জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান -১৮ / তুলসীদাস মাইতি

হাজার বছরের বাংলা গান।। পর্ব-১৮

তু ল সী দা স   মা ই তি


রবীন্দ্র-গানের সূচনা ও 
নানা পর্যায়ের রবীন্দ্র-সংগীতের ভূমিকা


"রবীন্দ্র-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি রবীন্দ্রসংগীতে।" বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত গবেষক প্রফুল্লকুমার দাসের 'রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গ' গ্রন্থ থেকে বিশেষ এই কথাটির প্রেক্ষিত এনে অন্য এক সমালোচক নারায়ণ চৌধুরী বলেছেন "এই মন্তব্য বা এই জাতীয় মন্তব্যের মধ্যে রবীন্দ্র-সংগীতের অনুকূলে কিছুটা পক্ষপাতী মনোভাব থাকলেও তার ভিতর যে অনেকখানি সত্য আছে তা অস্বীকার করা যায় না। বাস্তবিকই, রবীন্দ্র-সংগীতকে রবীন্দ্রকাব্য-নিরপেক্ষ একটি আলাদা এবং বিশেষ মর্যাদায় গরিয়ান সৃষ্টি হিসেবে বিচারের সময় হয়েছে"।  উদ্ধৃতিটির ব্যাখ্যার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীত প্রতিভার নানা দিক সম্পর্কে বিশদে আলোচনা জরুরি। প্রকৃতপ্রস্তাবে, হাজার বছরের বাংলা গানের ইতিহাসে 'রবীন্দ্রসংগীত' পর্যায়টি সবচেয়ে বিস্তৃত, বৈচিত্র্যময় ও সর্বোত্তম পর্যায়। বাণীর প্রাচুর্যে ও সুরের বিচিত্রতায় মহিমান্বিত রবিগীতি বঙ্গসংস্কৃতিতে অনন্য মাত্রা যোগ করেছিল। এই গানের কথা ও সুরের গভীরতা এতই সূক্ষ্ম  মানবিক অনুভূতিতে সমৃদ্ধ যে তাঁর প্রভাব দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র জনবিশ্বেই আজ তা সমাদৃত।

রবীন্দ্রনাথের গান আসলে এক বিবর্তিত পূর্ণাঙ্গ গীতকথা। ছোটো পরিসরে এই আলোচনা করা দুঃসাহসের। এই কথা মনে রেখেই সমস্ত অতি সংক্ষেপে রবির গানের গভীরে যেতে চাই। এ যাবৎ রবিঠাকুরের গান নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। দেশে বিদেশে গবেষণার কাজও কম হয়নি। আজও তা নিরবিচ্ছিন্ন একটা ক্রিয়া । এই সূত্র ধরেই এগোতে চাই। আগেই বলেছি কবির গান এক বিবর্তিত পূর্ণাঙ্গ গীতকথা। বিবর্তিত ও পূর্ণাঙ্গ শব্দ দুটির তাৎপর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঠাকুরবাড়ির সংগীতের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের সংগীতবিদ হযে ওঠার কিছু পূর্বসূত্র আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা গানের বিশেষ যে সময়পর্বে রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলা এবং ভারতীয় সংগীতের বিবিধ দিক রবীন্দ্রনাথ আত্মস্থ করছেন এবং সমুন্নত প্রতিভার সাথে তা জুড়ে গেছে।  ঠাকুরবাড়ির সারস্বত পরিমণ্ডল, শিক্ষা,পরিশীলিত বোধ-এগুলির নির্যাস সঞ্চারিত হয়েছিল রবীন্দ্র প্রতিভায়। আর একটি বিষয়ও এ প্রসঙ্গে এসে পড়ে তা হলো এক চিরন্তন ধর্মবোধের সাথে মানবিক অনুভবের নিবিড় সম্পর্কের বাতাবরণ। এ ধর্ম বিশ্বের যাবতীয় ধর্মের মুলকথার সঙ্গে আত্মিকতায় সংযোগ। এক আলোকিত মঙ্গলময়তাই এখানে উজ্জ্বল। বলা বাহুল্য, কবি রবীন্দ্রনাথ একদিকে ধ্রুপদী ঐতিহ্য কে গ্রহণ করেছেন তেমনই লোকায়ত চিরকালীন মানবিক আবেদনকেও  গ্রহণ করেছেন  গভীর অনুষঙ্গে। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা গানের ঐতিহ্যে যা ছিল তাই-ই বিবর্তিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানে। 

সংগীতের বাইরের কাঠামোয় থাকে কতগুলি অঙ্গ। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে এই অঙ্গগুলির গুরুত্ব অনেকখানি। রবীন্দ্রনাথের গান পূর্ণাঙ্গ কিনা বলার আগে এই বিষয়টির আলোচনা জরুরি। কথা- সুর- তাল ও লয় - এর সব কটিই গানের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে হিন্দুস্থানী ও মার্গসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা কথা ও সুরের মাত্রাগত পরিমাপ অনুযায়ী। পন্ডিতরা মনে করেন রবীন্দ্রগান বাণী ও সুরকে অখণ্ডভাবে দেখা হয়। আর এক্ষেত্রে দুয়ের ভেতর কোনো প্রতিতুলনা আসতেই পারে না। আবার অনেকে মনে করেন কবির কাব্যরূপকে সুরারোপ করে রবীন্দ্রসংগীতে প্রকাশিত। একথাও সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ এগুলি গান হিসেবেই সৃষ্টি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর তিনি গানের বাণীকে কাব্যের বাণীর থেকেও অনেক 'ভাবগাঢ়' করে  নির্মাণ করেছেন। কোথাও কোথাও দুয়ের অপূর্ব মেলবন্ধনে এক উচ্চ মাত্রা পেয়েছে বলা যায়। তাঁর গানের কথা সম্পর্কে এক সমালোচক বলেছেন- "রবীন্দ্রসংগীতের পদ বা বাণী বিস্ময়কররূপে মেদভারবর্জিত, সাবলীল-গতি, ও ধ্বনিময়। ভাবের দিক দিয়ে বিচিত্র রসের সেখানে আনাগোনা। অনুভবের, কল্পনারূপ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তন্তু দিয়ে সে সকল গানের দেহ গঠিত।" রবীন্দ্রগানের সুরের দিকটিও কথার মতোই তাৎপর্যপূর্ণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতে রসের যে অনির্বচনীয়তা তা কথা ও সুরে সমান ব্যঞ্জনায়। একটা বাদ দিয়ে আর একটা তৃপ্ত হয় না। রবির গানের অনুরাগী সকলেই বাণী ও সুর দুইয়েতেই মুগ্ধ হন। সংগীতের তাল ও লয়ের ক্ষেত্রেও একই কথাই বলে যায়। কথা- সুর- তাল ও লয় যেখানে যেমনটি প্রয়োজন সেখানে তেমনটি নির্মাণ করা হয়েছে।  যে কোনো একটি অঙ্গের কম-বেশি হলে ছন্দপতন ঘটে। একারণেই বলছি তাঁর গান পূর্ণাঙ্গগীত। আর উচ্চমানের সংগীত হয়ে ওঠার জন্য এই পর্যায়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে রবীন্দ্রগানের  তাল প্রসঙ্গটি একটি বৃহৎ পরিসর। তাল বিষয়ে ঢোকার আগে রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা সময়-পর্যায় ধরে তাঁর  গানের আলোচনা করতে চাই।
পন্ডিতগণ রবীন্দ্রনাথের গানের  বিপুল সম্ভারকে  নানা বিভাগ তৈরি করে বুঝতে সাহায্য করেছেন। এই বিভাগ করার নানান অভিমুখ। প্রাথমিক ভাবে বলা হয়ে থাকে তিনি ১৮৮০ সালের কাছাকাছি সময় থেকে সংগীত  রচনা শুরু করেন। এবং আমৃত্যু তিনি সংগীত রচনা করেছেন। এই যে দীর্ঘসময় ধরে গান তাকে  সাধারণ ভাবেই তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন:

প্রথম স্তর: ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত
দ্বিতীয় স্তর: ১৯০১ বা তার কাছাকাছি সময় থেকে    
                 ১৯২০ বা তার কাছাকাছি সময়।
তৃতীয় স্তর:  ১৯২১ বা তার কাছাকাছি সময় থেকে 
                 জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

প্রথম স্তরে রবীন্দ্রনাথের গানে হিন্দুস্থানী গান ও ধ্রুপদীগানের প্রভাব বেশি ছিল। ঠাকুরবাড়ির সমকালীন সংগীত চর্চার মধ্যে তিনিও ডুবে ছিলেন। এই সময় তো ঠাকুরবাড়িতে খ্যাতনামা সংগীতশিক্ষকগণ ছিলেন। ছিলেন বিষ্ণুপুরের যদুভট্ট সহ রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু চক্রবর্তী, শ্রীকণ্ঠ সিংহ প্রমুখ সংগীতগুরু। দেশের খ্যাতনামা সংগীতবিদগণ ঠাকুরবাড়িতে আসতেন, থাকতেনও। সংগীত আসর হতো। অনেকটাই শাস্ত্রীয় সংগীতের আবহ। ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ও ঠুমরি গান। তখন ব্রহ্মসংগীত ছিল আর এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। রবীন্দ্রনাথও ব্রহ্মসংগীত রচনা করলেন। ধ্রুপদ, খেয়াল ও টপ্পাকে ভেঙে সংগীত রচনা করলেন। সুরারোপ করলেন। ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য সদস্যগণও এ কাজ করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নির্মাণ ছিল স্বতন্ত্র। তাঁর এই সময়ের গানের আর একটি দিক হলো পদাবলী সাহিত্যের অনুকরণে নির্মিত সংগীত। 'ভানুসিংহের পদাবলী' এ পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য সংযোজন। প্রথম পর্যায়ের গানে রবীন্দ্রনাথ ঘরানার গানের আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেকটাই। এক্ষেত্রে বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদের একটা ভূমিকা ছিল। এ পর্যায়েই তিনি বিদেশ গিয়েছিলেন। বিদেশের অপেরাধর্মী সংগীতের প্রভাবেই তিনি বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা প্রভৃতি গীতিনাট্য গুলিই এ-পর্যাযে নির্মাণ করেন। ঋতু পর্যায়ের গানের সৃষ্টি এ সময় তেমন হয়নি। এ পর্যায়ের গানে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অক্ষয় চৌধুরী নিধুবাবুর গানের প্রভাব দেখা যায়।

দ্বিতীয় পর্যায়ের সংগীতে রবীন্দ্রনাথ সুরের বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছিলেন। বাংলা গানের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রগানের এই পর্যায়টি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ঋতু সংগীত নির্মাণ এই সময় থেকেই। প্রথমের দিকে বেশ কিছু স্বদেশীগান রচনা করলেও তা স্থায়ী হয়নি। এই পর্যায়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রবিজীবনের নানান কিছুর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। ১৯০১ থেকে শান্তিনিকেতনে বাস, ১৯০২ এ পত্নীবিয়োগ,  ১৯০৫ এ পিতার মৃত্যু, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, তৃতীয়বার বিলেত যাত্রা, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি, ১৯১৮ তে বিশ্বভারতীর কার্যারম্ভ প্রভৃতি ঘটনাগুলি উল্লেখযোগ্য। এই পর্যায়ের গান ধ্রুপদাঙ্গ ও খেয়ালঙ্গ কাঠামোতে থাকলেও সুর আরোপ করার ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন নিয়ে এলেন। বাংলার লোকায়ত সংগীতের সুর এই সময়েই এসেছে। বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, প্রভৃতি বাংলার নিজস্ব সুর তাঁর গানে প্রাণ পেলো। প্রথম পর্যায়ের গানের ভাব-গাম্ভীর্য পেরিয়ে এখানে তাঁর গান অপূর্ব মাধুর্যমণ্ডিত হয়ে সংগীত-অনুরাগীদের হৃদয় জয় করল। এই সময়ের গানে তালের বৈচিত্র্যও ছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আগে যে তাল তিনি ব্যবহার করেছেন ধ্রুপদী তাল- যেমন চৌতাল, সুরফাঁকতাল, তেওড়া, ঝাঁপতাল প্রভৃতি সেগুলি কম বেশি থাকলেও অপেক্ষাকৃত সহজ সরল পরিচিত তালগুলির ব্যবহার এই পর্যায়ে তিনি করেছেন। আসলে কথা ও সুর অনুযায়ী তালও বদলে বদলে গেছে এই পর্যায়ে। এই যুগেই কবি ছয়টি তাল সৃষ্টি করেছেন। তবে রবীন্দ্রনাথের গানে তাল-এই আকর্ষণীয়  বিষয়টির আলোচনা পরবর্তী পরিসরে করতে চাই।

রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় পর্যায়ের গানগুলি সম্পর্কে পণ্ডিতগণ মনে করেন মুক্তির সংগীত। সর্বপ্রকার সংস্কার ও বন্ধন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এখানে প্রকাশিত হয়েছে। এই পর্যায়ের গানে সুরের বাঁধন, তালের বাঁধন, কলিবিভাগের বাঁধন - এসব কঠোর বাধ্যবাধকতা থেকে গানকে বের করে এসেছেন তিনি।
এই পর্যায়ের গানে দেশি ও বিদেশি সুর নিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয় সুরকে তিনি নতুন রূপে তাঁর গানে প্রকাশ করেছেন। এ পর্যায়ের গানে সুরের বৈচিত্র্য বাংলা গানের বৃহৎ প্রাপ্তি। এই পর্যায়টির ব্যাপ্তি অনেক। নানাভাবেই এই পর্যায়ের গানগুলি কবির অভিজ্ঞতার রসে জারিত হয়ে মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথের এই বিভিন্ন পর্যায়ের সংগীত তাঁর জীবনের নানা ওঠা পড়া ও তার মধ্য দিয়েই তাঁর পরিণতির ধাপগুলিকেই  সহজে চিনিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে তিনিই বলেছেন -" প্রথম বয়সে আমি হৃদয়ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছি গানে, আশা করি সেটা কাটিয়ে উঠেছি পরে। পরিণত বয়সের গান ভাব বাৎলাবার জন্যে নয়, রূপ দেবার জন্যে। তৎসংশ্লিষ্ট কাব্যগুলিও অধিকাংশই  রূপের বাহন।"

(চলবে…)

(রবীন্দ্রনাথের গান যেহেতু বৃহৎ একটি পর্যায় তাই আরও দু একটি পূর্ণ পর্বে  রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক আলোচনাই থাকবে)

Post a Comment

1 Comments

  1. প্রথম পর্ব থেকেই আমি এই ধারাবাহিক টি পড়ছি , কতো অজানা গানের ইতিহাস দেখছি , কতো হারিয়ে যাওয়া গানের স্রষ্টা কে জানতে পারছি , হারিয়ে যাওয়া গানের ধারাকে না ধরে রাখার জন‍্য মন কেমন করছে , তেমনি আবার বিবর্তনের ইতিহাস জানতে পারছি ।
    যাই হোক সব মিলিয়ে লেখাটি একটি দলিল হয়ে থাকবে গানের ইতিহাসে । লেখক মহাশয় কে অনেক অনেক ধন‍্যবাদ , সঙে থাকছি।

    ReplyDelete