জ্বলদর্চি

সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিলেন আগমনী কর মিশ্র


হ্যাঁ, সেই অন্যায়টা আমি করেছি। যতবার সত্যজিৎ বলেছেন ততবার আমি "না" করেছি। 
অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিলেন আগমনী কর মিশ্র

আচ্ছা, চারুলতার হাতের দূরবীণটার কথা মনে আছে? চারু দেখতে চেয়েছিলো বহুদূরকে বা কল্পনার জীবনটিকে ঠিক সামনের ক্যানভাসে আঁকা জলছবির মতো করে। যে সব মানুষ এভাবে দেখতে চান  জীবনকে, চারু নিঃসন্দেহে তাঁদের পথপ্রদর্শক।  চারুলতা....... নামটা শুনলেই যাঁর মুখ ভেসে ওঠে, তিনি বাঙালীর হৃদয়ের চিরস্থায়ী আসনে বসে থাকা মাধবী মুখোপাধ্যায়।  জ্বলদর্চি পত্রিকার তরফ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে উঠে এলো অনেক না-জানা তথ্য। যা আমাদের কাছে চিরদিন থেকে যাবে অমূল্য সম্পদ হিসেবে। তখন রাত ঠিক নটা চল্লিশ । ও প্রান্ত থেকে "হ্যালো" বলতেই আমার রক্ত যেন মুহূর্তের মধ্যে আরো দ্রুত ছুটতে লাগলো। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে নমস্কার জানাতেই শান্ত গলায় হাসিমাখা প্রতি নমস্কার জানালেন। তারপর শুরু হলো অনর্গল  কথাবার্তা। যেমন যেমন কথা হয়েছে আমি হুবহু তা-ই তুলে দিচ্ছি আপনাদের জন্য....... 

আমি (আগমনী কর মিশ্র) :  এই করোনা পরিস্থিতিতে কেমন আছেন দিদি? 

মাধবী(মাধবী মুখোপাধ্যায়)  :  কি করে ভালো থাকি বলুন? চারদিকে যা দেখছি! কেউ মাস্ক পরছে না, কেউ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না,রোজ খবর পাচ্ছি কত মৃত্যু...কত অসুস্থতার কথা। মানুষের মুখের হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে। সকলে যদি মানতো, সকলে যদি সিস্টেমে চলতো! এই অবস্থার মধ্যে মানুষ যেমন থাকতে পারে তেমনই আছি আমি। 

আমি :  আপনি কি এখন কোনো কাজের মধ্যে আছেন নাকি বাড়িতেই আছেন ? 

মাধবী: আমি কোনো কাজ করছি না, বাড়িতেই আছি।

আমি: আপনার শরীর সুস্থ তো ? 

মাধবী: আমার হাই সুগার। 

আমি: আপনি ভালো থাকবেন সবসময় এটা আমরা প্রার্থনা করবো। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনার চলচ্চিত্র-যাপন নিয়ে কথা বলবো এবার। আচ্ছা দিদি, আপনি প্রথম কবে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করলেন সে বিষয়ে যদি একটু বলেন। 

মাধবী: প্রথম যখন আমি চলচ্চিত্রে আসি, সাত বছরে বাচ্চার দুধে দাঁত পড়ে কিন্তু আমার তখন দাঁতও পড়েনি। প্রথম ছবি করি "দুই বেয়াই" প্রেমেন্দ্র মিত্রের। প্রেমেন্দ্র মিত্র তখন টপ ডিরেক্টর ছিলেন। উনার কালোঘোড়া এবং আরো অনেক সুপারহিট ছবি ছিলো। আমি ছিলাম নায়িকার ছোটোবেলার চরিত্রে। শিশুশিল্পী হিসেবে। ইস্টার্ন টকিজ থেকে হয়েছিল ছবিটা। ইস্টার্ন টকিজ ছিলো দক্ষিণেশ্বরের ওখানে। সে সব নেই এখন। 

আমি: এর পরেই কি আপনি অভিনয় করেন তপন সিংহের ছবিতে? 

মাধবী: না না, তারপরে অনেক অনেক ছবি করেছি। প্রেমেন্দ্রবাবুরই তো দুই বেয়াই-র পর 'কাঁকনতলা  তারপরে 'সেতু', আর কি করেছি মনে নেই। তারপর প্রণব রায় যিনি গান লিখতেন, তিনি একটা ছবি করেছিলেন 'প্রার্থনা' বলে সেটা বেঙ্গল ন্যাশনাল সাউন্ড স্টুডিও থেকে হয়েছিলো। সে সব স্টুডিও আজ আর নেই। তারপর আরো ছবি করেছি। যেমন 'পাত্রী চাই' 'বলয় গ্রাস'.. এরকম অনেক ছবি করেছি। তারপর তপন সিনহার 'টনসিল' ছবি করেছি। 

আমি: এই ছবিতে কি আপনি মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন ? 

মাধবী:  হ্যাঁ, ছিলাম। কিন্তু তখন আমি খুব রোগা ছিলাম। কাহিনী অনুযায়ী মেয়েটির টনসিল ছিলো তাই সে খুব রোগা ছিলো। তারপর টনসিল কাটাবার পর সে মোটা হয়ে গেল। তখন সেই চরিত্রে রানীবালা দেবী ছিলেন, তাঁর মেয়ে ওই চরিত্রটা করেছিলো।

আমি: (অনবরত আমাকে আপনি করে সম্বোধন করাতে কেমন যেন লজ্জা করছিলো) দিদি, একটা কথা বলি। আমাকে 'আপনি' না বলে 'তুমি করে বললে আমার ভালো লাগবে। 

মাধবী: শাড়ি পরলেই আপনি বলতে হয়, আমাকে না বললে আমি রেগে যেতাম। (বলেই হেসে উঠলেন সঙ্গে আমিও) 

আমি: আপনি তো সমস্ত নামকরা পরিচালকদের সাথে কাজ করেছেন। এরপরেই কি মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করলেন ? সেটা কত সাল ছিলো মনে আছে ? 

মাধবী: তপন সিনহার ছবির পর তারপর হয়তো এটা ওটা করেছি। তারপর মৃনালবাবুর ছবিতে করলাম। বাইশে শ্রাবণ। সালটা মনে করতে পারছি না। 

আমি: আর তারপরেই ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজ ? 

মাধবী: হ্যাঁ। সুবর্ণরেখা ছবিতে। 

আমি: ছবিতে কি নদীর কথা আছে ? 

মাধবী: হ্যাঁ, সুবর্ণরেখা নদীতে যত গরীব মানুষ আছে তারা বালি ছেঁচতো। ছেঁচতে ছেঁচতে সোনা পাওয়া যেতো। এসব নিয়েই গল্প। 
আমি: সুবর্ণরেখা কিন্তু আমাদের মেদিনীপুরের। 

মাধবী: হ্যাঁ হ্যাঁ। 

আমি: এর পরেই বোধহয় আপনি আসেন আমাদের আইকন এক এবং অদ্বিতীয় সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে। 

মাধবী: হ্যাঁ, প্রথম ছবি --'মহানগর'। 

আমি: সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে প্রথমে কীভাবে এলেন যদি একটু বলেন। 

মাধবী: সত্যজিৎ রায়ের ওখান থেকেই দুজন লোক এসেছিলেন। প্রোডাকশন ম্যানেজার আর গিরিজা সেন যিনি সাউন্ড রেকর্ডিস্ট। এই দুজন এসে একটা ঠিকানা দিলেন । সেই ঠিকানায় যেন দেখা করতে যাই। ঠিকানাটা ছিলো সাউথ ক্যালকাটার, আর আমি থাকতাম নর্থ ক্যালকাটায়। যখন ওরা যখন চলে যাচ্ছে তখন মা বললেন তোমার যাওয়া উচিত। আমি বললাম, দেখো আমাকে দেখে ওনার পছন্দ হবে না আর এখান থেকে ওদিকে যাবার ট্যাক্সি ভাড়াটা অনেক। তাই আমার যাওয়ার দরকার নেই। সেই কথা শুনতে পেয়ে ওনারা আবার ফিরে এলেন। এসেই বললেন, আপনি ট্যাক্সি ভাড়াটা রাখুন। আমি তখন লজ্জা পেয়ে গেলাম। বললাম,  না না না ট্যাক্সিভাড়া লাগবে না আমরা ঠিক চলে যাবো। তারপর আমি আর মা গেলাম। চারতলায় কি পাঁচতলায় থাকতেন। (এমন সময় বাড়ির ল্যান্ড লাইনে একটা ফোন আসে। একটু দ্বিধা নিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ফোনটা ধরে নেবো ? আমি নিশ্চিত করে অপেক্ষা করছি বললাম। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে আবার শুরু করলেন।) যাবার পর চা, চানাচুর দেওয়া হলো। তিনি বললেন...আউটডোর যাচ্ছি, পরে কথা হবে। আমি তো ভাবলাম এরকম তো আমরা পাত্র-পাত্রী দেখতে গিয়ে বলি পরে কথা হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে সেরকম হলো না। তিনি আউটডোর থেকে ফিরে এসে আবার ডেকে পাঠালেন এবং স্ক্রিপ্ট শোনালেন। পরে আবার ডেকে স্ক্রিপ্ট দেন। তখনকার দিনে সেই স্ক্রিপ্ট ছিলো সম্পূর্ণ সত্যজিৎ রায়ের হাতে লেখা। 

আমি: আচ্ছা দিদি, মহানগর তো নারীচরিত্র প্রধান ছবি। তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে এই ছবি করতে গিয়ে একটু আলাদা রোমাঞ্চ কি অনুভব করেছিলেন ? 

মাধবী: পারিপার্শ্বিক অবস্থা নারীকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো ছিলো না। কিন্তু আমি শিক্ষা পেয়েছিলাম স্টেজ থেকে। স্টেজে অভিনয় করতে গিয়ে আমি শিক্ষা পেয়েছি  ছবি বিশ্বাস, অনিল চৌধুরী, নরেশ মিত্র, শিশিরকুমার ভাদুড়ী এরকম মানুষজনের কাছে। এঁদের থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি তার থেকে নারী চরিত্র প্রধান ছবি করতে অসুবিধে হয়নি। 

আমি : এবার আসি চারুলতা প্রসঙ্গে। প্রথমেই জিজ্ঞেস করবো নষ্টনীড় নাম বাদ দিয়ে চারুলতা রাখা হলো কি চারুলতাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য। 

মাধবী: না না, একেবারেই না। সে সময়ে নিয়ম ছিলো একটা নাম রেজিস্ট্রেশন হয়ে থাকলে পরে আর ওই নামে ছবি করা যাবে না। নষ্টনীড় নামে সুনন্দাদেবীর একটা ছবি ছিলো। যদিও ওটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে নয়, তবু আর ওই নামে করা যায়নি। বাধ্য হয়ে নামটা চেঞ্জ করে চারুলতা রাখা হয়েছিলো। 
আমি: চারুলতায় একটা দোলনার সিন রয়েছে। সেখানে একটা জায়গায় চারু ঠাকুরপোকে দোল দিয়ে দিতে বলছে অথচ আমরা দেখতে পাই চারুর পা মাটিতে ঠেকে আছে। তাহলে চারু কেন বললো ? এমনি নাকি ঠাকুরপোর প্রতি অনুরাগ বোঝাতে ? 

মাধবী: তখনকার দিনে যে ভাবা হতো, পতি পরম গুরু। পতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো গুরু শিষ্যার মতো। সেখানে বন্ধুত্ব থাকে না। অমল যখন এলো একটা সঙ্গী পেলো চারু। যে সঙ্গীর সাথে বক্তব্য আদান-প্রদান করতে সবাই চায়, যেটা পতির সঙ্গে হয় না। সেই বন্ধুত্বটা পেয়েছিল চারু। ভারি সুন্দর করে দেখানো হয়েছে এ ছবিতে। 

আমি: চারুলতা করতে গিয়ে নাকি হাতের লেখা বদলে ফেলতে হয়েছিল সৌমিত্রবাবুকে? 

মাধবী: হ্যাঁ, সৌমিত্রবাবুকে এক ধরনের হাতের লেখা প্রাকটিস করতে বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছবির প্রয়োজনে তা করেছিলেন চারুলতার অমল। আমিও মাইনে দিয়ে লোক রেখে অ্যামব্রয়ডারি শিখেছি। দোলনায় দুলতে দুলতে গানটাও নিজেরই গাওয়া। 

আমি:  চারুলতা যে অমলকে খাতাটা দেয় সেটার ডিজাইন কি সত্যজিতের করে দেওয়া ? 

মাধবী: হ্যাঁ হ্যাঁ, সব। 

আমি: আর একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয়ের সময় বিজয়া রায় নাকি অনেক সাহায্য করতেন আপনাকে। 

মাধবী: না না। একটা কথা বলি, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করা সবচেয়ে সহজ। যেমন কিছু প্রফেসর আছেন, তাঁরা কি বলেন বোঝা যায় না আবার কিছু প্রফেসর আছেন, তাঁদের কথাগুলো মাথার মধ্যে বসে যায় ছবির মতো, পড়বারও দরকার হয় না। সত্যজিৎ হলেন সেই রকম। একবার বুঝিয়ে দিলে বা স্ক্রিপ্টে রিডিং দিয়ে নিলে ঠিক বুঝে যাবে উনি কি চাইছেন। একটুও অসুবিধে হবে না। 

আমি: শুনেছি বিজয়াদেবী (রায়) নাকি খোঁপা বেঁধে দিতেন ? 

মাধবী: (হাসি) না না না না। তবে একটা জিনিস উনি করে দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মরা যেভাবে কাপড় পরে সেই ভাবে আমি পরতে পারতাম না। মারোয়াড়িদের মতো সামনে আঁচল, তবে সেটা ডান দিক দিয়ে নয়, বাঁ দিক দিয়ে। সেটা উনি পরিয়ে দিয়েছিলেন। 

আমি: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে অভিনয়ের কিছু মধুর অভিজ্ঞতার কথা একটু জানতে ইচ্ছে করছে। একসঙ্গে তো আপনারা অনেক ছবি করেছেন। 

মাধবী: (একদম পোড় খাওয়া অভিনেত্রী এখানে ) মধুর কিছু থাকে না। কাজ করতে যাই যখন সে সৌমিত্র চ্যাটার্জি হোন, উত্তমকুমার হোন, অনিল চ্যাটার্জি হোন , বিশ্বজিত হোন বা নতুন যারা তারাই হোন আমার কাছে একই রকম লাগে। কাজ করতে গিয়ে আমি তো সৌমিত্র চ্যাটার্জি ভাবি না , আমি ক্যারেক্টারটা ভাবি এবং তার সাথে কি করতে হবে সেটা ভাবি। তবে একটা জিনিস হয়, একজনের সঙ্গে কাজ করতে করতে সে কি বলতে চায় বা করতে চায় বোঝা হয়ে যায়। একটা স্ট্রং বন্ডিং হয়ে যায়। তখন তিনি যেটা করবেন আমাকে তার জবাব দিতে হয়। ঠিক সওয়াল জবাবের মতো। একে অপরকে বুঝে নেওয়ার ব্যাপারটা গড়ে ওঠে। 

আমি: সত্যজিতবাবুর সঙ্গে পরপর এতগুলো সফল ছবি করার পরেও তাঁর বিখ্যাত 'নায়ক' ছবিতে উত্তমকুমারের বিপরীতে আমরা মানে দর্শকরা পেলাম না কেন ? 

মাধবী: এটা বেশ জটিল প্রশ্ন। আসলে আমি আর করতে চাইনি । 

আমি: কেন ? 

মাধবী: এত পলিটিক্স শুরু হলো যে আমার মনে হলো ওখান থেকে বেরিয়ে আসাটাই ঠিক। কে করেছেন এই পলিটিক্স যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন তাহলে আমি বলবো, না আমি বলতে পারবো না কারন তিনি এখন আর বেঁচে নেই। তাই আমার আর বলার ইচ্ছে নেই। (ঈষৎ উত্তেজিত) আসলে ওটা রাজনীতি নয়, ওটা ছিলো নোংরামো। তাই আমি আর একসঙ্গে কাজ করতে চাইনি। নায়ক-এর আগে 'অশনি সংকেত'-এ ডেকেছিলেন। আমি না করে দিই। তারপর 'নায়ক' ছবিতে আমাকে ডাকলেন। সেটাও করলাম না। তারপর শেষে 'ঘরে বাইরে' যখন করেন তখন আর নিজে বলেননি। সেবাব্রত গুপ্ত বলে এক জার্নালিস্ট ছিলেন আপনি জানেন ? 

আমি: (আমি স্বাভাবিক ভাবেই বলি) না, জানি না। (তখন উনি বলেন..) 

মাধবী: ও বাবা ! সেবাব্রত গুপ্ত বিশাল জার্নালিস্ট ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার খুব ভালো রিলেশান ছিলো। তাঁকে বলেছিলেন...মাধবীকে যদি তুমি একটু রাজি করাও। তো সেবাদা আমাকে বলতে আমি সেবাদাকে বললাম...সেবাদা,আমি কখনো না বলি না কিন্তু একবার না বললে আর হ্যাঁ হয় না। আমার ঘাড়টা ভীষণ শক্ত। 

আমি: ভীষণ দামী কথা দিদি। সব মহিলারই যেন আপনার মতো ঘাড় শক্ত থাকে, মাথা উঁচু থাকে। আপনাকে পর্দায় দেখে মুগ্ধ হই বার বার। 

মাধবী: (আমার কথার মাঝেই স্মৃতি-মাখা আবেগে বলে ওঠেন )আজকে আমার মনে হয়, কিছুটা আমি হয়তো ভুল করেছি। এটা হয়তো আমার করা উচিত হয়নি। সেই না করে দেওয়াটা ঠিক হয় নি। আজ সেটা খুব মনে হয়। 

আমি: সত্যিই আপনি যদি তখন "না" করতেন না, তাহলে আমরা আরো বেশি করে হয়তো আরো নতুন করে পেতাম আপনাকে। 

মাধবী: হ্যাঁ, সেই অন্যায়টা আমি করেছি। যতবার সত্যজিৎ বলেছেন ততবার আমি না করেছি। 

আমি: তবু যতটা করেছেন তার মধ্য দিয়েই আমরা মানে বাঙালীরা মনের মাধুরী খুঁজে নিয়েছি। আচ্ছা এখানে নাম নিয়ে একটু জানতে ইচ্ছে করছে। আপনার নাম নাকি  আগে "মাধুরী " ছিলো ? মাধবী হলো কি করে ? 

মাধবী: হ্যাঁ, আমার নাম ছিলো মাধুরী। টনসিল ছবিতে এই নামেই কাজ করেছি। যখন মৃণালবাবুর ছবিতে কাজ করি তখন নামটা বদলে দিলেন। 

আমি: মৃণালবাবুই কি বদলে দিলেন? 

মাধবী: না, বিজয়বাবু। বিজয় চট্টোপাধ্যায়। উনি বললেন, যদি আমরা নামটা মাধবী করি তাহলে নবাগতা কথাটা ব্যবহার করতে পারি। তো আমি একটু চুপ করে ছিলাম। উনি বললেন, উত্তমকুমার কতবার নাম বদলেছিলেন জানো ? আমি বললাম ...না। উনি বললেন,  প্রথমে অরুনকুমার, তারপর অরূপকুমার তারপর উত্তমকুমার।  আর উত্তমকুমারটাই স্টে করলো। এরকম সব জায়গাতেই হয়। এই নাম বদলে এমন কিছু এসে যায় না, মানুষটা তো তুমি একই থাকছো। এভাবেই হয়ে গেল নাম বদল। আর আমিও মাধুরী থেকে হয়ে গেলাম মাধবী।(হাসি) 

আমি:  দিদি, এবার পরপর চারটে প্রশ্ন করবো যার উত্তর এক কথায় বা অল্প কথায় চাইবো। 

মাধবী: বলো। 

আমি: উত্তমকুমার না সৌমিত্র? 

মাধবী: (একটু থেমে) উত্তমকুমার আর জন্মাবেন বলে মনে হয় না। উত্তমকুমার এর ছবি বারবার দেখা উচিত। তিনি শিল্পী ছিলেন না সাধক ছিলেন সেটাই হলো সবচেয়ে বড় কথা।(অনুভব করতে পারছিলাম কতটা শ্রদ্ধা তাঁর সহ-অভিনেতার প্রতি) 

আমি: ঋত্বিক ঘটক নাকি সত্যজিৎ রায়? 

মাধবী: দুটো আলাদা। ঋত্বিক ঘটক এক রকম সত্যজিৎ আর এক রকম। আপনি যদি বলেন যে বাংলা ভাষা আর ইংরেজি ভাষা....কোন ভাষাকে আপনি বড় বলবেন (দুজনেরই হাসি) 

আমি: সুচিত্রা না সুপ্রিয়া  ? 

মাধবী: (হাসতে হাসতে) সুচিত্রা সেন। 

আমি: এখনকার চলচ্চিত্র সম্বন্ধে আপনার অভিমত কী? কিরকম ভাবনা? 

মাধবী: দেখুন, সত্যজিৎ রায়ের ছবি করেছি, মৃণাল সেনের ছবি করেছি, ঋত্বিক ঘটকের ছবি করেছি, সরোজ দের করেছি, তপন সিনহার ছবির করেছি, এঁদের সব ছবির মধ্যে দেখবেন একটা সৌন্দর্যবোধ রয়েছে। কোনো অসুন্দর কিছু নেই। অকারণ মারামারি, কাটাকাটি এরকম কিন্তু কিছু নেই। তাই না? এখন মারামারি, কাটাকাটি এবং শুধু তাই নয়, এই যে এখানের (স্পষ্ট ইঙ্গিত টলিউডের দিকে)যে ছেলে মেয়েরা, এরা কোথায় থাকে সেটা বুঝতে পারি না। কোথাকার এরা! এখানকার ছেলেরা কোন জায়গায় বিলঙ করে বুঝতে পারি না। তবে এর মধ্যেও যে ভালো ডিরেক্টর বা অভিনেতা অভিনেত্রী নেই তা নয়। কিছু ভালো ডিরেক্টর আছে। কিছু ছবি ভালো লাগে। 

আমি: এখনকার সময়ে আপনার চোখে ভালো ডিরেক্টর কে? 

মাধবী: এখনকার বলতে যেটুকু কাছ থেকে দেখেছি সেটুকুই তো বলতে পারবো। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি সেই হিসেবে অনীক দত্ত। "বরুণবাবুর বন্ধু" ছবিটা করেছিলেন। পারলে ওটা দেখবেন। খুব ভালো ছবি। 

আমি: (ছবিটা আগে না দেখায় একটু লজ্জিত) হ্যাঁ হ্যাঁ দিদি, অবশ্যই দেখবো। 
সর্বশেষ প্রশ্নে চলে আসবো। সত্যজিৎ রায়ের তো এবছর জন্ম শতবর্ষ। আপনার কি মনে হয় না, সরকারি তরফ থেকে তাঁর জন্ম শতবর্ষ যাপনের উদ্যোগ একটু কম ? বাঙালীর গর্ব যিনি, যিনি একটা জাতির মেরুদণ্ড বিশ্বের দরবারে অনেকখানি শক্ত করে দিয়ে গেছেন তাঁর জন্ম শতবর্ষ পালনে শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে কি ? 
মাধবী: এখন ইলেকশনের ব্যাপার এসে গেছে না! কি করবে! কিছু করার তো নেই। এই নন্দন, এই নামটিও তো সত্যজিৎবাবুর দেওয়া। 

আমি: কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে যে হুল্লোড় করা উচিত ছিলো, আমি হুল্লোড় কথাটা ইচ্ছে করেই বললাম, এটা তো সত্যি যে তাঁকে নিয়ে আমরা গর্ব করবো, তাঁকে নিয়ে আমরা বিশ্ব দরবারে পরিচিত হবো, অথচ এই শৈথিল্য! 

মাধবী: সেটা আসলে হয়েছে এই ভোটের জন্য  আর কোভিড এর জন্য।  কোভিভ আর ভোট এসে সব এলোমেলো করে দিয়েছে। 

আমি: ঠিক আছে দিদি ,আপনার অনেকখানি মূল্যবান সময় আমি নিলাম। জ্বলদর্চি পত্রিকার পুরো পরিবারের তরফ থেকে আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানাই। আপনি ভালো থাকুন....সুস্থ থাকুন এই প্রার্থনা করি। 

মাধবী:  আমি একা ভালো থাকতে পারবো না। 

আমি: না না আমরা আছি আপনার সঙ্গে। 

মাধবী: শুধু আপনারা থাকলে হবে না। আমাদের কাজটা তো দর্শকের সামনে। সেই মানুষগুলোই তো স্বীকৃতি দিয়েছেন মাধবী বলে। সেই মানুষগুলো সবাই সুস্থ থাক তবেই আমি ভালো থাকবো। আপামর মানুষজন ভালো থাকলেই আমারও মন শরীর দুই-ই ভালো থাকবে।
( কী অসামান্য মানবিক হৃদয়ের ছোঁয়া ছিলো এই কন্ঠে, সেটা না শুনলে অনুভব করা যাবে না। ) 

আমি: তবুও আপনি ভালো থাকুন। আপনি সুস্থ থাকুন। 

মাধবী: (আবারও) সবাই ভালো থাকুক, তবেই তো আমার ভালো থাকা। মনটা তো ভালো থাকছে না। মনে এত অশান্তি ! সারা দেশ যদি ভালো না থাকে তাহলে কেমন করে ভালো থাকবো বলো ? 

আমি: আপনার রাতের খাওয়া হয়েছে তো ? নাকি অনেকটা সময় আমি নিয়ে নিলাম? 

মাধবী: (একেবারে স্পোর্টসম্যানের মতো) না না । এখন কি খাওয়া! এরপর পড়াশুনো করবো, তারপর খাওয়া। 

তখন প্রায় রাত্রি সাড়ে দশটা বাজে। বুঝলাম এই জন্যই তিনি মাধবী। এক উঁচু মাথার উচ্চ ব্যক্তিত্ব। যাঁর হাতে ধরা দূরবীণটা শুধু চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে নয়, তাঁর সুদূরপ্রসারী ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক।
তাই "শুভ রাত্রি" বলার পর কিছুক্ষণ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। সেটা কি শুধু চারুলতার মোহ! বোধহয় না। আপন ব্যক্তিত্বে, আশ্চর্য ধী-শক্তিতে,অনন্য মানবিকতায়, অনন্ত শিক্ষার ইচ্ছায় সেদিনের চারুলতা আজ বটবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন। যার তলায় পথিক নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিতে পারে। আমি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকি  শুধু। জ্বলদর্চির তরফ থেকে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।
আমরা তাঁর সুস্থ ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।
ভালো থাকুন ঋত্বিকের - সীতা...... সত্যজিতের - চারুলতা ....আর দর্শকের - মাধবী।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments