জ্বলদর্চি

সংকট ও সংঘাতে রবীন্দ্রনাথ /অখিলেশ সুর

সংকট ও সংঘাতে রবীন্দ্রনাথ

 অখিলেশ সুর

"শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ পথে পথে"- বিশ্ব সাহিত্যের কুলীন জ্যোতিষ্ক আমাদের দেশ ও জাতির স্বার্থক প্রেরনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবির্ভাবের ১৬০ বছর পরে ও একাকী সৈনিক থেকে গেলেন। তাঁর অমলিন জন্মজয়ন্তী উদযাপন তাই বিশ্ব সংসারের একাকীত্বের হাহাকার।
         পীর আলীর সঙ্গে মসকরা করতে গিয়ে পূর্ব পুরুষদের কলঙ্ক থেকে মুক্তি যেমন মৃত্যুর পর ও পাননি, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে ও নানান সংঘাত ও সংকট থেকে মুক্তির জন্য আমারণ কলম যুদ্ধ করে ও নিস্তার মেলেনি। 
     যশোর জেলার টেঙুটিয়া পরগনার গুড়-বংশীয় জমিদার দক্ষিনারঞ্জন রায় চৌধুরীর চার পুত্র কামদেব, জয়দেব,রতিদেব ও শুকদেব -এর মধ্যে প্রথম দুজন স্থানীয় শাসক মামুদ মামুদ তাহির,(যিনি জাতিতে ব্রাহ্মন,নবদ্বীপের কাছে পিরল্যা গ্রাম থেকে গিয়েছিলেন বলে পীর আলী নামে পরিচিত ছিলেন)এর কর্মচারী ছিলেন। একদিন উদ্যানে একাকী বসে গন্ধরাজ লেবু নাকের কাছে নিয়ে বার বার গন্ধ নিচ্ছিলেন।এমন সময় দুই ভাই কামদেব ও জয়দেব সেখানে পৌঁছে ওই দৃশ্য দেখে ঠাট্টা করে বলেন- 'ঘ্রানেন অর্ধ ভোজন । মহাশয় আপনি লেবুটি এঁটো করে দিয়েছেন।ফেলে দিয়ে হাত ধুয়ে আসুন।'- এই কথা শুনে তিনি খুব অপমানিত ও রেগে গিয়ে এই দুই ভাইকে উপযুক্ত সময় শাস্তি দেওয়ার অপেক্ষায় রইলেন। একদিন রসুল খানায় ধুমধাম পড়ে গেল। গোমাংস রান্না করে অতিথি আপ্যায়ন করা হবে। সুগন্ধি মশলার গন্ধ নাকে আসতেই দুই ভাই রসুল খানায় হাজির হন। সেই খবর পীর আলীর কাছে পৌঁছাতে, তিনি তড়িঘড়ি করে রসুল খানায় হাজির হন। দুই ভাইকে তাদের পূর্বোক্ত কথা স্মরণ করিয়ে তাদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে ঘোষণা করেন। সেই ঘটনার পর তারা পীরালী ব্রাহ্মন রুপে পরিগণিত হন।তাদের ষষ্ঠ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফলতঃ এই জাতিগত খোঁচা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে আজীবন। মননের সেই সংঘাত থেকে রাখি বন্ধন উৎসবের আয়োজন। সালটা ছিল ১৯০৫ । ১৯ শে জুলাই বৃহস্পতিবার। লর্ড কার্জন বঙ্গ ভঙ্গ আইন পাশ করলে দেশ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পীঠস্থান বাংলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে আলোড়ন ওঠে। রবীন্দ্রনাথ সেই আবহ সঙ্গীত কাজে লাগিয়ে কলকাতা,ঢাকা ও সিলেট বিভাগের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের একত্রিত হবার ডাক দেন রাখি বন্ধন উৎসবের মাধ্যমে। কলকাতায় তার এই উদ্যোগকে পরিবার থেকে বাধা দেওয়া হয়।প্রবীনরা বাধা দিলে রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করিয়ে দেন তাদের পূর্ব পুরুষদের কথা- "আমাদের বংশগত বৈশিষ্ট্যের উপর আক্রমণ প্রায়শই নামিয়া আসে এই জাতপাত লহিয়া। আমি সেই পূর্ব কলঙ্ক মোচনের নিমিত্ত এই উৎসবের আয়োজন করিতেছি"। দীর্ঘ দিন হিন্দুত্বের এই অন্তঃসলিলা আত্মাগ্নিতে দহিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার ঘাদর আন্দোলনের হাত ধরে যখন আমাদের দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য পাঞ্জাব থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গোপনে হিন্দু-জার্মান চুক্তি হয়, ১৯১৫খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে, তখন সেটি গদর ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত হয়। এই আন্দোলনের অঙ্গ ছিল আ্যনি লারসেন অস্ত্র পরিকল্পনা, যুগান্তর-জার্মান ষড়যন্ত্র,ব্ল্যাক টম বিস্ফোরণ।যার বিচার হয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায়। হিন্দু জাগরণ মঞ্চের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচা মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্য প্রার্থনা করে চিঠি পাঠান।সবে মাত্র আমাদের রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে। নির্বাচনের প্রচারে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের আওয়াজ উঠেছে তীব্র ভাবে। ফলাফল বেরানোর পর দেখা গেল সেই মেরুকরণের প্রতিফলন ঘটেছে। আবার নির্বাচন পরবর্তী হিংসা ও সামাজিক সন্ত্রাস চলছে সেই মেরুকরণ মাফিক। খুব স্বাভাবিক ভাবেই পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম জয়ন্তী উদযাপন করতে গিয়ে অতীত এই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি। কখন কোন রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ কে ও কখনো হিন্দু কখনো মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে আবেদন নিবেদন করতে হয়েছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগ আজ ইতিহাস স্বীকৃত। বর্তমান সময়ের মেরুকরণ কতটা প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক তা সময় বিচার করবে।

   ব্যক্তিগত জীবনে ও রবীন্দ্রনাথ একাকীত্বের আত্ম সংঘাতে জর্জরিত হয়েছেন।কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্র নাথ জেঠু জ্যোতিরীন্দ্র নাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেরাদুনে গিয়ে ডায়েরিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যান। টেলিগ্রাফের তারেই অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ দেরাদুনে পৌঁছে গেট খুলে ঢুকে দেখেন সবাই দূরে সরে যাচ্ছে।সবার মুখ থমথমে অশ্রুসিক্ত। ভেতরের ঘরে প্রবেশ করতে করতে রবীন্দ্রনাথ বৌদি জ্ঞানদা নন্দিনী দেবীর কাছে জানতে চান- আপনারা কেন দূরে সরে যাচ্ছেন? বৌদি বললো আগের রাতে শমীন্দ্র নাথ মারা গেছে। তাই- ডুকরে কেঁদে উঠে রবীন্দ্রনাথ বলেন- "যে গিয়াছে সে তো আর ফিরিয়া আসিবে না। কিন্তু যাহারা এই সময় পাশে থাকিলে বল সঞ্চয় হয়, তাহারা দূরে সরিয়া গেলে ভার বাড়ে বৈ কমে না"। তারপর শমীর মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে অনেকক্ষণ মুখ গুঁজে কেঁদে যান। সেই একাকীত্বের বানী ফুটে ওঠে তাঁর কলমে-"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু,বিরহ দহন জাগে, তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে"। 

      ছোট মেয়ে মীরার সঙ্গে দেখেশুনে নগেন্দ্র নাথের বিয়ে দেওয়ার সময় পারিবারিক ভাবে বাধা পেয়েছিলেন। এমনকি মেয়ে মীরার ও অমত ছিল। মেয়ের অমতে বিয়ে দেওয়ার পর বুঝেছিলেন কি সর্বনাশ করে ফেলেছেন। নগেন্দ্র নাথ ছিল উচ্চাভিলাষী, নিষ্ঠুর ও অবিবেচক। দিনের পর দিন মেয়ের উপর অত্যাচার নির্যাতন করতেন। মেয়ের সেই দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথ কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে নীরব ছিলেন। মেয়ে যখন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তখন রবীন্দ্রনাথ মেয়ের মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেন। বাবা হয়ে মেয়ের মৃত্যু কামনা সত্যি খুব কষ্টের ও যন্ত্রনার ছিল। তবু মেয়েকে নিষ্ঠুর অত্যাচার নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে এই ছিল একাকী সৈনিকের আত্ম সংগ্রাম। এসময়ের কলমে তাই উঠে এসেছে- "হৃদয় নন্দন বনে নিভৃত এ নিকেতনে এসো হে আনন্দময় এসো চিরসুন্দর"। নান্দনিক সৌন্দর্যের আড়ালে ঢেকে রাখতে হতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত জীবন। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দিক থেকে দিগন্তের দার্শনিক।

     আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক। লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে করোনা ভাইরাসে। বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক থেকে ডাক্তার কেউ কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। পরিবেশ বিদ রা এই সময় সুযোগ বুঝে তর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। দীর্ঘ দিন ধরে তাদের উপদেশ অমান্য করার ফলে আজ এই দশা। আসলে এই ধরনের প্যান্ডেমিক সিচুয়েশন ইতিহাসে বার বার এসেছে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ও এই রকম অবস্থায় কাটাতে হয়েছে। আর ঠিক সেই সময় বিশ্ব দ্রষ্টা দার্শনিক খুঁজে পেয়েছেন মানুষের আসল অসুখ - "ম্যালেরিয়া,প্লেগ, দুর্ভিক্ষ কেবল উপলক্ষ মাত্র, তাহারা বাহ্য লক্ষ্মন মাত্র। মূল ব্যাধি দেশের মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। আমরা এতদিন একভাবে চলিয়া আসিতেছিলাম আমাদের হাটে বাটে গ্রামে পল্লীতে একভাবে বাঁচিবার ব্যাবস্থা করিয়াছিলাম। আমাদের সে ব্যাবস্থা বহুকালের পুরাতন। তাহার পরে বাহিরের সংঘাতে আমাদের অবস্থান্তর ঘটিয়াছে।এই নতুন ব্যাবস্থার সহিত আমরা এখনো সম্পূর্ণ আপস করিয়া লইতে পারি নাই। একজায়গায় মিলাইয়া লইতে গিয়া আর এক জায়গায় অঘটন ঘটিতেছে।যদি এই নতুনের সহিত আমরা কোনোদিন সামঞ্জস্য করিয়া লইতে না পারি তবে আমাদিগকে মরিতেই হ ইবে।"রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বার্তা আজ হাটে বাজারে পুলিশ প্রশাসন দিয়ে সরকারকে প্রয়োগে উদ্যোগী হতে হয়েছে। আমরা মাস্ক পরে বাহিরের সঙ্গে মেলাতে পারছি না। তাই পকেটে, থুতনিতে,কানে ঝুলিয়ে আইনের রক্ষক দের ফাঁকি দিচ্ছি। জনবহুল এই রাজ্যে আমরা দীর্ঘদিন বাসে,ট্রেনে যাতায়াতের সময় কোনোরকম দূরত্ব বজায় রাখতাম না।গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায় যেমন, তেমনি বিপদ ও ডেকে আনে। করোনা তার সংকেত দিচ্ছে এখন। কিন্তু,রবী ঠাকুরের 'পুরাতন ভৃত্য' কবিতার কেষ্ট আর পাওয়া যাচ্ছে না।যে বসন্ত রোগের হাত থেকে বাবুকে বাঁচাতে সব সময় নিজেকে নিযুক্ত রেখেছিল। কিংবা চতুরঙ্গ উপন্যাসে জগমোহনের মৃত্যুর বিবরণ দিয়ে বলেছেন-পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল।পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন-"ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই"। আজ হাসপাতালে হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে সরকার হোম আইসোলেশনে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।কম উপসর্গ ও  কোমরবিডিটি থাকলে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করাচ্ছেন মানুষ।আর এই ভাবে বাঁচতে গিয়ে সমাজ ও সভ্যতা থেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করছে। চিকিৎসক,নার্স, থেকে বাড়ির আত্মীয় স্বজন সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ক্রমাগত বাড়ছে মানবিক অস্থিরতা। পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে স্মরণ করতে গিয়ে তাই একটু কষ্ট করে যদি আমরা তাঁর ব্যাক্তি জীবনের সংঘাত ও সংকট থেকে মুক্তির উপায় গুলো অনুসরণ করি, তাহলেই আমাদের সাহিত্য চর্চা, সংস্কৃতি চর্চা, সমকালীনতার   সঙ্গে নিজেকে ও সমাজকে তাল মিলিয়ে চলার পথ প্রদর্শন করে আগামী সভ্যতাকে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করার উদ্যোগ সার্থক হবে।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments