জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-২৩/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-২৩

শুভদীপ বসু

বিষয়-রবীন্দ্রকবিতা আবৃত্তি

রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভা বিস্ময়কর।তাঁর বিচিত্র চিন্তা ও কর্মের প্রবাহ বিচিত্র প্রকাশের মধ্যে তার সাহিত্য রচনার বিচারে যে পরিচয়টি আমাদের কাছে প্রকাশিত হয় তাহোল তার কবি প্রকৃতি।তিনি জগতকে ঋষি সুলভ দৃষ্টিভঙ্গিতে উপলব্ধি করেছেন। জীবনস্মৃতিতে তিনি জানিয়েছেন 'সেই জগতকে আর কেবল ঘটনা পূর্ণ,বস্তুপূর্ণ করিয়া দেখা গেল না, তাহাকে আগাগোড়া পরিপূর্ণ দেখিলাম।'সাত-আট বছর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন।জীবন স্মৃতির পাতায় তিনি লিখছেন-"আমার বয়স তখন সাত-আট বছরের বেশী হইবে না। আমার এক ভাগিনেয় শ্রীযুক্ত জ্যোতিপ্রকাশ আমার চেয়ে বয়সে বেশ একটু বড়।তিনি তখন ইংরেজি সাহিত্যে প্রবেশ করিয়া খুব উৎসাহের সঙ্গে হ্যামলেটের স্বগতোক্তি আওড়াইতেছেন। আমার মত শিশুকে কবিতা লেখাইবার জন্য তাহার হঠাৎ কেন যে উৎসাহ হইল তাহা বলিতে পারি না।"তিনি যখন নরমাল স্কুলে পড়তেন তখন সাতকড়ি দত্ত নামে এক শিক্ষক তাকে কবিতা লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় 'দ্বাদশ বর্ষীয় বালকের রচিত অভিলাষ' এই কবিতাটি তার প্রথম মুদ্রিত কবিতা।এরপর 'হিন্দুমেলার উপহার' নামে একটি কবিতা অমৃতবাজার পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল।তাঁর সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগে বনফুল, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, কবিকাহিনী,রুদ্রচন্ড,ভগ্নহৃদয়, শৈশব সঙ্গীতে কাব্যগুণের প্রকাশ মেলে।সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থ থেকেই তাঁর  কাব্যগুণ গতানুগতিক কাব্য রচনার বন্ধন থেকে মুক্তি পায়।এরপর'কল্পনা- ক্ষণিকা-নৈবেদ্য-খেয়া'হয়ে যে নবজীবনের সূচনা হয়েছিল তা 'গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি' এর মধ্যে নিঃশেষে আত্মপ্রকাশ করেছে ও পরিপূর্ণ পরিণতি লাভ করেছে আবার নবজীবনলাভে উন্মুখ হয়ে সৃষ্টি হয়েছে বলাকা কাব্য।বলাকার 'পূরবী' ও 'মহুয়া' থেকে 'পুনশ্চ''শেষ সপ্তক' কাব্য গুলিতে নব নব চিন্তাভাবনার যেমন প্রকাশিত হয়েছে তেমনি আবার একেবারে শেষ পর্যায়ের কাব্য গুলিতে মর্তপ্রীতি ও মানুষের প্রতি গভীর নৈকট্য স্থাপন হয়েছে। রবীন্দ্র কাব্য প্রতিভা নিয়ে রবীন্দ্র গবেষকরা নানা তথ্য ও তত্ত্ব বিভিন্ন বইতে প্রকাশ করেছেন।উৎসাহী পাঠকরা অবশ্যই সেগুলো পড়ে দেখতে পারেন।এখানে আমি রবিন্দ্র কবিতা আবৃত্তি বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
আবৃত্তি ও রবীন্দ্রনাথ:
আবৃত্তির কী এমন প্রশ্নের একটি সংজ্ঞা রবি ঠাকুর বহু আগেই দিয়ে গেছেন "আমাদের মনের ভাব যখন বেগবান হয় তখন আমাদের কণ্ঠস্বর উচ্চ হয়, নইলে অপেক্ষাকৃত মৃদু থাকে।"রবি ঠাকুরের কন্ঠ ভালো ছিল। বহু জায়গায় একটি কবিতার আবৃত্তি পর একই কবিতা পুনরায় আবৃত্তির জন্য তিনি অনুরোধ পেতেন।আমরা বর্তমানে রবি ঠাকুরের নিজের কন্ঠে আবৃত্তি যে ক'টি রেকর্ড পাই তা শুনে অনেকের মনে হতে পারে কন্ঠ সুরেলা মিনমিনে ও মেয়েলি। রেকর্ডিংয়ের ও সংরক্ষণের অভাবে এরকম দশা। না হলে কবির গাম্ভীর্য ঔদার্য পূর্ণ কন্ঠের প্রশংসা সর্বত্র।
[04/05, 00:49] Z shuvodip Basu: রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তির পূর্বে কিছু কথা:
১) রবীন্দ্র আবৃত্তির সময় টানা টানা সুরেলা রীতি বর্জন করতে হবে।
২) কবিতার ভাব বুঝে ভাবের অনুবর্তী স্বরক্ষেপণ করতে হবে। অর্থাৎ যিনি আবৃত্তি করবেন তার বুদ্ধি চিন্তা ও অনুভব ক্ষমতার মত করে আবৃত্তির বিষয় হওয়া ভালো।
৩) আবৃত্তির একটি দিক নাটকীয়তা।তাই আবৃত্তির ক্ষেত্রে কতটা নাটকীয়তা প্রয়োজন তা আবৃত্তিকার কে ঠিক করতে হবে। ধরুন বীরপুরুষ কবিতাটি তে আবৃত্তিকার নিজেই ঐ শিশু। তাই তার ভূমিকাটা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন।
৪) যে কোন কবিতার পটভূমি সম্পর্কে আবৃত্তিকারের জানা থাকলে ভালো হয়।
৫) রবীন্দ্র কবিতার বিষয়ের সাথে আবৃত্তিকারের একাত্মতা না থাকলে কবিতাটির সঠিক আবৃত্তি হয়ে ওঠে না।
ছোটদের  উপযোগী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবৃত্তি:
শৈশব-চর্চা(১-৬): এ সময় শিশুদের প্রকৃত বোধ জন্ম গ্রহণ হয়নি।সে এসময় আবৃত্তি করবে না।বহু শিশুর দু বছরের আগে কথা বলতেই শেখে না।কিন্তু সে শোনে।তাই এই পর্ব তার কাছে করার জন্য নয়,শোনার জন্য। মা-বাবা বা অন্য কেউ যিনি তার সাথে সবসময় থাকেন,তাকে অনবরত কথা বলতে হবে।এই কথার মধ্যেই তো থাকে সুর।রবি ঠাকুরের ছেলেভুলানো ছড়া এই সময়ে শিশুর কানে যদি অল্প অল্প শোনানো যায় তাহলে সেও ক্রমে আবৃত্তি করতে থাকবে।কবিতার প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে।এসময় তাকে শোনানো যেতে পারে--
১)আয় আয় চাঁদ মামা কী দিয়ে যা,২)আয় ঘুম আয় ঘুম বাগদী পাড়া দিয়ে,৩)নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোটন বেঁধেছে, ৪) বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদী এলো বান ৫)খোকা যাবে মাছ ধরতে খির নদীর কূলে,৬)আয়রে আয় টিয়ে নায়ে ভরা দিয়ে৭)দস্তানা৮)নাড়ি টেপার ডাক্তার৯) হাঁতির হাঁচি ইত্যাদি ছড়া গুলো।
বাল্য চর্চা (৭-১১): এ সময় শিশুর নিজস্ব বোধবুদ্ধি জেগে উঠেছে। অগভীর বিষয়ে সে নিজে বোঝে। তার নানা রকম কল্পনা রয়েছে নিজেকে নিয়ে,মাকে নিয়ে,বাবাকে নিয়ে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ে অনেক কিছু ভাবতে চায়।সর্ব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ভাবে সে নিজেকে।অন্তরঙ্গতা বোধ করবে এরকম প্রাণস্পর্শী কবিতা তার চর্চার বিষয় হয়ে উঠবে।এ পর্যায়ে এসে চর্চা করতে পারে-
১) সমব্যথী ২)বিচিত্র সাধ ৩) মাস্টার বাবু৪)বিজ্ঞ৫)সমালোচক ৬)প্রশ্ন৭)ছোট-বড়৮)জ্যোতিষ-শাস্ত্র৯)লুকোচুরি১০)নদীর ঘাটের কাছে১১)কাগজের নৌকা১২)নৌকা যাত্রা১৩)মাঝি ১৪)ছুটির দিনে১৫)বুড়ি১৬)পুতুল ভাঙ্গা১৭)মনে পড়া১৮)রবিবার ১৯)খেলাভোলা২০)রাজা ও রানী ২১)দুষ্টু২২)ইছামতি২৩) 
অন্যমা ইত্যাদি।
সদ্য কিশোর (১২-১৩): এসময় অর্থবোধ স্পষ্ট,যুক্তিবোধ স্পষ্ট, গল্প শোনাও বলার প্রবণতা প্রবল। সেজন্য এই পর্বে প্রধানত গল্প মূলক কিছু কবিতা সে করতে পারে।এ কবিতা গুলি আবৃত্তি করতে গিয়ে সে মনে রাখবে যে কবিতা গুলিতে খানিক বিবৃতি খানিক চরিত্রের কথা।সমগ্র কবিতায় এক পরম নাটকীয়তা রয়েছে।একক অভিনয়ে নাটক ফুটিয়ে তুলতে হবে। যেমন-১)শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা২)নগরলক্ষ্মীা)রাজ বিচার ৪)নকল গড় ৫)দীনদান৬)জুতা আবিষ্কার৭)দুই বিঘা জমি ৮)পূজারিণী ৯)পুরাতন ভৃত্য ১০)কথা কও কথা কও ইত্যাদি কবিতার চর্চা করতে পারে।
পূর্ণকৈশোর চর্চা(১৪-১৫): কিশোর মন বাল্যের কল্পনা প্রবণতা ত্যাগ করেছে।তার অভিজ্ঞতার বেড়েছে।পৃথিবীর সম্পর্কে নিজস্ব একটা ধারণা গড়ে উঠেছে।এ সময়ে সে চর্চা করতে পারে-ভজহরি,মাকাল, বীরপুরুষ, সুখ-দুঃখ,রাজারবাড়ি, কাঠের সিঙ্গির মত কবিতা গুলো।
পরিণত কৈশোর চর্চা(১৫-১৬):এটি সন্ধিক্ষণের পর্ব।এ সময় হালকা তারুণ্য বা আবছা যৌবন।এসময় জীবনে নানা প্রশ্ন ও সমস্যার উঠে আসে।এখানে রোমান্টিক প্রেমের ছায়া দেখা যায়।বড় হয়ে ওঠার প্রস্তুতি।তাই এই পর্বে চর্চার জন্য সে-যথাস্থান,শুভক্ষণ, আগমন,কৃপণ,হারিয়ে যাওয়া, ঠাকুরদাদার ছুটি,কুয়ার ধারে,দিঘি, সেকাল ইত্যাদি কবিতাগুলি রাখতে পারে।
সময় থাকলে এবার একটু শোনা যেতে পারে।

Post a Comment

0 Comments