জ্বলদর্চি

রবীন্দ্র সাহিত্যে নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজ/ড. বিভাস মণ্ডল

রবীন্দ্র সাহিত্যে নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজ

ড. বিভাস মণ্ডল

ইংরেজ শাসনাধীন ভারতবর্ষে সামাজিক জীবনে বর্ণগত শ্রেণীবৈষম্য ও অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্য প্রবলগভাবে ভারতীয় সমাজ জীবনকে গ্রাস করে। যদিও তা একদিনে হয়ে ওঠে না। এর পেছনে ভারতীয় বৈদিক সমাজ ও হিন্দু সমাজের বিশেষ অবদান ছিল। স্মৃতিশাস্ত্র নির্ভর হিন্দু সমাজে শ্রেণিস্বার্থের প্রতিভুদের প্রচলিত নানান প্রথা আচার বিশ্বাস সংস্কার চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সমাজে নানা বিভেদ বৈষম্য, কু- প্রথার শৃঙ্খলে মানুষকে চরম অবজ্ঞা অবহেলায় অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়।আর্য- অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণে গড়ে ওঠা হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে বর্ণগত শ্রেণীবৈষম্যর সুদৃঢ় প্রাচীর গড়ে উঠেছিল। এর স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ তাঁর " পূর্ব- পশ্চিম" প্রবন্ধে লিখেছেন-- " বর্ণের যে শুভ্রতা লইয়া একদিন আর্যরা গৌরববোধ করিয়াছিলেন সে শুভ্রতা মলিন হইয়াছে , এবং আর্যগণ শূদ্রদের সহিত মিশ্রিত হইয়া তাহাদের বিবিধ আচার ও ধর্ম, দেবতা ও পূজা প্রণালী গ্রহণ করিয়া , তাহাদিগকে সমাজের অন্তর্গত করিয়া লইয়া হিন্দুসমাজ বলিয়া এক সমাজ রচিত হইয়াছে, বৈদিক সমাজের সহিত কেবল যে তাহার ঐক্য নাই তাহা নহে , অনেক বিরোধও আছে।"( রবীন্দ্র রচনাবলী ১৩ খণ্ড)

 পরবর্তী সময়ে প্রথম বৌদ্ধ সংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দু সংস্কৃতি র সংঘর্ষ বাধে ।আরও পরে ঊনবিংশ শতকে ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রবল অভিঘাতে বৈষম্য ঘুচে গিয়ে সমাজে মিশ্র সংস্কৃতির ঐক্য ভাবনা গড়ে ওঠে। কবিগুরুর ভাষায়-- " আজ ব্রাহ্মণ শূদ্রে সকলে মিলিয়া হিন্দু জাতির অন্তর্নিহিত আদর্শের বিশুদ্ধ মূর্তি দিখিবার জন্য সচেষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। শূদ্রেরা আজ জাগিতেছে বলিয়াই ব্রাহ্মণ্যধর্মও জাগিবার উপক্রম করিতেছে।" তাঁর মতো বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দও শ্রমজীবী মানুষ যা শূদ্র জাগরণের বিষয়টিও সোৎসাহে ঘোষণা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিপুল সাহিত্য সম্ভার বিশেষ করে কাব্য সাহিত্যে,  কথাসাহিত্যে, নাটকে সমাজের সবচেয়ে ব্রাত্য বা অপাংক্তেয় মানুষজনের কথা অসংখ্য চরিত্র চিত্রণের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করেছেন। যার মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর মানব প্রেমিক মহানুভবতার নিগূঢ় পরিচয় পরিস্ফুট হতে দেখি ।


কাব্য কবিতায় নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজ 

জমিদার বাড়ির সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথ আজীবন সমাজের শোষিত বঞ্চিত অত্যাচারিত নিপীড়িত অন্ত্যজ অস্পৃশ্য শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন। সমাজের শোষিত নিম্নবর্গের প্রতি আন্তরিক প্রাণের টান অনুভব করে তিনি বলেন -----
 চাষি খেতে চালাইছে হাল / তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল/ বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার/ তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে/ সমস্ত সংসার।( জন্মদিনে-- ১০ নং কবিতা ) 
সমাজের নিপীড়িত অত্যাচারিত অবহেলিত মানুষদের প্রতি বঞ্চনাকে লক্ষ্য করে " সোনারতরী"  কাব্যে। যেমন রয়েছে , তেমনি " চিত্রা" কাব্যের " এবার ফিরাও মোরে " কবিতায় তিনি বলেন--- 
এই সব মূঢ় ম্লান মুখে/ দিতে হবে ভাষা এই সব শুষ্কভগ্ন বুকে/ ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।"
 সমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কবিমন ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন ----
 " যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, 
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?" (_ প্রশ্ন --- পরিশেষ)
 কবি পৈতৃক জমিদারি তদারকিতে গিয়ে শিলাইদহ পতিসরে পূর্ব বঙ্গের পল্লীজীবনের যে পরিচয় পেয়েছিলেন, বা পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন কার্যোপলক্ষে ভারত পরিক্রমায় ভারতীয় জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ঔপনিবেশিক শাসনে তাদের অধঃপতন কবিকে ব্যথিত করে। " জন্মদিনে" ," আরোগ্য" ," পুনশ্চ" প্রভৃতি কাব্যের অসংখ্য কবিতায় সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের কথা ব্যক্ত করেছেন ।
" চেতনা প্রত্যন্ত প্রদেশে
চিত্তে যে আজ তাই জেগে ওঠে
এই সব উপেক্ষিত ছবি
জীবনের সর্বশেষ বিচ্ছেদ বেদনা
দূরের ঘন্টার রবে এনে দেয় মনে। ( আরোগ্য, ঘন্টা বাজে দূরে, ১নং কবিতা) 
পরাধীন দেশের জনগনের উন্নতিকল্পে কবি শিক্ষা প্রসার ও তার উন্নতি, কৃষির উন্নতি ও স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। আর্থ সামাজিক জীবনে শ্রেণীবৈষম্য জনিত মানুষের ওপর অন্যায় অবিচার সংকট ও অবক্ষয় কবিকে ব্যথিত করে তুলে। চিত্রা, চৈতালি প্রভৃতি কাব্যে নিপীড়িত নির্যাতিত শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় তাঁর একাত্মতার পরিচয় মেলে। তিনি লেখেন-----
 " একদিন বসে বসে / লিখিয়া যেতেছি কবে/ এ দেশেতে কার দোষে / ক্রমে কমে আসে শস্য। ( শীত বসন্ত- চিত্রা) 
" কল্পনা" কাব্যের হতভাগ্যের গান, পসারিনী, উন্নতি লক্ষণ, " ক্ষণিকা" কাব্যের সুখদুঃখ, শাস্ত্র, ভিখারি প্রভৃতি কবিতায় অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্য ও সামাজিক শ্রেণীবৈষম্যের ছবি প্রকাশ পেয়েছে। সেইসঙ্গে " গীতাঞ্জলি" কাব্যের ভারতবর্ষ, দীনের সঙ্গী, অপমানিত, ধূলামন্দির প্রভৃতি কবিতাতেও তাঁর মানবপ্রীতিবোধ প্রকাশ পেয়েছে----
 মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
(অপমানিত--  গীতাঞ্জলি)
 পুনশ্চ, বীথিকা, পত্রপুট, শ্যামলী, রোগশয্যায়, আরোগ্য, জন্মদিনের বিভিন্ন কবিতায় অন্ত্যজ অস্পৃশ্য জনমানবের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিবোধ প্রকাশ পেয়েছে। এ দুর্ভাগা দেশ ভারতবর্ষে যে সমস্ত মানুষের অধিকার বঞ্চিত করছে, ক্রমশ সেই পিছিয়ে পড়া মানুষই সমগ্র দেশকে সমগ্র সভ্যতাকে পিছিয়ে দেবে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নেই যেন সমস্ত শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে । তাই তিনি বলেন ---- 
" এসো হে আর্য, এসো অনার্য, 
হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ
এসো এসো খৃস্টান। 
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন
ধরো হাত সবাকার ।
এসো হে পতিত করো অপনীত
সব অপমান ভার।( ভারততীর্থ, গীতাঞ্জলি)
 কবি জীবনের অন্তিম লগ্নে তিনি শুনতে পেয়েছেন সমাজের নিচু তলার অবহেলিত, বঞিত উপেক্ষািত বিপর্যস্ত মানব জীবনের বেদনার্ত রাগিনী।  আরোগ্য কাব্যে সেই বেদনামথিত সম্পূর্ণতারৢ পূর্ণ বেদগাথা। ব্রাহ্মণ কবিতায় সত্যকাম পতিত হয়েও গুরুর চোখে দ্বিজোত্তম, সত্য কুলজাত। পুনশ্চ র মুক্তি, শুচি, প্রেমের দোলা প্রভৃতি কবিতায় অস্পৃশ্যতা বিরোধী কথা ফুটে উঠেছে। এই কাব্যের " প্রথম পূজা " কবিতায় কবি শ্রেণিদ্বন্দ্বের বাস্তব সত্য উদ্ঘাটন করেছেন।

কথাসাহিত্যে নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজ 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কথা সাহিত্য উপন্যাস ও ছোটোগল্পে নিম্নবর্ণ শ্রেণিসমাজের উন্নতির কথা, শ্রেণীবৈষম্যমূলক সমাজ জীবনের কাহিনী রচনা করেছেন। সংস্কার মুক্ত জীবনের ছবি এঁকেছেন। তাঁর " গোরা", " চতুরঙ্গ", " ঘরে বাইরে" উপন্যাসগুলোতে বেশ কিছু অন্ত্যজ নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজের প্রতিনিধিদের তুলে এনেছেন। 
   "গোরা" উপন্যাসে সর্বধর্মবর্ণ সমন্বয়ের চেতনা সুস্পষ্ট রূপ লাভ করেছে।এখানে রবীন্দ্রনাথ অহমিকা ও সংস্কারবোধকে আঘাত হেনেছেন। গ্রামীণ সমাজের অবহেলিত পতিত মানুষজনের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ, বর্ণবৈষম্যহীন বিদ্রোহী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তৎকালীন ভারতের সমাজ জীবনের অজ্ঞতা, জড়তা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, জাতপাত নিয়ে মিথ্যে বিরোধ সম্পর্কে গোরার মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। এ উপন্যাসে নিম্নবর্গ সমাজের তন্তুবায়, কামার, কুমোর, ছুতোর, অন্ত্যজ অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের মানুষের কথা উঠে এসেছে। যাদের মধ্যে খৃস্টান দাসী লছমিয়া, ঘোষচরপুরের মুসলমান প্রজাসাধারণের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মমত্ববোধের প্রকাশ ঘটেছে। সমগ্র ভারতবর্ষ উঠে এসেছে এই উপন্যাসে । গোরা জাতীয় ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তমনা পরেশবাবুর শিষ্য হয়েও সমস্ত জাতপাতের প্রাচীর ভেঙে সংস্কারের বেড়া পেরিয়ে সামাজিক অনাচার কে নির্মূল করার ব্রত নিয়েছে। সমস্ত ছুৎমার্গের ঊর্দ্ধে উঠে খৃস্টান রমণী লছমিয়ার জল গ্রহণেও তৎপর হয়েছে। সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্যের কথাও এখানে উঠে এসেছে। চরঘোষপুরের সকল প্রজাই মুসলমান। তাদের সঙ্গে নীলকর সাহেবদের বিরোধ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে জাত পাতের বিভেদ। বদমেজাজি ফর সর্দার নীলকরদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। তার সঙ্গে সহযোগিতা করেছে গোরা।

  "ঘরে বাইরে" উপন্যাসে ১৯০৫ সালের দেশের বিপর্যয় ও সংকটময় মুহূর্তে নিম্নবর্গ সমাজের বাস্তব রূপটি উঠে এসেছে। এই উপন্যাস জমিদারি শাসনের ভয়াবহতার পাশাপাশি দরিদ্র অসহায় রায়তদের জীবন কাহিনী ফুটে উঠেছে। যা উপন্যাসে পঞ্চুর চরিত্রটির মধ্যে পরিস্ফুট হতে দেখা যায়। নিখিলেশ জমিদার হয়েও সাধারণ প্রজাদের জন্য তার হৃদয় কেঁদে ওঠে। তাই তার মুখ দিয়ে কথাকার বলেছেন---" আমার ভারতবর্ষ কেবল ভদ্রলোকেরই ভারতবর্ষ নয়। আমি স্পষ্টই জানি আমার নীচের লোক যত নাবছে, ভারতবর্ষই নাবছেে, তারা যত মরছে, ভারতবর্ষই মরছে"।
  রবীন্দ্রনাথ তাঁর "চতুরঙ্গ" উপন্যাসে জাত ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে, সামাজিক অবক্ষয়মুক্ত মানসিকতায় সমস্ত রকমের সংস্কার বিরোধী সাম্যচেতনায় সুস্থ মানব ধর্মের দিকটি তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র জগমোহনের জনৈকা বুড়ি ঝিকে পরিচারিকা রাখা, পতিতা ননীবালার হাতে রন্ধনের দায়িত্ব দেওয়ার মধ্যে সংস্কার মুক্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। সেই সঙ্গে শচীশের সংস্কার মুক্ত মন পতিতা ননীবালাকে বিবাহ করতে যাওয়ার মধ্যে অনন্য মাত্রা এনে দেয়। কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাস সাহিত্যে মানবিক মূল্যবোধ ও সমাজ প্রগতিমূলক মনোভাবের পরিচয় দেখিয়েছেন এই নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজের কথা পরিস্ফুট করে।

ছোটোগল্পে নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজ

 রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি ছোটোগল্পে তথাকথিত ব্রাত্যজনের অধিকার মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। সমাজের শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত অভাজনদের মর্মব্যথা ফুটে উঠেছে ছোটোগল্পের পাতায়। এধরণের গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হল --- দেনাপাওনা, পোস্টমাস্টার, ত্যাগ, শাস্তি, মেঘ ও রৌদ্র, অনধিকার প্রবেশ, মুসলমানীর গল্প, দুরাশা, উলুখড়ের বিপদ , হালদারগোষ্ঠী প্রভৃতি। 
অর্থনৈতিক শোষণের দ্বারা অপমানিত বঞ্চিত নির্যাতিত হওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে " দেনাপাওনা" গল্পে। সমাজের এক জঘন্য প্রথা পণপ্রথা র বলির যূপকাষ্ঠে এক অসহায়া নারীর বেদনাদীর্ণ চিত্র দেনাপাওনা।নাম মাহাত্মে পরিপূর্ণ নিরূপমা বিত্ত মাহাত্ম না থাকায় নিজ শ্বশুরবাড়িতেই নিম্নবর্গ হয়ে যায়। যার বিপরীতে রয়েছেন বিত্তশালী অহংকারী শ্বশুর রায়বাহাদূর ও শাশুড়ী রায়গিন্নী। পণের টাকা মনোমত না পাওয়ায় নিত্য বধূ নিরূপমাকে শ্বশুরবাড়িতে গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের সংসার জীবনের এক অন্ধকারময় দিকটি এই গল্পে উদ্ভাসিত।
  "পোস্টমাস্টার" গল্পে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত পোস্টমাস্টার চাকরিসূত্রে উলাপুর গ্রামে আসে। হত দরিদ্র নিরন্ন মানুষগুলো ও তাদের অসংস্কৃত জীবনচর্যাকে তিনি সহজে মেনে নিতে পারেননি। নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনধারাকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে বিভাজনের চিত্র এখানে ফুটে ওঠে। পল্লীজীবন পোস্টমাস্টারকে হাঁফিয়ে তোলে। উচুতলার মানুষ পোস্টমাস্টার নিম্নবর্গের পরিচারিকা রতনের সেবা ভালোবাসা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারলেন না, যার কাছে অর্থমূল্যটাই প্রাধান্য পেল। 
"ত্যাগ" গল্পে এক গৃহবধূর লাঞ্ছনাকে, নির্মম অসহায়তাকে তুলে ধরেছেন গল্পকার। পুরুষ শাসিত সমাজে লিঙ্গভিত্তিক শোষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কুসুম। নারী বলে তার ভুলের কোন ক্ষমা থাকে না। যা চিরকাল অমানবিক। অথচ পুরুষ শাসিত সমাজে পরিবারের কর্তা শ্বশুরমশায়ের রক্তচক্ষু নারীকে মুখ বুজে সয়ে যেতে হয় ।গৃহ বধূকে ভুলের শাস্তি দিতে কড়া ভাষায় পুত্রকে নির্দেশ দেন -- " হেমন্ত বউকে এখনি বাড়ি হইতে দূর করিয়া দাও।" ছেলে ভুল করলে কখনো তার এমন শাস্তি হয় না। দৈনন্দিন অপমানে জর্জরিত হতে থাকে কুসুম। সে নিরাশ্রয় হওয়ার ভয়ে তার স্বামীর " পা জড়াইয়া পায়ের উপর মুখ রাখিয়া পড়িয়া থাকে।" কুসুম তার প্রেমকে সবার উপরে স্থান দিয়েছে। পুরুষ শাসিত সমাজে নিত্যদিন নারীর অবমাননার চিত্র রবীন্দ্রনাথ এই গল্পে দেখিয়েছেন।

  "শাস্তি" গল্পেও সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ কুরি সম্প্রদায়ের চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক। সেখানেও নারীর মর্যাদার অবমাননা হয়েছে। স্ত্রীর কটূক্তি সইতে না পেরে বড় ভাই দুঃখিরাম বউ এর মাথায় দা এর কোপ মারে। ছোটভাই ছিদাম বড়োভাইকে বাঁচাতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। অবশেষে তারই বউ অর্থাৎ ছোটবউ চন্দরাকে ফাঁসির কাঠগোড়ায় ঠেলে দেয়।পুরুষ শাসিত সমাজের মজ্জাগত সংস্কার--- " বউ গেলে বউ পাইব, কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে তো ভাই পাইব না।" এই তীক্ষ্ণ শেল সম বাক্যবাণ সংসারের যেকোন বধূকে প্রাণে বিদ্ধ করতেই যথেষ্ট।
"মেঘ ও রৌদ্র" গল্পেও লেখক শোষক-- শোষিতের স্বরূপটি উদ্ঘাটন করেছেন। নিম্নবর্গের মানুষ শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই তখন তার পীড়ণের মাত্রা বেড়ে যায়। আদর্শবাদী যুবক শশীভূষণ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মানসিক সম্মান হারায়। বিনা অপরাধে জেল খাটে। নিম্নবর্গের আরও এক নির্মম রূপের পরিচয় পাওয়া যায় " উলুখড়ের বিপদ" গল্পে। জমিদার গোমস্তার হাতে প্যারী দাসীর লাঞ্ছনা নিম্নবর্গের মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকে সুস্পষ্ট করে। দাসী বলে তার কোন সামাজিক সম্মান নেই। নায়েব গিরিশ বসুর কদর্য ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে সে শিকার হয়েছে।

নাট্য সাহিত্যে নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজ

 রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ নাটকেই নিম্নবর্গ শ্রেণিসমাজের চরিত্র সকল উঠে এসেছে।তাঁর রাজা ও রাণী, প্রায়শ্চিত্ত, অচলায়তন, মুক্তধারা, রক্তকরবী, কালের যাত্রা প্রভৃতি নাটকে তথাকথিত অন্ত্যজ অস্পৃশ্য মানুষের পাশাপাশি চিত্রিত হয়েছে অর্থনৈতিক শ্রেণীর প্রতিভপ বা জনতার প্রতিনিধি রূপে নিম্নবর্গ শ্রমিক ও কৃষক চরিত্র। " রাজা ও রাণী"  নাটকে রাজপথে লোকারণ্যের চিত্র দেখানো হয়েছে। যেখানে কিনু নাপিত, মনসুখ চাষী, কুঞ্জর লাল কামার, শ্রীহর কলু, হরিদীন কুমোর, জওহর তাঁতিদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ নন্দলাল ও কায়স্থ মননুরামদের একসঙ্গে চলাফেরা করতে কোনো সংস্কারে বাধছে না। কারণ তারা প্রত্যেকেই একই অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামোতে অবস্থান করছে। রাজার রাজকার্যে উন্নাসিকতার কারণে এরা অর্থনৈতিক দীনতায় ক্লিষ্ট। তাই তারা লুঠ- পাট কর্মে অগ্রসর হয়েছে।
   "শারদোৎসব" ( ১৯০৮) নাটকটিতে নিম্নবর্গের মানুষের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯২১ সালে এই নাটকটিকে সামান্য পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ রচনা করে " ঋণশোধ" । দুটি নাটকের মূল কাহিনী ও মুল ভাব এক। নাটকগুলোতে ছেলেরা, একদল লোক, বালকগণ কে নিম্নবর্গ চরিত্রের অভিধায় আনয়ন করেছেন। 
"প্রায়শ্চিত্ত" নাটকে নিম্নবর্গের শোষিত, লাঞ্ছিত মানুষ জনের মুখে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ভাষা ফোটায় ধনঞ্জয় ।বাংলার বার ভুঁইয়ার অন্যতম প্রতাপাদিত্য এই নাটকের প্রতাপশালী ব্যক্তি। ধনঞ্জয়কে গারদে রেখেও জনতার রোষের মুখে পড়েন। ধনঞ্জয়ের কাছে মানসিক লড়াইয়ে পর্যুদস্ত হয়েছেন প্রতাপাদিত্য। রাজশক্তির বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষের এমন অভ্যুত্থান ইতিপূর্বে পাওয়া যায়নি। এই অভ্যুত্থানের চরম পরিণতি দেখা যায় " রক্তকরবী" তে।
" মুক্তধারা" নাটকেও ধনঞ্জয় বৈরাগী, বটুকপাগল, ফুলওয়ালি, নাগরিকবৃন্দ, পথিক, একদল ছাত্রদের পাওয়া যায়। এই নাটকে নিম্নবর্গের মানুষদের দুধরণের চরিত্র পাওয়া যায়। উত্তরকূটের নাগরিকরা সামান্য অহংকারী, উচ্ছৃঙ্খল, সে তুলনায় শিবতরাইয়ের প্রজারা ধনঞ্জয়ের সংস্পর্শে থেকে অনেকখানি শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দিয়েছেন।
" রক্তকরবী" নাটকে নিম্নবর্গের মানুষের স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। শোষক ও শোষিতের সুস্পষ্ট চিত্র ও নন্দিনী রঞ্জনদের প্রেরণায় শোষণযন্ত্র ভাঙার উন্মাদনা নাটকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এই নাটকে নিম্নবর্গীয় মানুষদের বেশিরভাগই সোনার খনির শ্রমিক। নিম্নবর্গের আত্ম সচেতনতা, আত্ম জাগরণ, শোষণের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়া, প্রতিবাদী ভূমিকা, সর্বোপরি আত্মত্যাগের মাধ্যমে নিয়মের পরিবর্তন সাধনের প্রচেষ্টা " রক্তকরবী" তে প্রকাশ পেয়েছে। তবে " মুক্তধারা" র বিভূতি বা " রক্তকরবী" র মোড়ল নিম্নবর্গের মানুষ হলেও আপন প্রচেষ্টায় উচ্চবর্ণে নিজেদের উন্নীত করার প্রচেষ্টা রাখে।

  রবীন্দ্রসাহিত্য মানব জীবনকে বিচিত্র দিকের সন্ধান দেয়। গ্রামীণ ও নাগরিক উভয় জীবনেই মানুষের মনুষ্যত্ববোধোর জাগরণ, আত্মিক চেতনাবোধে আপামর মানুষকে উজ্জীবিত করতেই সমাজের অভিজাত ও অন্ত্যজ উভয় শ্রেণীর মানুষকে তাঁর সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন। যার মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতা সহমর্মিতা দেখিয়ে পথ চলবে। তা- ই রবীন্দ্র সাহিত্যের চরিত্রের অন্তরের ভাষা। যা রূপদানে অত্যন্ত সচেতন শিল্পীরূপে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য চিরকালীন শাশ্বত সাহিত্য রূপে বেঁচে থেকেছে।

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments