জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-২৪/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-২৪
শুভদীপ বসু
বিষয়-বাংলার জনপ্রিয় আবৃত্তিকার

শম্ভু মিত্র (১৯১৫-১৯৯৭)-ভারতীয় নাট্যজগতে এই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব আবৃত্তি শিল্পের প্রথম সময়ের পথপ্রদর্শক।পিতা শরৎ কুমার বসু, মাতা শতদল বাসিনী দেবী।উনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বহুরূপী নাট্য সংস্থা।স্ত্রী তৃপ্তি মিত্র ও কন্যা শাঁওলি মিত্র স্বনামধন্য অভিনেত্রী। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর'মধুবংশীর গলি' কবিতাটি আজও ওনার কন্ঠে সমানভাবে জনপ্রিয়। এছাড়াও রবি ঠাকুরের কবিতা পাঠ, জীবনানন্দের কবিতা তাঁর কন্ঠে জনপ্রিয় হয়েছিল। শম্ভু মিত্রের আবৃত্তিতে একটি নিজস্ব ম্যানারিজম ছিল যা তাঁর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য।১৯৭০ সালে ভারত সরকার উনাকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করেছিলেন।

কাজী সব্যসাচী ইসলাম(১৯২৯-১৯৭৯) ষাট- সত্তরের দশকে কাজী সব্যসাচী ছিলেন জনপ্রিয় আবৃত্তিকার।কাজী নজরুল ইসলামের তৃতীয় পুত্র ছিলেন কাজী সব্যসাচী। ১৯৬৬ সালে নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাটি তার কন্ঠে জনপ্রিয় হয়েছিল।ইনি বাংলা আবৃত্তি শিল্পকে জনপ্রিয় করেন ও মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। তাঁরই হাতে আবৃত্তি একটি প্রায়োগিক ও নান্দনিক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।তিনি হয়তো প্রথম ব্যক্তি যিনি আবৃত্তি শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। আকাশবাণী কলকাতার ঘোষক ছিলেন ইনি।স্বয়ং নজরুল ইসলাম তাঁর'পুতুলের বিয়ে'নাটকটি কাজী সব্যসাচীর নামে উৎসর্গ করেছিলেন।তাঁর উদাত্ত,দরাজ, গম্ভীর কণ্ঠস্বর ও বলিষ্ঠ উচ্চারণ সকলকে বিমোহিত করত।১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর কন্ঠে কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার আবৃত্তি প্রচারিত হয় যা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।নজরুল ইসলামের যে কবিতাগুলি তার কণ্ঠে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল সেগুলি-বিদ্রোহী,সৃষ্টি সুখের উল্লাসে,আমার কৈফিয়ৎ,সাম্যবাদী,কামাল পাশা, কান্ডারী হুঁশিয়ার,জাতের নামে বজ্জাতি,অভিভাষণ, যদি বাঁশি আর না বাজে।এছাড়াও কবি শামসুর রাহমানের-স্বাধীনতা তুমি, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দ ভৈরবী,কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের উদ্বাস্তু,কবি জীবনানন্দ দাশের তোমার যেখানে সাধ চলে যাওকবিতাগুলি তাঁর কণ্ঠে সমানভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। আধুনিক বাংলা আবৃত্তির এই অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব আবৃত্তি সম্রাট কাজী সব্যসাচী ইসলাম ১৯৭৯সালে ২ মার্চ কলকাতা চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে পরলোকগমন করেন।

প্রদীপ ঘোষ (১৯৪২-২০২০)-অসামান্য মন্দ্রিত কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট উচ্চারণে নিখুঁত স্বরক্ষেপণ গুনে ষাটের দশকের বাংলা শিল্প এবং সংস্কৃতির জগতের কিংবদন্তি আবৃত্তিকার ছিলেন প্রদীপ ঘোষ।তাঁর পিতা চিন্ময় ঘোষ ও ছিলেন প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী।অসম্ভব স্মৃতি শক্তির অধিকারী প্রদীপ ঘোষ তিন বছর বয়স থেকেই পিতার কাছে আবৃত্তি শিক্ষা পান।কাজী সব্যসাচীর সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল এবং দুজনেই একই মঞ্চে আবৃত্তির অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করতেন। কাজী সব্যসাচীর পরে তাঁর কণ্ঠে কামাল পাশা,রবি ঠাকুরের দেবতার গ্রাস জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল। নজরুল ইসলামের'আমার কৈফিয়ত'ও বুদ্ধদেব বসুর 'জোনাকির'মতো কবিতা তার কণ্ঠে আজও ভুলতে পারেনি বাঙালি।তিনি দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের যুগ্ম অধিকর্তা ছিলেন। আবৃত্তি শৈলীর উপর তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি বই হল- 'আবৃত্তির কবিতা,কবিতার আবৃত্তি'।উনি উপসর্গহীন করোনায় ভুগছিলেন ও অবশেষে কলকাতায় নিজ বাসভবনে ২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর প্রয়াত হন।

জগন্নাথ বসু: জন্ম উত্তর কলকাতায় হাজার১৯৪৬ সালে। পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকেই নাটক ও আবৃত্তি জগতে প্রবেশ। মুখ্যত শ্রুতি নাটকের শিল্পী হলেও কলেজ জীবনে মেতে উঠেছিলেন মঞ্চনাটক নিয়ে।নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সেই সময়'শিল্পী যাযাবর'নামে একটি নাটকের দল গঠন করেছিলেন।পরবর্তীকালে বাংলা নাট্যজগতে শ্রুতিনাটক নামে নাট্য মাধ্যমটির প্রসারের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। স্ত্রী শ্রীমতি ঊর্মিমালা বসুর সঙ্গে তার শ্রুতি নাটকের অভিনয় দেশ দেশান্তরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অবসর গ্রহণের পর তিনি আকাশবাণীর নাট্য প্রযোজক হয়েছিলেন। বেতার নাটক'বেঞ্জামিন মোলায়েজ' নাটকের নাম ভূমিকায় তার অভিনয় সমৃদ্ধ প্রযোজনাটি ইতালিতে আন্তর্জাতিক বেতার নাটক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে।দূরদর্শনের বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়ভার তিনি সামলেছিলেন।দূরদর্শন কলকাতার কেন্দ্র নির্দেশক হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। 'বেতারের কথকতা এবং','পরচর্চা','বেতারের গ্রীন রুম থেকে'বইগুলি বাচিকশিল্পী এর জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।তাঁর সম্পাদিত বেশ কয়েকটি শ্রুতি নাটকের বই কলাভৃৎ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।মাইক্রোফোনের ব্যবহার সম্পর্কে তার কর্মশালা গুলি প্রত্যেক শিল্পীর কাছে অত্যন্ত লাভজনক।জগন্নাথ বসু ও ঊর্মিমালা বসু অভিনীত'রবিবার','পাকা দেখা' 'দম্বল','বড়ি ও শ্বশুরমশাই','নতুন বৌঠান'ইত্যাদি শ্রুতি নাটক গুলি বাঙ্গালিদের হৃদয় সর্বকাল থেকে যাবে।

উৎপল কুন্ডু: জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর১৯৫০। বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবত একনিষ্ঠ আবৃত্তি সাধনায় তিনি শুধু তারা আবৃত্তিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন তাই নয় আবৃত্তিচর্চার বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতি নিরূপণ ও আবৃত্তির শিল্পতত্ত্ব অনুসন্ধানে তিনি নিয়ত সজাগ ও পরিশ্রমী। উৎপল কুন্ডুর লেখা আবৃত্তি করার আগে,আবৃত্তি চর্চা,আবৃত্তি নিষিদ্ধ হোক,আবৃত্তির কথা বইগুলি আবৃত্তি চর্চা ও শিক্ষার অন্যতম সাধনা ক্ষেত্র। আবৃত্তির শিক্ষক হিসেবে বিরল প্রসিদ্ধির অধিকারী উৎপল কুন্ডু আবৃত্তির সমানভাবে জনপ্রিয়। বিভিন্ন কর্মশালায় তার আবৃত্তি কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের নতুন দেখায়। তিনি বলেন -"আবৃত্তি শুধু ভাবের আবেগে কবিতা বলে যাওয়া নয়,আবৃত্তিশিল্পী কে এক স্বতন্ত্র বোধের অধিকারী হতে হয়। সেই মৌলিক বোধ কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কক্ষপথে আবর্তিত হয় তার নানাবিধ মনন ও পর্যবেক্ষণ।"
কাজল সুর: উত্তর ২৪ পরগনায় হালিশহরে জন্ম কাজল সুরের। মায়ের হাত ধরে আবৃত্তি জগতে প্রবেশ শ্রী সুরের।'আঙ্গিক'বলে একটি নাট্য সংস্থা উনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ,গণনাট্য সংঘ ও কবিতা একাডেমির সদস্য কাজলের পরিচিতি আজ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের প্রতিটি প্রান্তে ও বিদেশে।তার প্রায় 25 টির বেশি আবৃত্তির অ্যালবাম দেশে-বিদেশে সমাদৃত।বাচিক দম্পতি শ্রী জগন্নাথ বসু ও ঊর্মিমালা বসুর সান্নিধ্যে এসে শ্রুতি নাটক লেখার সূত্রপাত করেন উনি।'আদিত্য ঠাকুর স্মৃতি পুরস্কার''কাজী সব্যসাচী পুরস্কার' 'আবৃত্তি রত্ন'ইত্যাদি বহু পুরস্কার তার ঝুলিতে।রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চাকরির পর বর্তমানে আবৃত্তির মাঠে ময়দানে কবিতার বিপ্লবের নাম কাজল সুর।অবশ্য তিনি সবাইকেই বলেন আবৃত্তি শিল্পটি জনপ্রিয়তা পেলেও দু-একজন হাতেগোনা শিল্পী ছাড়া এটিকে শুধুমাত্র পেশা করে জীবন নির্বাহ করা যাবে বলে তার মনে হয় না। তাই তার কথায়-'আবৃত্তি করে ব্রেকফাস্ট জটানো যায় কিন্তু ডিনার লাঞ্চ জোটানো কঠিন।'

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments