জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪২/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৪২

শ্যামল জানা

সাররিয়েলিজম্

সাররিয়েলিজম্ কথাটি এসেছে সুপার রিয়েলিজম্(Super Realism)থেকে৷ অর্থাৎ অতিরিক্ত বা অতি(Super) বাস্তবতা (Realism)থেকে৷ আর, সাররিয়েলিজম্ কথাটির আক্ষরিক মানে হচ্ছে পরাবাস্তবতা৷ সহজ করে বললে তৃতীয় বাস্তবতা৷ সাধারণত প্রকৃতিতে আমরা যা দেখি, সেগুলির সব কিছুরই একটি সাধারণ বাস্তবতা থাকে৷ কিন্তু তার সঙ্গে যদি অতিরিক্ত আরও একটি বা একাধিক বাস্তবতা যোগ হয়, তাহলে সেই বাস্তবতা প্রকৃতির সাধারণ বাস্তবতার থেকে আলাদা হয়ে যায়৷ এ প্রসঙ্গে আসার আগে একটি কথা বলে নেওয়ার প্রয়োজন আছে৷ সেটি হল— দৃশ্যের সাহায্য ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি না৷ তা, কাজ করা, কথা বলা, লেখা, ছবি আঁকা, যাইই করি না কেন৷ সে সরাসরি দেখা দৃশ্য হতে পারে, স্মৃতি থেকে পেড়ে আনা পুরোনো কোনো দৃশ্য হতে পারে, বা মগজে কল্পনায় তৈরি করা কোনো দৃশ্যও হতে পারে৷
ধরা যাক বন্ধুদের সঙ্গে দার্জিলিং-এর ম্যালে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখছি৷ এত সুন্দর যে, ছেলে-বউয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, ওরা থাকলে খুব খুশি হত৷ রাতে হোটেলে বসে ছেলেকে চিঠি লিখছি— “জানিস তো, কী অসাধারণ সূর্যোদয় দেখলাম”৷ এই যে চিঠি লিখছি, এটি লেখার সময় চারটি দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে৷ একটি সরাসরি, এই চিঠি ও কলম৷ আর, তিনটি মনে মনে৷ প্রথমটা ম্যালের দৃশ্য, একটু আগে আমি যেটা দেখলাম৷ দ্বিতীয় ও তৃতীয়— ছেলে ও বউয়ের মুখ বা চেহারা৷ এটাই সত্য৷
আবার, এর ঠিক উল্টো সত্যটিও আছে৷ সে দিক থেকে দেখলে— যা আমি দেখিনি, তাকে আমি ভাবনা-চিন্তায় কখনো আনতে পারব না৷ আঁকতেও পারব না, কল্পনাতেও আনতে পারব না৷ একবার কোনো একটি কলেজে এই সাররিয়েলিজম্ পড়াতে গিয়ে এক ছাত্রী প্রশ্ন করেছিল— “স্যার, আমরা তো রাক্ষস দেখিনি, তাহলে তার ছবি আঁকি কী করে, বা তাকে কল্পনা করি কী করে? মোক্ষম প্রশ্ন৷
  ছোটোবেলায় আমরা যখন খেলাধুলা করতাম, বড়কা বলে আমাদের একজন ডানপিঠে বন্ধু ছিল৷ আমাদের সবার থেকে সে ছিল অনেকটা লম্বা-চওড়া, আর তেমনি গায়ে জোর৷ আর, সব সময় একে মারছে, তাকে মারছে, আমরা তটস্থ হয়ে থাকতাম৷ ওর অনুপস্থিতিতে আমরা বলবলি করতাম— ইস্ আমরা যদি ওর থেকে আরও বড় হতাম, ওর থেকে গায়ে জোর বেশি হত, তাহলে ওকে দেখে নিতাম৷ একদিন আমাকেও শুধুশুধু ও বেশ করে মারল৷ খুব রাগ হলেও কিছু বলতে পারলাম না৷ মারটা হজম করলাম৷ সেদিন স্বপ্নে দেখলাম আমি বিশাল বড় হয়ে গেছি, প্রায় তিনতলা সমান৷ ইয়া বড়বড় সব নাক-মুখ-চোখ-কান৷ ঘুম ভাঙার পরেও ওই স্বপ্নটা বেশ মনে ছিল৷ ঘুমের ঘোরে বুঝতে না পারলেও ঘুম থেকে ওঠার পর বুঝতে পেরেছিলাম আমি একজন শক্তিশালী রাক্ষস হয়ে গেছিলাম৷ বুঝলাম এই কারণে, যে আমি ‘ছোটোদের মহাভারতে’ রাক্ষসের গল্প পড়েছিলাম৷ সেখানে রাক্ষসের ছবিও আঁকা ছিল৷ সেদিন কিছুই বুঝিনি, আজ বুঝি কেন বাস্তবে রাক্ষস না থাকলেও কী করে আমি অবচেতনে স্বপ্নের মধ্যে রাক্ষস দেখেছিলাম, বা একজন শিল্পী কী করে কল্পনায় রাক্ষস এঁকে ফেলে?
  আসলে, একজন মানুষকে আমরা যদি বাড়িয়ে (Enlarged) তিনতলা সমান উঁচু করি, তাহলে সে বাস্তবের সঙ্গে মিলল না শুধুমাত্র তার আকৃতিগত কারণে৷ কিন্তু, দৃশ্যত তার কোনো পরিবর্তন ঘটল না৷ যা যা মানুষের থাকে— চোখ-কান-দাঁত ইত্যাদি সেগুলোই ছিল, এমন কিছু ছিল না, যা মানুষের থাকে না, বা আমি আগে দেখিনি, কিংবা প্রকৃতিতেই তার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ তবে, মানুষের আকৃতিটা যেহেতু বিশাল বড় হয়ে গেছে, তার শরীরের অংশগুলিও সেই রকম বড় হয়ে যাবে৷ সেজন্য সেই অংশগুলির মতোই দেখতে অথচ অনেক বড় এমন কোনো বস্তু দিয়ে আমরা সেগুলি বদলে(Replace)দিলাম৷ যেমন— কানের বদলে কুলো, চোখের বদলে ভাটা(জ্বলন্ত উনুন), নাকের বদলে নারকেল গাছের গুঁড়ি, দাঁতের বদলে মূলো, ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এই এত কিছু এক জায়গায় জড়ো হয়ে যা দাঁড়াল, তাতে করে সে আর দৃশ্যত বা ধারণার দিক থেকে মানুষ থাকল না, রাক্ষস হয়ে গেল, যা বাস্তবে নেই৷ কিন্ত, যদি আমরা এই জড়ো হওয়া বস্তুগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে দেখি, তাহলে দেখব এগুলো আমরা হামেশাই দেখি৷ প্রত্যেকটিরই বাস্তবে অস্তিত্ব আছে৷ কিন্তু যখনই এগুলি একসাথে জড়ো হল, তখন আর তা বাস্তব থাকল না৷ তৃতীয় বাস্তবতা, বা পরাবাস্তবতা (Surrealism) তৈরি হল৷ এটি সম্ভব হল একই রকম দেখতে একটির সঙ্গে আর একটির পাল্টাপাল্টি হল বলে৷ আর, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যে, এক রকম দেখতে(অন্য রকম দেখতে হলে হত না) একটির সঙ্গে আর একটির পাল্টাপাল্টি৷ যার জন্যই কিন্তু এই ধারণাগত আমূল পরিবর্তন বা রূপান্তর(Metamorphosis) ঘটানো সম্ভব হল(ছবি-১)৷

  আর, এই যে, কোনো এক বা একাধিক বাস্তবে থাকা দৃশ্য, এক রকম দেখতে বলে(juxtaposition) একটির সঙ্গে আর একটির সহজে পাল্টাপাল্টি ঘটে গেল, এই ঘটে যাওয়াটা ঘটে আমাদের অবচেতন অবস্থায়৷ অথচ তাকে আমরা সচেতন অবস্থায় প্রয়োগ করতে পারি৷ এই অবচেতনে ঘটে যাওয়া একটি দৃশ্যের সঙ্গে আর একটি দৃশ্যের পাল্টাপাল্টিকে যদি আমরা সচেতন অবস্থায় সঠিক বা সুচারুভাবে করতে পারি, তখন তাকে আমরা সাররিয়েলিজম বলি৷
  দাদাইজম্-এর যে বিরুদ্ধ-যুক্তিবাদের তত্ত্ব(Theory of anti-rationalism), মূলত একে কেন্দ্র করেই সাররিয়েলিজম্-এর সৃষ্টি হল৷ কিন্তু তফাৎ হল— দাদা-র সময় যে বিজ্ঞানটা ছিল না, বা তখন আবিষ্কার হয়নি, সাররিয়েলিজম্ কিন্তু সেই বিজ্ঞানকে পেল৷ যেটি হল— সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর ‘মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব’(Theory of psychoanalysis)৷ এই বিজ্ঞান যুক্ত হওয়ার ফলে সাররিয়েলিজম্-এর সৃষ্টিগুলি যেমন শক্তিশালী হল, তেমন আকর্ষণীয়ও হল৷ এই সাররিয়েলিজম্ প্রসঙ্গে সবচেয়ে ছোটো করে সবচেয়ে উপযোগী কথাটি বললেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাররিয়েলিস্ট শিল্পী ম্যাক্স আর্নস্ট— "creativity is that marvelous capacity to grasp mutually distinct realities and draw a spark from their juxtaposition."                                       (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে দুশাম্প, পিকাবিয়া, ম্যান রে, এবং তাঁদের সঙ্গে আর যে সব শিল্পীরা ছিলেন, তাঁরা পরীক্ষামূলকভাবে যে শিল্পকর্মগুলি সৃষ্টি করেছিলেন, সেগুলি থেকেই দাদাইজম্-এর সূত্রপাত হলেও তখনও ওই শিল্পকর্মগুলিকে দাদাইজম্ হিসেবে চিহ্নিতকরণ করা হয়নি।

Post a Comment

1 Comments

  1. পরের পর অনেকগুলো এপিসোড
    পড়তে পড়তে এসে সাররিয়ালিজম্
    পর্ব পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। এর আগে
    এর ব্যাখ্যা শ্যামলের মুখে বহুবার শোনা। যেটা আমাকে সব সময়ই প্রাণিত করেছে। এই লেখাটিতে যে
    মূল্যায়ন ও করে চলেছে তার কালের
    দলিল হিসেবে থাকবে আমি নিশ্চিত। শুভেচ্ছা রইল আগামীর।

    ReplyDelete