জ্বলদর্চি

বিমল কর, ‘বসন্ত বিলাপ’ ও মেদিনীপুর/ অর্ণব মিত্র

বিমল কর, ‘বসন্ত বিলাপ’ ও মেদিনীপুর  

অর্ণব মিত্র 

 
‘খড়গপুরে গেছিলাম,পিসিমা খুব অসুস্থ’। 
কথাটি বলেছিলেন নবনিতা।কিন্তু কথাটি ছিল মিথ্যা। আর কথাটি ছিল ‘বসন্ত বিলাপ’ সিনেমার একটি দৃশ্যে। 
‘বসন্ত বিলাপ’হল একটি মেয়েদের মেসের নাম ও একই সাথে কথাসাহিত্যিক বিমল কর লিখিত একটি গল্প ও সত্তরের দশকের একটি সিনেমার নাম।সিনেমাতে এই মিথ্যা কথাটি যিনি বলেছিলেন সেই নবনিতার ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুমিত্রা মুখাজী।তিনি ‘বসন্ত বিলাপ’-এর কাউকে না জানিয়ে সেই পাড়ার ছেলে ‘ললিত’ বা লালুর সাথে সন্ধ্যেবেলা গেছিলেন মেদিনীপুরের সিনেমাহল ‘মহুয়া’তে সিনেমা দেখতে। এই ব্যাপারটি ঘটবে সন্দেহ করেছিল ‘বসন্ত বিলাপ’-মেয়েদের মেসের নেত্রী অনুরাধা ও অন্যান্য মেয়েরা।সিনেমায় অনুরাধা-র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অপর্ণা সেন।সিনেমায় দেখা যায় মেসের নেত্রী অনুরাধা ও আরও কয়েকজন ‘মহুয়া’ সিনেমাহলের কাছে গিয়ে লুকিয়ে লক্ষ্য করে নবনিতা ললিত এর সাথে ‘ইভিনিং-শো’ দেখতে এসেছে।নবনিতা যখন মেসে ফিরে আসে অনুরাধা ও বাকি মেয়েরা জিজ্ঞ্যেস করে ‘কোথায় গেছিলি’। উত্তরে ললিতের সাথে সিনেমা দেখার ব্যেপারটি লুকানোর জন্য নবনিতা এই প্রবন্ধে লিখিত প্রথম বাক্যটি বলে ।এরপর অনুরাধারা খড়গপুরে তার পিসিবাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞ্যেস করাতে নবনিতা এমনকি এও বলেওঠেন- তার পিসিবাড়ির ঠিকানা হল ‘১৭ নম্বর পুরাতন বাজার’।  

বিমল করের জন্ম হয় ১৯২১ সালে উত্তর চব্বিশ পরগণায়। বাবার চাকরির সুত্রে তার ছেলেবেলা ও কিশোর বয়সের অনেকটা সময় কেটেছে
পশ্চিমের ধানবাদ,হাজারিবাগ ও আসানসোলে।এরপর স্নাতকস্তরের পড়াশুনা হয়েছে কোলকাতাতেই ও চাকরিজীবনও সেখানেই।তিনি কোনদিন মেদিনীপুরে এসেছিলেন বলে শোনা যায়নি।ও গল্পটিও মেদিনিপুরের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়নি।

একটি মেয়েদের হোস্টেল-এ চারজন চাকরি করা মেয়ের সাথে ওই পাড়ার আশেপাশের চারটি ছেলের আলাপ করার ইচ্ছা,প্রেম,ঝগড়া ও তাদের রসিকতা ভরা কাণ্ড-কারখানা নিয়ে বিমল কর লিখেছিলেন এই গল্প ও সেই গল্প থেকে সত্তরের দশকে বানান হয়েছিল এই ছবি।  ছবিতে মূল চারটি ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সদ্যপ্রয়াত সৌমিত্র চট‍্যোপাধ্যায়। তিনি হয়েছিলেন ছেলেদের নেতা ‘শ্যাম’। ‘দত্তগুপ্ত’-র চরিত্রে ছিলেন রবি ঘোষ।অনুপ কুমার অভিনয় করেছিলেন ‘ললিত’–এর চরিত্রে,ও ‘সিধু’- র ভুমিকায় ছিলেন চিন্ময় রায় ।
লেখক বিমল কর–এর ছোটোগল্প ‘বসন্ত বিলাপ’ থেকে এই ছবি করেছিলেন সেই সময়ের বাংলা মূলধারার সিনেমার বিখ্যাত পরিচালক দীনেন গুপ্ত। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শেখর চট‍্যোপাধ্যায়।সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৭৩ সালে। এ ছবির বেশ কিছুটা বাইরের দৃশ্যগ্রহণ হয়েছিলো মেদিনীপুরে। 


শুরুতে একটি ঘটনার কথা লেখক এনেছেন যা ঘটছে একটি রেলস্টেশন–এর কাছে। কিন্তু বিমল কর স্টেশনটির নাম লেখেননি। তিনি লিখছেন ‘ শ্যামের বেলায়ও ব্যাপারটা সেই রকম ঘটেছিল। রেল স্টেশনের বাইরে সিঁড়ির কাছে শ্যাম দাড়িয়ে ছিল।শাটল ট্রেনের যাত্রীরা সকলেই চলে গেছে একরকম ।’ বা তিনি শ্যাম -এর বন্ধু ললিত- এর বাড়ির গলির যে বর্ণনা দিয়েছেন তা পড়ে মনে হয় কলকাতার বা শহরতলির কোন জায়গা । ‘মেদিনীপুর’ বলে মনে হয়না। তিনি লিখেছেন ‘ললিতদের বাড়ির রাস্তাটা আজ তিন –চার দিন ধরে অন্ধকার হয়ে আছে।মিউনিসিপ্যালিটি–র আলো ; জল ঝড় বৃষ্টিতে কোথায় কি গণ্ডগোল হওয়ায় তা আর এখনও সারানো হয়ে উঠলো না। বেশ খানিকটা অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই শ্যাম টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছিল’।


বিমল কর–এর লেখা মূল গল্পে আছে একবার মেয়েদের দল শ্যাম কে বসন্তবিলাপ -এ ধরে নিয়ে এসে জেরা করে। মেয়েদের নেত্রী অনুরাধা শ্যামকে জিগ্যেস করে‘পলাশ পাড়ার দিকে থাকা হয়’। তাতে শ্যামের উত্তর ছিল ‘হ্যাঁ’। কিন্তু এই ‘পলাশ পাড়া’ মেদিনীপুরে বা কলকাতার কাছে কোন জায়গায় কিনা গল্প পড়ে তা জানা যায়না। এছাড়া মেয়েদের দল শ্যাম –এর কাছ থেকে জানতে চায় কলকাতার কাগজে পাত্র চেয়ে যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে সেই দুষ্কর্মটি শ্যামের করা কিনা। তা সমন্ধে লেখক লিখছেন ‘তার অবশ্য মনে মনে এরকম একটা সন্দেহ হচ্ছিল । কিন্তু ব্যপারটা এত গোপনে করা হয়েছে যে বসন্তবিলাপের মেয়েদের জানার কথা নয় । কোথায় কলকাতার কাগজে টাকা পাঠিয়ে বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যবস্থা করা আর কোথায় এরা?’। এখানে বোঝা যায় বসন্তবিলাপ যে পাড়ায় অবস্থিত সেটি কলকাতার মত বড় শহর থেকে দূরে হলেও কলকাতা থেকে প্রায় একশো-কুড়ি কিলোমিটার দুরে মেদিনিপুরের মতো কোন আধো-শহর আধো গ্রামে হতে পারেনা । অনুরাধা শ্যামকে অভিযোগের সমর্থনে বলে ‘ আমরা কলকাতার কাগজের অফিস থেকে খোজ নিয়ে জেনেছি,এখান থেকে মানি-অর্ডার টাকা পাঠানো হয়েছে।শ্যামের নামে।’ 

সিনেমায় আছে সিধুর কাকিমা তাকে মহুয়া সিনেমাহল থেকে ম্যটিনি–শো এর টিকেট কেটে আনতে বলে।এই ‘মহুয়া সিনেমাহল’ টি অবশ্য মেদিনীপরে ছিল আগে। তবে এখন আর নেই । বিমল করের লেখা মূল গল্পে এই ‘সিনেমাহল থেকে টিকেট কেটে আনা’-র অংশটি নেই। বোঝা যায় চিত্রনাট্যকার শেখর চট‍্যোপাধ্যায় এই অংশটি আলাদা করে জুড়েছেন । 

‘বসন্তবিলাপ’এর শুটিং হয়েছিল মেদিনীপুরের নানা জায়গায়। ছবিতে দেখা গিয়েছে স্টেশন রোড, সেখপুরা চার্চ– এর সামনের রাস্তা, ও চিন্ময় রায় বা ‘সিধু’-র বিখ্যাত পুকুরে ঝাপ দেওয়ার দৃশ্যটি তোলা হয়েছিল কোতবাজারের কাছে সাহাদের বাড়ির পুকুরে।
ছবিতে কয়েকবার দেখানো হয় মেয়েদের মেস ‘বসন্তবিলাপে’-এর সাইনবোর্ড ও তাতে ঠিকানা লেখা আছে ‘৩নম্বর রথতলা রোড’। এই ‘রথতলা’ টি  মেদিনীপুরের–ই একটি জায়গা । ছবির শেষে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর অপেক্ষারত শ্যামের সাথে আনুরাধার দেখা হওয়ার দৃশ্যটিও মেদিনীপুর স্টেশন–এ তোলা । 

আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বরুণ দে-র লেখা থেকে জানা যায় ১৯৭২ সালে মেদিনীপুরে শুটিং করতে এসে ইচ্ছে থাকলেও পরিচালক–এর পক্ষে আউটডোর শুটিং করা সম্ভব হয়নি।পরে আউটডোর লোকেশন–এর অনুকরণে সেট তৈরি হয়েছিল কলকাতার ইন্দ্রপূরী স্টুডিয়োতে।
তবে সিনেমাটির চিত্রনাট্য লেখক বিমল কর–এর লেখা মূলগল্পটিকে মেদিনীপুরের শহরের মত করে এমনভাবে সাজিয়েছিলেন ও তাতে যেহেতু খড়গপুরের অংশটিও জুড়েছিলেন তাতে প্রশ্ন জাগে চিত্রনাট্যকার শেখর চট‍্যোপাধ্যায় কি মেদিনীপুর বা খড়গপুরের বাসিন্দা ছিলেন!। 


তথ্যসূত্র - আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বরুণ দে-র প্রবন্ধ। 
বিমল কর এর ‘সরস গল্প’।  
ইন্টারনেট।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments