পর্ব-১২
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত
সু দ র্শ ন ন ন্দী
১৮৮৩, ২৭শে মে ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর আহারান্তে বিশ্রাম করছেন। কীর্তনিয়া মনোহরসাঁই গোস্বামী উপস্থিত হলেন।
শুরু হল কীর্তন। প্রথমেই গৌরচন্দ্রিকা কীর্তন। “করতলে হাত -- চিন্তিত গোরা -- আজ কেন চিন্তিত? -- বুঝি রাধার ভাবে হয়েছে ভাবিত।”
গোস্বামী এবার গান গাইছেন:
ঘরের বাহিরে, দণ্ডে শতবার তিলে তিলে আসে যায়
কিবা মন উচাটন, নিশ্বাস সঘন, কদম্ব কাননে চায়...
গানের এই লাইনটি শুনে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মহাভাবের অবস্থা হল। গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেললেন। এবার কীর্তনিয়া যখন গাইছেন:
শীতল তছু অঙ্গ।
তনু পরশে, অমনি অবশ অঙ্গ!
মহাভাবে ঠাকুরের কম্প হইতেছে!
তখন ঠাকুর কীর্তনের সুরে বলছেন, “প্রাণনাথ, হৃদয়বল্লভ তোরা কৃষ্ণ এনে দে; সুহৃদের তো কাজ বটে; হয় এনে দে, না হয় আমায় নিয়ে চল; তোদের চিরদাসী হব।”
পরের গানে আসি। সেদিন সোমবার, ইংরেজী ৪ঠা জুন, ১৮৮৩। জ্যৈষ্ঠ, কৃষ্ণা চতুর্দশী। সাবিত্রী চতুর্দশী। আবার অমাবস্যা ও ফলহারিণী-পূজা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে নিজ মন্দিরে বসে আছেন। ভক্তেরা তাঁকে দর্শন করতে এসেছেন। মাস্টার আগেরদিন রবিবারে এসেছেন। ওই রাত্রে কাত্যায়নীপূজা। ঠাকুর প্রেমাবিষ্ট হয়ে নাটমন্দিরে মার সম্মুখে দাঁড়িয়ে, বলছেন, “মা, তুমিই ব্রজের কাত্যায়নী, বলে গান ধরলেন:
তুমি স্বর্গ, তুমি মর্ত মা, তুমি সে পাতাল।
তোমা হতে হরি ব্রহ্মা, দ্বাদশ গোপাল......
ঠাকুর গান করছেন, প্রেমে একেবারে মাতোয়ারা! মাঝরাত পর্যন্ত মার নাম হয়েছিল সেদিন।
এই গানটির রচয়িতা অজ্ঞাত। গানটি আরও বিস্তৃত। কথামৃতে ছয়বার গানটির উল্লেখ পাই। ঠাকুর ছাড়াও বৈষ্ণবচরণ এবং অন্য বালিকাদের কণ্ঠে কাশীপুর উদ্যানে শুনতে পাই গানটি।
১০ইজুন ১৮৮৩। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে নিজের ঘরে ভক্তদের সাথে কথা বলছেন । ঠাকুর ছেলেবেলার কথা বলেছেন। বলতে বলতে রামলালকে গান গাইতে বললেন। রামলাল প্রথম গান গাইলঃ
কে রনে নাচিছে বামা নীরদ বরণী,
শোণিত সায়রে যেন ভাসিছে নব নলিনী।
গানটির রচয়িতা শ্রীনাথ। এই গানটি রামলালকে তিনবার গাইতে দেখি।
দ্বিতীয় গানটি দাশরথি রায়ের রচনা। গানটি হলঃ
কি করলে হে কান্ত ! অবলারি প্রাণ কান্ত,
হয় না তাহা শান্ত এ প্রাণান্ত বিনে...
ঠাকুর গান শুনে বললেন এ গান আমি মাঝিদের গলায় শুনে কেঁদেছি কত !
পরের গানটি রামলাল গাইলেন দাশরথি রায়ের রচনা থেকেঃ
শুনেছি রাম তারক ব্রহ্ম, মানুষ নয় রাম জটাধারী।
পিতা কি নাশিতে বংশ, সীতে তার করেছ চুরি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ঐদিন বেলঘরিয়ার একজন গায়কও ঠাকুরের ইচ্ছায় একটি রামপ্রসাদী গেয়েছিলেন। সেটি হলঃ
ছুঁসনে রে শমন আমার জাত গিয়েছে।
যদি বলিস ওরে শমন জাত গেল কিসে...
পরের উল্লেখিত দুটি গান রামপ্রসাদ সেনের। ১৮৮৩, ১৭ই জুন দক্ষিণেশ্বরে ভক্তদের সাথে কথা বলতে বলতে গাইলেন ঠাকুর। প্রথম গানটি গাইলেন কর্মফল নিয়ে কথাপ্রসঙ্গে ।
গাইলেন:
মন রে কৃষি কাজ জানো না।
এমন মানব-জমিন রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলত সোনা......
এই গানটি ঠাকুরের কণ্ঠে দুবার গাইতে দেখি, আরেকবার দেখি এক ভক্তের সাথে মাস্টারকে গাইতে।
দ্বিতীয় গানটি গাইলেনঃ
শমন আসবার পথ ঘুচেছে, আমার মনের সন্দ ঘুচে গেছে।
ওরে আমার ঘরের নবদ্বারে চারি শিব চৌকি রয়েছে......
গেয়ে ঠাকুর বললেন, কাশীতে ব্রাহ্মণই মরুক আর বেশ্যাই মরুক শিব হবে।যখন হরিনামে, কালীনামে, রামনামে, চক্ষে জল আসে তখনই সন্ধ্যা-কবচাদির কিছুই প্রয়োজন নাই। কর্মত্যাগ হয়ে যায়। কর্মের ফল তার কাছে যায় না।” ভক্তরা একমনে সেই অমৃতসুধা পান করছেন।
এছাড়া এদিন পূর্বে উল্লেখিত আরও দুটি গান গেয়েছিলেন ঠাকুর।
_________________________________________
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক।
নজর রাখুন - www.jaladarchi.com
মতামত দিতে পারেন - jaladarchi@yahoo.in
0 Comments