জ্বলদর্চি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : নীললোহিতের মায়াময় জগৎ


Sunil Gangopadhyay: The enchanted world of Nillohit

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : নীললোহিতের মায়াময় জগৎ


প্র শা ন্ত  ভৌ মি ক

‘নীলুটা আর মানুষ হল না!’- নীললোহিতের আশেপাশের মানুষেরা ঠিক এভাবেই তাঁর সম্পর্কে বলে থাকেন। কিন্তু নীললোহিতের তো মানুষ হওয়ার প্রয়োজনই নেই। সে তার মত থাকতেই ভালবাসে। বলছি নীললোহিত সম্পর্কে, যার ডাক নাম নীলু।
পরিবারে আছেন মা, দাদা আর বৌদি। আর আছে কিছু বন্ধু। সবার মধ্যে থেকেও যেন নীলু আলাদা। মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায় দিকশুন্যপুরে। পাঠকেরাও নীললোহিতের সঙ্গে মজে গিয়ে বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চার করে আসতে পারেন।  
তবে নীললোহিত নিজের নামে কাহিনি লিখলেও নিজেকে লেখক বলতেই নারাজ। ‘নীললোহিত সমগ্র প্রথম খণ্ড’-এর ভূমিকা থেকে- “আমি কি লেখক? লেখকরা তো হন অতি দূরদর্শী, অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তিসম্পন্ন, অথবা মহাপণ্ডিত। লেখকরা ইচ্ছে মতন কত নারী-পুরুষদের চরিত্র সৃষ্টি করেন, তাদের জীবন-মৃত্যু লেখকের কলমের ডগায় কাঁপে। লেখকরা খুব সাধারণ ব্যাপারকেও অসাধারণ করে তুলতে পারেন। তাঁরা অতীতকে ফুটিয়ে তোলেন বর্তমানে, আর বর্তমানকে পাঠিয়ে দেন ভবিষ্যতে। আমার সেরকম কোনো ক্ষমতাই নেই। আমি নিছক ঘুরে ঘুরে বেড়াই, কলকাতা শহরে মাঝে মাঝে আমার দম আটকে যায়, এখানে বড় রকমের কোন সমস্যা দেখলেই পালিয়ে যাই জঙ্গলে-পাহাড়ে, ট্রেন থেকে নেমে পড়ি কোনো অখ্যাত স্টেশনে। কখনো লুকিয়ে থাকি দিকশুন্যপুরে।”
একই লেখায় লিখেছেন- “লেখক নই, তবু কিছু কিছু লিখি, পাঠকদের জন্য নয়, নিজের জন্য। দু’একজন প্রকাশক তা ছাপিয়ে দেন, আমার খুব লজ্জা করে। বাংলা ভাষার বড় বড় লেখকদের পাশে, আমি কে? চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রদের পাশে এক জোনাকি!”
নীললোহিত রচিত বইয়ের সংখ্যা কত? বেশ কিছু প্রকাশনী ঘুরেও এর সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে ‘দে’জ পাবলিশিং’ প্রকাশ করেছে ‘নীললোহিত সমগ্র’-এর আটটি খণ্ড। এতে সব গল্প কিংবা উপন্যাস নেই নীললোহিতের। এখানে রয়েছে ৩১টি উপন্যাস। এছাড়াও বিভিন্ন পুজো সংখ্যায় ছাপা হওয়া আরো দশটির অধিক গল্প এবং উপন্যাসের হদিস পাওয়া যায়।
নীললোহিতের কাহিনির বিশেষত্ব কী? সত্যি বলতে, কোন বিশেষত্ব না থাকাটাই নীললোহিতের কাহিনির বিশেষত্ব। নীললোহিত ২৭ বছরের এক যুবক, বেকার। যদিও সে নিজেকে বেকার ভাবে না। সে মনে করে তার জন্মই হয়েছে এভাবে ঘুরে বেড়াবার জন্য। তার দাদা তার এই বাউন্ডুলেপনা ঠিক মেনে না নিলেও বৌদি তাকে এই ব্যাপারে উৎসাহ যুগিয়ে যায়। বৌদিও মনে করে নীললোহিতের জন্ম হয়েছে উড়ে বেড়াবার জন্য।
অধিকাংশ গল্পেই দেখা যায়, নীললোহিত শহর থেকে একপ্রকার পালিয়েই চলে যায় দিকশুন্যপুর। যখনই শহরে কোন সমস্যা দেখা দেয়, কিংবা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে ওঠে নীললোহিতের মন, তখনই চলে যায় সে দিকশুন্যপুর।
দিকশুন্যপুরে যারা যায় তারা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে যায়, অধিকাংশই আর ফিরে আসে না। নীললোহিতই ব্যতিক্রম শুধু। সে সেখানে যায়, আবার ফিরে আসে। তবে কাউকেই সে ঠিকানা দেয় না দিকশুন্যপুরের। সেখানে বন্দনাদি আছে, বসন্ত রাও আছে, জয়দীপ আছে, রোহিনী আছে। দিকশুন্যপুর গিয়ে নীলু ঠিক তাদের একজন হয়ে যায়। আবার ফিরেও আসে একসময়। নীললোহিতের গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়, প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই একেকটা দিকশুন্যপুরের প্রয়োজনীয়তা আছে। সবারই পালিয়ে যাওয়ার মত একটা আশ্রয় থাকা উচিত।  
নীললোহিত ছদ্মনামে উপন্যাসগুলো লিখেছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধিক জায়গায় তিনি লিখেছেন, অন্নসংস্থান করার জন্য একসময় ওনাকে পত্রিকায় অসংখ্য লেখা লিখতে হয়েছে। একই পত্রিকায় হয়ত একই দিনে তিন-চারটে লেখাও লিখেছেন তিনি। সেসব লেখা একজনের নামে ছাপা হলে লোকে পড়বে না, কিংবা পত্রিকার তরফেও হয়ত বাঁধা ছিল। তাই একাধিক নামে তিনি লিখে গেছেন। নীললোহিত ছদ্মনামে লিখেছেন বাউন্ডুলেপনার গল্প। এই ভাবেই জন্ম হয়েছেন নীললোহিত শিরোনামের এই চরিত্রের। এক সময় তো পুজো সংখ্যায় নীললোহিত ছাড়া ভাবাই যেত না।
সুনীলপত্নী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন- “সবাই তো বলে সুনীল দিকশুন্যপুরে চলে গেছে। সত্যিই কোথায় হারালো!”

Post a Comment

0 Comments