জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব-৫৯ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম- পর্ব-৫৯

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও মুক্তচিন্তা

বলা বাহুল্য স্পিনোজার এই মু্ক্তচিন্তা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বাইবেলের মূলে কুঠারাঘাত করে খ্রিষ্ট ধর্ম ও ইহুদি ধর্ম উভয়েরই উদ্বেগের কারণ হয়েছিলো। বাইবেলের ঐতিহাসিকতা অস্বীকার করা ছাড়াও ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মের অনেকগুলো কমন বিশ্বাসের উপরেই স্পিনোজা আঘাত করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল স্রষ্টা ঈশ্বরের তত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, আদি-পাপ সহ পাপ-পুণ্যের তত্ত্ব, ঈশ্বরের করুনার তত্ত্ব প্রার্থনার তত্ত্ব মেসাইয়া বা উদ্ধারকর্তা  অবতারতত্ত্ব। সেকারণে একবার 1656 সালে এবং আর একবার তার মৃত্যুর এক বছর পরে স্পিনোজা কে ইহুদিধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু আগেকার মুক্তচিন্তকরা যে শাস্তি পেয়েছিলো, এটা তার থেকে অনেক লঘু শাস্তি বলে মনে করা হয়। 

  সম্ভবত তার সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, প্রায় নিঃসঙ্গ এবং উদাসীন জীবনই তাকে আরও গুরুতর নির্যাতন থেকে রক্ষা করেছিলো। অনেকে অনুমান করেন যে সম্ভাব্য নির্যাতনের ভয়ে তিনি ইহুদি ধর্মের পরিচয় বহনকারী পিতৃদত্ত নাম বারুখ পরিত্যাগ করে খ্রিস্টীয় নাম বেনেডিকট ব্যবহার করতেন। সহজে ছাড়া পাবার আরেকটি কারণ ছিল যে তার জীবদ্দশায় তার মূল রচনাগুলোর কোনোটিই প্রকাশিত হয়নি, এবং তার মুক্তচিন্তার স্বরূপ আমস্টারডামের বাইরে খুব বেশি পরিচিত ছিল না। তাছাড়া ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির পরে ইউরোপে ধর্ম সম্বন্ধে সহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরি হতে আরম্ভ করেছিলো।

আরো অনেক বৈজ্ঞানিক এবং মুক্তচিন্তককই  পরবর্তীকালে ধর্ম ও রাষ্ট্রের শিকার হতে হয়েছিলো। এদের মধ্যে যে বৈজ্ঞানিক সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন চার্লস ডারউইন (১৮০৯- ১৮৮২), যিনি ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তার origin of species  নামক গ্রন্থে বিবর্তনবাদের উপস্থাপনা করেন। মানুষ ছ'হাজার বা তার আগে এক দিনের একবেলায় ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্টি হয়নি, লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে শেষ পর্যন্ত বানর জাতীয় প্রাণী থেকে ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছে, ডারউইনের এই তত্ত্ব ছিল খ্রিষ্টধর্মের সৃষ্টিতত্ত্বের পুরোপুরি বিরোধী। অতএব ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট নির্বিশেষে সমস্ত ধর্মীয় নেতারা, এবং কার্লাইল গ্লাডস্টোন প্রভৃতি রক্ষণশীল রাষ্ট্রচিন্তক, এরা ডারউইনের তত্ত্বকে ঈশ্বর ও ধর্ম' বিরোধী বলে ঘোষণা করলেন। সৌভাগ্যবশত ততদিনে রেনেসাঁস রিফর্মেশন এবং শিল্পবিপ্লব ঘটে গেছে।

 রাজনীতিতে তথাকথিত উদারনৈতিক যুগের সূচনা হয়েছে আর বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।  তাই ব্রুনো ও গ্যালিলিওর পরিণতি থেকে ডারউইন অব্যাহতি পেলেন। কিন্তু খ্রিস্টধর্মের অভ্যন্তরে ডারউইন তত্ত্বের বিরোধিতা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলো। সম্ভবত আজও তার রেশ আছে। 
বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ও মননশীল মুক্তচিন্তকদের স্তব্ধ করে দেয়া ছাড়াও মধ্যযুগ থেকে বিংশ শতাব্দি পর্যন্ত ধর্ম নানাভাবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার অগ্রগতিকে প্রতিহত করেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রোগের কারণ হিসেবে 'ভুতে পাওয়া' বাখ্যার ধর্মীয় সমর্থন ( বাইবেলে যীশু খ্রীষ্ট দ্বারা ভূত তাড়ানোর কাহিনী আছে)। শব ব্যবচ্ছেদের এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিরোধিতা আর ডাইনিবাদ ডাইনি হত্যায় ধর্মীয় সমর্থন। বিশেষত ডাইনিবাদ ডাইনি নিধনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নারীর পারিবারিক ও আর্থসামাজিক হীনমন্যতা। আধুনিক সমাজ বৈজ্ঞানিক গবেষণার তর্কাতীত এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রহিনী স্বাধীনচেতা নারীদেরই সাধারণত ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হতো। ধর্মান্ধতার এই তান্ডবনৃত্যের ফল হয়েছিল এই যে, প্রাচীন গ্রিস ও রোমে হিপোক্রেটিস এবং গ্যালেনর অবদানে চিকিৎসাবিদ্যার যে উন্নতি হয়েছিলো, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আগে ইউরোপ আবার সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments