জ্বলদর্চি

উদ্ভিদনামে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামনাম (পর্ব - ৩)/ ভাস্করব্রত পতি

The plant name is the village name of East Midnapore (Episode - 3)

উদ্ভিদনামে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামনাম 
(পর্ব - ৩)

                         ভা স্ক র ব্র ত  প তি

কলা  -- সারা ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ফলের মধ্যে কলা অন্যতম। স্বভাবতই কলাকে আশ্রয় করে গ্রামনাম হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন- কলাতলা, কলাবনি, কলাগেছিয়া, কলাবেড়িয়া ইত্যাদি। কলাকে অসমীয়াতে মেয়জ, ফারসিতে মাঙ্গ, ওড়িয়াতে বেন্তল, তেলুগুতে অরিতি, চন্দ্রাকেলি, গুজরাটিতে কেন্য, হিন্দিতে কেরা, কেলা, তামিলে বাঠেঠ, রম্ভ, হুগালী, সংস্কৃতে কদলী নামে পরিচিত। এর পাশাপাশি কলার পরিচিতি সুকুমার, লােচক, রেচক, মােচকত্রয়, সকৃৎফলা, অংশুমফলা, সুফলা, চর্মণ্বতী, বালকপ্রিয়া, গুচ্ছদন্তিকা, বারবুযা, বারনবল্লভা, রাজেষ্টা, নিঃসারা, ভানুকলা, বনলক্ষী, গুচ্ছ ফল, হস্তিবিষাণী, বারণবুসা এবং উরুস্তম্ভা নামেও। 

কলার বিজ্ঞানসম্মত নাম Musa sapientum। এটি Musaceae পরিবারভুক্ত। ভারত, মালয় ও সিঙ্গাপুরে প্রায় ৮০ প্রজাতির কলাগাছ হয়। মুখেলি, রসখেলি, পাছা, বেঙ্গলা, যেন্নেপানিয়ামনে পিদিমোথে, বজেলি, রসরই, বেসকেলি, কনকধোল, বরৎমানি, সিঙ্গাপুরি, গণ্ডি, মর্তমান, জাহাজি, ভোট মনুহর, ভীমকলা, মালভোগ, পে, কাঁঠিলা, পেবেলি, যমেই, সেবেল্লিবন্দে, সেরবা, লোঘণ্ডি, করঞ্জেলি, নরসিঙ্গি, সোনকেলি, সয়াকলা, মদনী, মদনা, দয়েকলা, পোড়া রঙ্গবীর, রঙ্গবীর, তুলসী, বিচাকলা, কাঁচকলা, ডোগরেকলা, মনুয়া, মনুহর, ছেনিচম্পা, পুরা, দাঘজোয়া, জেপা আঠিয়া ইত্যাদি নামের কলার সন্ধান মেলে!

কথায় কথায় আমরা বলে থাকি 'আলােচাল, বেঁড়ে কলা / খাও না ঠাকুর, এই বেলা'। অমৃতলাল বসু 'রাজা বাহাদুর'-এ লিখেছেন 'কলা খেল যেত বান্দর/রাজ্য পেল রামচন্দর'। তা ছাড়া 'কলা দিয়ে পােলা ভােলানাে', 'কলা দেখানাে' ইত্যাদি প্রবাদ প্রবচনগুলি সমধিক জনপ্রিয় গ্রামাঞ্চলে। গ্রামের দিকে আরেকটি প্রথার বেশ চল রয়েছে কলাকে কেন্দ্র করে। যাঁদের বিয়ে হয় না বা আইবুড়াে, তাঁদের 'আইবুড়াে' নাম খণ্ডনের জন্য কুলীন কন্যাদের কলাগাছের সাথে সাথে আগে বিয়ে দেওয়া হত। যাঁদের পর পর দুই স্ত্রীর মৃত্যু হয় তাঁদের তৃতীয়বার বিয়ের আগে যাতে অমঙ্গলে ছেদ পড়ে, সেজন্য কলাগাছের সাথে কাল্পনিক বিবাহ করানাে হত। আর দুর্গা পূজার সময় 'নবপত্রিকা' তৈরি হয় কলাগাছ দিয়ে। বধূর মতাে বস্ত্রাচ্ছাদিত ও অবগুণ্ঠনরতা করা কলাবউ রাখা হয় গণেশের পাশে। গিরিশ ঘােষের 'বলিদান'-এ মেলে 'নেহাত কলাবউয়ের মতাে যে বসে থাকবে, তাতে আমি নারাজ'। অতি পরিচিত কলাগাছকে কেন্দ্র করে যে এলাকার পরিচিতি গড়ে উঠেছে তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকেনা।
আম -- আমকে কেন্দ্র করে পাই আমগেছিয়া, আম্বি আমতলিয়া, আমতলা, আমগেছা, আমডুবি গ্রামনামগুলি। আম এখন অত্যন্ত অর্থকরী ফসল। হয়তাে মালদা-র মতাে আম এখানে ফলেনা। তবুও যথেষ্ট পরিমাণে আমগাছ রয়েছে জেলায়। আমাদের আলােচিত এই আমকে ওড়িয়াতে আম্বতাম্ব, অসমিয়াতে অম্বজ, ফার্সিতে আম্বা, কন্নড়ে মাবিন ফল, গুজরাটিতে আম্বাে, সংস্কৃতে আম্র, আম্রতাম্র, চ্যুত, মারাঠীতে আম্বা, আঁবা এবং তেলুগুতে মাবিডি বলা হয়। 

'অ-য় অজগর আসছে তেড়ে / আ-য় আমটি আমি খাবাে পেড়ে' - ছড়াটি তাে ভােলার নয়। জনপ্রিয়তার নিরিখে আমের তাই অসংখ্য নাম—শ্রীপ্রিয়, পিকপ্রিয়, নৃপপ্রিয়, অনিপ্রিয়, কামশর, কান্তদূত, মাধবদ্রুম, কামবল্লভ, মধুলী, মদিরাসখ, ভৃঙ্গাভীষ্ট, সীধুরস, কোকিলােৎসব, মদাঢ্য, কামাঙ্গ, মধ্বাবাস, ষটপদাতিথি, পিকরাগ, প্রিয়াম্বু, সুমদন, রসাল, মন্মথালয়, মাকন্দ, অম্লফল, চুত, কীরেষ্ট, বসন্তদ্রু, মধুদ্রত, গন্ধবন্ধু, অম্র, কোকিলাবাস ইত্যাদি। অ্যানাকার্ডিয়াম' গােত্রভুক্ত আমের ল্যাটিন পরিভাষার নাম MANGIFERA INDICA | 

আমড়া -- আগেই উল্লেখ করা হয়েছে আম সম্পর্কে। সুদূর পলিনেশিয়া থেকে আগত আমড়া অবশ্য ভিন্নতর ফল। যদিও নামের মিল রয়েছে কিছুটা। অম্লপ্রিয় পূর্ব মেদিনীপুরবাসীর কাছে বেশ আগ্রহের ফল - আমড়া। এই আমড়া কাঠের ঢেকি হয়তাে হয়না। কিন্তু গ্রামনাম হয়। যেন—আমড়াগাছিয়া, আমড়াতলিয়া, আমড়াতলা, আমড়াগোয়াল ইত্যাদি।
আমড়া + তলা > আমড়াতলা > আমড়াতলিয়া আমড়া + গােয়াল > আমড়াগােয়াল 
অর্থাৎ গােয়ালঘরের পাশে থাকা আমড়াগাছ যে এলাকার পরিচিতি জ্ঞাপক চিহ্ন। 

কেউ কেউ আমড়াকে আম্রাত, পীতনক, কপিচূড়া, আম্রাবর্ত, রসাঢ্য, কপিচূড়, অম্বরীয়, পীতন, বর্ষপাকী, ভৃঙ্গীফল, অম্বরাতক, তনুক্ষীর এবং অভ্রবাটিক নামে অভিহিত করেছেন। তবে সংস্কৃতে আম্রাতক, হিন্দিতে আম্বাড়া, তামিলে মরিমঞ্চেতি, ওড়িয়াতে আম্বড়া এবং তেলুগুতে টেরিমনোডী অর্থে আমড়াই বােঝায়। ল্যাটিন পরিভাষায় আমড়াকে বলা হয় SPONDIAS MANGIFERA। ইংরেজিতে বলে Wild Mango বা Hog pulm। তবে বিলিতি আমড়াকে বলে Otaheite apple তথা Spondias dulcis। 

চালতা -- টক জাতীয় ফলের সংসারে আমড়ার সাথেই উচ্চারিত হবে ডাইলেনিয়েসী গােত্রভুক্ত DILLENIA INDICUS বা চালতা-র নাম। খুবই স্বল্প পরিমাণ গাছ এখন রয়েছে। জেলায় এই চালতাকে কেন্দ্র করে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে -- 'পাঁচ ভাই তাঁর আঁকাবাকা / এক ভাই তাঁর শিকননাখা'। চালতার অদ্ভুত গঠনই এই প্রবাদের সৃষ্টি করেছে। 

চালতি, চালতা তলিয়া গ্রামনাম দুটি চালতার সাথে সম্পৃক্ত। একসময় অনুষ্ঠানবাড়িতে চালতার টক 'মেনু' থাকত। এখন অবশ্য তা মেলেনা। প্রথমত চালতার অপ্রতুলতা, দ্বিতীয়ত মানুষের আধুনিক রুচিতে চালতার মতাে অপাঙক্তেয় ফল ঠাঁই পায়না।

পলতা -- আমরা যাকে ‘পটল' নামে চিনি সেটাই আসলে 'পলতা' পাতা গাছ। স্বাদু সকলকেই বলে পটল বা পটোল। আসলে বহুকাল ধরে তিৎপটোল সযত্নে লালিত হওয়ায় তা স্বাদু পটলে পরিনত হয়েছে। ল্যাটিন ভাষায় TRICHOSANTHES DIOICA | বেলে দোঁয়াশ মাটিতে পটল চাষ হয় এখানে। দুধরনের পটল চাষ হয়। একটি মাটিতে পটল এবং অন্যটি ভারার পটল। পলতাবেড়িয়া নামটি পলতা থেকেই সৃষ্ট। তেমনি পটলবাড়ি নামটি পটল থেকে সৃষ্ট। প্রবাদের 'পটল তোলা'র অর্থ তো তো সবাই জানি।

ইংরেজিতে বলে Trumpet flower tree এবং Wild Snake gourd। এটি কুষ্মাণ্ডাদিবর্গ তথা কিউকারবিটেসি গোত্রের গাছ। হিন্দিতে পরাবর, কডবে পরবল, গুজরাটিতে পোঢ়ল,পটোল, তেলুগু তে কম্বু পোটলা, ফার্সিতে মোরহতী, ওড়িয়াতে পটল, তামিলে কাম্বপুদাই এবং পাঞ্জাবিতে পলওয়ান বলে। পটলকে তিক্তফল, পাণ্ডুফল, কুলক, কর্কশচ্ছদ নামেও ডাকেন শাস্ত্রকাররা। তবে 'পটোলিকা' আলাদা গাছ। ধুঁধুললতাকে বলে। এর বিজ্ঞান সম্মত নাম Luffa aegytica।

ফলসা -- পাঁশকুড়াতে পলসা বা পলশা নামে একটি গ্রামনাম রয়েছে। যার উৎপত্তি এই ফলসা থেকেই। হিন্দিতে একে বলা হয় ফালসা, পুরুষ, কন্নড়ে বেটহা, দাগলি, মারাঠিতে ফঠুঠসা, ওড়িয়াতে ফারসা, তেলুগুতে ঘ্রামণ, ফার্সিতে পালশা এবং ল্যাটিন ভাষায় XYLOCARPUS GRANATUM এবং GREWIA ASIATICA বলে। আসল নাম পুরুষ বা পরুষক। নীলঝিন্টও বলে।

এর ফলের জন্য বাগানে লাগানো হয় গাছটিকে। শীতের শেষে পঞ্চদল ফুল ফোটে। কাঁচা ফল কষা লাগে। তবে গ্রীষ্মকালে ফল পাকলে বেশ অম্লমধুর হয় এবং নীল রঙের হয়। এটি ভেষজ উদ্ভিদ। নাগদলোপম, অল্পাস্থি, পরাবত, নীলমণ্ডল, পরু, নীলচর্ম, পরুষ, মৃদুফল, নীলবর্ণ নামেও পরিচিত।

পলাশ -- উপরিউক্ত 'পলশা' গ্রামনাম কি পলাশ থেকে সৃষ্ট? উচ্চারণের বিপর্যয়ে এধরনের নামকরণ হতে পারে। তবে অবশ্য পলাশিয়া, পলাশতলা গ্রামনামগুলি পলাশ থেকেই সৃষ্ট। BUTEA FRONDOSA নামে একে চেনে উদ্ভিদ বিশারদরা।
পলাশ + ইয়া > পলাশিয়া 
পলাশ + তলা > পলাশতলা

সংস্কৃতে কিংশুক নামেই চিনি। সাঁওতালিতে মুরুপ, নেপালীতে পলাশী, বিহারীরা বলে ফরস, পরস। বেদে এই গাছের নামোল্লেখ আছে পূতদ্রু, কিংশুক, যাজ্ঞিক, বাতপোথ, পর্ণ হিসেবে। ব্রাম্ভনের উপনয়নের সময় দরকার পলাশদণ্ডের। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি অতি পবিত্র বৃক্ষ। এটির পাতার তিনটি ফলা -- যা ব্রম্ভা, বিষ্ণু, মহেশ্বর নামে কোথাও কোথাও কথিত হয়। আমেদাবাদে পলাশ পাতার থালা বাটিতে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

নিম -- কৌলিক লােকাচার 'নলসংক্রান্তি' পালিত হয় আশ্বিন সংক্রান্তিতে। কৃষিকেন্দ্রিক অন্যতম লােকাচারটি পালিত হয় জেলাজুড়েই। ধান গাছের সাধ ভক্ষণ করানােকেই বলে 'নলসংক্রান্তি'। ধানের জমিতে নলগাছের ডাল পুঁতে দিয়ে উচ্চারণ করা হয়- 'নল নল নল / মহাদেবের বােল / ধান ফোল / অ্যায় আছে কী ?/সব শনি ভূঁয়ে লুকা / অ্যায় আছে ঝােট পাট / সব শনির মাথা কাট / অ্যায় আছে সুকা / সব শনি ভুঁয়ে লুকা।" 

নলসংক্রান্তিতে দু'ধরনের নল দিতে হয়। নিরামিষ নল দিতে হয় মন্দিরে। আমিষ নল দিতে হয় জমিতে। আমিষ নলে শুকা মাছ দিতে হয়। কিন্তু দুই ধরনের নলেই দেওয়া হয় নিমপাতা, হলুদ ইত্যাদি। ওইদিন খেতে হয় নিমপাতা। আসলে জেলার মানুষের বারাে মাসের তেরাে পার্বণের সাথেও এভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়েছে। নিমগাছ জেলাবাসীর কাছে অন্যতম পবিত্র গাছ। 

মহিষাদলের নাটশাল গ্রামে রূপানারায়ণ নদের দক্ষিণ পাড়ে নিমগাছের তলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লৌকিক দেবতা বদর ঠাকুর। এখানকার নদী পথে মাঝি মাল্লারা যাওয়ার সময় বদর ঠাকুরকে স্মরণ করে চিৎকার করে—“দরিয়ার পাঁচ পীর/বদর বদর" স্বভাবতই, নিম-কে কেন্দ্র করে গ্রামনাম হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
নিম + তলা > নিমতলা
নিম + তট > নিমতট > নিমতৌড় > নিমতৌড়ি 
'তট' অর্থে উচ্চস্থান বা প্রবণ ভূমি। সংস্কৃত ‘তট’ থেকে প্রাকৃত 'তড়' এসেছে। মারাঠিতে বলে 'তড', ওড়িয়াতে 'তড়া' বলে। 'তড়' অর্থে তীর বা তট।

নিমতৌড়ি গ্রামটির অদূরেই রূপনারায়ণ নদ। বলা হয় এখন যেখানে নদী বাঁধ রয়েছে আগে অবশ্য এই নদীর বিস্তার আরও পশ্চিমদিকে বিস্তৃত ছিল। ক্রমশঃ সরে গিয়েছে। ফলে সেসময় নদীর তীরে বা তটে থাকা নিমগাছ যে এলাকার পরিচিতি হয়ে উঠেছিল তাই-ই 'নিমতৌড়ি।

নিমকে বলা হয় পারিভদ্রক, শূকমালক, পীতসারক, সর্বতােভদ্র, রাজভদ্রক, পভদ্র, সুমনা, অরিষ্ট, নিম্বক, ছর্দন, কীটক, কৈটর্য, পুয়ারি, বরত্বচ, যবনেষ্ট, অর্কপাদ, পিচুমর্দ, পক্ককৃৎ, কাকফল, নেতা, কীকট, বিশীর্ণপর্ণ, তিক্তক, পার্বত, প্রিয়শাল ইত্যাদি নামেও। 

মেলিয়ােসী গােত্রভুক্ত নিমকে ল্যাটিন পরিভাষায় AZADIRACHTA INDICA, সংস্কৃতে নিম্ব, ওড়িয়াতে লিম্ব, তেলুগুতে বেবুমমরম, ফারসিতে নেনবনীম দরখত হক এবং তামিলে বেম্বু বলা হয়। Mangosa tree বলে ইংরেজিতে। খােস পাঁচড়া হলে নিমপাতার হাওয়া খাওয়ার চল দেখা যায় আজও। 

খড়ি -- পানচাষের জন্য এই গাছ ভীষণ দরকার। তমলুক, পাঁশকুড়া, নন্দকুমার, ময়না, এলাকায় প্রচুর পরিমাণে খড়ি গাছের চাষ হয়। এই খড়ি গাছের নামেই সৃষ্ট হয়েছে খড়িপেড়িয়া এবং খড়িগেড়িয়া।
খড়ি + পেড়িয়া > খড়িপেড়িয়া
খড়ি + গেড়িয়া > খড়িগেড়িয়া
খড়ির উদ্ভিদবিদ্যাগত পরিভাষায় নাম SACCHARUM FIESCUM । এটি আখের মতােই গ্রামিনী গােত্রের অন্তর্গত। 

বেনা -- বেনা ঘাসকে হিন্দিতে বলে ‘খস'। খসরবন গ্রামনামটি 'খস-এর বন' থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলা যেতে পারে। এই গ্রামে অবশ্য প্রচুর পরিমাণে খড়ি গাছ জন্মায়। সেই হিসেবে আমরা ভাবতে পারি খড়ি-র বন থেকেও সৃষ্টি হতে পারে 'খসরবন' নামটি। কিংবা খসরন্দ গাছ বা ক্ষীরীশ গাছ থেকেও খসরবন নামের উদ্ভব হতে পারে। খসরন্দের বন থেকেও খসরবন আসতে পারে। তবে 'খসখস গাছের বন' এভাবে খসরবন গ্রামনাম সৃষ্টি হয়েছে ভাবলেও তা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। কেননা বেনা ঘাসকেই বলা হয় 'খসখস'। যদিও গুজরাটে পােস্তর বীজকে বলা হয় খসখসে। বেনা ঘাস বা খসখস-এর বিজ্ঞানসম্মত নাম ANDROPOGON SQUARROSUS। 

তেলুগুতে বেনাকে বট্টিবেল্লু, মালয়লামে ভোট্টভার, সংস্কৃতে উশীর, ধারণ, হিন্দিতে খস, মারাঠি তে বালা, কন্নড়ে বালদেবেরু বলে। এই বেনাগাছের নামেই সৃষ্টি হয়েছে বেনাগলিশা, বেনামুড়ি গ্রামনামগুলি। নদীর ধারে, জমির আলে এবং নিচুস্থানে প্রচুর জন্মায় বেনে ঘাস। জমির আর নির্নয়ের জন্য এই গাছ লাগানো হয়। বড়া সাপের নিশ্চিত আশ্রয়স্থল এই বেনাবন। জ্বালানি হিসেবে গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। উশীর, বেণীগমূলক, শিতিমূলক, জলবাস, হরিপ্রিয়, রণপ্রিয়, মৃনাল, বারণ নামেও পরিচিত শাস্ত্রে।

শর -- এটিও খড়ি বা বেনা জাতীয় গাছ। এই শরকাঠি অবশ্য এদের মতাে ততটা সহজলভ্য নয়। খড়িগাছের মতােই দেখতে শরগাছ। ক্ষুরিকাপত্র, পােটগল, মৃদুপত্র, কীচক, মৃদুপঠ, নাড়ী, শতপর্বা, নালবংশ, তৃণধ্বজ, সায়ক, ইক্ষুর, ইক্ষু, বিশিখ, উৎকট, বাণ, বংশপত্র নামেও পরিচিত শরগাছ। তেলুগুতে গুন্দ্র, সংস্কৃতে বাণ, শর, ইক্ষুর, মারাঠিতে সারন এবং হিন্দিতে কাঁড়া বলে। শহরের মতো আরেকটি গাছ আছে। তাকে খড়ি বলে। বিজ্ঞান সম্মত নাম Sacccharum fuscum। ব্রাম্ভনের পৈতের সময় এর পাতা দরকার হয়। নদীর ধারে এবং পতিত জমিতে জন্মায়। বিভিন্ন পূজাদিতে শরকাঠি ব্যবহার করেন ব্রাহ্মণ। এই শরগাছের নামেই সুষ্ট গ্রামনাম সরবেড়িয়া।
শর + বেড়িয়া > শরবেড়িয়া > সরবেড়িয়া 
শর + পাল > শরপাল 

কার্পাস -- পূর্ব মেদিনীপুরের মাটি কার্পাস চাষের উপযুক্ত নয়। কার্পাস চাষেও আগ্রহী নয় লােকজন। যদিও সাধারণত যেসব কার্পাসের দেখা মেলে, তা হল— রামকাপাস, দেবকাপাস, ওলনাকাপাস, গাছকাপাস এবং থেরোকাপাস বা তুণ্ডিকেরী।
'কার্পাস' আসলে সংস্কৃত শব্দ। বাংলায় বলি 'কাপাস'।
কার্পাস (সং) > কাপাস
কার্পাসকে তেলুগুতে পন্ডিচেট্ট, হিন্দিতে কপাস, রুই, বিনোলা, ওড়িয়াতে কপা, কন্নড়ে হত্তি, কাতহত্তি, মারাঠিতে কাপসী, কাপুস,সরকী, তামিলে পঞ্জি, ফারসিতে কুতুন, আরবিতে কতান, কুতন্ এবং গুজরাটিতে বনরুকপাস বলে। উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় কার্পাসকে চেনা যাবে GOSSYPIUM HERBACEUM নামে।
কার্পাস যুক্ত গ্রামনামগুলি হল --
কার্পাস > কাপাস + আড়া > কাপাসআড়া > কাপাসএড়্যা
কার্পাস > কাপাস + দহ > কাপাসদহ > কাপাসদা

Post a Comment

0 Comments