জ্বলদর্চি

স্মৃতি থেকে যায় / সমরেশ মজুমদার

The memory remains
Samaresh Majumdar

স্মৃতি থেকে যায়  

সমরেশ মজুমদার 


আমরা তখন বিমল করের কার্জন পার্কের আড্ডায় নিয়মিত ঢুঁ মারছি। এর দুটো কারণ ছিল। বাংলা সাহিত্যের ছােটগল্প, নতুন রীতির জনক ছিলেন বিমল কর। কল্লোল গােষ্ঠীর আমল থেকে যে ধরনের ছােটগল্প লেখা হয়ে আসছিল তা থেকে বেরিয়ে এসে অতি আধুনিক ফর্মে ছােটগল্প লিখেছেন বিমল কর। 

লেখার ব্যাপারে অমন খুঁতখুতে লেখক আমি কখনও দেখিনি। লাইনের পর লাইন যত্ন নিয়ে লেখার পরেও ছিঁড়ে ফেলতেন। ঘটনার ঘনঘটার বদলে মানুষের মন নিয়ে তাঁর লেখায় অপূর্ব সমীক্ষা থাকত যা আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। পাশাপাশি, যে কথা কেউ মুখে উচ্চারণ করত না, আড্ডায় যাওয়ার পেছনে সেটাও একটা কারণ ছিল। বিমল কর 'দেশ' পত্রিকার গল্প নির্বাচন করতেন। তরুণ গল্পকাররা ভাবত নিত্য দেখাশােনা হলে নির্বাচিত হতে সুবিধে হবে। কিন্তু এই ব্যাপারে বিমল কর কখনই আপস করেননি। গল্প পছন্দ না হলে তৎক্ষণাৎ ফেরৎ পাঠিয়ে দিতেন। 

একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। 

দীর্ঘকাল ছােটগল্প লিখে পরিচিত একজন প্রবীণ লেখক, যিনি আড্ডায় আসতেন, 'দেশ'-এ গিয়ে গল্প জমা দিয়েছেন। সেই গল্প পড়ে বিমলদা ফেরৎ নিয়ে যেতে বললেন। লেখক ঘাবড়ে গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতে বিমলদা বললেন, 'তােমার নায়ক তার নিজের কাকিমার সঙ্গে বিছানায় শুচ্ছে, কোনও দরকার ছিল? লেখক পরের দিনই আর একটা গল্প এনে বললেন, 'এবার দেখুন।' দেখা গেল, কাকিমার বদলে বউদি করে দেওয়া হয়েছে। লেখকের যুক্তি এটা রবীন্দ্রনাথও করেছেন। বিমলদা জবাব দিয়েছিলেন, 'আগে রবীন্দ্রনাথ হও তারপর এই গল্প ছাপবাে।'

পছন্দসই কয়েকজনের সঙ্গে কে সি দাসের দোকানে চা খেয়ে কার্জন পার্কে বসতেন বিমলদা আড্ডা মারতে। অপরিচিত কোনও নতুন লেখক আচমকা এসে গেলে অস্বস্তিতে পড়তেন। সবিনয়ে বলতেন, 'আমরা এখন এ্যাডাল্ট কথাবার্তা বলব, আপনি অন্য কোনওদিন আসতে পারেন।'

খুব ঘরকুনাে, নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে না যাওয়া, আদ্দির পাঞ্জাবি ধুতি পরা মানুষটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। সিগারেট খেতাে খুব কিন্তু মদ স্পর্শ করেননি। একদিন আমাদের বললেন, 'কাল বাড়িতে এসাে, তােমাদের মদ খাওয়াবোই।'

'মদ? কোথায় পেলেন?'

'হুঁ হুঁ। একজন একটা বােতল দিয়ে গিয়েছে। এসাে কিন্তু।'

পরের দিন বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অভ্র রায়, সুধাংশু ঘােষ, সত্যেন্দ্র আচার্যের সঙ্গে আমি পৌঁছে গেলাম ওঁর সল্টলেকের বাড়িতে। ভালো ভালো খাবার খাওয়ালেন। বললেন, 'খালি পেটে মদ খাওয়া ঠিক নয়।' 

সেসব খাওয়ার পর গ্লাস এল, তাতে অর্ধেক জল ঢালা হল। বরেনদা বললেন, 'আগে জল কেন, আগে তাে হুইস্কি
দেবেন।'

'একই হল।' বলে পকেট থেকে হােমিওপ্যাথির চেয়ে একটু বড় শিশি বের করে তার ছিপি খুলে প্রত্যেক গ্লাসে কয়েক ফোঁটা ঢেলে বললেন, 'বুঝেসুঝে খাবি, যেন নেশা না হয়ে যায়!'
 
আমরা হাঁ হয়ে গেছি। বরেনদা সাহস করে বলেছিলেন, 'ইস, খুব ভুল হয়ে গেল। আজ শক্তিকে নিয়ে এলে ও খুব খুশী হত।' তারপর গ্লাস তুলে চেঁচিয়ে বলেছিলেন ‘চিয়ার্স!'

Post a Comment

1 Comments