জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান - ১৯/ তুলসীদাস মাইতি

Thousands of years of Bengali songs

হাজার বছরের বাংলা গান ।। পর্ব-১৯

তু ল সী দা স  মা ই তি


রবীন্দ্রনাথের গান : 
তার বৈচিত্র্য ও অনন্যতা

"একটা কথা আমার মনে হইল-প্রভাতে মহাসমুদ্র আমার মনের যন্ত্রে এই যে গান জাগাইল তাহা তো বাতাসের গর্জন ও তরঙ্গের কলধ্বনির প্রতিধ্বনি নহে। তাহাকে কিছুতেই এই আকাশব্যাপী জল বাতাসের শব্দের অনুকরণ বলিতে পারিনা। তাহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; তাহা একটি গান। তাহাতে সুরগুলি ফুলের পাপড়ির মতো একটির পরে আরেকটি, ধীরে ধীরে স্তরে স্তরে উদ্ঘাটিত হইতেছিল।" ১৩১৯ সালের 'আরব সমুদ্র' পথে যাত্রাকালীন এই অনুভব থেকে রবীন্দ্রনাথের সংগীতভাবনার একটা গভীর অভিমুখ পাই। অন্তরের নানাবিধ আবেগ অনুভূতিকে সুরের আশ্রয়ে প্রকাশ করতেই তিনি সারাজীবন সংগীত নির্মাণ করেছেন। কবিতার মতোই তাঁর গান হয়ে উঠেছে শিল্পের অপূর্ব আকরভূমি। বিচিত্র তার রূপ। বিচিত্র তার প্রকাশ। বিচিত্র তার চলন। অনেকে মনে করেন রবীন্দ্র সৃষ্টির চরমতম সৌন্দর্য তাঁর গানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।
শুধু বাংলা নয়, দেশ নয়, সমগ্র বিশ্বসংস্কৃতির উঠোনে রবীন্দ্রসংগীত প্রিয়তা লাভ করেছে।

বাংলাগানের গানের জগতে রবীন্দ্রনাথের গান কেন শ্রেষ্ঠ কি তাঁর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে এসব বলা দুরূহ। এসব বিশদ না করেও রবীন্দ্রসংগীত এর নানাবিধ দিকের ভেতর প্রবেশ করতে চাই। আগে বলেছি রবীন্দ্রনাথের গান বিবর্তিত ও পূর্ণাঙ্গ সংগীত।  রবীন্দ্রনাথ যখন সংগীত নির্মাণ সূচনা করবেন তখন তাঁর সামনে বাংলাগানের একটা বড়ো ইতিহাস। শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক কম ছিল না। সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে প্রচলিত  সাধারণ মানুষের গান, বাউল, কীর্তন, কথকতা, পাঁচালি, যাত্রা- সমস্তকিছুর প্রতি ছিল তাঁর অদ্ভুত টান। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সংগীত সম্পর্কে একটা বিচিত্র উপলব্ধি তৈরি হয়। গানের কাঠামোতে, ভাবের বিনিময়ে ও সুরের ভেতর এসবই সঞ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পরিবারে শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষার একটা পরিমণ্ডল ছিল একথা আগেই (আগের পর্বে) বলেছি। এই সূত্র ধরেই ভারতীয় সংগীতের রাগ-রাগিনীর সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন। অনেকে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ আশিটির বেশি রাগ-রাগিনী আয়ত্ব করেছিলেন। এই রাগরাগিনীর সাথেই মিশিয়ে ছিলেন নানান রস। ভাবগাঢ় কথার সৌন্দর্য্য ও উপলব্ধিজাত সুরের মাধুর্যে দিয়ে নতুন বাংলা সংগীত ধারা আনলেন। যাকে আমরা বলি 'রবীন্দ্রসঙ্গীত'। সংগীতের বিপুল সম্ভারে বাংলা গানের ক্ষেত্র ভরে উঠলো। রবীন্দ্রনাথ জীবনব্যাপী দু-হাজারের  বেশি রবীন্দ্রসংগীত সৃষ্টি করেছেন। পণ্ডিতগণ এই আয়োজনকে নানাভাবে ভাগ করেছেন। সুরের বৈচিত্র্য, ভাবগত উপলব্ধি, সময়গত পর্যায়, তালের ভিন্নতা, বিভিন্ন অঙ্গের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নানান প্রকারে রবীন্দ্রসংগীত গুলির শ্রেণিবিভাগ করেছেন।

প্রাথমিক ভাবে রবীন্দ্রনাথ সুরের দিক থেকে বিভিন্ন সংগীতধারা অনুসরণে সংগীত রচনা করেন ও সুরারোপ করেন। পরে তিনি অসংখ্য মৌলিক গান রচনা করেন। এই দুই প্রকার গানই অপূর্ব নির্মাণ। প্রথম প্রকার সংগীতের বিন্যাসটির মধ্যেও বৈচিত্র্য অনেক।
পণ্ডিতগণ বিভিন্নধারার গানের সুরে রবীন্দ্রনাথের 'ভাঙা গান' পর্যায়টিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে থাকেন-

এক।   উচ্চাঙ্গ সংগীত:
ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরি, গৎ, তারানা প্রভৃতি ভারতীয় শাস্ত্রীয় ও হিন্দুস্থানী সংগীতের ধারা অবলম্বনে  রবীন্দ্রনাথ বহু সংগীত রচনা করেন। প্রায় সত্তরের কাছাকাছি ধ্রুপদ, চৌদ্দটি ধামার, পচাত্তরটির কাছাকাছি খেয়াল সহ তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের বিভিন্ন ধারার সুরে গান রচনা করেন। ধ্রুপদ, ধামার সহ উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্ষেত্রে তিনি বিষ্ণুপুর ঘরানায় গানকেই অবলম্বন করেছেন।

দুই।    বিভিন্ন দেশীয় সংগীত:
বাংলা সহ দেশের বিভিন্ন ভাষার গানের ধারাকে অনুসরণ করে তিনি বহু সংগীত রচনা করেছেন।
বাংলার বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, সারিগান প্রভৃতি গানের ধারা অবলম্বনের রবীন্দ্রসংগীত ভীষণ জনপ্রিয়। 
রামপ্রসাদী সুরের অবলম্বনেও তিনি গান রচনা করেছেন। বাউল গানের ক্ষেত্রে তিনি লালন ফকির, গগন হরকরা প্রমুখের গান কেই অনুসরণ করেছেন। 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি', 'আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া' প্রভৃতি গানগুলি এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। কীর্তন গানেও তিনি বাংলা কীর্তনের অবলম্বন নিয়েছেন। আখরযুক্ত বা আখরবিহীন দুই ধরণের গানই তিনি অনুসরণ করেছেন। তাঁর কীর্তনাঙ্গের গানের মধ্যে 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়', 'ওহে জীবনবল্লভ' প্রভৃতি গানগুলির খুবই জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত। 

অন্যপ্রদেশের সংগীতের মধ্যে মহীশূর প্রদেশের সংগীত অবলম্বনে 'আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে', 'একী লাবণ্যে, পূর্ণ প্রাণ' সহ মোট ছটি গান, 'বড়ো আশা করে' সহ তিনটি কর্ণাটী গান, 'বাজে করুণসুরে' সহ অনেকগুলি জনপ্রিয় গান মাদ্রাজী ভাষার  গানের সুর থেকে নেওয়া। 'বাজে বাজে রম্য বীণা' এই জনপ্রিয় রবীন্দ্র সংগীতটি পাঞ্জাবী গানের সুরের অবলম্বনে নির্মিত।

তিন।   পাশ্চাত্য সংগীত:
রবীন্দ্রনাথ বহু পাশ্চাত্য সংগীত তথা বিদেশি গানের ধারা অবলম্বনে সংগীত রচনা করেছেন। সুরারোপ করেছেন। গানগুলি গাওয়াও হয় প্রচুর। রবীন্দ্রনাথ বার বার বিদেশ গেছেন। প্রথম জীবনে তিনি 'বাল্মীকি প্রতিভা' ও 'কালমৃগয়া না অপেরাধর্মী গীতিনাট্য লেখেন পাশ্চাত্য প্রভাবেই। আর বিদেশি গানের প্রভাবে ও বিদেশি সুর ভেঙে যে সংগীত রচনা করেছেন তার মধ্যে 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে', 'কতবার ভেবেছিনু', 'পুরানো সেই দিনের কথা' প্রভৃতি গান গুলি উল্লেখযোগ্য। 

অল্পবয়সে রবীন্দ্রনাথ পদাবলী সাহিত্য পাঠ করেছিলেন মনোযোগ সহকারে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ পড়েছিলেন বার বার। ব্রজবুলি ভাষা আয়ত্ব করেছিলেন। এই ভাষা ও  পদাবলী গানের প্রভাবেই তিনি 'ভানুসিংহের পদাবলী' নামে অনেকগুলি সংগীত রচনা করেন। 'গহনকুসুম কুঞ্জ মাঝে', 'মরণ রে তুহু মোরা শ্যাম সমান' সহ অনেকগুলি গান বহুল প্রচলিত।
এ ছাড়া সারাজীবন ধরে রবীন্দ্র নাথ নানান মৌলিক গান রচনা করেছেন। সময় অনুযায়ী ঋতু অনুযায়ী কথা, সুর এমনকি ভাবের বৈচিত্র্যে তাঁর গান উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গীতবিতানে তাঁর গানগুলিকে পূজা প্রকৃতি ও প্রেম এসব পর্যায়ে ভাগ করা। তাছাড়া আনুষ্ঠানিক ও স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলিকে আলাদা করা হয়েছে। কবির অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি'-এসব বৃদ্ধির সাথে সাথে গানের গভীরতাও বেড়েছে। বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের আগেই বাংলা গানে প্রকৃতির রূপ প্রকাশ পেলেও রবীন্দ্রনাথের গানেই তাঁর পূর্ণতা। বহিরঙ্গ প্রকৃতি অন্তরঙ্গ বন্ধনে ধরা দিয়েছে রবির গানে। রবীন্দ্রগানের নানা  পর্যায় গুলি দেখলে বোঝা যায়, জীবনের শেষ কুড়ি বছর প্রকৃতির গানে তিনি একাত্ম হয়েছেন বেশি। শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন- "ঋতুর গানের দিক থেকে এই সময়টি বিশেষ উলেখযোগ্য। শান্তিনিকেতনে তাঁর কুড়ি বছরব্যাপী সাধনার প্রকৃত পরিচয় এখনই প্রকাশ পেল। অথবা এও বলা চলে যে, এখন থেকেই তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার সার্থক পরিণতি দেখা দিল"। বর্ষার গান, শরতের গান, ও বসন্তের আগে থেকে লিখতে শুরু করলেও হেমন্ত ও গ্রীষ্মের এই সময় থেকেই লিখতে শুরু করেন। প্রকৃত অর্থে অনন্ত প্রকৃতির নিবিড় রহস্যে কবি ডুবে গেলেন। প্রেম পর্যায়ের গানে বা পূজা পর্যায়ের গানেও কবির পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধিরও নিবিড়তা দেখা যায়।

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলি বাংলা গানের জগতে এক উল্লেখযোগ্য যোজনা। তাঁর দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ছিল অগাধ টান। পরাধীন দেশের প্রতি তিনি অনেক দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম গানটির তিনি নতুন করে সুরারোপ করেন। তাঁর লেখা 'জন গণ মন অধিনায়ক' গানটিও ভারতের জাতীয় সাংগীত রূপে মর্যাদা পায়। অন্য একটি গান 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' বাংলাদেশের জাতীয়সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। তাঁর 'কেন চেয়ে আছো গো মা', 'সার্থক জনম আমার', 'অয়ি ভুবন- মন মোহিনী' প্রভৃতি গানগুলি জনপ্রিয় স্বদেশ প্রেমের গান হিসেবে গাওয়া হয়ে থাকে।
'রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাল'-একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এটি একটি বৃহৎ পর্যায়। দেশীয় গানের তাল ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের গানে নতুন তাল নির্মাণ তাঁর নিজস্বতার পরিচয় বহন করে। সুরফাঁকতাল, চৌতাল, ধামার, যৎ, খেমটা, আড়খেমটা, কাশ্মীরি খেমটা, ঝাঁপতাল, একতাল, ত্রিতাল, দাদরা, কাহারবা তো ছিলই।  তাছাড়াও  তিনি ব্যবহার করেছেন তেওড়া, রূপক, কাওয়ালি এসব প্রচলিত তালগুলি। তারপরেও তিনি রুপকড়া, নবতাল, ষষ্ঠীতাল, ঝম্পকতাল, নবপঞ্চতাল, একাদশীতাল প্রভৃতি তাল নির্মাণ করলেন। নির্দিষ্ট গানের সাথে এই নতুন তালগুলি যুক্তও করলেন। তবে এই তালগুলি নির্মাণের ক্ষেত্রে কিছু তালের অনুসরণ করেন তিনি। দক্ষিণ ভারতের সার তাল অনুযায়ী রূপকড়া, কর্ণাটী দুস্কর তালের মাত্রা কে অনুসরণ করে নবতাল, কর্ণাটী সংগীতের মনিতাল, বিন্দুতাল, নীলতাল অনুসরণ করে একাদশীতাল নির্মাণ করেন বলে গবেষকগণ মনে করেন।

সুরের বৈচিত্র্যে, তালের বৈচিত্র্যে ভাবের বৈচিত্র্যে এভাবেই রবীন্দ্রগান মহিমাময়।  বাঙালির প্রাণের গান বিশ্বপ্রাণের দুয়ারেও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর প্রসাদ গুণে। আজ পর্যন্ত বাংলায় যত রকম গানের ধারা আছে রবীন্দ্রসংগীত তাঁর মধ্যেই অনন্য। একালের রবীন্দ্রসংগীত গবেষক আলপনা রায়ের কথায় - "রবীন্দ্রগানের একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য, শব্দ উচ্চারণের যে সময়সীমা ও কাঠামো নির্দিষ্ট আছে, তার মধ্যে শব্দগুলি উচ্চারণ করতে হয়...কীর্তন, নিধুবাবুর গান থেকে দ্বিজেন্দ্রগীতি-নাজরুলগীতি পর্যন্ত প্রায় সব বাংলা গানেই কোথাও কথা কোথাও বা সুরের বিস্তারের একটা সুযোগ থাকে, যাকে ইম্প্রোভাইজেশন বলা হয়। আর সেই কারণেই অনেক সময়ে শিল্পী শব্দের পুনরুচ্চারণের, বা সুরের খেলায় শব্দের উচ্চারণ দীর্ঘায়িত স্বাধীনতা নিতে পারেন। রবীন্দ্রসংগীতে সেরকম কোনও অবকাশই নেই।"

এখানেই রবীন্দ্রনাথের গানের অনন্যতা।

(চলবে...)

Post a Comment

1 Comments

  1. রবীন্দ্রনাথ এক সাগরের নাম , রবীন্দ্রনাথ এক আকাশের রামধনু,
    রবীন্দ্রনাথ এক বিশ্ব বায়ুর অবয়ব ।
    রবীন্দ্রনাথ কে জানা কোন মানুষ এক জন্মের সময়ে কুলতে পারে না ।
    আপনার এই জানানোর প্রয়াস কে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই ।
    লেখাটা পড়তে একটু দেরী হয়ে গেলো কিন্তু সারা সপ্তাহ অপেক্ষায় থাকি কি আসছে এই ভাবে ।
    অদ্ভূত সুন্দর সমীক্ষার আমরা পাঠক , সমৃদ্ধ হচ্ছি আপনার লেখার মাধ‍্যমে ।
    খুব সুন্দর , চলুন সঙে আছি ।

    ReplyDelete