জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৩৪

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৩৪
সম্পাদকীয়
ছোটো বন্ধুরা,  কোভিড কি তোমাদের কেবল যুদ্ধ করতেই শিখিয়েছে নাকি? ভেবে দেখেছ, কোভিডকালে স্কুলে না গিয়েও তোমরা নিজে নিজে পড়াশুনা করতে, যে সমস্ত খাবার মোটেও খেতে  চাইতে না, সেগুলো খেতে শিখে গেছ। এই যে দেখ না প্রচ্ছদের ছবিটি তোলার সময় অমিয় বিশ্বাস যখন বুলবুলিটাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করছ? সে কি বলল জানো? বলল, আমটি আমি খাব পেড়ে। ভাবতে পারছ, বুলবুলিটাও নিজে নিজে....
আমি জানি বুলবুলিটার মতো তোমরাও এই এক বছরে নিজে নিজে খাবার খেয়ে নিজের থালা বাটি মেজে নিতে শিখে গেছ, স্নানের সময় নিজের জামা প্যান্ট গামছা কেচে শুকাতে দিতে শিখে গেছ। তাই তো শ্রীকান্ত আঙ্কেল আবার এসে গেছেন তোমাদের রাঙাপিসির মজলিশি গল্প শোনাতে। তবু যদি কেউ স্বপ্ননীল রুদ্রের ছড়ার ভানু ভায়ার মতো এখনও কুঁড়েমি কর কিংবা তোমাদের বন্ধু সূর্যানী নাগের গল্পের ফাঁকিবাজটার মতো থেকেও থাকো তারা অন্তত নিজের খাবারের শেষটা বাঁচিয়ে বেড়াল কুকুর কাককে দিও। কাকের কথায় মনে পড়ে গেল, তোমাদের বন্ধু উর্মি কাকেদের গল্প লিখেছে। এতসবের পরেও কেউ যদি বাড়ির বড়োরা জল চাইলে ছুট্টে গিয়ে জল না দাও, বাড়ির ছোটোদের ছোটোবেলা পড়ে না শোনাও তাতেও আমি রেগে যাব না। একটু দু:খ পাব শুধু। কারণ নন্দিতা আন্টির ছড়ায় আমি জেনে গেছি হারাধনের দশটি ছেলের সবাই সমান হয় না। আর যারা এসব কিছু শিখে গেছ তারা সারাদিনের পড়াশুনা, ছোটোখাটো কাজ আর খেলাধুলার শেষে যখন বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজবে তখন শুভশ্রী আন্টির গল্পের নীল চোখের পরীটাকে স্বপ্নে দেখতে পাবেই পাবে। আর একটা কথা বলে রাখি, আমার তরুণ লেখক লেখিকাদের জন্য আমি রতন জেঠুর কাছ থেকে ফোন নন্বর নিয়ে ফুলকুসুম পুরের গল্পকাকা আর ছড়া পিসিকে বলে দেব যাতে তারা তোমাদের বেশি বেশি গল্প আর ছড়া লেখা শিখিয়ে দেন। আর তোমরা আমাকে পাঠিয়ে দাও। কাজের কথা আজ এখনেই শেষ।  - মৌসুমী ঘোষ

ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ৭
রতনতনু ঘাটী 
অহেতুকপুর পঞ্চায়েত অফিসে কাজ করেন গল্পকাকা। পঞ্চায়েতের কাজের থেকে নানা সমাজসেবা মূলক কাজে মেতে থাকেনতিনি। যেমন, তিনি সমস্ত গৃহপালিত প্রাণীপক্ষীর পক্ষে। কলকাতার ‘পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি’র মেম্বারশিপ নিয়েছেন আজ অনেক দিন হয়ে গেল। গত মার্চ মাসে আসানসোলে পথকুকুরদের নিয়ে এক পশুপ্রেমী সংগঠন কার্নিভাল করেছিল বার্নপুরের এস এস পি ময়দানে। কুকুররা লাইন করে প্রসেশান করল। সেই অনুষ্ঠানে গল্পকাকা অতিথি হিসেবে ডাক পেয়েছিলেন। কুকুররা সেই অনুষ্ঠানে কত খেলা দেখাল, তাদের পুরস্কারও দেওয়া হল। জলাতঙ্ক হবে না--এমন টিকাও দেওয়া হল কুকুরদের। গল্পকাকা এরকম নানা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে যান পথকুকুরদের নিয়ে। 
   পরদিন সকালবেলা নিধিকাকুদের কাজের ছেলে বিটকাই এসে গল্পকাকাকে ডাকতে লাগল। গল্পকাকা বাইরে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিটকাই, কী হয়েছে রে? ডাকছিস কেন?’
    বিটকাই বলল, ‘নিধিবাবু খবর পাঠিয়েছেন, তুমি একটা কুকুর বাচ্চা নেবে বলেছিলে না? আজই সেটা নিয়ে আসতে বলেছেন। চারটে কুকুর মিলে গোটা বাড়িটাকে নোরাং করে তুলছে। নিধিজেঠিমা এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাধিয়েছেন বাড়িতে। বাড়িতে তেষ্টানো দায়।’ বলেই চলে গেল বিটকাই।
   কুকুর বাচ্চাটা নিয়ে আসার কথাটা ইচ্ছেদাদুর কান এড়াল না। রাগত গলায় বললেন, ‘এই যে ছোটদের গল্পকাকা, যাও, এবার তোমার পুষ্যিটিকে বাড়িতে নিয়ে এসো। ওই বা কী অপরাধ করল যে, ও এখনও এ বাড়িতে প্রবেশাধিকার পেল না? আমি জানি, এ বাড়িতে এর পর একদিন পাড়ার সকলেই দেখতে পাবে, একজনও মানুষ নেই। শুধুই ঝাঁকে-ঝাঁকে গৃহপালিত প্রাণীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে!’
   অনিচ্ছেঠাকুরমা সামনের বাগান থেকে পুজোর ফুল তুলত যাচ্ছিলেন। দাদুর কথা শুনে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বললান ‘কুকুর বাচ্চাটা তো আনতে চেয়েছে ওদের গল্পকাকা। কই রে, যা না বাবা, কুকুর বাচ্চাটাকে বাড়িতে নিয়ে আয়! কী নাম রেখেছিস রে? ওকে আমরা কী নামে ডাকব?’
   গল্পকাকা বললেন, ‘মা, ওর নাম ‘বিংগো’।’
   ঠাকুরমা ফুলের সাজি হাতে তাকালেন গল্পকাকার মুখের দিকে। বললেন, ‘এ কীরকম নাম হল রে? কুকুর লাল রঙের দেখতে হলে তার নাম হয় ‘লালু’। আর সে কুকুর যদি ভুলোমনের হয় তা হল তার নাম ‘ভুলু’, কালো রঙের দেখতে হলে তাকে ‘কালু’ বল ডাকা হয়, নয়তো আদরের নাম হয় ‘তুতু’। কিন্তু আমদের গ্রাম-দেশের কুকুরের নাম ইংরেজিতে কেন? না না, তুই বরং একটা বাংলা নাম রাখ! দেখছিস না, আমার হীরামনের নাম আমি অন্য কিছু না রেখে রেখেছি ‘রাধাগোবিন্দ’?
   বিন্নি সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে ঠাকুরমার কথা শুনছিল। সে বলল, ‘কেন ঠাকুরমা, আমাদের ছড়াপিসি তোমার হীরামনের একটা নাম রেখেছিল না ‘এলাটিং’? ছড়াপিসির বিয়ে হয়ে এখন শ্বশুরবাড়িতে চলে গেছে দুমকায়। কিন্তু কথায়-কথায় ছড়া বলতে পারত? কত ছড়াই না তার মুখস্থ ছিল, বলো? তুমিই তো পিসির নাম রেখেছিলে ‘ছড়াপিসি’?
   ইচ্ছেঠাকুরমা হাসলেন, ‘তা বলতে পারত বটে। তবে তোদের ছড়াপিসির দেওয়া এলাটিং নামটা আমার পছন্দ হয়নি। ওসব টিং টাং, ওগুলো কি কোনও নাম হল রে? তার চেয়ে আমার হীরামনের রাধাগোবিন্দ নামটাই আচ্ছা!’ তারপর গল্পকাকা মজার গলায় বললেন, ‘জানো তো মা, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেইন ওবামার পোষা দুটো পর্তুগিজ কুকুর ছিল। একটা কুকুরের নাম ‘বো’, আর-একটার নাম ‘সানি’। এখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেরও তো দুটো পোষা জার্মান শেফার্ড কুকুর আছে। একটার নাম ‘চ্যাম্প’ আর একটার নাম ‘মেজর’। তাঁরা তাঁদের কুকুরের বাংলা নাম রাখেননি বলে কি আমি আমার কুকুরের ইংরেজি নাম রাখতে পারি না? মা, ওর নাম বিংগোই থাক, তুমি আর আপত্তি কোরো না। এক্ষুনি বাবা শুনলে আকাশ মাথায় তুলবে!’
   ঠাকুরমা বাগানের দিকে ফুল তুলতে যেতে-যেতে বললেন, ‘তা যা, বিংগোকে নিয়ে আয়। নিধিকাকারা যখন রাখতে চাইছে না, তখন ওকে সেখানে ফেলে রাখার দরকার নেই।’
   গল্পকাকা বেরিয়ে গেলেন। মনে হয় বিংগোকে আনতেই গেলেন। এখনই বাড়িতে বিংগোর আগমন ঘটতে চলেছে বিন্নি এই টাটকা খবরটা তিন্নি আর বুম্বাকে দিতে ছুটল দোতলায়। কোনও খবর ওদের দিতে দেরি হয়ে গেলে বিন্নির মোটেও ভাল লাগে না।
(এর পরে আগামী রোববার)

আলেক্সানা 
শুভশ্রী সাহা

নীল চোখের পুতুলটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেলো, জারিনের। কি সুন্দর!  সোনালি চুল নীল তারার। গায়ের রঙ টা কেমন আইস হোয়াইট। একটা লাল গাউন পরা।  শপিং মলের ডলস হাউস থেকে তুলে নিয়ে কাউন্টারে ড্যাডির কাছে ছুট্টে চলে এলো সে। ইস কেউ যদি নিয়ে নেয়  আবার! 
রাস্তাতেই তার নাম দিয়ে দিয়েছে সে, মোহুর।
নিজের ঘরে এসে বিছানার পাশে রাখতেই মনে হল, কে যেন বলছে আমি তো ইউরোপিয়ান ডল, এ নাম বদলে দাও প্লিজ। 
জারিন একটুও রাগ করল না। নাম দিল আলেক্সানা। নীল তারার চোখ ঝক ঝকে হয়ে গেল আবার। 
-- ইউরোপিয়ান বেবি কি ড্যাডি? 
-- যেমন তুমি টার্কিশ বেবি! 
জুহাল হাসল, খাবার দিতে দিতে, হানি, তুমি এখনো ছোট্ট আছ, বড় হলে জানতে পারবে। এখন ড্যাডিকে খেতে তো দাও! 
-- না আমি বড় হয়ে গেছি। জারিন মুখ ঘোরালো।
জুহালকে সহ্য করতে পারেনা জারিন, তার মম  এখন আকাশের তারা হয়ে গেছে, তাই জুহাল সব সময় তার ড্যাডির পাশে পাশে ঘোরে। 
কোলে বসানো ছিল  আলেক্সানা দুম করে পড়ে গেল মাটিতে, অমনি আওয়াজ হলো তাদের কিচেনে। একি 
জুহাল মাটিতে পড়ে হাত কেটে রক্তারক্তি! 
পরের দিন স্কুলে একটুও মন বসল না জারিনের। কখন বাড়ি যাবে সে! রাগী মিসেস ইয়াগিজ ক্লাস থেকে বের করে দিলেন জারিন কে। জারিন আর কে করে, তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে এলো। সে স্কুলের লবি থেকে টেনিস কোর্ট,  প্লে গ্রাউন্ড দেখতে দেখতে  দেখতে পেল দোল্পনায় দুলছে আলেক্সানা। এত দূর থেকেও তার নীল চোখ ঝকঝকে। একি! আলেক্সানা এখানে  কি করে এলো? টিফিন ব্রেকে ক্লাসে ফিরতেই হেডমিস বললেন মিসেস ইয়াগিজ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ক দিন আর আসবেন না! জারিন চুপ করে গেল। বাড়ি ফিরে দেখল আলেক্সানা নিজের জায়গায় বসে আছে, তার চোখের নীলতারা ঝক ঝক করছে। 
ড্যাডি বেরিয়ে গেলেই জুহাল সারাদিন কম্পিউটারে কি সব খুট খাট করে যেন। জারিন দেখে কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। জারিনের ড্যাডি কম্পিউটর ইঞ্জিনিয়ার  টার্কিশ এমব্যাসীতে কাজ করেন, জারিন সেটা জানে।  কিন্তু কি করে বলবে ড্যাডিকে!  আলেক্সানার দিকে তাকাতেই, মনে হল সে যেন   চিন্তা করছে কি! নীলতারাদুটো  ধুসর লাগছে তার! 

উফফফ জারিন, তুমি কি এই কম্পিউটর ধরেছিলে, পাসওয়ার্ড বদলে গেছে কি করে! 
-- আমি! জুহাল আন্টি,  ড্যাডের কম্পিউটর তো তুমি খোলো রোজ! আমি তো দেখি! 

জুহাল চিৎকার করতে গিয়েও পুতুল্টার দিকে চোখ পড়তে সে চুপ করে গেল! ধকধক করছে তার মণি দুটো।

রাতের বেলা এক গ্লাস দুধ খায় সে ডিনারের পর। কি বিদঘুটে গন্ধ ওলা,আর মম  কি সুন্দর ভ্যানিলামন শেক করে দিতো। ঠিক মায়ের গায়ের ভ্যানিলা গন্ধ আর বাবার গায়ের লেমন গন্ধ মাখা! এই দুধ তার খেলেই ঘুম পায়। জেগে থাকতে পারেনা, ড্যাডির সাথে দেখাও হয় না তার আর। 
-- আমি দুধ খাব না! খেলেই ঘুম পায়, জারিন চেঁচালো। 
-+ বেয়াদপ মেয়ে! এবার ড্যাডকে বলে তোমাকে স্কুল বোর্ডিং এ দিয়ে দেব। 
জারিন খুব কাঁদল। বোর্ডিং এ তার খুব ভয়। জুহাল বকতে বকতেই নীল তারা পুতুলের দিকেচোখ চলে  গেল! কি অসম্ভব ঠান্ডা দৃষ্টি।  কিন্তু লাল। 
জুহাল গ্লাস টা জোর করে দিতে যেতেই ঘাড়ে একটা খট করে শব্দ পেল। ভার শূন্য হয়ে পড়ে গেল সে মেঝেতে।  মেঝেতে  পড়ার আগে সে  একটা অদ্ভুত রঙের আলো দেখতে পেয়েছিল মাটিতে।  
তিনদিন বাদে তার যখন জ্ঞান ফিরে এলো, পুলিশ তাকে আরেস্ট করে নিয়ে গেল। ওর ল্যাপটপে টার্কিশ এমব্যাসীর অনেক ইনফরমেশন পাওয়া গেছে।  পুলিশ অনেক দিন ধরেই ওর খোঁজ করছিল। ওই জুহাল নামে লুকিয়ে ছিল ওদের বাড়িতে, ওর বাবার কম্পিউটার হ্যাক করে ইনফরমেশন পাচার করবে বলে। 

আজকাল আলেক্সানার চোখে জারিন একটা সানগ্লাস পড়িয়ে রেখেছে। সে তো জানে ওর চোখেই সব সমস্যা। যদি বাকিরাও বুঝতে পেরে যায়!  গভীর  রাতে আলেক্সানা নীল পরী হয়ে অনেক উপরে উঠে যায়।

হারাধনের দশটি ছেলে
নন্দিতা দাসবসু

হারাধনের দশটি ছেলে যায়নি কোথাও হারিয়ে,
রয়েছে কেউ নকশীখাতায় কেউ বা স্বপ্ন জড়িয়ে,
একটি ছেলে ডাক্তার হয়ে করছে সেবা দশের-
উদয়াস্ত হুকুম তামিল করছে কেউ বসের ;
কেউ বা গায়ক, কেউ প্রকাশক কেউ বা শখের কবি,
কেউ বা ইছামতীর তীরে আঁকছে প্রাণের ছবি,
একটি ছেলে রিং-এর ভিতর করছে বেজায় কুস্তি-
তালমিলিয়ে কষছে যে প‍্যাঁচ নেই যে মোটেও স্বস্তি ;
শেষ ছেলেটি নিরুদ্দেশের পথে দিচ্ছে হাঁটা,
নয় সে লম্বা, নয় সে বেঁটে, নয় সে মোটাসোটা,
চেয়ে দেখো লাজুক দৃষ্টি হানছে তোমার চোখে,
হারিয়ে সে যাবে না কোথাও থাকবে সবার বুকে !


রাঙাপিসির গল্প
গঙ্গাবক্ষে পাঁচ রাজকন্যে  
শ্রীকান্ত অধিকারী 

বেড়াতে কার না ভাল্লাগে।  দিনটা ছিল গুডফ্রাইডে। হিসেব করলে পর পর তিন দিন ছুটি। মা বাবার প্লানমাফিক এবার ঠিক হল মুর্শিদাবাদে যাব। হাজার দুয়ারি, মতিঝিল, ঘসেটি বেগমের ঢিবি, জগৎ শেঠের বাড়ি, ঘড়ি ঘর, সেই চমৎকার আয়না, যা দিয়ে পিছনের সব গুপ্ত শত্রুদের দেখা যেত, গঙ্গার ধার,--  আরো কত কি। আর তর সইছিল না। আমি  আর দাদা গাড়িতে চেপেই ড্রাইভারকাকুকে বললাম , কতদূর গো কাকু?  
 ড্রাইভারকাকু বললেন , ঠিকঠাক চললে দু’-আড়াইঘণ্টার মধ্যে ঢুকে যতে পারব।  
গাড়ি বাঁ বাঁ করে ছুটে চলল। ও হো বলাই হয়নি রাঙাপিসি ছাড়া বেড়ানো হয় কি। ঘুরে বেড়াতে  সেখানের গল্পগুলো তো রাঙাপিসিই বলবে। বলতে বলতে রাঙাপিসি বললেন, বল তো মুর্শিদাবাদ কি জন্য বিখ্যাত ?  
-- প্রাচীন বাংলার রাজধানী । আর পলাশীর যুদ্ধ । সঙ্গে সঙ্গে দাদা উত্তর দেয় ,-- ১৭৫৭ সাল। ইংরেজের সঙ্গে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার যুদ্ধ। যুদ্ধে হেরেও যায় সিরাজ ।  
রাঙাপিসি মুচকি হেসে বলে, সেটা ঠিক । একদম ঠিক। কিন্তু এর আগেও এইখানে এই আমবাগানে বিশাল যুদ্ধ হয়। বর্গীদের সঙ্গে । তোদের তেমন ভাবে জানার কথা নয় । সে সব কথা ইতিহাসে সেভাবে লেখাও নেই। সেই ছড়াটা শুনিশ নি—“ ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো ,বর্গী এলো দেশে ।  বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে? ধান ফুরোলো পান ফুরোলো খাজনার উপায় কী... 
-- বর্গী আবার কি? আমার মুখে এই প্রশ্ন শুনে রাঙাপিসি আর দাদা যেন হতবাক! – এমন গাড্ডু আর বোধহয় পৃথিবীতে নেই। আমি আর কোনও প্রশ্ন চোখে মুখে না এনে বাইরের দিকে  মুখ করে বসে রইলাম । 
গাড়ি ময়ূরাক্ষী নদীর সঙ্গে ছুটে চলল। দেখতে দেখতে কখন যে বীরভুম পেরিয়ে পূর্ববর্ধমানকে ডাইনে রেখে আমরা পৌঁছে গেলাম বহরমপুরের গঙ্গার ব্রীজে । সেখান থেকে কিছুদূর যেতেই ঘোড়ার গাড়ির টুমটুম আওয়াজে বুকটা ধকধক করে উঠল। চারদিকে তখন নানা রঙের  ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়াগুলো কি সুন্দর রংবেরঙের ফিতে কাপড় দিয়ে সাজানো। মন চটফটিয়ে উঠল কখন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ব।-- হতাম যদি একটা দিনের রাজা। রাজরাজরা তো ঘোড়ার গাড়িতেই চড়ত। আশায় বুক বাঁধছি, ঠিক তখনি বাধল গোল। রাস্তা আটকে দাঁড়াল মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা । তাদের একজন বললেন, আজ কেন এলেন ? আজ তো সব বন্ধ। শুক্রবার না।–জুম্মা বার। ভালো করে দেখতে পাবেন না। 
আমাদের মুখগুলো তখন দেখার মত। মেঘলা আকাশ। 
হঠাৎ রাঙাপিসি সবাইকে চমকে দিয়ে বলে,  ভালোই হল। নবদ্বীপধাম তো যাওয়ার কথা ছিল , হাতে একদিন সময় যখন পেলাম এই অবসরে উদ্ধারণপুর হয়ে কাটোয়া ঘুরে নেওয়া যাবে।  সোনারুন্দি রাজ পরিবার। মুরুন্দি গ্রাম, লোহারুন্দি ।কিশোরী সায়র পুকুর, গোল পুকুর। 
  রাঙাপিসির কথাকে কাটে কার সাধ্যি। গাড়ি ঘুরে সালার হয়ে সোজা সোনারুন্দি। পুরোনো নিত্যানন্দ দেবের রাজবাড়ি। শোনা যায় মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কাটোয়াতে থাকাকালীন এই রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। এই পুরনো বিশাল বিশাল প্রাসাদের মাঝে মাঝে ইট পলেসট্রা খসে খসে পড়েছে। কোথাও দেয়ালের গায়ে বট-পাকুর আর বুনো ঝোপ ঝাড়ে ভরে গেছে। বাঁদিক ডানদিক যেদিক তাকাই উঁচু উঁচু ভাঙা ভাঙা দেয়ালগুলো ভূতের মতন দাঁড়িয়ে আছে । তাদের সাম্রাজ্য আগলাচ্ছে। আগে কখনও পুরোনো রাজবাড়ি দেখি নি। বুক ঢিবঢিব করছে।  
  তখন সকাল দশটা সবে পার হয়েছে। বাইরে রোদ ঝকঝক করছে । কিন্তু এখানে কেমন ছায়া ছায়া । নিঝুম ! একজনকেও দেখতে পেলাম না। 
দাদার হাত ধরে অলিগলি এ প্রাসাদ সে কুঠুরি, পুরনো দড়দালান, ভাঙা সিঁড়ি ঝুল বারান্দা পেরিয়ে কোন ম্যাজিকে কখন পৌঁছে গেলাম বিশাল এক পুকুরের সামনে। চারদিকে বাঁধানো। চারটে সিঁড়ি।  অদ্ভুত এক চুপচুপ ভাব। দাদার হাতটা চেপে ধরেছি ঠিক তখনি রাঙাপিসি বলল কামরাঙা একটা মজা দেখবি ? –জোরে হাততালি দে। দে না। রাঙাপিসিও জোরে জোরে হাততালি দিতেই আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ পুকুরের মাঝখানে জল উথাল পাথাল করে তীর বেগে এগিয়ে এলো গোটা কয়েক মাছ। ভয়ে আঁতকে উঠে রাঙাপিসিকে জাপটে ধরে প্রায় চিৎকার করে উঠি –রাঙাপিসি--!   
রাঙাপিসি হেসে ওঠে,- এতো ভয় কীসের রে ? ওরা কারও ক্ষতি করে না। ওরা হল এই রাজবাড়ির আশ্রিতা ,-- সোনারুন্দি , রুপোরুন্দি , লোহারুন্দি, শ্রীরুন্দি আর কাটুন্দি। নবাব আলিবর্দীর পাঁচ বেগম।   
  মাছগুলো ততক্ষণে পরিষ্কার ঘাটে এসে উঁকি দিচ্ছে। কি বিশাল বিশাল সব মাছ।  এ যে আমার থেকেও বড় মনে হল। আর কি সুন্দর দেখতে! বেগমই বটে। একবার করে মাথা তোলে আবার জলের তলে চলে যাচ্ছে।     
  ওই দ্যাখ ওই দ্যাখ , নাকে সোনার নথ কেমন চকচক করছে।  
এবার খুব কাছ থেকে দেখলাম সত্যি ওরা নথ পরে কেমন পুরো ঘাট জুরে লেজ নাচিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  
  দাদা হঠাৎ রাঙাপিসিকে শুধোয় , ওই মাছগুলো মানে ওই রাজকুমারিগুলোর এমন নাম হল কেন ? 
--হবে না কেন? এখানে তখন যে সোনা রুপো লোহার মত ধাতুর খুব কাজ হত। এখানের লোকেরা ছিল ব্যবসাদার। বাণিজ্যই ছিল এদের জাতি ব্যবসা। তাইতো এদের শখ করে নাম  রেখেছিল সোনা রুপো লোহা এই সব দিয়ে।  
দাদা মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল , রাজকুমারি তো এখানে এই পুকুরে কী করছে? আর মাছই বা হল কেন ?
  ---হ্যাঁ । এইটা তো শুনতেই হবে। তবে এটাকে পুকুর বলে না, বলে সায়র। এর গল্প তো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হবে না। তার আগে কিছু পেটে দিতে হবে। 
 
  মা’র তৈরি লুচি মুখে ভরতেই রাঙা পিসি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, এর কারণ সেই ভয়ঙ্কর বর্গী আক্রমণ । তোকে সকালে শুধালাম না মুর্শিদাবাদ কী জন্য বিখ্যাত? পলাশীর যুদ্ধের ঠিক পনেরো ষোলো বছর আগে বর্গীরা এখানে এসেছিল বেশ কিছু অর্থ-সম্পদ জোগাড় করতে। তখন বাংলার নবাব অর্থাৎ রাজা ছিলেন আলিবর্দী খান। উড়িষ্যা দেশের নবাব দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খানের উৎসাহে সুদূর মারাঠা মানে এখন যেটা মহারাষ্ট্র প্রদেশ সেখানের নাগপুর রাজ্যের শাসনকর্তা রঘুজী ভোঁসলে বাংলা আক্রমণ করে। তবে তিনি নিজে আসেননি, তার প্রধান সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বাংলার মুর্শিদাবাদ সহ আশপাশে বীরভূম বর্ধমান হুগলী আক্রমণ করে। সাথে সাথে ভয়ঙ্কর লুটপাট চালায়। মাঠের ফসলে গ্রাম-গঞ্জে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সাধারণ মানুষদের এমন অত্যাচার করতে শুরু করে যে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই বর্গীর নাম শুনে আঁতকে ওঠে। আমাদের মত মা মাসি পিসিরা নিজের জীবনের ভয়ে; সম্মানের ভয়ে যে যেখানে পারে লুকিয়ে পড়ে। কেউ বাড়ির চোরাকুঠুরিতে, তো কেউ মাটি খুঁড়ে গর্তে ঢুকে পড়ে। কিংবা কাছাকাছি কোনও জঙ্গলে লুকিয়ে যায়। আর যারা এইটুকুও করতে পারে না তারা পুকুর দিঘিতে কিংবা নদীর জলে ডুবে নিজেদের বাঁচায়। দশ বছর ধরে এই বাংলা ওদের দস্যুপনা সহ্য করেছিল।  
ওরা আসা বন্ধ করেছে কবে ।  তারপর ইংরেজরা রাজ্য শাসনে এসেছে, প্রায় দুশোবছর রাজ্যত্ব করে তারাও চলে গেছে ।  তবু এখনও মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান, হুগলী, মেদনীপুরের আনাচে কানাচে বর্গীর নাম শুনলে মানুষ হেঁচকি তোলে। 

  তখন ছিল এরকম এক বোশেখ মাসের বিকেল। গঙ্গার তীরে মৃদুমন্দ বাতাস বয়ছে। নবাব আলিবর্দীর কিছু বেগম ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর সাজানো নৌকাতে চড়ে গুনগুন গান করতে করতে নদীর  ঢেউ গুনছেন আর হাওয়া খাচ্ছেন। মনে তাদের অফুরন্ত খুশি। ততক্ষণে বর্দ্ধমান শহরে রানিদিঘির ধারে তাঁবু খাটিয়েছেন যুদ্ধ ফেরত নবাব। সেখানে বসে নবাব আলিবর্দী ভাস্কর পণ্ডিত নামে মারাঠা সেনাপতির চাওয়া দশ লক্ষ টাকা চৌথ কর দিতে নারাজ হয়েছেন। ব্যস আর যাই কোথা! সঙ্গে সঙ্গে মারাঠারা শুরু করে দেয় লুটপাট, মারধর । --হেন কালে চতুর্দ্দিকে বরগী দিল দেখা / চারদিকে বরগী আইল কত আর । / তা সভার হাতে দেখি লাহাঙ্গা তলোয়ার।। -- রাঙাপিসি রামায়ণ পড়ার মত সুর করে গেয়ে ওঠে।   
  আতঙ্কে সব ঘর ছেড়ে পালাতে চাইলে বর্গীরাও ঘিরে ধরে । বেগম খানা। হাতীখানা। কোষখানা ,নবাবের যেখানে যা অঢেল ধন সম্পত্তি আছে কিছুই বাদ যায় না। সেই খবর পৌঁছায় গঙ্গার জলে। প্রাণের ভয়ে সেই রাজনৌকো ছুটল গঙ্গার ধার ধরে। কেউ কেউ কোনও রকমে উঠতে পারল গঙ্গার পুব পারে। কেউ গঙ্গার জলে ঝাঁপ দেয় । সেই নৌকোতে আরও অনেক  বেগমের সঙ্গে ছিল জমাদার কন্যারা । পরে তারা বেগম হয়েছিল —সোনারুন্দি, রুপারুন্দি , লোহারুন্দি, শ্রীরুন্দি আর কাটুন্দি । তারা গঙ্গার পশ্চিম পার ধরে অনেকটা এসে লুকিয়ে পড়ে উদ্ধারণপুর দাঁইহাটের কাছাকাছি কোন ঝোঁপ-জঙ্গলে। সেখানেইও তারা রেহাই পায় না। শেষে  কাঁদরা ফুটিসাঁকোর জমাদারের তৈরি এক বিশাল পুকুরের জলে পাঁচজনে একসঙ্গে ডুব দেয়।   
বর্গীদের চলে যাওয়া কত বছর যে পেরিয়ে গেল। যখন আবার দ্বিতীয় শাহ আলমের  সাহায্যে মহারাজা রুপে নিত্যানন্দ দালাল তার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন করে রাজপ্রাসাদ করার সময় লোকে দেখে এই সায়রে বিশাল পুকুরের জলে পাঁচজনে একসঙ্গে ডুব দেয়।   

  বর্গীদের চলে যাওয়া কত বছর যে পেরিয়ে গেল। যখন আবার দ্বিতীয় শাহ আলমের  সাহায্যে মহারাজা রুপে নিত্যানন্দ দালাল তার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন করে রাজপ্রাসাদ করার সময় লোকে দেখে এই সায়রে বিশাল বড়বড় মাছ সোনালি লেজ নিয়ে জলে খেলে বেড়াচ্ছে । তাদের প্রত্যেকের নাকে সোনার নথ পরা। আসলে ওরা ওদের জন্মভূমির টান ভুলতে পারে নি।   
  রাঙাপিসির কথা শুনতে শুনতে আমরা যখন বর্গীদের সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা, আর পাঁচ রাজকন্যের মাছ হয়ে যাওয়ার কথায় বিভোর হয়ে আছি। সায়রের জল হাওয়া লেগে তির তির করে কাঁপছে,-- হঠাৎ কার যেন গলা শোনা গেল।         
--বড় ভালো মেয়ে ওরা। মানুষদের ভালবাসে, কথা শোনে নাচ দেখায় ।  এক  পুরোহিত হাতে একটা ঘটি নিয়ে পাশে কলমি গাছে ফুল তুলছিলেন । খেয়াল করিনি। উনি গাছের আড়াল থেকে বলেন, --তবে ওদের  এবার খাবার সময় হয়েছে। আর এখানে থাকা চলবে না। 
     
  চলে আসার সময় মনে হল আমাদের ইতিহাস বইয়ে না থাকা একটা অধ্যায় থেকে বেরিয়ে এলাম। আর পেছন ফিরে দেখছিলাম একবার, একবার অন্তত একসঙ্গে পাঁচ রাজকন্যে জলের মধ্যে নেচে উঠুক ।
ফিরে আসার মুখে দাদার শেষ প্রশ্ন – রাঙাপিসি আবার যদি বর্গীরা আসে? 
--আসতেই পারে। তোরা তো আছিস! ঠেঙিয়ে বিদেয় করবি।

ভানু ভায়ার ভাবচক্কর  
স্বপ্ননীল রুদ্র

ভোরে উঠে ভানু ভায়া নকল দন্ত ব্রাশ না করে
রান্নাঘরে ঢুকেই সোজা ভাত গিলে তার উদর ভরে

ঢেকুর তুলে মাঠে গিয়ে জগিং শুরু, সঙ্গে ব্যায়াম—
একটু পরেই হাঁপিয়ে উঠে গপ করে খান দু-তিনটি আম

মুখটি মুছেই দৌড় শুরু হয় থামে গিয়ে বাস ডিপোতে,
চালককে কন, ‘রেস লাগাবেন? যাক না দেখাই কে আজ জেতে!’

বাড়ি ফিরে জলখাবারে প্লেটে সাজান লুচির ঢিপি,
ফ্রিজের থেকে পাঁচ লিটারের কোকের বোতল, খোলেন ছিপি

খেয়েদেয়ে নকল দাঁতের পাটি খুলে সাবান জলে
ভিজিয়ে রেখে ঘন্টাখানেক নোংরা তাড়ান রগড়ে কচলে

ভরদুপুরে চায়ের নেশা মাটির কুঁজো জোগাড় করে
চায়ের পাতা দুধ ও লবণ কেনেন রোজই দেনা করে

চায়ের পরে গলা ব্যথা, গলা টেপেন ভৃত্য নগেন
আরাম পেয়ে নিদ্রা গভীর, দিন পেরিয়ে ভোরে ওঠেন।

একটি না মানুষের কথাকলি 
উর্মি শর্মা 
দ্বাদশ শ্রেণি, চন্দননগর

শীতের সকাল।উত্তরের হাওয়া। আমি বাস স্ট্যান্ডে।আকাশে ঝলমল করছে  সূর্য। হঠাৎই চোখ গেল
ব্যাঙ্কোয়েটের সামনে ডাস্টবিনের দিকে। এক মস্ত বুড়ো ঝোরো কাক ডাস্টবিনে উঁকি ঝুঁকি মারছে। 
ব্যাপারটা কী? 
এগিয়ে চললাম সেই দৃশ্যের দিকে।ছিঁড়ে গেছে তার ডানা,শরীরে ক্ষতচিহ্নের সমাহার,সে এক জীবন্ত নরকঙ্কাল। কয়কটি কুকুরও আছে এই দৃশ্যে।সকলে মিলে খাবার খুঁজে চলেছে। 
কিছু একটা পেলেই আনন্দে চকচক করে উঠছে লোকটির চোখ।নিজেও খাচ্ছে আর বন্ধু কুকুরদেরও খাওয়াচ্ছে।এ যেন নরকে পিকনিক। 

আমার মন খারাপ হয়ে গেল। পাশের দোকান  থেকে
কিনে আনলাম বিস্কুট আর পাউরুটি। তুলে দিলাম তার হাতে। সে তো অবাক। মুখে ছড়িয়ে পড়লো আলো।

ফিরে চললাম বাসষ্ট্যান্ডের দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে হল পিছনে কেউ হাঁটছে। ঘুরে দেখি সেই ঝোরো কাকটি খোঁড়াতে  খোঁড়াতে আসছে এবং
অদ্ভুত শব্দ করে আমাকেই ডাকছে। আমি ভয় পেয়ে 
গেলাম।একছুটে বাসস্ট্যান্ডে।
কী হল? কী হয়েছে? 

আশপাশ থেকে লোকে জানতে চাইল।
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে জানালাম ঘটনা। ঝোরো কাকটিও অবশেষে হাজির হল সেখানে। রে- রে করে উঠলো লোকজন।সে অদ্ভুতভাবে বাড়িয়ে দিল তার মলিন হাত।
সে হাতে ঝলমল করছে আমার ছোট্ট পার্স।


স্বপনবাবুর নতুন নাতি
সূর্যানী নাগ 
দ্বাদশ শ্রেণি, ইউ. পি. পাবলিক স্কুল, সিউড়ি, বীরভূম

আজ প্রায় তিন চারদিন হল স্বপনবাবুকে নিয়ে তাঁর বাড়ির লোকেরা  জেরবার। সত্তর বছরের একজন রিটায়ার্ড হেডমাস্টার যদি এইসব কাণ্ড ঘটান তাহলে বাড়ির লোকের চোখ কপালে ওঠার আর দোষ কী ? গত পরশু তিন বছরের ছোট নাতির হাত থেকে বল কেড়ে চিমটি কেটেছেন। সে বেচারি 'ভ্যাঁ' করলে ভেংচি কেটেছেন। বড় নাতির অঙ্কের মাস্টার মশাইয়ের পাঞ্জাবির পেছনে দোয়াতের কালি ঢেলেছেন। রামধন গয়লার পেছনে ঢিল ছুঁড়েছেন। সবচেয়ে কেলো যেটা করেছেন রান্নাঘরের কাচের বয়ামে রাখা আমের আচার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে নিজের স্ত্রীকে বলেছেন, "সরি দিদা,  আর করব না"। শুনে স্বপনবাবুর স্ত্রী হাত-পা ছড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছেন, "একী সব্বোনাশ হল গো আমার! আমায় ডাকছে কিনা দিদা !” খবর পেয়ে বেয়াই মশাই এক হাড়ি মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন ।গুলতি ছুঁড়ে রসগোল্লার হাঁড়িতে অর্জুনের মত লক্ষ্যভেদ করতেই ঘরের মেঝেতে রসগোল্লা আর রস মাখামাখি। ছেলে স্বরূপ বাবাকে পাকড়াও করতে গিয়ে হাতে কামড় খেয়েছে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে বেয়াইমশাই আর রিস্ক না নিয়ে পিঠটান দিয়েছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে বাড়ির সবাই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর তোড়জোড় শুরু করেছে।
                               
  না স্বপনবাবুকে শেষ পর্যন্ত সাইক্রিয়াটিস্ট এর কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। কারণ চারদিন পর থেকেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। স্ত্রীকে দিদা না বলে গিন্নি বলে ডেকেছেন। ছোট নাতির জন্যে নতুন বল কিনে এনেছেন। নিয়মমাফিক বাজার গেছেন। বেয়াই এর  সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছেন। ব্যাপার-স্যাপার দেখে স্বপনবাবুর  স্ত্রী ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছেন, "হ্যাঁরে ক্ষেপেই বা গেল কেন? আবার সেরে উঠলোই বা কেমন করে?" স্বরূপ মাথা নাড়তে নাড়তে বলে," ঠিক বুঝতে পারছি না। পিকিউলিয়ার ব্যাপার।" তার মা ছেলেকে বলেন, "আমাকেই না হয় একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস।" ছেলে বাবাকে শুনিয়েই মাকে বলে, "কেসটা কি একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো।"
                         
  বাড়ির লোকের কথা শুনে মুচকি হাসেন স্বপন বাবু । জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবেন। যা বলবেন তা কি বাড়ির লোক বিশ্বাস করবে? তিনি যদি বলেন এই চারদিন একটা ছোট্ট ভূতের ছানা তার মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল। আর তার জন্যই এতসব অশৈলী কান্ড তাহলে হয়ত সত্যিই সাইকিয়াট্রিস্টের  কাছে নিয়ে যাবে। আসলে দিন কয়েক আগে দোতলার ছাদে চেয়ার পেতে সন্ধেবেলায়  একটু হাওয়া খাচ্ছিলেন । হঠাৎ নারকেল গাছের লম্বা পাতা বেয়ে সরসর করে কে যেন নেমে এল তার কাছে। তিনি আঁতকে উঠে দেখেন কালো রোগা ডিগডিগে একটা বাচ্চা ছেলে তার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল , “ আঁমাকে বাঁচাও গোঁ দাঁদু ।" খোনা স্বর শুনে চমকে উঠে বললেন, "কে তুই?"
  - - -" আঁমি ভূঁত গোঁ দাঁদু । দঁয়া কঁরে বাঁচাও আঁমায়।"
- - কেসটা কি?
- -" পঁরীক্ষায় ফেঁল কঁরেছি।  বাঁবা শ্যাওড়া ডাঁল হাঁতে খুঁজে বেঁড়াচ্ছে।"
স্বপনবাবু অবাক হন, - “ ভূতের আবার ইউনিট টেস্ট? পাস ফেল? ”
   - হ্যাঁ গোঁ দাঁদু ।বঁলছি কিঁ তোঁমার শঁরীরের ভেঁতর আঁমাকে তিঁন চাঁর দিঁনের জঁন্য এঁকটু শেঁল্টার দাঁও না। বাঁবার রাঁগ পঁড়লে আঁবার বেঁরিয়ে আঁসব।"
প্রথমে আমল দেননি স্বপন বাবু ।কিন্তু ভূতের ছানার কাঁদুনিতে নিমরাজি হতে হল। তবে শর্ত দিয়েছিলেন," দেখ আমি হেডমাস্টার হয়েও ফেল করা ছেলেকে মানে ভুতের পোকে শেল্টার দিচ্ছি। কথা দে পরের বার ভালো রেজাল্ট করবি। না হলে চেয়ার ডাউন করে রেখে দেব। ”
  - - “ রাঁজি রাঁজি রাঁজি!” বলেই ওপরে ভুতের পো সেঁধিয়ে গিয়েছিল স্বপন বাবুর শরীরে। আর তারপরেই যত ভৌতিক কান্ড।
                    
  মাস তিনেক পরে আরেকটা সন্ধ্যাবেলা। স্বপনবাবুর বাড়ি আজ সরগরম। ছোট নাতির জন্মদিন। অতিথিরা উপহারের প্যাকেট নিয়ে আসছেন। স্বপনবাবুর পাঞ্জাবির পকেটে হঠাৎ একটা ছোট্ট টান পড়ল। একটা খোনা গলা কানে ফিসফিস করে বললো, “ এঁকটু ছাঁদে যাঁবে দাঁদু? ”
সকলের নজর এড়িয়ে ছাদে উঠতেই ভুতের পো ধপাস করে প্রণাম করে বলে, “ দাঁদু ইঁউনিট টেঁস্টে এঁবার পাঁস কঁরেছি। কঁথা রেঁখেছি দাঁদু । ”
নেহাত ভূতের পিঠ নেই তাই পিঠ চাপড়াতে পারলেন না। খুশি হয়ে বললেন - - “ বেশ বেশ , তা ভালো দিনেই এসেছিস। বাড়িতে ভালো মন্দ রান্না হয়েছে। দুটো ফিস ফ্রাই খাবি?”
ভূতের ছানা সোৎসাহে ঘাড় নারে - - “ হ্যাঁ দাঁদু ভেঁটকির তোঁ?”
- - - “ আর চিলি চিকেন! দাঁড়া একটু। নিয়ে আসছি, পালাস না যেন। ”
নতুন নাতির জন্যে ফিস ফ্রাই আর চিলি চিকেন আনতে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে থাকেন।
পাঠ প্রতিক্রিয়া ১
(জ্বলদর্চির ৩৩ তম ছোটোবেলা সংখ্যা পড়ে সৌপর্ণ সেন,কোলকাতা পাবলিক স্কুল,দমদম, যা লিখল)

  করোনা নামক এই ভয়ংকর অতিমারীর কবলে পড়ে সকল মানব জীবন যখন সংকটে,সকলের মন যখন বিষন্নতার কালো মেঘে আচ্ছন্ন তখন জ্বলদর্চি নামক এই শিশুদের পত্রিকাটি মনকে নতুন ভোরের আলো দেখায়।

  প্রচ্ছদে কল‍্যান আঙ্কেলের তোলা ছবিটি সত‍্যি অসাধারণ।ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ধারাবাহিক উপন‍্যাসটি আমার খুবই ভালো লাগছে।ড.ণবনীতা আন্টির পরামর্শ শুনে মনে নতুন আশার আলো জাগলো।স্নেহা দাস,অরিজিৎ ঘোষ এদের আঁকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিগুলি খুব সুন্দর।মানসী আন্টির ভুট্টা চুরি গল্পটা পড়ে খুবই মজা পেলাম।সমাদৃতা দিদির স্বপ্নের দুষ্টুমি আমার খুব ভালো লেগেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি পরের সংখ‍্যার জন‍্য।

পাঠ প্রতিক্রিয়া ২
(জ্বলদর্চির ছোটোবেলা ৩৩ পড়ে কলকাতা থেকে বিশ্বনাথ চৌধুরী যা লিখলেন)

সারা পৃথিবী যখন অতিমারির কবলে ভুগছে
যে সময় বেশিরভাগ পত্র পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে না, মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ছে
সেইসময় জ্বলদর্চির মতো ই ম্যাগাজিন, এত নিপুণ হাতে নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদনা করে নিয়মিত প্রকাশ করছেন মৌসুমী ঘোষ, যেটা একশো শতাংশ প্রশংসার দাবী রাখে। ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ৩৩ পড়লাম। চোখ
  প্রথমেই আটকে যায় কল্যাণ সাহার অপূর্ব
চিত্রে। চিত্রগ্রাহক হিসেবে উনি স্বার্থক। এ ছাড়া সায়নী কুন্ডু, কথাকলি দত্ত,
স্নেহা দাস, অরিজিৎ ঘোষ ও শুভজিত ঘোষের আঁকাগুলো দেখে আলাদা আলাদা 
আনন্দ পেলাম। মৌসুমী ঘোষের সম্পাদকীয় পড়লে সমগ্র সংখ্যাটির সম্যক ধারণা পাওয়া
যায়। রতনতনু ঘাটির ধারাবাহিক " ফুল কুসুমপুর খুব কাছে -৬ " প্রতিবারের মতো লেখাটায় ডুবে গেলাম আর মুগ্ধ হলাম। ধন্যবাদ রতনতনু বাবু। " রবি ও মাম " লেখায়
  অভিজিৎ চৌধুরী খুব সুন্দর ভাবে " আমাদের ছোট নদী " এই কথাটা ব্যবহার করেছেন। রঞ্জনা বসুর ছন্দময় কবিতা মন কাড়ল। মানসী গাঙ্গুলীর " ভুট্টা চুরি " খুব ভালো লাগলো। বাণীয়া সাহার " কিডন্যাপ " নিবেদনে অন্যরকম স্বাদ পেলাম। ছোট্ট সোনা
শতভিষা মিশ্রর " বৃষ্টি ", সমাদৃতা হালদারের
" স্বপ্নের দুষ্টুমি " খুব সুন্দর উৎসাহব্যঞ্জক প্রচেষ্টা। পরিশেষে জানাই, সোমরাজ দাস ও অদিতি ঘোষ দস্তিদারের পাঠ প্রতিক্রিয়া আমাদের মতো সব লেখকেরা প্রচুর উৎসাহ পায় এবং এর গুরুত্ব অপরিসীম।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 



Post a Comment

1 Comments