জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব- ৫৭ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব- ৫৭

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও মুক্তচিন্তা


প্রাচীন ভারতে যেমন ধর্মগুরু ও রাষ্ট্রশক্তির যৌথ উদ্যোগে, অর্থাৎ রাজন্য শ্রেণি ও পুরোহিত শ্রেণীর পারস্পরিক সমঝোতায় বেদবিরোধী 'পাষণ্ডদের' দমন করা হয়েছিলো, মধ্যযুগের ইউরোপে তেমনি রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং রাজতন্ত্রের যৌথ উদ্যোগে খ্রিস্ট ধর্মের প্রতিকূল সব রকম মতবাদকেই ধ্বংস করা হয়েছিলো। যদিও গির্জাতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের যৌথ শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ সময়ে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মীয় সম্প্রদায়ই সোচ্চার এবং সক্রিয় হয়েছিলো, তথাপি এই আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্য ছিলো অ্যালবিজেনসীয়রা (Albigensian) যারা জোরোয়াস্ট্রিয় ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো। ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ ল্যাটেরান কাউন্সিল (Lateran Council) এই ডিক্রি জারি করে যে খ্রিস্ট ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য সব ধর্মদ্রোহীকে হত্যা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। এই উদ্যোগকে আরো জোরদার করবার উদ্দেশ্যে ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দে সৃষ্টি হয় সেই ইনকুইজিশান (Inquisition) ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে অসংখ্য ধর্মদ্রোহীকে জীবন্ত দগ্ধ করে অথবা শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। মধ্যযুগীয় খ্রিস্ট ধর্মের তাত্ত্বিক দিকপাল সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস (১২২৫-১২৭৮) ইনকুইজিশনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে 'খাঁটি ধর্মবিশ্বাস' বাঁচিয়ে রাখবার জন্য ধর্মদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেন, এবং রাষ্ট্রশক্তির উপর এই বিধান বলবৎ করবার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৪৭৮ সাল থেকে আবার স্পেনে আরেকটি ইনকুইজিশন চালু হয় যার নিয়ন্ত্রণ ছিল সরাসরি রাষ্ট্রশক্তির হাতে। অগণিত মুক্ত চিন্তক, অবাধ্য কিংবা বিদ্রোহী মানুষকে এভাবে ধর্মদ্রোহীতার নামে মধ্যযুগীয় ইউরোপে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছে অথবা ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই নৃশংস শারীরিক নির্যাতনের পরে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগীয় খ্রিস্ট ধর্মের মত অন্য কোন ধর্মে মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে এতো বড়ো নৃশংস এবং বর্বরচিত আক্রমণ কখনো সংঘটিত হয় নি। কিন্তু আমরা এখানে প্রধানত ইনকুইজিশনের ভিতরে ও বাইরে কয়েকজন খ্যাতনামা মুক্তচিন্তক মানুষের ধর্মের নামে নির্যাতন নিয়ে কিছুটা আলোচনা করবো। 

মধ্যযুগীয় ইউরোপে রাষ্ট্র যেসব মুক্তচিন্তক এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে ধর্মের নামে নির্যাতন করেছে তাদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য রজার বেকন (১২১৮-১২৯৪)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক, এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, এবং গবেষণাগারে অনেক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চা করতেন। তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেকনের এই বৈজ্ঞানিক তৎপরতাকে ধর্মবিরোধী জ্ঞান করেন। ফলে একটি গির্জার কারাগারে তাকে অনেক বৎসর বন্দী থাকতে হয়েছিলো। অন্য ধরনের আরেকটি নির্যাতিত এবং নিহত অসাধারণ ব্যক্তিত্বের নাম জোয়ান অফ আর্ক (১৪১২-১৪৩১)। আর শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সময়ে তিনি ইংল্যান্ডের আগ্রাসনে পরাজিত ফরাসি যুবরাজকে সাহায্য করবার উদ্দেশ্যে পুরুষের পোশাক পরে অস্ত্রধারণ এবং সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন। তার মনে হয়েছিলো যে এ কাজে পরলোক থেকে সেন্ট মাইকেল টাকে অনুপ্রাণিত করছেন। অনেকগুলো যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজিত করবার পর তিনি নিজে পাশে দাঁড়িয়ে ফরাসি যুবরাজকে রাজপথে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু পরে একটি যুদ্ধে ইংল্যান্ডের মিত্ররাজ্য বুরগান্ডির কাছে পরাজিত ও বন্দী হন। বুরগান্ডি তাকে ইংল্যান্ডের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারপর তাকে যুদ্ধবন্দী রূপে গণ্য না করে একটি ধর্ম আদালতের মিথ্যা বিচারে ধর্মদ্রোহী এবং ডাইনি বলে ঘোষণা করে পুড়িয়ে মারা হয়, মাত্র আঠারো-উনিশ বৎসর বয়সে। 

পরবর্তী উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ইতালির জিওলারমো সাভানারোলা (১৪৫২-১৪৯৮)। তখন ইউরোপে বৌদ্ধিক নবজাগরণ বা রেনেসাঁস আরম্ভ হয়ে গেছে, কিন্তু তথাপি ধর্মের নামে মুক্তচিন্তার কণ্ঠরোধ শেষ হয়নি। সাভানারোলা নিজে ডোমিনেকানপন্থী ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তিনি ক্রমশ পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের কোর্টে যৌন ব্যাভিচার সহ অসংখ্য দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারের তীব্র সমালোচক হয়ে দাঁড়ান। ফলে ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে পোপ তাকে ধর্মচ্যুত করেন। তারপর সরকারি আমলারা তাকে গ্রেফতার করে তার উপর শারীরিক নির্যাতন চালায়, এবং শেষ পর্যন্ত তাকে ফাঁসি দেয়। এ ভাবেই সার্বভৌম জাগতিক ও ধর্মীয় অধিশ্বর পোপের সমালোচনার জন্য রাজন্য শ্রেণী ও পুরোহিত শ্রেণীর যৌথ উদ্যোগে ধর্মাসুরদের এক নির্ভিক সমালোচককে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগে হত্যা করা হয়। 
বৌদ্ধিক নবজাগরণের ফলশ্রুতি রূপে মুক্তচিন্তা এবং বিজ্ঞানমনস্কতার যুগ আরম্ভ হবার পর থেকে ইউরোপে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে। এই সংঘাতের প্রথম বলি ইতালীয় দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক জিওরদানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০)। জন্মসূত্রে ডোমিনিকানপন্থী রোমান ক্যাথোলি হলেও ব্রুনো ছিলেন ধর্মান্ধতা বিরোধী। তার দার্শনিক মত এই ছিলো যে প্রত্যেক মানুষই নিজ নিজ অবস্থান অনুযায়ী পৃথিবীকে দেখে। জ্ঞান অন্তহীন, এবং চূড়ান্ত সত্য হলে কিছুই নেই।

 খ্রিস্ট ধর্মের ঈশ্বরতত্ত্ব এবং সৃষ্টিতত্ত্বের বিরোধিতা করে চার্বাকের মতো ব্রুনোও বলেন যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বস্তুকণা (monad) সমূহের সমাহারে প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবী এবং জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের 'ধর্মবিরোধী' স্বাধীন মতবাদ প্রচারের ফলে পোপের নির্দেশে এবং সরকারি আদেশে ভেনিস শহরে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। কিন্তু পরবর্তী কালের দর্শন ও বিজ্ঞান চিন্তার উপরে, বিশেষত স্পিনোজা এবং লাইবনিৎসের চিন্তাধারায় ব্রুনোর গভীর প্রভাব পড়েছিলো।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments