জ্বলদর্চি

আমার অনুভবে রবীন্দ্রনাথ /সুমিত্রা পাল

আমার অনুভবে রবীন্দ্রনাথ 

সুমিত্রা পাল

২৫ শে বৈশাখ এলে বুকের মাঝে কে যেন বলে ওঠে- “এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার…”  মাতন লাগে তখন আম্রকুঞ্জের ডালে ডালে। কোপাই আর ভূবনডাঙ্গা অবলীলায় এসে ধরে হাত। জমা খরচের হিসেবের খাতাটা তখন হয়ে ওঠে একান্ত রবি কথা। বাউলের একতারা   আর গাবগুবি ধ্বনিতে তির তির করে বয়ে যায় অন্তহীন শব্দের নকশিকথা! 
     তাঁকে স্মরণ করে সেদিন কাব্যসম্মেলনের আয়োজন, মঞ্চযাপন। অন্তরের অন্তঃস্থলে  আমরা অনুভব  করি তাঁর শাশ্বত, সনাতন বাণী। যা আজ আমাদের এক অনন্য সংস্কৃতি। বেঁধে রেখেছে আমাদের এক এবং অভিন্ন জাতিসত্ত্বায়, যার নাম-বাঙ্গালিয়ানা। তাঁকে        আত্মস্থ করা মানে সমগ্র  ভারতীয় সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করা।  আর তাইতো তাঁর পুণ্যতিথিতে সমস্ত ভারত হয়ে ওঠে বিশ্বভারতী।
যদিও দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে বিস্তর, ঝড় বয়ে গেছে আলোচনা- সমালোচনার। কিন্তু আজও মনে হয়- 
“কে কবে তোমাকে চিনিল পরিপূর্ণরূপে
যতই জানিতে চাহি, কেবলই মনে হয়
রহিল সবই বাকি।“
যান্ত্রিক ও জটিলতা সর্বস্ব এই জীবনে আমরা মানুষেরা সবাই সবার কাছ থেকে বড় বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। হয়ে উঠেছি কেমন যেন একা, নিঃসঙ্গ ও অনেকবেশি স্বার্থমনস্ক। সমাজ সামাজিকতা থেকে দূরে সরে, দিনকে দিন সম্পূর্ণ নিজস্ব এক গণ্ডিতে নিজেদের আবদ্ধ রাখতে রাখতে আমরা যখন কেউ কারুর ডাকে সারা দিতে অক্ষম, উপল খাপল, বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে  যখন টের পাই চেনা মানুষের কত অচেনা রূপ, জটিল সম্পর্কসূত্র আর তার টানাপোড়েন তখন তিনিই কাছে আসেন। শুনিয়ে যান তাঁর চিরন্তন বাণী- “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...”          
      আলো, বায়ু, জলের মতো তিনি আমাদের বাঙালি জীবনের সবখানে বিরাজমান। উৎসবে, ঋতুপরিবর্তনে, ভালোবাসায়, বিরহে, সজনে-বিজনে, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি… জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বারে বারে আমরা তাঁরই দ্বারস্থ হই। 
সবকিছুর মাঝেও মাঝে মাঝেই একাকীত্ব বড্ড বেশি গ্রাস করে আমাকে। বিশেষ করে অখণ্ড নিস্তব্ধতায় যখন ডুবে যায় চরাচর, তখন তাঁকে অনুভব করার সীমানাটা যেন  ছাড়িয়ে যায়। কেননা তখন আমার অবচেতনা থেকে চেতনায় শুধু ছড়িয়ে পড়ে তাঁর সঙ্গীতের বাণী, তাঁর সুরের সম্মোহন। ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই সপ্তসুরের তরঙ্গ, মূর্ছনায় ভেসে বেড়ায়  প্রাণ, শুধু প্রাণ। শুধু জীবনের জয়গান। মনে হয়, যেন এই পৃথিবীর সমস্ত  প্রাণের সঙ্গে আমিও মিলেমিশে এক হয়ে গেছি। অনুভব করি গানের ভিতর পাতা এক বিশাল ভূবন, অন্য এক ভূবন। অন্তরের আলোকিত ভূবন। 
তখন, যে কথা মুখে বলা যায় না, গানে গানে বলে ফেলি সে কথা। মুক্ত করে দিই মনের বন্ধ অর্গল।  আসলে তাঁর গান প্রতিটি বাঙালির মতো প্রভাবিত করে রেখেছে আমার জীবন ও জীবনদর্শনকেও। যখনই নিজেকে অসহায় বা দুর্বল বলে বোধ হয়, তাঁর গান মন্ত্রের মতো জাগিয়ে তোলে আমাকে। অক্লেশে আমি বলে উঠতে পারি-  
“আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পূর্ণ কর দহন দানে।“ 
 
প্রতিটি বাঙালির মতো আমারও সমস্ত অনুভব জুড়ে এইভাবেই ছড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ।    
এইতো সেদিন শান্তিনিকেতনের সংগ্রহালয়ে,হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলাম রবি ঠাকুরের। সিঁড়ির একপাশের দেয়ালে টাঙ্গানো বিশাল ছবিটি থেকে আলগোছে উঠে এসেছিলেন তিনি। তাকিয়ে ছিলেন একদৃষ্টে আমার দিকে। তাকিয়ে ছিলাম আমিও তাঁর চোখে চোখ পেতে। অজস্র দর্শনার্থীদের উপস্থিতি,তাদের চলাফেরা,ফিসফিস গুঞ্জন কিছুই আমাকে স্পর্শ করছিল না। কয়েকটি মুহূর্ত কত দীর্ঘায়িত হয়ে আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল,জানা নেই আমার।
    শুধু মনে হচ্ছিল তিনি আমার রবীন্দ্রনাথ। শুধু আমার,শুধুই আমার রবীন্দ্রনাথ। মনে  হচ্ছিল তিনি যেন আমার ভিতরে আসন পেতে বসেছেন। আর একটানে খুলে দিয়েছেন আমার জীবন সংহিতার পাতা। সেখানে শুধু ছলাৎ ছলাৎ শব্দতরঙ্গ… এক অদ্ভুত প্রাণস্পন্দন… শুধু অমৃত বারিধারা… এক দীর্ঘ অবগাহণ…  ক্ষুদ্র জীবনের গণ্ডিটাকে একপাশে সরিয়ে আমি অনন্ত জীবনটাকে এক নিমেষে যাপন করলাম। শব্দ ব্রহ্মমুলে শব্দকে প্রতিষ্ঠাপন করলাম। আমি সাকার থেকে নিরাকার হলাম। মিশে গেলাম তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments