জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব(৪)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম - পর্ব(৪).

 সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম 

ধর্ম এক বহুরূপী ধারণা। নীতিশাস্ত্রে বা ধর্মশাস্ত্রে নিয়মবন্ধনকে ধর্ম বলা হয়েছে। ধর্ম সূক্ষ্ম ও অনির্ণেয়। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে- "শ্রুতিঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ"।আবার বকরূপী যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির ধর্ম সম্পর্কে বলেন- "ধর্মের তত্ত্ব গুহ্যাতিত তবে  মহাজনো গতঃ স পন্থা।" এই মহাজন তিনি, যিনি স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল, যার অন্তঃকরণের প্রবৃত্তি সদাচারের সমৃদ্ধ, নৈতিকতায় ঋদ্ধ, শাস্ত্রানুশীলনের দ্বারা সবিচার ও সবিতর্ক মননের ফলে নিজের আত্মার কাছে যা প্রিয় বা গ্রহণীয় তা-ই ধর্ম। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী 'কর্ম কথা' গ্রন্থে বলেন- "যাহাতে মানব সমাজকে ধরিয়া আছে তাহাকে ধর্ম নাম দাও, আর যাহাতে সৌরমন্ডল ধরিয়া আছে বা জীবজগৎ ধরিয়া আছে তাহাকে ধর্ম নাম না দাও, তাহাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু উভয়েই একটি বৃহত্তর ব্যাপারের অঙ্গ; সেই বৃহত্তর ব্যাপারের নাম ঋত। সমস্ত বিশ্বজগৎ তাহার অধীন।.... এই যে ঋত, যাহা জগতের নিয়ামক... তাহা, ব্যবহারিক বিশ্বজগতের সত্যের সহিত অভিন্ন। বিজ্ঞান বিদ্যায় যাহার নাম সত্য।" অর্থাৎ যেখানে ঋত বা সত্য বিরাজ করছে, সেখানে ধর্ম ও বিরাজমান। 
  যেহেতু মানুষ পশুত্ব, মনুষ্যত্ব ও ঈশ্বরত্ব এই তিনটির সমন্বয়ে গঠিত, তাই তত্বদর্শীগণ এই উপলব্ধিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- অধিভূত, অধিদৈবত ও অধিযজ্ঞ। যা কিছু প্রবহমান, মরণশীল ও ক্ষয়িষ্ণু, তা সবই অধিভূত উপাদান। আর যার ক্ষয় নেই, যা 'ব্রহ্ম' শব্দের সমার্থক তাই হচ্ছে অধিদৈবত। অধিযজ্ঞ অংশ মানবিক স্তরে প্রকাশিত ঈশ্বরপ্রাপ্ত মহাজীবন বা মানুষের অবতাররূপ।
  মানুষ যখন জীব, তখন তার একমাত্র চেষ্টা বৈষয়িক চেষ্টা আর সংসার চর্চা। কিন্তু যখন মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করে, আমি কে? তখনই সে মনুষ্যত্বে সচেতন হয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। তখন সে সাময়িক লাভ অপেক্ষা, দীর্ঘস্থায়ী লাভ কিসে হয়, তার চেষ্টায় ব্রতী হয়। অনিত্য অপেক্ষা, নিত্য তার কাছে প্রিয়। জড়কে ত্যাগ করে চৈতন্যের অনুসন্ধানের ব্রতী হয়। এই মানুষ সঠিক অর্থে ধার্মিক। আপাত অপেক্ষা চিরন্তন তার লক্ষ্য। মৃত্যু তখন নাট্যকারের লেখা নাটকের একটা দৃশ্য। যা আবার আগামীদিন অভিনীত হবে। শুধু বাঁচার জন্য সংগ্রাম, তার কাছে জীবন নয়, জীবন তখন মরণ জয়ের সাধনা, সত্য শিব সুন্দরের আরাধনা। আর এরই অপর নাম ধর্ম। 
  ধর্ম কোন অলস ব্যাক্তির জীবিকা নির্বাহের ব্যাপার নয়, নিছক ভাববিলাসের সুরেলা কথা নয়। মানুষের জীবনের উৎকর্ষ সাধনই ধর্ম। তা না হলে বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন বলতেন না, "যে আদর্শবাদের প্রজ্জ্বলিত বর্তিকা আমার যাত্রাপথকে আলোকিত করিয়াছে এবং প্রতিনিয়ত যাহা আমাকে সহর্ষে জীবনের সম্মুখীন হইবার সাহস জোগাইয়াছে, তাহা হইতেছে " সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্"। রবীন্দ্রনাথ সত্য ও সুন্দরকে মানুষ নিজের নিজের অভিজ্ঞতায় ধরতে পারে- এই মত প্রকাশ করলে, আইনস্টাইন বললেন, সুন্দরের ক্ষেত্রে তা মানা যায়, কিন্তু সত্যের ক্ষেত্রে নয়। রবীন্দ্রনাথ সত্যকে মানুষের উপলব্ধি করতে হবে- এই মত প্রকাশ করলে আইনস্টাইন জোর দিয়ে বলেন, "I can not prove that my conception is right, but that is my religion... If there is reality independent of man,there is also a truth relative to this reality."
রবীন্দ্রনাথ ধর্মের বৈশ্বিক রূপটি উপলব্ধি করে লিখলেন:
"...বুঝিলাম, ধর্ম দেয় স্নেহ মাতারুপে, / পুত্ররূপে স্নেহ লয় পুন; দাতারূপে/
করে দান, দীন রুপে করে তা গ্রহণ;/
শিষ্য রুপে করে ভক্তি, গুরু রুপে করে/
আশীর্বাদ; প্রিয়া হয়ে পাষাণ-অন্তরে/
প্রেম- উৎস লয় টানি, অনুরক্ত হয়ে/
করে সর্বত্যাগ। ধর্ম বিশ্বলোকালয়ে /
ফেলিয়াছে চিত্তজাল, নিখিল ভুবন/
টানিতেছে প্রেম ক্রোড়ে- সে মহাবন্ধন/
ভরেছে অন্তর মোর আনন্দবেদনে..."
 ধর্মের তিনটি দিক- Essential of religion- সত্য বলা, সৎ পথে চলা ইত্যাদি; Philosophy of religion- জন্ম মৃত্যু জীবন ইত্যাদি বিষয়ে দার্শনিক মতবাদ; Ritual of religion- ধর্মীয় সংস্কার আচরণিক আনুষ্ঠানিক বিবিধ কর্তব্যপালন। সকল ধর্মেরই সারকথা- নিজেকে দমন করো; অন্যকে দান করো; দুঃখীর প্রতি দয়া প্রদর্শন করো। মানব সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত ধর্ম বিষয়ে চর্চা অব্যাহত রয়েছে। ধর্মকে প্রতিদিনের জীবন চর্চার অঙ্গ করে নেওয়ার ক্ষেত্রেই যত সমস্যা।  অপরা-শক্তির দাপট পরা-শক্তিকে পরাভূত করে চলেছে। মানুষ জিজ্ঞাসু হয়ে নিয়ত অন্বেষু হতে গিয়ে অপরা শক্তির দিকেই তার মন নিবিষ্ট করছে; Philosophy of religion,Essential of religion ও Ritual of religion-এর কাছে পরাজিত হচ্ছে। বাস্তব জগতের সঙ্গে পারমার্থিক ভাব জগতের সংশ্লেষণ না ঘটার ফলে ধর্মের রুপ কলঙ্কিত হচ্ছে। 
 দার্শনিক অ্যারিস্টটল যে কোন বস্তুকে চারটি স্তরে বিশ্লেষণ করেছেন- material cause, efficient cause, formal cause and final cause। মাটি উৎপাদনটি material cause। তার পরিবর্তিত রূপটি একটি পাত্র, যা হলো efficient cause; এই পরিবর্তন ঘটানোর ক্ষেত্রে যিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত তিনি formal cause এবং সর্বশেষে এই রূপবৈভবের আলোয় উদ্ভাসিত সৃষ্ট বস্তুটি গড়ে তোলার পিছনে যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে, সেইটি হল final cause।এখানেই সৃষ্টিকর্তা এলেন। সৃষ্টির পিছনে সৃষ্টিকর্তা কি রয়েছেন? তত্ত্বজ্ঞানী বললেন- রয়েছেন। যদি থাকেন, তবে তার উৎপত্তিস্থল কোথায়? তত্ত্বজ্ঞানী তত্ত্বের দিক দিয়ে, বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের দিক দিয়ে এই রহস্যময় স্রষ্টাকে খুঁজে চলেছেন।
  শ্রেণি পূর্ব বন্য মানুষদের জীবনের অধিকাংশটাই জুড়ে থাকতো প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং এই সংগ্রাম তখন তারা সবেমাত্র বুঝতে ও পরিচালনা করতে শুরু করেছে। তখন পর্যন্ত তাদের উৎপাদনের শক্তি অপরিণত এবং কৌশলও দুর্বল। অবশ্য এ সম্পর্কে তারা নিজেরা তখন সচেতন নয়। এই কৌশলের দুর্বলতা তারা মনে মনে পূরণ করতে চাইল ইন্দ্রজালের দ্বারা। ইন্দ্রজাল হচ্ছে এক মায়াবী কৌশল যার দ্বারা তারা এক স্বেচ্ছাচারী ইচ্ছাশক্তির জোরে প্রকৃতিকে বশ করতে চেষ্টা করে। 
  শ্রেণিসমাজে প্রকৃতিকে মানুষ ক্রমান্বয়ে বুঝতে আরম্ভ করে এবং নিজেদের বশে আনতে থাকে, কিন্তু মানুষের সমাজই তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভক্ত হয়ে গেছে। শাসকশ্রেণি তখন নিজেদের বিশেষ অধিকারগুলোকে ঐশ্বরিক অনুগ্রহের রং চড়িয়ে বেশি মেহনত করে কায়েম করার জন্য ইন্দ্রজাল কৌশলের সৃষ্টি করতে থাকে। এইভাবে মেহনতী শ্রেণিকে তাদের পদানত করে। জীবনের আসল কারণ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার ফলে মেহনতীশ্রণি তাদের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এইভাবে সৃষ্টি হয় ধর্মবিশ্বাসের। শ্রেনীসংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে এই যে ইন্দ্রজালের সৃষ্টি, তারই পরিবর্ধিত রূপ হচ্ছে ধর্মমত। সামাজিক বাস্তবতার এটি হচ্ছে একটি উল্টো ছবি। প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে আদিম মানুষের দুর্বলতা যেমন রুপ নিয়েছে ইন্দ্রজালের- ঠিক তেমনি সমাজের অগ্রগতির সামনে সভ্য মানুষের দুর্বলতা রুপ নিয়েছে ধর্মবিশ্বাসের।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments