জ্বলদর্চি

করোনা ভাইরাস না, রাষ্ট্রই খুন করছে আমাদের /ঋত্বিক ত্রিপাঠী

করোনা ভাইরাস না, রাষ্ট্রই খুন করছে আমাদের 

ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

যে সামাজিক মাধ্যমে এতকাল ব্যক্তিটি নিজের মুখের ছবি দিয়ে অপেক্ষা করেছে শুভেচ্ছার লাইক কমেন্টের, সেখানে আজ ব্যক্তি অনুপস্থিত। ব্যক্তির প্রিয়জনেরা হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির ছবি পোস্ট করে করছে হাহাকার। হাহাকারের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে-- 'ভাবতেই পারছি না', 'অপূরণীয় ক্ষতি' 'তুমিও চলে গেলে' 'হেরে গেলে তুমিও' 'শ্রদ্ধা', 'আত্মার শান্তি কামনা করি' ইত্যাদি ইত্যাদি।

  প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু সংবাদ ভেসে উঠছে, তলিয়েও যাচ্ছে। মৃত্যু দুঃখজনক তো বটেই। এর পাশাপাশি রাগ জন্মায় না?

  আমরা কি ভাববো না -- কেন, কেন এই মৃত্যুমিছিল? যার আগে পরে আমরা সবাই। প্রশ্ন উঠবে না, এ কি নিছক মৃত্যু না কি খুন?

  করোনা ভাইরাস সংক্রমণ যখন প্রায় স্তিমিত, যখন ভ্যাক্সিন আবিষ্কার আমাদের নতুন জীবনের আলো দেখাতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়ুল মেরে বসলাম! জীবনের চাইতে গুরুত্ব পেল ভোট রাজনীতি আর ধর্মীয় অনুষ্ঠান! 

  ব্যক্তির ত্রুটি সংশোধনের জন্য রাষ্ট্র দণ্ড দেয়। কিন্তু, রাষ্ট্র তার নিজের ভুল শুধরে নিতে আদৌ সদিচ্ছা দেখায়? তবে কি রাষ্ট্র একচক্ষু-কানা! তবে কি গণতন্ত্রের নামে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে চলেছি আমরা আজও! 

  এমনটা কি হওয়ারই ছিল? না কি আত্মঘাতী আমরা! তবে আর হাহাকার করে, মোমবাতি মিছিল করে কি লাভ! দুঃখবিলাসিতা! যারা খুনের নেপথ্যে থাকলো, তাদের থেকে এই দুঃখবিলাসীদের মধ্যে দূরত্ব কতখানি! না কি মানুষ সব মেনে নেয়! মেরুদণ্ডের রোগে ভুগছে মানুষ? তাই কি প্রতিবাদী চেতনার বদলে লাফিয়ে ওঠে দুঃখ প্রকাশ! না কি প্রতিবাদ করা কঠিন, তাই সে বেছে নেয় সহজতর উপায়--হাহাকারকে! এ কি সহজলভ্য ভাবমোক্ষণ(ক্যাথারসিস)!

  করোনার দ্রুত বংশবিস্তারে তো আমরাই! করোনার অজুহাত দেখিয়ে কি লাভ! ভাইরাসের প্রতি আমাদের বিস্তর অভিমান! আর সিস্টেমকে ভাগ্যের পরিহাস বলে মেনে নিয়ে দিব্যি অপেক্ষা করছি আগামীকাল কে কে আমাদের ছেড়ে চলে যায়, তাই দেখার জন্য! আর দেখামাত্রই শোক! সুলভ সামাজিক মাধ্যমে শোকজ্ঞাপনের সহজতর উপায়কে অবলম্বন করে হয়ে উঠছি সামাজিক! লাইক কমেন্ট চিহ্ন সংকেত মাধ্যমে সেরে নিচ্ছি ইহলোক পরলোকের শ্রাদ্ধশান্তি।  

  জনসভা করলে করোনা বাড়বে এটা যেন নাবালক-শিশু নির্বাচন কমিশন জানতই না! জানতই না আমাদের জননেতারা! গণতন্ত্র রক্ষার নামে এই এত এত মানুষের অসুস্থতা ও মৃত্যুর দায় কে নেবে? নির্বাচন কমিশন কোর্টের ধিক্কার পেয়েছে। আমরা কী খুশি কী খুশি! নিরপরাধ মানুষকে যখন মাওবাদী সন্ত্রাসবাদীরা বোম ছুঁড়ে মেরে ফেলে, তাকে 'খুন' বলি। খুনের পিছনে যারা থাকে, রাষ্ট্র তাদের শাস্তি দেয়। অবশ্য এখন (অনেকক্ষেত্রে) মাওবাদীরা সরকারি চাকরির সম্মান পাচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কি কোনও শাস্তি পাবে না? তবে কি ব্যক্তি আর সংগঠনের জন্য আলাদা আইন? সংগঠন যাঁরা পরিচালনা করেন-- তাঁরা কি অতিমানব!
  আর, আমরা। আমরা কারা!
আমরা দু'অক্ষর, তিন অক্ষর, চার অক্ষর!  

  আমরা ভোট দিয়ে সরকার গড়ি। সরকার মন্দির মসজিদ মূর্তি গড়ে। আমরা মূর্তির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমরা জনপ্রতিনিধিদের জনসভায় ভিড় করি। জনসভায় তিরিশ ভাগ সত্তর ভাগের ধর্মবিভাজন শুনে বাড়ি ফিরি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এই সব বে-আইনি কথাবার্তা শোনে। কখনও নীরব থাকে। কখনও রোমান্টিক তিরস্কার দেয়। রোমান্টিক কেন? সে তিরস্কারে জনপ্রতিনিধিদের কিছুই যায় আসে না যে! প্রশ্ন জাগে, এই সুপ্রিম কোর্ট, আদালত-- এরাও কি অসহায়! না কি সিস্টেমের দাস! হিন্দু মুসলিম করে যারা ভেদাভেদ গড়ে তুলছে তারা তো দিব্যি জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভোটে নামছে। ভোটে জিতে শপথ নিচ্ছে সর্বধর্ম সমন্বয়ে! আমাদের হাসি পাচ্ছে। আমাদের বিস্ময় লাগে আমাদের সংবিধান এত দুর্বল! 

  এরপরও আমরা ভুলে যাচ্ছি এই সব দুঃখকথা, অনাচার। ফের জনহিতকর কাজে যুক্ত হচ্ছি। সরকারের ত্রাণতহবিলে দান করছি। রাষ্ট্রের নামে মানত করছি। স্বপ্ন দেখছি, একদিন সব সমস্যা কেটে নতুন সূর্য উঠবে। ইতিমধ্যেই আমরা ভুলতে বসেছি পরিযায়ী শ্রমিক হত্যা প্রসঙ্গ। রাজ্য ও কেন্দ্র জানে না, জানতেও চায় না পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কত! আর, কত পরিযায়ী শ্রমিক খুন হলো!

 এরপর লাস্টসিনে নায়কনায়িকার আবির্ভাব ঘটবে।শিরোনামে উঠে আসবে করোনা মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ। আমরা বলবো -- বাহ, বাহ, সাধু সাধু! আর আমরা ভুলে যাবো হাজারো খুনের পরিসংখ্যান। ভুলে যাবো, এই নায়কনায়িকারাই আসলে আমাদের জীবন-নাটকের ভিলেন!
  মরে তো যাবোই সবাই। মরে যাওয়ার আগে, আসুন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বীকার করি সত্যকে! মরার আগে কেউ তো দায় নিক! ভাইরাসের দোষ না ধরে কেউ তো বলুক, ভুল হয়েছে এত এত জনসভা! এরপর কেউ বলবেনই, যে রাজ্যে ভোট ছিল না সেখানেও কেন এত সংক্রমণ! যেখানে ভোট নেই, সেখানে অন্য অন্য নাটক চলেছে। ধর্মের নামে অধর্মের নামে হাজারো ভঙ্গিমা। আর প্রশাসনিক গাফিলতিতে করোনা বিধি না মানা। আমরা আসলে আত্মঘাতী। প্রশ্ন জাগে আমাদের রাষ্ট্র কি আত্মহত্যার স্বীকৃতি দিল অলিখিত ভাবে? আত্মহত্যা এক বিষয়। কিন্তু সংক্রমণ ছড়িয়ে এই যে মৃত্যুমিছিল গড়ে উঠলো তার দায় একা ভাইরাস মাথা পেতে নেবে? ধর্মসভা ও  নির্বাচনসভার কর্মকর্তারা নেবেন না দায়! অথচ সেই ধর্মের পায়ে আমরা মাথা রাখবো! আর এই জনপ্রতিনিধিদের দেশ-শাসনে আমরা হব দেশবাসী! খুন ও খুনীকে মেনে নেওয়া আমরাও তো তবে পরোক্ষে খুনী! তাহলে খুন দেখলে, হিংসা দেখলে, ধর্ষণ দেখলে আমরা হাহাকার করে উঠি কেন! কী প্রমাণ করতে চাই-- যে আমরা এ সব চাইনি? প্রকাশ্যে হয়তো চাইনি, কিন্তু অবচেতনে চেয়েছি। চেয়েছি বলেই আজ এত অশান্তি, এত সংক্রমণ! চেয়েছি বলেই আজ মৃত্যুমিছিলের আগেপরে দাঁড়িয়ে সবাই। প্রজাহীন রাজার কী-বা প্রয়োজন! রাজাকে রাজা বলবার মতো একদিন প্রজা থাকবে তো! আসুন, শেষমেষ মানত করি ও করোনাভাইরাসের পায়ে পড়ি। কারণ, এখন একমাত্র নিয়তিবাদ ছাড়া আর কী-বা আছে বাকি! রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্রের হত্যাকারী!

  এরপরও আপনি বলতে পারেন, না না এতটা ভয় ও হতাশার কিছু নেই। আসলে, যে পরিবার পরিস্থিতির শিকার, যে পরিবার প্রিয়জনকে হারিয়েছে, সে পরিবারই জানে খুন ও মৃত্যুর সঠিক সংজ্ঞা।

  ঘরে আগুন লাগিয়েছি আমরাই। সেই আমরাই এখন পুকুর খুঁড়তে শুরু করবো, ভাবছি।

সংযোজন 
আমি আপনি তথা আমরাও সরকারের অংশ। তাই আমাদেরও দায় আছে। শুধু সিস্টেম ও সরকারকে দোষারোপ করলে চলবে না। সাংস্কৃতিক(নাচ-গান, কবিতা পাঠ, পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদি) ও সামাজিক অনুষ্ঠান(বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি) কিছুদিন বন্ধ থাকলে বড় ক্ষতি থেকে আমরা বাঁচবো। বয়স্ক লেখক শিল্পীর বাড়ি যাওয়া ও তাঁর পাশে বসে ছবি তোলা অন্যায় নয়, কিন্তু এই কোভিড পরিস্থিতিতে তা আদৌ বিজ্ঞানসম্মত নয়। খেয়াল রাখতে হবে, হয়তো আমার কিছুই হলো না, কিন্তু আমার জন্য অন্যের যদি কিছু বিপদ হয়, তবে আমি খুনী। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি আমিও খুনী।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments