পূর্ব-মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
পর্ব-১
বি ম ল ম ণ্ড ল
কোনও ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোটো ছোটো দলে বা অঞ্চল বিশেষে প্রচলিত ভাষা ছাঁদই হল উপভাষা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত কথ্যভাষাগুলি অঞ্চল ভেদে কিছু স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। এই স্বাতন্ত্র্যের দিকে লক্ষ্য রেখে ভাষা তাত্ত্বিকরা বাংলা ভাষায় প্রচলিত উপভাষাগুলিকে পাঁচটি উপভাষা অঞ্চলে বিভক্ত করেছেন। যেমন- রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, বঙ্গালী,কামরূপী, ঝাড়খণ্ডী। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কথ্যভাষা রাঢ়ী উপভাষার অন্তর্গত। তবে আজকের পরিবর্তিত আর্থ - সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য জেলায় কথ্যভাষার ন্যায় পূর্ব- মেদিনীপুর জেলার কথ্যভাষাও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে। এই জেলার পূর্বদিকে বঙ্গোপসাগর বেষ্টন করে রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে জেলার জন-জীবিকার উপর সমুদ্রের একটা আলাদা গুরুত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া ব্রিটিশ আমলে এই জেলারই খেজুরী বন্দরকে কেন্দ্র করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্যের একটি আদান-প্রদান প্রচলিত চলছিল। পরবর্তীতে শুধু খেজুরী বন্দর নয়, জেলার সমুদ্র - উপকূলবর্তী অন্যান্য অঞ্চলেও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থানুকূল্যে এই জেলার দীঘা সন্নিকটস্থ শংকরপুরে একটি মৎস্য বন্দর গড়ে উঠেছে।
এই মৎস্যজীবী সম্প্রদায় জেলার অন্তর্গত দীঘা, রামনগর, কাঁথি, খেজুরী, নন্দীগ্রাম, হলদিয়া,
সুতাহাটা, মহিষাদল প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করেন। হিন্দু - মুসলিম উভয় সম্প্রদায় এই জীবিকার সাথে যুক্ত আছেন। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের ভাষা ব্যবহারে এই জীবিকা প্রভাব বিস্তার করে। আবার ভৌগোলিক দিক থেকে উড়িষ্যা এই জেলার নিকটবর্তী হওয়ায় জেলার কথ্যভাষায় ওড়িয়া ভাষার প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। শুধু তাই নয় নব গঠিত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সঙ্গে এই জেলার একটা যোগাযোগ রয়েছে। এই সূত্র ধরে হিন্দি ভাষার সঙ্গে এই অঞ্চলের কথ্যভাষার সংযোগ রয়েছে। আবার এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে খোট্টাভাষার প্রচলন রয়েছে। বহুবিধ সংযোগে জেলার কথ্যভাষার রূপ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ বিশেষ প্রয়োজন।আমি তাই কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে ভাগ করে এই জেলার কথ্যভাষা বিশ্লেষণের পরিকল্পনা করেছি তা হলো নিম্নরূপ :-
প্র থ ম অ ধ্যা য়
পূর্ব- মেদিনীপুর জেলা ও জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের সাধারণ পরিচয় :-
পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম জেলা ছিল মেদিনীপুর, লোকসংখ্যাও এই জেলায় সর্বাধিক। অন্যান্য জেলার তুলনায় আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম বলে এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধাএ জন্য ২০০১ সালে ১লা জুন এই জেলাটিকে দু'ভাগে বিভক্ত করে তাদের নামকরণ করা হয় - পূর্ব-মেদিনীপুর ও পশ্চিম- মেদিনীপুর। তবে পশ্চিম- মেদিনীপুর জেলার তুলনায় পূর্ব -মেদিনীপুর জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি। বর্তমান অধ্যায়ে পূর্ব- মেদিনীপুর জেলা ও জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের সাধারণ পরিচয় নিম্ললিখিত চিন্তাসূত্রের মাধ্যমে আলোচনা করছি—
১.অবস্থান:-
পূর্ব -মেদিনীপুর জেলার ভৌগোলিক আয়তন প্রায় ৪১৫১,৬৪ কি.মি.। এই জেলা কাঁথি, হলদিয়া, তমলুক, এগরা মহাকুমা নিয়ে গঠিত। এই জেলার মোট জনসংখ্যা - ৪৬,৮৬,০৮১ জন (বিগত ২০০১ সালে আদম শুমারি অনুসারে) এই জেলার অক্ষাংশ- ২১.৯৪° উত্তর ও দ্রাঘিমাংশ - ৮৭.৭৭° পূর্ব।
এই জেলার উত্তরে হাওড়া জেলা, পূর্বে - হুগলী নদী ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে পশ্চিম- মেদিনীপুর ও উড়িষ্যা রাজ্য।
পূর্ব- মেদিনীপুর জেলা অন্যান্য জেলার মতোও একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে। এ ইতিহাস যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত, ঠিক তেমনই আর্থ- সামাজিক, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ও এর একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই জেলার ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল।
পূর্ব - মেদিনীপুর জেলা কৃষি ও শিল্প দুই ক্ষেত্রেই যথেষ্ট অগ্রসর। এই জেলায় অবস্থিত হলদিয়া শিল্পাঞ্চল দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্পাঞ্চল। এই জেলার দীঘা, মান্দারমনি, তাজপুর-সমুদ্র সৈকতগুলি পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণীয়।
এই জেলায় চারটি মহাকুমা, ২৫টি ব্লক, ৩১৪৫টি মৌজা, পৌরসভার সংখ্যা-৫টি। যথা- কাঁথি,এগরা,তমলুক,হলদিয়া,পাঁশকুড়া। গ্রাম পঞ্চায়েতের সংখ্যা-২২৬টি।
কাঁথি মহাকুমা মাছ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই মহাকুমা প্রায় ১০% অধিবাসী এখানকার মৎস্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কাঁথি মহাকুমা ছাড়াও তমলুক মহাকুমায় প্রায় ১৫% মানুষ কোন না কোন ভাবে মৎস্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। হলদিয়া ও কোলাঘাটে প্রায় ২০% মানুষ মৎস্যচাষের উপর নির্ভরশীল। পূর্ব-মেদিনীপুর জেলাবাসীর জীবনে নদীর প্রভাব অল্প নয়। তমলুক, কাঁথি, হলদিয়া, রামনগর, খেজুরী প্রভৃতি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এক সময় ব্যবসায়ীরা মাল বোঝাই নৌকা নিয়ে রূপনারায়ণ ও সুবর্ণরেখা নদীতে যাতায়াত করতেন। বর্তমানে হলদি নদীর মোহনাতে গড়ে উঠেছে হলদিয়া বন্দর। এই জেলার দুটি প্রধান নদী রূপনারায়ণ ও সুবর্ণরেখা। কলকাতা থেকে দীঘার দুরত্ব ১৮৭ কিমি.। দীঘার কাছে নিউ দীঘাতে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য রয়েছে অমরাবতী লেক, মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম আর সর্পোদ্যান। (চলবে)
প্রতি শুক্রবার নিয়মিত প্রকাশ পাবে এই ধারাবাহিকটি।
মতামত জানাতে পারেন।
jaladarchi@yahoo.in
3 Comments
ভালো তথ্যবহুল লেখা। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteকৃতজ্ঞতা জানাই। মনের লুকিয়ে রাখা একটা বাসনা পূর্ণ হতে চলছে। কেননা একবার১৯৭৫সালে দীদার হোটেলে,, একবার ১৯৮৪/৮৫ সালে কিছু মেদিনীপুর এর বাসিন্দাদের সাথে তিন দিন , কাটিয়ে ছিলাম। আর-একবার কন্টাই( কাঁথি) তে
ReplyDeleteএক শিক্ষক মহাশয়ের বাড়িতে সাতটি দিন। অন্য বার বর্ধমান ইউনিভার্সিটি।।
প্রতি ক্ষত্রেই একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার সাথে কথাবার্তা, বইয়ের ভাষা।। অথচ নিজেদের মধ্যে কথপোকথন এর বিন্দু বিসর্গও বুঝতে পারিনি কখনো।
তাই।
পরে আবারও বলবো।
সতত সবার শুভকামনা জানালেম
দীঘা / হবে দীদা ন।।
ReplyDelete