জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- তিব্বত(রাজামশাইর বেয়ান ঠাকরুণ)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- তিব্বত 
চিন্ময় দাশ 

রাজামশাইর বেয়ান ঠাকরুণ 

বহু বহুকাল আগের কথা। 
হিমালয় পাহাড়ের কোলে, এক পাহাড়ি শহর লাসা। একেবারে ছবির মত সাজানো। দেখলে, চোখ জুড়িয়ে যায়। আর, হবে না-ই বা কেন? রাজার রাজধানী বলে কথা। রাজামশায়ের পেল্লায় বাড়িখানাই বা কম যায় কিসে? শহরের সবচেয়ে বড়, আর সবচেয়ে সুন্দর করে সাজানো অট্টালিকা। 
রাজার বাড়ির খানিক দূরেই এক ইঁদুরের বাড়ি। তবে কিনা, ইঁদুরের কি আর বাড়ি হয়? একটা গর্তের মধ্যে থাকে কোনও রকমে।
  সারা জীবনভর মনে ভারি দুঃখ ইঁদুরের। কত কত জীব আছে বিধাতার এই দুনিয়ায়। তারা কত বলবান, কত সুন্দর, কত বুদ্ধিমান। আর, ইঁদুর? তাদের কেবল দুর্বল, কুৎসিত আর বোকা করে গড়েছেন বিধাতা পুরুষ । এ কেমন বিচার !
 একবার হল কী, ইঁদুরটির বাচ্চা হবে তখন। একদিন টুক করে রাজার মন্দিরে গিয়ে ঢুকে পড়ল ইঁদুর। মূর্তির পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল-- ঠাকুর, বর দাও আমাকে। আমার ছেলে যেন বলবান হয়।
সেবার দেবতারও যেন সত্যিই দয়া হল ইঁদুরের উপর। যখন বাচ্চা হল, দেখা গেল, আস্ত একটা সিংহের বাচ্চা জন্মেছে। দেখতে দেখতে বড় হল বাচ্চাটা। তেজী সিংহ একেবারে।
  একদিন সিংহ-ছেলে তার ইঁদুর-মাকে ডেকে বলল-- এখানে তো আর থাকা যায় না, মা। আমি বনে যাই বরং।
  শুনে মা তো কাঁদতে লাগল। সিংহ বলল--চিন্তা কোর না, মা। যখনই কোন দরকার পড়বে, বনের কিনারায় যাবে। এক মুঠো লোম বাতাসে উড়িয়ে দেবে। আর, তিনবার ডাকবে আমার নাম ধরে। পলক পড়বে না, তোমার ছেলে এসে হাজির হয়ে যাবে সামনে।
মায়ের হাতে লেজের একমুঠো লোম ধরিয়ে দিয়ে, বনে চলে গেল সিংহ।
  সময় গড়াল। আবার বাচ্চা হবে ইঁদুরের। সে আবার গিয়ে হাজির হল মন্দিরে-- ঠাকুর, দয়া করো আমাকে। আমার ছেলে যেন এবার রূপবান হয় তোমার বরে।
দয়া হল বিধাতার। এবার একটা ময়ূরের ছানা জন্মালো। দেখতে দেখতে বড়ও হল বাচ্চাটা। রঙ যেন ঝলমল করছে তার সারা শরীরে। চোখ জুড়িয়ে যায় দেখলে। একদিন ময়ূর বলল-- মা, আর তো এখানে থাকা যায় না। এবার আমি বনে যাই ,মা।
ইঁদুর কেঁদে বলল-- তুমিও চলে যাবে, বাছা?
ময়ূর বলল-- চিন্তা কোর না, মা। যখনই দরকার পড়বে, বনের কিনারায় চলে আসবে। একমুঠো পালক উড়িয়ে দেবে বাতাসে। তোমার ছেলে তোমার সামনে এসে হাজির হয়ে যাবে।
  গা থেকে একমুঠো পালক তুলে, মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বনে চলে গেল ময়ূর।
সময় গড়ালো আবারও। বাচ্চা হবার সময় হল ইঁদুরের। আবারও মন্দিরে এসে ঠাকুরের পায়ে পড়ল ইঁদুর-- অসীম করুণা তোমার, ঠাকুর। দু'বার দয়া করেছ আমাকে। আর একবার দয়া করো। আমার ছেলে যেন বুদ্ধিমান হয় এবার। এই শেষবার। আর কোনদিন আসবো না তোমার মন্দিরে।
কী আশ্চর্য, এবার একেবারে আস্ত এক মানুষের বাচ্চা জন্মাল ইঁদুরের। আনন্দে বুক ভরে গেল মায়ের। 
কিন্তু ছেলে যত বড় হতে লাগল, ভয় হতে লাগল তার। এই ছেলেও একদিন চলে যাবে না তো মাকে ছেড়ে! শহরে গিয়ে বাস করবে তার মানুষ জাতভাইদের সাথে!
  অনেক ভেবে-চিন্তে, একদিন সব কথা খুলে বলল সে ছেলেকে। তার দুই বড় ভাইয়ের কথা। তাদের বনে চলে যাওয়ার কথা। সব, স-অ-ব খুলে বলল দুঃখিনী ইঁদুর-মা। বলে, চেয়ে রইল ছেলের মুখের দিকে।
ছেলে বলল-- দুঃখ কোর না, মা। কথা দিলাম, কোনদিন ছেড়ে যাব না তোমাকে। আমরা মা-ছেলে একসাথেই থাকব দুজনে। শুনে, আনন্দে বুক ভরে গেল মায়ের। 
  ছেলে বড় হচ্ছে দিন দিন। ভিতরে তো ঢুকতে পারে না, গর্তের মুখে বসে থাকে ছেলে। দিন সুখেই কাটতে লাগল দুজনের।
  একদিন একটা ঘটনা ঘটল। রাজার নাপিত যাচ্ছিল রাজবাড়িতে। ছেলেটাকে চোখে পড়ে গেল তার। এমন সুন্দর একটা ছেলে, এখানে পথের ধুলায় বসে কেন? মনে খানিক ধন্দ হল তার। 
  সবাই জানে, নাপিতের মাথায় ঝুড়ি-ভর্তি বুদ্ধি। সে পুঁটলি খুলে, বসে পড়ল ছেলেটার সামনে-- এসো তো, বাছা! নখ-চুলগুলো কেটে-ছেঁটে দিই। এমন চাঁদের পারা মুখ। চুলের আড়ালে দেখাই যায় না।
নিজের কথা শেষ করল না। কিছু বলতে দিল না ছেলেটাকেও। কুচ করে কাঁচি চালিয়ে দিল নাপিত। মনে ভাবনা, কিছু একটা রহস্য আছে, মালুম হচ্ছে। দেখা যাক, উদ্ধার করা যায় কি না।
  কিন্তু অবাক হতে অনেক বাকি ছিল তার। যেই না এক গাছা কাটা চুল মাটিতে পড়েছে, অমনি আজব ব্যাপার। কোথায় কী চুলের গোছা? এক মুঠো হীরে-মুক্তো গড়াগড়ি খাচ্ছে পথের ধুলায়।
নাপিত? তার চোখ দুটো তখন ছানার বড়া। মাথা ঘুরছে বোঁ-বোঁ করে। ভিরমি খাবার জোগাড় বেচারার। 
  কিছুটা সময় গেল ধাতস্থ হতে। মাথাটাকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল প্রাণপণে। চুল কাটতে লাগল হাত চালিয়ে। আর, ভাবতে লাগল, কে এই ছেলে? তারপর যেই না একটা নখ কেটেছে, এবার আস্ত একটা মণি গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। চোখ পড়তেই চমকে গেল নাপিত। হাতে তুলে পরখ করে দেখল জিনিষটা।
জিনিষটা পাথর। তবে, তেমন স্বচ্ছ নয়। আসমানি রঙ সেই পাথরের। তাহলে, এ তো নীলকান্ত মণি! রাজার ঘরেও অমন জিনিষ বেশি নাই! 
  হাতের নখ কাটল। পায়ের নখ কাটল। একই ব্যাপার। একটা নখ কাটে, একটা মণি গড়িয়ে পড়ে মাটিতে।
  চোখ গোল গোল। হাত-পা কাঁপছে লোকটার। এদিকে লোভও হচ্ছে খুব। কিন্তু ভয়ও করছে তার চেয়ে বেশি। রাজার কানে গেলে, শূলে চড়তে হবে। কী করা যায়? কী করা যায়?
  এদিক ওদিক চেয়ে দেখল, এ তল্লাটে কেউ নাই কোথাও। তড়িঘড়ি মণিমুক্তোগুলো কোঁচড়ে ভরে, লাগালো ছুট। ছুটতে ছুটতে একেবারে সোজা রাজার বাড়ি। কাউকে কিচ্ছুটি না বলে, রাজার কাছে গিয়ে, কানে দিল কথাটা। কোঁচড় একটু ফাঁক করে রাজামশাইকে দেখাল জিনিষগুলো। 
  রাজার তো চোখ চকচক করে উঠল। আর একটু হলে, পড়েই যেত মাথা ঘুরে। এমন ঘটনা তার বাপ-ঠাকুরদাও দেখেনি কোনদিন। নাপিতকে বলল-- ঠিক আছে, দেখছি। এগুলো খাজাঞ্চির হেফাজতে জমা দিয়ে, তুমি যাও এখন। 
  খানিক বাদেই, রাজার পাঁচজন পেয়াদা এসে হাজির গর্তটার সামনে। পাঁচটা ঘোড়ার কুড়িখানা খুরের আওয়াজ! চাট্টিখানি কথা নাকি? মাটি কাঁপছে থরথর থরথর। গুম গুম আওয়াজ হচ্ছে গর্তের ভিতর। পড়িমরি করে ইঁদুর বেরিয়ে এসেছে গর্তের মুখে। ব্যাপার কী? আমার ঘরে রাজার লোক কেন? ভয়ে তো শরীর কাঁপতে লাগলো। তবে কি এই ছেলেও চলে যাবে তার?

লোকগুলো বলল-- এই ছেলে, তলব হয়েছে রাজামশাইর। রাজবাড়িতে চলো। 
যেমন হুকুম, তেমন কাজ। ভরা দরবারে এনে হাজির করা হল ছেলেটাকে। রাজা গম্ভীর গলায় বলল-- কোথা থেকে এসেছ তুমি? রাজার বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢোকার সাহস হল কী করে? শাস্তি পেতে হবে এজন্য। তোমার মায়ের মৃত্যুদন্ড। আর তুমি চাকর হয়ে থাকবে রাজবাড়িতে। 
  ছেলেটার কী-ই বা বলবার আছে? ভরা দরবার দেখেই মাথা ঘুরে গেছে তার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কেবল।  
রাজা মাথা নেড়ে বলল-- তবে--, কথা শেষ না করে থেমে গেল রাজা। 
-- তবে কী, রাজামশাই? ছেলেটা ভাবল, ভয় পেলে চলবে না। বরং কোন উপায় বের করা যায় কি না, দেখা যাক।
  রাজা গম্ভীর গলায় বলল-- তবে, একটা উপায় আছে। আমার রাজবাড়ীর চারদিকে চারটা দেউড়ি। সেগুলোর পাহারাদার হিসাবে চারটে সিংহ চাই আমার। যদি এনে দিতে পারো, মা-ছেলে দুজনেই রেহাই পেয়ে যাবে। শুধু তাই নয়। রাজকন্যার সাথে বিয়ে দেব তোমার। তখন আমার রাজ্যের অর্ধেকটা যৌতুকও দেব তোমাকে। তবে হ্যাঁ, চার দিনের মধ্যে আনতে হবে কিন্তু।
  রাজা মনে মনে ভালোই জানে, এ কাজ এই ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়। চার দিন পর, আমার চাকর হয়ে থাকবে ছেলেটা। তার পর? যত মণি-মুক্তো সব ঢুকবে আমার সিন্দুকে। ভাঁড়ার ফুলে ফেঁপে উঠবে বছর না ঘুরতেই। 
  এক বুক ভাবনা নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে এল ছেলেটা। সব কথা খুলে বলল মাকে। ইঁদুর-মা বলল-- এখনই ভেঙে পোড় না, বাছা। আরও দুই ছেলে আছে আমার। এই বিপদে, তারা নিশ্চয়ই বাঁচাবে আমাদের।
গর্তের ভিতর একটা খোঁদলে রাখা ছিল সিংহের লোমগুলো। সেগুলো এনে, ছেলের হাতে ধরিয়ে দিল ইঁদুর। কী করতে হবে, সব বুঝিয়ে, রওনা করে দিল ছেলেকে। 
  হাঁটতে হাঁটতে গভীর জঙ্গলের মুখে এসে হাজির হল ছেলেটা। মুঠো ভর্তি হাতের লোম বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে, 'সিংহভাই' ‘সিংহ ভাই' বলে তিনবার হাঁক পাড়ল গলা তুলে। 
  অমনি এক অবাক কান্ড। হাঁকের রেশ মেলায়নি তখনও বাতাসে। বিশাল এক সিংহ হাজির তার সামনে। কী জবরদস্ত চেহারা! কী তার তেজ! মাটিতে লেজ আছড়ে, বলল-- বলো, কী করতে হবে?  
 রাজার হুকুমের কথা খুলে বলল ছেলেটা। কথা ফুরোতে পেল না তার। বিশাল এক গর্জন বেরুল সিংহের গলা দিয়ে। আকাশ, বাতাস, সমস্ত বনভূমি কেঁপে উঠল সেই বিকট গর্জনে। কে কথায় কী বুঝল, কে-ই বা জানে! পালে পালে বনের যত সিংহ এসে জড়ো হতে লাগল দুই ভাইয়ের সামনে। ভয় পাওয়ার ফুরসৎ কোথায়? ছেলেটার তখন অবাক হওয়ার পালা। 
  আর, তার সিংহ-ভাই? তার মুখে মুচকি হাসি। সবচেয়ে বড় সিংহটার পিঠে ভাইকে চাপিয়ে দিয়ে, বলল-- হাজির হবে সোজা দরবারে গিয়ে। রাজাকে বলবে, পছন্দ মত চারটে সিংহ সে নিজে বেছে নেয় যেন।
  সিংহের পিঠে সওয়ার হয়ে চলেছে এক যুবক ছেলে। তার পেছনে এক পাল সিংহ চলেছে দল বেঁধে। পথের দু'পাশে ভীড় জমিয়ে, হাঁ করে দেখতে লাগল লোকেরা। যেমন ভয়ও পাচ্ছে, অবাক হয়েছে তার চেয়ে কম নয়। এমন ব্যাপার কে কবে দেখেছে? 
রাজবাড়ীর সদর ফটকে পৌঁছতেই, সে এক হুলুস্থুল কান্ড। পাহারাদারের দল, যে যেদিকে পারল, হুড়মুড়িয়ে পালাল। চোখে পড়ামাত্রই দৌড় লাগল সেপাই-শান্ত্রীরাও। 
কোনও ভ্রূক্ষেপ নাই ছেলেটার। যেমনটি বলে দিয়েছিল তার সিংহ-ভাই, সোজা দরবারে গিয়ে ঢুকে পড়ল সে।
  দরবার ভরা লোকজন। সবাই থ'। সবাই তটস্থ। সিংহের পিঠ থেকে নেমে, রাজার কাছে পৌঁছে গেল ছেলেটা, বলল-- বনের সেরা সিংহগুলোকে বেছে এনেছি। পছন্দ মত চারটে বেছে নিন আপনি। 
কথা বলবে কী, এবার রাজার চোখ ছানাবড়া। এক সাথে এতগুলো বুনো সিংহ! রাজা কোনদিন চোখেও দেখেনি। কে এই ছেলে? নির্ঘাত কেউকেটা হবে কেউ একজন।
  কিন্তু মনের ভাব জানতে দিতে নাই। রাজা সিংহাসন থেকে নেমে, চারটে সিংহ বেছে  নিয়ে বলল-- ঠিক আছে, এখন যেতে পারো তুমি।
  পুরস্কার দেবে বলেছিল রাজামশাই, ছেলেটা ভাবল, সে কথা এখন তোলা ঠিক হবে না। এখান থেকে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সিংহের পাল নিয়ে বেরিয়ে গেল সে। রাজাও বাঁচল হাঁফ ছেড়ে।
  কিন্তু মুক্তোর লোভ বলে কথা। সে তো মন থেকে যায় না রাজার। আবার ক'দিন বাদে, পাঁচ পেয়াদা এসে হাজির ইঁদুরের ঘরের সামনে। -- শোন গো, ছেলে। আবার ডাক পড়েছে তোমার। চলো রাজবাড়িতে। 
দুরু দুরু বুকে আবার দরবারে এসে হাজির হতে হল ছেলেটাকে। রাজা বলল-- আমার রাজবাড়ীর চার দেউড়ির মাথায়, চারটে ময়ূর রাখব আমি। অনেক দিনের সখ আমার। এনে দিতে হবে তোমাকে। তবে হ্যাঁ, এবার আর চার দিন নয় কিন্তু। আজই চারটে ময়ূর চাই আমার। নইলে, শাস্তির কথা তো তুমি জানোই।
  আবার দারুণ ভয় নিয়ে ঘরে ফিরল ছেলেটা। ইঁদুর-মা সব শুনে বলল-- অত ভাবনার কী আছে? আরও এক ছেলে আছে আমার। 
গর্তের খোঁদল থেকে একমুঠো ময়ূরের পালক এনে ধরিয়ে দিয়ে, ছেলেকে পাহাড়ে পাঠিয়ে দিল সে। 
পথের হদিস মা বলে দিয়েছে। সেই মত পাহাড়ে চড়ে পড়ল ছেলেটা। মুঠোর পালক বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে, হাঁক পাড়ল-- ময়ূর-ভাই।
তিন বারের ডাক শেষ না হতেই, সুন্দর একটা ময়ূর তার সামনে এসে নেমে পড়ল ঝপ করে। বলল-- বলো, কী করতে হবে? 
  জবাব দেবে কী, ছেলেটা তো তখন হাঁ করে দেখছে ময়ূরকে। অত সুন্দরও রূপ হয় কোন পাখির! ময়ূরটাও চেয়ে চেয়ে দেখছে সেই ছেলেকে। কী সুন্দর দেখতে! এ কি না আবার তার নিজের ভাই! তারপর, ছেলেটা  হুঁশ ফিরে পেয়ে, রাজার ফরমান ময়ূরকে শুনিয়ে বলল-- কিছু একটা বিহিত করো তুমি। নইলে আমরা দুজন মারা পড়ব একেবারে।
ময়ূরের মুখে মিষ্টি হাসি। অভয় দিয়ে, বলল-- একটুও ভাবনা কোর না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে এক্ষুনি। বলেই, উঁচু দেখে একটা গাছের মাথায় চড়ে,  ভয়ানক জোরের এক ডাক ছাড়ল ময়ূর। ময়ূর দেখতে ভারী সুন্দর। কিন্তু তার গলা যে এত কর্কশ, কে জানতো? তবে হ্যাঁ, গলায় জোর আছে বলতে হবে। 
অমনি দেখতে না দেখতে যেন ঝড় উঠল বাতাসে। বনের মাথার সারা আকাশ ঢেকে গেল ময়ূরদের ডানায়। হাজার হাজার ময়ূর এসে হাজির হয়ে গেল সেখানে। সবাই রাজবাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে এসেছে।
  সেদিন আবার এক অভাবনীয় দৃশ্য। গাছ-পালা, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর-- সবকিছুরই উপর দিয়ে ভেসে চলেছে নীল রঙের একটা ঘন মেঘ। ভালো করে দেখ তে, বোঝা গেল-- মেঘ কোথা গো? এ যে হাজার হাজার ময়ূরের ডানা। একেবারে সামনে, চারটে ময়ূরের পিঠে চেপে বসে আছে এক ছেলে। যেন রথ হাঁকিয়ে মৃগয়ায় চলেছে কোন অচিন দেশের রাজকুমার।
  রাজার দরবারে পৌঁছে, সার বেঁধে দাঁড়াল সবাই। সবার সামনে ছেলেটি। সে বলল-- দেশের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে সুন্দর ময়ূরদের নিয়ে এসেছি। আপনি নিজে বেছে নিন পছন্দ মতন।
সেদিন আর অবাক হল না রাজা। একেবারে অভিভূত। তবে, মুখে বলল না কিছুই। চারটে ময়ূর বেছে নিয়ে, বাকিদের ফিরিয়ে দিল। 
  রাজপ্রাসাদের চার দেউড়ির মাথায় বসিয়ে দেওয়া হল চার ময়ূরকে। কী তাদের শরীরের গড়ন! রূপই বা কী তাদের! প্রজারা ভিড় করে এসে দেখে যেতে লাগল। কিন্তু রাজার মনে সুখ নাই। সিংহ বা ময়ূরে কী এমন কাজ দেবে। কেবল দেখনদারী বই তো নয়। মণি-মুক্তো সিন্দুকে ভরতে না পারলে, কিসের রাজা! 
ক'দিন বাদে আবার পেয়াদা এসে হাজির রাজার তলব নিয়ে-- চলো, বাছা। ডাক পড়েছে আবার। এবার কিন্তু তোমার মাকে নিতে হবে সাথে। তেমনি হুকুম হয়েছে যে।
   ছেলেটা দেখল, এক ফাঁকে এক পেয়াদা গিয়ে, চুপিচুপি কিছু বলে এল ইঁদুরের কানে। মুখ ভার করে ছেলেটা বলল-- এবার আমাদের কে বাঁচাবে, মা? 
ইঁদুরেরও মুখ শুকনো। তবুও বলল-- ভাবছো কেন, বাছা? এবার আমি তো আছি সাথে। রওনা হওয়ার আগে, ইঁদুর তার ছেলেকে বলল, তার সারা গায়ে পুরু করে বিষ মাখিয়ে দিতে। সেই বিষ-মাখা শরীরে ছেলেকে নিয়ে রাজবাড়িতে এসে হাজির হল ইঁদুর।  
সেদিন আর দরবারে নয়। মা ছেলেকে আনা হল রাজবাড়ীর মাঠে। লোকে লোকারণ্য সেখানে। মাঠের মাঝখানে এনে রাখা হয়েছে রাজার হাতিকে। রাজা ঘোষণা করেছে-- এই হাতির সাথে লড়াই হবে ইঁদুরের। হেরে গেলে, ইঁদুর তো মরবেই। তার ছেলেকে চাকর হয়ে থাকতে হবে রাজার বাড়িতে।
   ইঁদুর লড়বে হাতির সাথে! এমন আজব কথা কে কবে শুনেছে? মজা দেখবে বলে, প্রজারা সব এসে ভেঙে পড়েছে মাঠে। মাঠ কানায় কানায় ভর্তি। ভিতরে সেঁধোতে পারেনি যারা, তাদের কেউ কেউ আশপাশের ঘরবাড়ির মাথায়, উঁচু গাছের ডালে চেপে বসেছে।
হাজারো লোক-লস্কর চার দিকে। উঁচু একটা বেদি বানানো হয়েছে। সেখানে বসেছে মন্ত্রী-সান্ত্রী, উজির-নাজির, কোতয়াল-দেওয়ান-- কেউ বাদ যায়নি। তাদের একেবারে মাঝখানটিতে বসেছে রাজা। তার একদিকে রানীমা। অন্য দিকে রাজার আদরের মেয়েটি। 
  মা-ছেলেকে এনে সেখানে হাজির করল পেয়াদার দল। ছেলেটি রূপসী রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। লম্বা একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক থেকে। রাজার চোখ এড়াল না ব্যাপারটা।
রাজা বলল-- এই হাতির সাথে লড়তে হবে তোমার মাকে। যদি জিততে পারে, তোমার সাথে বিয়ে দেব আমার এই মেয়েকে। দেব আমার রাজ্যের আধখানাও। আর, যদি হেরে যায়, হাতির পায়ে থেঁতলে মরবে সে। আর তুমি চাকর হয়ে থাকবে আমার রাজবাড়িতে।
  ঘোষণা শুনে, হায় হায় করে উঠল মাঠভরা লোকজন। এমন অবিচার কে দেবে দেখেছে, না শুনেছে? কিন্তু ইঁদুরের মুখে একটুও ভয় নাই। সে এগিয়ে গিয়ে মাঠের মাঝখানটিতে হাজির হয়ে গেল। হুকুম পেয়ে, রাজার মাহুত গিয়ে শেকল খুলে দিল হাতিরও। একদিকে পাহাড়ের মত বিশাল চেহারার হাতি। অন্য দিকে ছোট্ট সর্ষেদানার মত একটা পুঁচকে ইঁদুর।
  ছেলেটা বেদম ভয় পেয়ে, চেঁচিয়ে বলল-- রেহাই দিন, রাজামশাই। আমি চাকর হয়ে থাকব রাজবাড়িতে। আমার মাকে ছেড়ে দিন, দয়া করে।
রাজার একটু দোনোমনো ভাব এল মনে। কিন্তু লেজ উঁচিয়ে দৌড়ে এল ইঁদুরটাই-- ভয় পাচ্ছ কেন, বাছা? লড়াইটা হতেই দাও না।
এরপর ভালো করে কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই, নিমেষের মধ্যে যা ঘটল, সব একেবারে ভোজবাজির মত। কেউ যেন আগে থেকে সাজিয়ে রেখেছে সব কিছু।
  শেকল খোলা পেয়ে, শুঁড় উঁচিয়ে ছেলেটার দিকে তেড়ে এল রাজার হাতি। তখনই তিড়িং করে এক লাফ দিয়ে তাদের মাঝখানে এসে পড়ল ইঁদুরটা। 
-- এটা আবার কে? থমকে থেমে গিয়ে, তাকে দেখতে গেল হাতি। অমনি আর এক লাফে, হাতির পায়ে এসে পড়ল ইঁদুর। আর কুটুস করে একটা কামড়!
কুতকুতে চোখ হাতির। একসাথে সব কিছু দেখতে পায় না। যেমনি মাথা নামিয়ে পা দেখতে গিয়েছে, লম্বা শুঁড়খানাও ঝুলে পড়েছে।  অমনি টুকুস করে শুঁড়ের ফুটো দিয়ে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল পুঁচকেটা।  সোজা পেটের ভেতর। অনেকখানি খোলা জায়গা। সেখানে পৌঁছে বেদম গড়াগড়ি খেতে লাগল ইঁদুর। আসলে সে তখন গায়ে মেখে আনা বিষ মাখিয়ে দিচ্ছে হাতির পেটে। 
হাতি তো অতশত জানে না। বেচারা বুঝতেই পারেনি ব্যাপারটা। কেবল ভিতরে কিছু একটা সুড়সুড়ি মতন লাগছে, এটা বেশ বুঝতে পারছে। আর সুড়সুড়ির ঠেলায় ভয়ানক ছটফট আর লাফালাফি করতে লাগল সে। লোকজনও ভারী মজা পেতে লাগল তা দেখে।
  কিন্তু সে আর কতক্ষন? যেই না বিষের কাজ শুরু হল, নেতিয়ে পড়তে লাগল হাতি। পায়ের দাপানি থেমে আসতে লাগল। এক সময় দেখা গেল, স্থির দাঁড়িয়ে আছে হাতিটা, অবিচল পাহাড় যেমন। তারপর ধপাস করে আছড়ে পড়ে গেল মাটিতে।
ইঁদুর তো ছিল হাতির পেটের ভিতরে। ভালো মতন একটা ঝাঁকুনি খেল সে। তবে, ইঁদুর বুঝে গেল, হাতির কেরামতি শেষ। সুড়ুৎ করে বাইরে বেরিয়ে এল সে। ছেলেকে সাথে নিয়ে, মাঠময় এক পাক দৌড়েও নিল লেজ উঁচিয়ে। 
  কথা রাখল রাজামশাই। মহা ধুমধাম করে ছেলেটার সাথে বিয়ে দিল রাজকন্যার। সাত দিন ধরে ভুরিভোজ খেল দেশসুদ্ধ লোক। বন আর পাহাড়ের যত বাঘ-সিংহ-হরিণ, যত পাখির দল-- তাদের সবাইকেও ভোজ খাওয়ানো হল। রাজার মেয়ের বিয়ে বলে কথা! আনন্দের বন্যা বয়ে গেল সারা  রাজ্য জুড়ে।
কেবল রাজকন্যা নয়, কথা মতন, অর্ধেক রাজ্যও দেওয়া হয়েছে ছেলেটাকে। নতুন একখানা পেল্লাই প্রাসাদও। দাস-দাসী, লোক-লস্কর সব কিছু। রাজকুমারীকে নিয়ে মহা সুখে দিন কাটে ছেলেটির।
আর ইঁদুর-মা? তার আনন্দ দেখে কে? সিংহ আর ময়ূর--দুই বড় ছেলেকে রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। তাদের নিয়ে কোনও ভয় নাই এখন আর। স্বয়ং দেশের রাজা এখন তার বেয়াই। ভয়টা কিসের? সারা রাজ্যে তার মত কেউকেটা আর কেউ আছে না কি এখন?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments