দ্বিতীয়ত একটি গ্যালাক্সির কথা ধরা যাক। যেমন আকাশ গঙ্গা বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। এখানে এখন প্রায় দশ হাজার কোটি তারকার বাস। এই বিশাল সংখ্যক তারকার সমষ্টিগত ভর আকাশ গঙ্গা ছায়াপথের বর্তমান ঘূর্ণনহার ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। তার জন্য বিরাট পরিমাণ অতিরিক্ত মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বল দরকার। আর এই অতিরিক্ত মহাকর্ষ বিশ্বে ব্ল্যাকহোল ধারণা দৃঢ় করে।

তৃতীয়ত ছায়াপথের কোন বড় তারকা যখন কৃষ্ণগহ্বরের নিকটবর্তী হয়, তখন তারকার নিকটতর ও দূরতর অংশে কৃষ্ণগহ্বরের অসীম মহাকর্ষ টানের জন্য তারকাটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এর ফলে তার বায়বীয় খণ্ডিত অংশগুলো ঐ কৃষ্ণগহ্বরে অন্তর্লীন হবে। সেজন্য গহ্বর থেকে নির্গত অত্যন্ত ঘন সন্নিবিষ্ট বেতার তরঙ্গ ও অবলোহিত রশ্মি ছায়াপথে অবস্থান করবে। সেই রশ্মির উৎসের সন্ধান কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে সমর্থ হবে।

চতুর্থত একমাত্র আদিম ব্রম্ভাণ্ড যদি নিঁখুতভাবে মসৃণ ও সমরূপ না হয়, তবে বিশ্বের সব স্থানের ঘনত্ব অভিন্ন হবে না। যেখানকার ঘনত্ব গড় ঘনত্বের চাইতে বেশি হবে, সেখানে কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হবার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। কারণ ক্ষুদ্র অঞ্চলে অত্যধিক চাপের ফলে কালো দৈত্য তৈরি হতে পারে।

                               (ছয়)
হকিং রেডিয়েশন:
প্রতীয়মান একটি ব্ল্যাকহোল কি শুধু কুম্ভকর্ণের মতো খায়-দায়-ঘুমায়, কোনকিছু নির্গমন করে না? কণাবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে কণাবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ১৯৭৪ সালে ব্ল্যাকহোল সমস্যার একটি যুগান্তকারী ঘটনা আবিষ্কার করেন। 'ব্ল্যাকহোল রেডিয়েশন'। কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ যা হকিং রেডিয়েশন নামেও বিখ্যাত। এই বিকিরণের সমীকরণটি তাঁর সমাধির ওপরে লিপিবদ্ধ আছে, যা একদম প্রথমে উল্লেখিত। সমীকরণটি হল―
হকিং বিকিরণ কী? কীভাবে জন্মায় এ হেন রেডিয়েশন?
শূন্যস্থান কী? শূন্যস্থান একদম শূন্য নয়, বরং বিকিরণের (ফোটোন কণা) আধার যা থেকে ক্ষণিকে জন্ম নেয় একজোড়া পারটিক্যাল― একটি কণিকা ও অপরটি তার বিপরীত কণিকা। পরক্ষণেই কণিকা―বিপরীত কণিকা সংযুক্ত হয়ে একজোড়া ফোটোন কণিকা ওরফে আলোক স্ফুলিঙ্গ (বিকিরণ) তৈরি করে। চক্রবৎ বিকিরণ থেকে কণিকা ও কণিকা থেকে বিকিরণে পরিবর্তন প্রতি মূহুর্তে ঘটছে শূন্যস্থানের ভেতর। 

এই একজোড়া কণিকার একটি পরা (ধনাত্মক) শক্তি সম্পন্ন ও অপরটি অপরা (ঋণাত্মক) শক্তি সম্পন্ন। অপরা শক্তির কণিকা স্বল্পায়ু হয়। কারণ বাস্তব সব কণাই স্বাভাবিক অবস্থায় ধনাত্মক শক্তি সম্পন্ন। এখন কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের খুব নিকটস্থ শূন্যস্থানে বিকিরণ থেকে একজোড়া কণিকা তৈরি হলে তার তিনটি সম্ভাবনা থাকে―
এক, কণিকাদুটি তৈরি হল ও জোড়া লেগে বিকিরণ উৎপন্ন করে পুনরায় ধ্বংস হয়ে গেল।

দুই, কণিকাদুটি তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাকহোলের অসীম মহাকর্ষজনিত টান তাদের জোরপূর্বক টেনে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। তারা আর বাইরে বের হতে পারল না। অর্থাৎ তাদের সলিলসমাধি ঘটল।

তিন, একজোড়া কণিকার মধ্যে অপরা শক্তির কণিকাটিকে ব্ল্যাকহোল তার ঘটনা দিগন্তে ঢুকিয়ে নিল। কিন্তু পরা শক্তির কণিকাটিকে সে ধরতে পারল না। এই পরা শক্তি সম্পন্ন কণিকা তীব্র বেগে ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্ত থেকে ছুটে দূরে পালিয়ে গেল। আর পালানোর সময় সে যতটা বেশি সম্ভব ব্ল্যাকহোলের শক্তি ঘটনা দিগন্ত থেকে চুরি করে নিয়ে গেল। ব্ল্যাকহোলের বাইরে অবস্থিত কোন পর্যবেক্ষক দেখবে কণিকাটি যেন কৃষ্ণগহ্বর থেকে নির্গত হল। এ হেন কণিকা (ফোটোন কিংবা বাস্তব কণিকা)-র স্রোত হল কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণ বা হকিং রেডিয়েশন। আইনস্টাইনের {E = mC^2} সমীকরণ মেনে এই নিঃসৃত বিকিরণ ব্ল্যাকহোলের ভর ও ঘূর্ণন ক্ষমতা ক্রমশ কমিয়ে দেয়। এই ঘটনা 'ব্ল্যাকহোল এভাপোরেশন' (কৃষ্ণগহ্বর বাষ্পীভবন) নামে পরিচিত। এর ফলস্বরূপ ভর কমতে কমতে একসময় কৃষ্ণগহ্বরটি ভ্যানিশ হয়ে যাবে। অবশ্য এর জন্য কৃষ্ণগহ্বরের ১০^৬৬ বছর সময় লাগবে। এখন ব্রম্ভাণ্ডের বয়স সবেমাত্র ১৩.৮ ×১০^০৯ বছর। তাই সে-ক্ষণ আসতে এখনও অনেক দেরী। তার আগে মহাজগতে গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি ইত্যাদি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে কিছু ব্ল্যাকহোল। সেটা 'ব্ল্যাকহোল যুগ' (১০^৪০ ― ১০^১০০ বছর সময়কাল)। 

পুনশ্চ, আদিম কোন কৃষ্ণগহ্বরের ভর যদি একশো কোটি টন হয়, তবে তার আয়ু মহাবিশ্বের বর্তমান সময়ের সমান হবে। অর্থাৎ ইতিমধ্যে হয়ত সেটি উবে গেছে, নয়ত বড় কোন রাঘববোয়াল তাকে গিলে খেয়েছে।

Post a Comment

0 Comments