জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প – আফ্রিকা (মাদাগাস্কার) চাতুরী করো না/ চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প – আফ্রিকা (মাদাগাস্কার)

চিন্ময় দাশ 

চাতুরী করো না 

পাহাড়ের একেবারে কোল ঘেঁষে একটা গভীর জঙ্গল। আর, বন-জঙ্গল মানেই হাজারো প্রাণীর বাস। বাঘ, সিংহ, হাতিদের মত বড়সড় প্রাণীরা আছে। আছে খরগোশ, বেজি বা কাঠবেড়ালির মত ছোটরাও। আর পাখ-পাখালি, পোকা-মাকড়দের তো কথাই নাই। 
তো সেই বনের ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে একটা নদী। তাতে বেশ সুবিধাই হয় সকলের। তেষ্টা পেলে পেট ভরে জল পান করে নাও। গরম পড়েছে, তো গা ডুবিয়ে নাও নদীতে নেমে। সকলের কাছেই বেশ উপকারী নদীটা।
  একবার সেই নদীই সকলের বিপদ হয়ে উঠল। বিপদ বলে বিপদ! একেবারে মৃত্যুদূত যেন। হয়েছে কী, দু'দিন ধরে টানা বৃষ্টি হল সেবার। পাহাড়ের গা বেয়ে সব জল নামতে লাগল নদীতে। শুধু জল আর জল। সে জলের যেন মাপজোক নাই।
  দেখতে দেখতে ফুলে-ফেঁপে টইটুম্বুর হয়ে গেল নদীটা। প্রথমে পাড় ছুঁয়ে ফেলল জল। তারপর নদী উপচে পড়ল ডাঙায়। বনের ভিতর অনেক দূর পর্যন্ত সব ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।
  বড় বড় জীব যারা, তাদের তেমন কিছু হল না। তবে ছোট যারা, তারা পড়ল ভারী বিপদে। ঘর-বাড়ি তো ভাসলোই, কত জীবজন্তুও যে ভেসে গেল, লেখাজোখা নাই।
  সেই বিপদের সময় একটা ভালো জিনিষ দেখা গেল। এতদিন ভারী বদনাম ছিল বুনোকুকুরদের। যেমন ধূর্ত, তেমনি হিংস্র তারা। দল বেঁধে থাকে। শিকারও করে দল বেঁধে। মওকা পেলে বাঘ, সিংহ, এমনকি হাতিকেও রেয়াত করে না তারা। বন্যার সময় তেমনই পাঁচটা বুনোকুকুর দল বেঁধে নেমে পড়েছিল উদ্ধারের কাজে। কতজনকে যে তারা বাঁচিয়েছে, তার ঠিক-ঠিকানা নাই।
  সবাই অবাক, সবাই ভারি খুশি। সবাই ভাবল-- এতদিন যতটা মন্দ ভেবেছি হতভাগাগুলোকে, ততটা মন্দ নয় ওরা। ঠিকই, বিপদের সময়েই বোঝা যায়-- কে ভালো আর কে মন্দ।
 বেশি খুশি হয়েছে বনের রাজা-- সিংহ। কুকুরগুলো বন্যা দেখে, হা-হুতাশ না করে, পালিয়ে না গিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়েছে পড়শিদের উদ্ধারের কাজে। দেখাই যায় না এমনটা। এই ভেবেই রাজা খুশি।
সিংহ ভাবল, বনের সবাইকে ডেকে বলতে হবে এই পাঁচজনের বড় মনের কথা। সকলের সামনেই ধন্যবাদ দিতে হবে কুকুরগুলোকে। এই ভেবে, একটা সভা ডাকল রাজামশাই।  কিন্তু তার বউ, সিংহী বিশ্বাসই করল না কুকুরদের ভালোমানুষির ঘটনাটা। সভায় গেল না সিংহী। গা এলিয়ে শুয়ে রইল গুহায়। 
বেশ বড়সড় একটা গুহায় থাকে সিংহ। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা। সেখানে এসে জড়ো হয়েছে বনের যত প্রাণী। ছোট থেকে বড়-- কেউ বাদ যায়নি। রাজার ডাক বলে কথা, আসতেই হবে। তাছাড়া এমন সভা তো আর সচরাচর হয় না। হবে কী করে? এমন বন্যাও হয় না ফি-বছর। এমন ভালোমানুষিও দেখা যায় না যখন তখন। সকলেই এসেছে বেশ খুশি মনে।
নিচে যেমন ভিড়, উপরে গাছের মাথাতেও ভিড় কম নয়। পাখিরাও এসেছে দল বেঁধে। বৃষ্টির দাপটে তাদের বেশ ভোগান্তি হয়েছে বটে, তবে বন্যায় কোন ক্ষতি হয়নি। একজনও ভেসে যায়নি পাখিদের। তবু তারাও এসে ভিড় করেছে। 
  সিংহ বসেছে একটা উঁচু পাথরে। সামনে সবাই যে যেমন পারে বসে পড়েছে। পাঁচটা কুকুর বসেছে আলাদা একটা পাথরের উপর। রাজার হুকুমে আলাদা করে বসানো হয়েছে তাদের। এটাও তাদের একটা সম্মান দেখানো-- এই আর কী।
সিংহ বলতে শুরু করল-- শোন সবাই। বয়স আমার কম হয়নি। এখানে আরও কেউ কেউ আছে, যারা বয়সে আমার চেয়েও বড়। কিন্তু আমরা কেউই জীবনে এতো বড় দুর্যোগ দেখিনি কখনও। একসাথে এতজন নিজেদের লোক ভেসে গিয়েছে, এমন দুর্ভাগ্য কখনও হয়নি আমাদের। 
  সবাই সায় দিতে লাগল মাথা নেড়ে, লেজ নেড়ে। রাজা বলল-- তবে বিপদের সময়, অসহায়ের পাশে এসে দাঁড়াতে হয়, এমন ছবিও কখনো দেখিনি আমরা। এবারের বন্যায় এমন ভালো কাজের উদাহরণও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের। এটা কম পাওয়া নয়। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদের। বেঁচে থাকতে হলে, সকলে হাত ধরাধরি করে বাঁচতে হয়। পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়াতে হয় বিপদের সময়। কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবলেই চলে না।
  সিংহকে যেন কথায় পেয়েছে আজ। থামতেই চাইছে না। বলে চলেছে, তো বলেই চলেছে। রাজা বলে কথা। কেউ কিছু বলতে পারছে না। চুপটি করে শুনে যাচ্ছে বসে বসে।
  এদিকে হয়েছে কী, কুকুর পাঁচটা সেসব শুনছে আর হাসছে মিটিমিটি করে। একটা মোড়ল ছিল কুকুরদের। সে বলল-- এবার দেখছি, রাজা বদল করতে হবে আমাদের। রাজা এমন বোকা হলে, চলে কখনও? এটার মাথায় তো ঘিলু বলে কিছু নাই দেখছি। 
  পাশের কুকুরটা বলল-- আর বোল না, মোড়ল। তখন থেকে শুনছি, আর পেটের ভিতর গুড়গুড় করে উঠছে আমার। কখন না হাসতে গিয়ে পেটটাই ফেটে যায় ফটাস করে।
  অন্য পাশের কুকুরটা বলে উঠল-- অভাবের দিনে খাবো কী, এই ভেবে যে আমরা যে ক'টা জীবকে পারি বাঁচাতে গেছিলাম, সেটা ধরতেই পারেনি কেউ। রাজাটা সত্যিই একটা গোঁয়ার গোবিন্দ।
একজন বলে উঠল-- যার মাথায় ঘাড়ে অমন বুনো ঝোপের মত চুল জড়িয়ে থাকে, তার মাথায় ঘিলু থাকবে কী করে? 
  কুকুরদের তো আলাদা পাথরে বসানো হয়েছে। ধারে কাছে নাই কেউ। কেউ শুনতেও পাবে না তাদের কথা। এই ভেবে, মন খুলে গল্প করতে লেগেছে পাঁচটাতে।
কিন্তু পাথরের পিছনে ঘাপটি মেরে বসে ছিল একটা কাঠবেড়ালি। অত ভিড় দেখে, সামনে যায়নি পুঁচকেটা। কুকুরদের সব কথা শুনে যাচ্ছে সে। শুনছে, আর অবাক হয়ে যাচ্ছে। পেটে পেটে এতো ধূর্ত বুদ্ধি বদমায়েসগুলোর? পরে ধরে ধরে খাবে, এইজন্য বাঁচিয়েছিল অন্যদের! 
  এদিকে রাজার কথা শেষ হয়ে এসেছে। সব শেষে রাজা বলল-- আমি খুব খুশি হয়েছি কুকুর পাঁচটার ওপর। তোমরাও সবাই নিশ্চয় খুশি।
সবাই চিৎকার করে সম্মতি জানালো তাদের। বেশ একটা কলরব তৈরী হল সভা জুড়ে।
সিংহ বলল-- খুশি হয়ে আজ আমি পাঁচ জনকে ভোজ দিতে চাই। আজ এই পাঁচজন আমার অতিথি। আমার বাড়িতে ভোজ খাবে পাঁচজন।
আবার একটা হুল্লোড়।  সবাই হৈ-হৈ করে সায় দিল তাদের রাজার কথায়।
  কাঠবেড়ালিটা পাথরের পিছন থেকে বেরিয়ে সোজা রাজার কাছে চলে এসেছে ততক্ষণে। একেবারে রাজার ঘাড়ে উঠে পড়েছে সে। সবাই তার কান্ড দেখে যেমন ভড়কে গেল, ভয়ও পেয়ে গেল তেমনই। ক্ষেপে গিয়ে কিছু একটা না করে বসে রাজা। 
কাঠবেড়ালির কিন্তু কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। সে ফিসফিস করে কুকুরদের সব কথা বলতে লাগল রাজার কানে-- উপকার করবার জন্য কাউকে বাঁচায়নি ওরা। সবাই ভেসে গেলে, ওরা খাবে কী? নিজেরা ধরে ধরে খাবে বলে, বাঁচিয়ে রেখেছে যে কজনকে পারে। সবটাই ধূর্তামি। 
  যত শোনে, হাসিখুশি মুখ পাল্টে যায় সিংহের। প্রথমে গম্ভীর। তারপর ভয়ানক ক্রূদ্ধ। যেন এখনই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে কুকুরগুলোর উপর।
  কাঠবেড়ালি তাড়াতাড়ি সামাল দিল রাজাকে। বলল-- একেবারেই চটবেন না, রাজামশাই। যা করবার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। উচিত শিক্ষা দিতে হবে বদমায়েসগুলোকে।
রাগ সামলে রাজা বলল-- কী করা যায় এখন? নেমন্তন্ন করে দিয়েছি যে সবার সামনে। 
কাঠবেড়ালি বলল-- উতলা হবেন না আপনি। দেখছি, কী করা যায়। আপনি বরং একবার খরগোশকে ডাকুন এখানে।
  সিংহও ভালোই জানে, ছোট্টটি হলে কী হবে, বুদ্ধি ভালোই আছে খরগোশের মাথায়। বুদ্ধি শেয়ালের মাথাতেও আছে। কিন্তু শেয়ালের মত ধুরন্ধর নয় খরগোশ। বেশ শান্ত-শিষ্ট প্রাণীটি।
খরগোশকে ডেকে পাঠানো হোল। কাঠবেড়ালি আর সিংহ দুজনে মিলে বলল তাকে সব কথা। রাজা বলল-- উচিত শাস্তি দিতে হবে পাঁচটাকে। আবার, নেমন্তন্নের ব্যাপারটাও যেন ভেস্তে না যায়। 
একটু ভেবে নিয়ে খরগোশ বলল-- আপনি কিচ্ছুটি ভাববেন না, রাজামশাই। সব বন্দোবস্ত করে ফেলছি।
কথাবার্তা যা কিছু হোল, সবই তিনজনের মধ্যে। জমায়েতের কেউই সেসব শুনতে পেল না। জানতে পারলো না। 
  পরামর্শ শেষ করে, সিংহ সবাইকে বলল-- দেরি করা ঠিক নয়। সময়ের কাজ সময়ে করাই নিয়ম। নেমন্তন্নের ব্যাপারটা এখনই সেরে ফেলতে বলল আমার এই দুই বন্ধু।  আমিও মেনে নিয়েছি।
সবাই হই-হই করে উঠল আনন্দে। সকলেই খুশি।
খরগোশ বলল-- তবে, একটা কথা। সবাই হয়তো জানো না, আমাদের রানীমার শরীর ভালো নাই। সেজন্যই এই সভাতেও আসেননি তিনি। সেজন্য, একসাথে আমাদের পাঁচ বন্ধুকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। হট্টগোল হয় যদি।
  একটু থেমে রইল খরগোশ। একবার চোখ বুলিয়ে নিল জমায়েতটার ওপর। পাঁচটা ধূর্ত শেয়ালের ওপরেও। কেউ কিছু সন্দেহ করছে কি না, ঠাহর করার চেষ্টা করল সে।
  আবার বলতে লাগল-- অতিথিদের এক একজন করে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হবে। একজনের খাওয়া শেষ হলে, তখন পরের জন যাবে। তবে, খাওয়া শেষ হলেই চলে আসতে হবে না কাউকে। ভিতরেই বিশ্রাম করবে সে। সবার খাওয়া শেষ হলে, রানীমার সাথে দেখা করানো হবে আমাদের উপকারী বন্ধুদের। তিনি কিছু উপহারও দেবেন পাঁচজনকে। এমন উপকার তো কেউ কখনও করেনি আমাদের। সেজন্যই এই আয়োজন।
সকলের বেশ মনে ধরল পুরো ব্যাপারটা। উপকারী বন্ধুদের উপযুক্ত সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থাই করা হয়েছে। সবাই সায় দিল কথাটাতে। 
কুকুরদের সাথে হায়েনাদের বরাবরের বিবাদ। তাদের তো গা জ্বলে যাচ্ছে কুকুরদের এমন ভোজ আর সম্মান জানানো হচ্ছে বলে। মুখ ভার করে বসে ছিল তারা। খরগোশ গিয়ে তাদের মোড়লকে বলল-- মনে কষ্ট পেয়ো না তো। ভোজ শেষ হলেই দেখবে, খুব ভালো লাগবে তোমাদেরও। একটা ভালো কাজের সময়, মনকে ছোট করে রাখতে নাই। যাকগে, শোন গো মোড়ল! তুমিই আজ এক এক করে আমাদের অতিথিদের ভোজসভায় নিয়ে যাবে। এতবড় দায়িত্ব রাজামশাই নিজে তোমাকে দিয়েছেন। কাজে লেগে পড়ো। দেরী করো না।
 খরগোশ যেমন পরামর্শ দিয়েছে, তেমনটাই মেনে নিয়েছে সিংহ। সে হাসি-হাসি মুখ করে নিজের গুহায় ঢুকে পড়ল। 
  সিংহী তো তখনও মুখ গোঁজ করে বসে আছে ভিতরে। সিংহ হাসি মুখে বলল-- মুখ ভার করবার কিছু নাই। খরগোশ ব্যাটা ভারী সুন্দর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পাঁচ-পাঁচটা ভেট পাওয়া যাবে এখুনি। তিনটা তোমার। দুটো রাজার।
রাজার হেঁয়ালি রানীমার মাথায় কিছুই ঢুকলো না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কেবল।
হাসতে হাসতে পুরো বন্দোবস্তটা বউকে বলে দিল সিংহ। তখন সিংহীর মুখেও হাসি ফুটল। রাজা বলল-- ঠিক আছে, প্রথম ভেটটা তুমিই নেবে। এবার খুশি তো?
 কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হায়েনাদের মোড়ল একটা কুকুরকে গুহার মুখে পৌঁছে দিয়ে গেল। কুকুরটা ভেতরে আসতেই, এক লাফে তার ঘাড়ে গিয়ে পড়ল রানীমা। টুঁটি কামড়ে একটাই মাত্র আছাড়। তাতেই অক্কা পেয়ে গেল বেচারা কুকুরটা। খানিক বাদে এল দ্বিতীয়টা। এবার রাজা পড়ল সেটার ঘাড়ে। 
এইভাবে পাঁচ ধূর্ত একে একে চলে গেল রাজামশাই আর রানীমার পেটে। 
  এবার খরগোশ আর কাঠবেড়ালি ভেতরে এসে হাজির হলো । তাদের কিছু বলবার আগেই, সিংহ বলল-- এখন আর জ্বালাস না, বাপু। পেট আমাদের দুজনেরই ভার। একটু গড়িয়ে নিতে দে। আর শোন, বাইরে সবাই হাঁ করে বসে আছে। পুরো ব্যাপারটা বলে দিস সবাইকে খুলে। সবাই জানুক, চালাকির ফল ভালো হয় না। ভারী পেট নিয়ে হেলতে দুলতে গিয়ে শুয়ে পড়ল সিংহ আর সিংহী।
 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments