জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব-২(নিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা)/ সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব-২
সন্দীপ কাঞ্জিলাল
নিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা 

নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা মানে, একটা সুবিধাবাদী অবস্থান। একটি নিরাপদ জায়গা যেখানে আপনাকে কোন পক্ষকেই অসুখী বা খুশি করার চিন্তা থাকে না। ক্ষমতার দলবদলে নিজের সুবিধাজনক অবস্থানের পরিবর্তনের ঝুঁকি থাকে না। তবে আমি মনে করি, এই মুহূর্তে ঠিক যখন বর্তমানে আমাদের দেশকে ধর্মীয় মেরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করা আশু কর্তব্য, যখন বুঝিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে আমাদের একমাত্র পরিচয় ভারতবাসী তখন কেমন করে আমি একজন নাগরিক হয়ে নিরপেক্ষ থাকতে পারি? এই মুহূর্তে দেশ দুটি পক্ষে বিভক্ত একদিকে ধর্ম অন্যদিকে ভারতীয়, এর মাঝে যদি বা কিন্তু- র কোন স্থান নেই। হয় আপনি যে কোন ধর্মের নয়তো আপনি ভারতবাসী এই পরিচয়ের পক্ষে। এর মাঝে যারা চায় থাকতে তারা হচ্ছে তথাকথিত নিরপেক্ষ, সুবিধাবাদী দল। নিরপেক্ষতার অর্থ হলো সত্য ও ন্যায়ের সাথে থাকা। মাঝামাঝি থাকা মানে নিরপেক্ষতা নয়। ভালো-খারাপ, সত্য-মিথ্যা, আলো- অন্ধকার এরমধ্যে মাঝে কিছু নেই। আপনাকে যে কোনো পক্ষ অবলম্বন করতেই হবে। তবে সত্যের পক্ষে থাকাটাই নিরপেক্ষতা। দলমত নির্বিশেষে সত্যকে সত্য হিসেবে প্রকাশের মানসিকতা থাকতে হবে। আর এটাই নিরপেক্ষতা। 

  এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত একজন ভারতীয় সে যেই পেশাতেই থাকুন না কেন, তাকে নির্ধারণ করতে হবে তিনি কি চান এবং নিজের অবস্থান আসলে কি। আর এই সঠিক পক্ষটি নির্ধারণ করতে পারলেই, আমি মনে করি, এই বর্তমান বাস্তবতায় আপনি নির্ধারণ করতে পারবেন আপনার পেশাগত নৈতিকতা, বস্তুনিষ্ঠতা, জবাবদিহিতা এবং সার্বিক অর্থে নিরাপত্তা। আপনাকে নির্ধারণ করতে হবে আপনার কথা বা অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আপনি কাকে শক্তিশালী করতে চান। আপনার এই সঠিক পক্ষটি বেছে নেওয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক অগ্রগতির সিদ্ধান্ত। সেই সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে দেশের পক্ষ বিশেষ করে কেউ যখন একটি পেশায় যুক্ত থাকেন, সেখানে আপনার অবস্থান হতে হবে এমন, যেন আপনার মতামত সেখানে প্রতিফলিত না হয়। খেয়াল রাখতে হবে আপনার মনোভাব যেন কোনো বিশেষ পক্ষের দিকে চলে না যায়। 
আপনি একজন সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার দর্শন অনুযায়ী আপনাকে হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ। তার মানে, আপনাকে হতে হবে সমাজের আয়না, যেখানে আপনার নিজের রং লাগানোর সুযোগ থাকবে না। কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে, একটি দেশের নাগরিক হিসেবে আপনি কি কোন না কোন মতের বা পক্ষের নন? আপনি যখন ভোট দেন তখন কি নিরপেক্ষ বলে কোন ব্যালট থাকে? থাকে না। তার মানে, আপনিও না কোনো-না-কোনো মত ও পথের অনুসারী। আর একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে আপনিও কিন্তু সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনায় ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করেন; ভালোলাগা-মন্দলাগা অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে পছন্দ করেন। আপনিও চান আপনি যে দর্শনে বিশ্বাস করেন সমাজে সেই দর্শনের অনুসারীর সংখ্যা বাড়ুক।আপনিও প্রভাবিত করতে চান। আপনি চান বা না চান আপনি কোন না কোন পক্ষ অবলম্বন করেই নিজেকে প্রকাশ করতে চান। আপনাকে দেখতে হবে, আপনার মতের দ্বারা যেন সমাজে কোনো নেতিবাচক প্রভাব গড়ে না ওঠে, আপনি যে মতটি প্রকাশ করতে চাচ্ছেন তার দ্বারা সমাজে কোন ধারার শক্তিকে আপনি উৎসাহিত করছেন। 

  আপনি চাইলেই মনগড়া কোন বক্তব্য রাখতে পারেন না বা ছড়িয়ে দিতে পারেন না; কারণ আপনার একটি দায়িত্বশীলতা অবশ্যই থাকতে হবে। বিশেষ করে আপনি যখন একটি বৃহত্তর গোষ্ঠী কে প্রভাবিত করে এমন কিছু করতে যাচ্ছেন, তখন অবশ্যই আপনাকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। একে বলে পেশাদারিত্ব বা জবাবদিহিতা। এই জবাবদিহিতা শব্দটি আপনাকে অনেক কিছু থেকে বেঁধে রাখে। জবাবদিহিতা থাকলে আপনি চাইলেই যা ইচ্ছা তা করে ফেলতে পারেন না। অনেকে বলে থাকেন আমি স্বাধীন নাগরিক, তাই চাইলেই আমার যে কোনো মত প্রকাশ করতে পারি, চাইলেই যা করলে আমি সুখ পাব তা করতে পারি। আর এখানেই প্রয়োজন জবাবদিহিতার। একটি ছোট শব্দ, কিন্তু ওজন অনেক বেশি। স্বাধীনতা মানে আমি যা চাইলাম তা করা নয়। স্বাধীনতা মানে দায়িত্বশীল ভাবে নিজেকে প্রকাশ, অন্যের অধিকার হরণ না করে নিজের অধিকারের চর্চা। আজকের এই সময়ে আমাদের দেশে সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার খুব বেশি প্রয়োজন। ভারতে এই মুহূর্তে বা সামনে যারা রাজনীতি করবেন বা করছেন তাদেরও এই ধারায় ফিরে আসতে হবে যার প্রমান কিন্তু আমরা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেখেছি। 
  খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের গুণগত পরিবর্তন আসছে। রাজনীতিবিদরা এখন আর তাদের পেশিশক্তির দৌলতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, দিন শেষে তাকে জনতার আদালতে ধরা দিতে হচ্ছে। যিনিই রাজনীতিতে আসবেন বলে ভাবছেন তাকে প্রমাণ করতে হচ্ছে তিনি দেশকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। শুধু মুখে বললেই এখন আর জনগণকে যে কোনো কিছু তারা খাওয়াতে পারছেন না। সবার আগে তাকে নির্ধারণ করতে হচ্ছে, ভারতের অস্তিত্ব তার কাছে নিরাপদ, নাকি ভারতের অস্তিত্ব তার কাছে বিপদজনক? কয়েক বছর আগেও এসব আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল। কারণ আমাদের এই প্রজন্ম এখন অনেক বেশি সচেতন, দেশপ্রেমিক ও দেশের স্বার্থে আপোষহীন। 

  আজকের সময় এসেছে আমরা নাগরিকরা কোন পক্ষের হব তা ভাবার বিষয়। আমি আমার মত কিভাবে প্রকাশ করব, কিভাবে আমি একটি সংবাদ প্রচার ও প্রসারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবো। এই মুহূর্তে ভারতে প্রয়োজন দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সঠিক পক্ষ অবলম্বনকারীদের যৌথ অবস্থান। নিরপেক্ষতার আড়ালে নাম লেখানোর দিন মনে হয় আর নেই। সোজা লাইনে আসতে হবে আমাদের। তাই আসুন, নিরপেক্ষ নয়, সঠিক পথ বেছে নিই  এবং সে পথে ভারতবর্ষকে এগিয়ে নিয়ে যাই। জয়ের ধারা বাঁচিয়ে রাখি নিরন্তর। জনতার জয় অনিবার্য। 

  নির্বাচন এলেই 'নিরপেক্ষতা' নামক নীতিকথা সর্বত্রই আলোচিত চর্চিত হয়ে থাকে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, সুষ্ঠু,  নিরপেক্ষ নির্বাচন বলতে কিছু না থাকলেও যখন যার পক্ষে নির্বাচন যায় তিনি তখন নিরপেক্ষ। আবার যারা পরাজিত হন তারা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের প্রাক্কালে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা আপেক্ষিক। 'বনে যে যায়, সেই বাঘ হয়!' নীতি চর্চায় অভ্যস্ত  আমাদের বহুমুখী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। নিরপেক্ষ মানে পক্ষপাতিত্বহীন, ন্যায়পরায়ণ বা পক্ষপাতশূন্য। আসলে আমরা কেউ কোনো বিষয়ে নিরপেক্ষ নই। কারও পক্ষে সম্ভবও নয় নিরপেক্ষ থাকা। এমনকি ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেও নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নয়। রাজনৈতিকভাবে তো নয়ই। যখন ভোট দেওয়া হয় তখন নিরপেক্ষ বলে কোন ব্যালট থাকে না। তার মানে, প্রত্যেক মানুষই কোন না কোনো মত ও পথের অনুসারী। একজন রাষ্ট্রপতি কিংবা একজন বিচারক, যিনি নিরপেক্ষভাবে বিচার করেন, তিনিও ভোটের সময় কোন না কোন দলকে ভোট দেন। নিরপেক্ষ একটি ছোট শব্দ হলেও এর ওজন অনেক বেশি। শান্তিপ্রিয় মানুষ সাদা চোখে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি বলতে বুঝে থাকেন- যিনি সৎ, লোভী নন, অন্যায় করেন না, দেশের বা দশের মঙ্গল চান, যার মাধ্যমে দশের বা দেশের উন্নতি হবে, শৃঙ্খলা রক্ষা হবে, কোনো পক্ষপাতিত্ব নয়, সবার জন্য সমান দায়িত্ব পালন করবেন। আবার কারও কারও মতে, নিরপেক্ষতা হচ্ছে শপথের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কোনো নির্দিষ্ট পক্ষ অবলম্বন না করে সত্যের পক্ষ নেয়া। 

  আপনি কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন? প্রশ্ন করলেই অদ্ভুত উত্তর আসে। আমি নিরপেক্ষ। কোনও দলে নেই। এখন এই কথা বলার সময় গিয়েছে। এখন পক্ষ নিতে হবে, পক্ষের সঠিক বুদ্ধি দিয়ে বেছে নেওয়ার সময় এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ পক্ষ নেওয়ার বার্তা দিচ্ছেন। কাদের পক্ষে?ওরা বলছেন মনুষ্যত্বের পক্ষে,  সম্প্রীতির পক্ষে, নারী-স্বাধীনতা, ভালোবাসা, বাকস্বাধীনতার পক্ষ বেছে নেওয়ার। আর কাদের বিপক্ষে? অমানবিকতার বিপক্ষে, ধর্মান্ধতার বিপক্ষে থাকতে হবে।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। সারদা কোম্পানিতে যারা টাকা রেখেছিল, তাদের টাকা খোয়া গেছে। যাদের খোয়া গেছে তাঁরা আন্দোলন করবেই। আর যাদের খোয়া যায়নি তাঁরা কি ঘরে বসে থাকবে? আন্দোলন করতে গেলে পাছে পুলিশের বাড়ি খেতে হয়, এই ভয়ে ঘরে সিঁটিয়ে থাকবে? নাকি যাদের টাকা খোয়া গেছে তাদের সাহায্য করতে আন্দোলনে নামবে? অথবা টাকা জমা রাখে নি বলে কেউ কেউ ঘরে বসে তালি বাজাবে? নয়তো যারা টাকা চুরি করেছে তাদের সাহায্য করবে? এখন পাঠক কে ভাবতে হবে কে নিরপেক্ষ, আর কারা নিরপেক্ষ নয়। আর এই ঘটনায় নিরপেক্ষতা কোনটা? অর্থাৎ নিরপেক্ষতা হচ্ছে আদর্শিক নৈতিকতার সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি নৈতিক বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা। মোদ্দাকথা আদর্শিক, নৈতিক বা সত্যের প্রশ্নে আদর্শ বা নৈতিকতার মানদন্ড আপেক্ষিক হলেও সত্য হচ্ছে একটি সার্বজনীন বাস্তবতা। কেননা সত্য আদর্শ এবং নৈতিকতা নিরপেক্ষ।

  আবার আমাদের গণমাধ্যমের মধ্যে নিরপেক্ষতা নিয়ে একটা বিভ্রান্তি আছে। অনেক গণমাধ্যম ভাবে নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমানে প্রয়োজনে সত্য মিথ্যার মাঝখানে থাকা জরুরি। যদি সত্য প্রকাশ করি তাহলে আমার পাঠক বা দর্শক অথবা শ্রোতার সংখ্যা কমে যেতে পারে। অথবা রাজরোষে পড়তে পারি। সরকারি বদান্যতা থেকে বঞ্চিত হতে পারি। তাই দৃশ্যত মনে হয় তারা মিথ্যার মধ্যস্থতা করে। কিন্তু ব্যাপারটা তা হওয়া অনুচিত, কেননা কোন সত্যপ্রকাশ যদি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেও যায় বা কারো বিপক্ষে যায় তবে তা প্রচারে বা প্রকাশে বিরত থাকাই বরং বস্তুনিষ্ঠ আর নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমের পরিপন্থী।

   সংবাদমাধ্যমের আপেক্ষিক সত্যের প্রকাশ সত্যের মিথ্যাচার। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম তাই সমাজের দর্পণ না হয়ে, আজ হয়ে উঠেছে আদর্শের দর্পণ। 
বিচারক নিরপেক্ষ থাকেন কিভাবে?  বিচারক কি অপরাধী বা বাদির প্রশ্নে নিরপেক্ষ থাকেন? না বিচারক অপরাধী বের করেন? আমরা এটা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি বিচারক,  অপরাধী আসলে অপরাধী কিনা তা যাচাই করেন সমস্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ মতামতের যৌথ ও পক্ষপাতহীন প্রতিফলনের ভিত্তিতে। নিরপেক্ষতা বলতে বুঝায় সত্যের পক্ষে থাকাকে। তথাকথিত নিরপেক্ষতা নয় বস্তুনিষ্ঠ সত্যনিষ্ঠ নিরপেক্ষতাই নিরপেক্ষতা।

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments