জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ৯৪

 ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ৯৪

সম্পাদকীয়,
করোনার জন্য ছুটির পর গ্রীষ্মের ছুটি, তারপর তো স্কুল খুলে গেছে।  আর স্কুল মানেই হল পড়া আর খেলা দুই। সেদিন রাজদীপ হাসতে হাসতে এসে ওর স্যারকে দেখালো রাজদীপের বন্ধু তাকে কিভাবে চকের গুড়ো মাখিয়েছে গোটা মুখে। সেই দেখে স্যারও খুব হাসতে লাগলেন আর আমি রাজদীপের সেই ছবি দেখে নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের উয়ারে বেড়ানো দেখছিলাম। কি তোমরা কি দেখছো? জানিও কিন্তু। সোমরাজ জানিয়েছে সে পড়ার ঘরের জানলায় বসে কি কি দেখে। তোমরাও জানিও। অন্যদিকে রূপা আন্টি আবার সাদা নয় কালো মেঘের ছড়া বলেছে। স্বপ্ননীল, মেঘের বুকে গণেশের মুখ এঁকে পাঠিয়েছে। মেঘের কথা শুনে মেঘের মতো ভেসে ভেসে বেড়াতে মন চাইছে তো? জয়দীপ আঙ্কেল তাইতো বহরমপুর যাবার গল্প বলেছেন। আর মলয় জেঠু যেখানে বেড়াতে গেছেন সেখানে আবার মুজেরা থাকে। মুজ কি? বলব না। জানতে পড়তে হবে হিমবাহের ঘাড়ের উপর। যাক অনেক বেড়ানোর গল্প হলেও এটা তো ঠিক পুজো এসে গেল। পুজো মানেই উমা তার মা বাবার কাছে ফিরবে। এদিকে জয়াবতীরাও পুজোয় বাড়ি ফিরবে। কিন্তু পেরজাপতি? উমাশশী? তারা? তারাও কি বাড়ি ফিরবে? এসব নানা প্রশ্ন নিয়ে এবার হাজির তৃষ্ণা আন্টির ধারাবাহিক উপন্যাস জয়াবতীর জয়যাত্রা। এত সবের মধ্যেও পীযূষ আঙ্কেল আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মহাশ্বেতা দেবীর মতো মহান লেখককে। আর সৌনকশৌর্য এঁকেছে ব্যস্ত রাস্তার ছবি। সুদীপ্তাদি শুধু যে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছে তাই নয়, জয়াবতীর জন্য প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছে। এত সবের মধ্যেও মনে করিয়ে দিই, মাত্র আর কয়েকটা সপ্তাহ পরেই কিন্তু ছোটোবেলা ১০০, কি খুশির খবর।  তাই না? --- মৌসুমী ঘোষ।

ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর  জয়যাত্রা
 ষষ্ঠবিংশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক


তিরিশ
যাবে তো বটে, কিন্তু কে কে যাবে? দেখা গেল  জয়াবতী আর পুন্যির সঙ্গে পেরজাপতি আর উমাশশী তো বটেই, এমনকি পানু অব্দি যাবে  বলে কোমর বেঁধেছে।তাই শুনে খুড়িমার মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি বলে উঠলেন
‘কী যে বলিস তার ঠিক নেই। পুজোর সময় ঘরের ছেলে নাকি পরের বাড়ি গিয়ে থাকবে?’
পানু অমনি লাফিয়ে উঠে বলল ‘বাঃ, তা ঘরের মেয়েরা যে চলে যাচ্ছে, সে বুজি কিছু না? যত নিষেধ আমার বেলা!’
‘আরে পাগল ছেলে, ওরা তো যাচ্ছে ওদের নিজেদের বাড়ি, নিজেদের বাবা মার কাছে। তুই থাকবি তোর বাড়ি, তোর বাবা মার কাছে। দেখনা, মা দুগগাও বছরের চারটে দিন বাপের বাড়ি আসেন থাকতে’
‘বললেই হবে! তাহলে পেরজাপতি আর উমাশশীও নিজেদের বাড়ি যাক’ বলে ফেলেই জিভ কাটল কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। নিজেদের বাড়ি ফেরার কথা শুনেই পেরজাপতি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে লেগেছে, আর উমাশশী, শক্ত ধাতের মেয়ে, তার অব্দি চোখ ছলছল করে উঠেছে। পুণ্যি অমন ভীতু মেয়ে, সেও পানুর দিকে কটমট করে তাকাল। জয়াবতী অন্য সময় হলে পানুকে দুঘা বসিয়ে দিত, কিন্তু সে আজ ভারি অন্যমনস্ক। তার জায়গায় ঠাকুমা পানুর পিঠে এক ঘা বসিয়ে বললেন ‘দিলি তো মেয়ে দুটোকে কাঁদিয়ে। শোন তবে, পেরজাপতি আর উমাশশীর এইটাই বাপের বাড়ি আর মায়ের বাড়ি। 

ঠাকুমার বাড়ি। মোট কথা এটাই ওদের নিজেদের বাড়ি। ওরা পুণ্যিদের সঙ্গে বোলসিদ্ধি গিয়ে কদিন বেড়িয়ে চেড়িয়ে আসতে পারে, আবার এখানেও থাকতে পারে। সেটা ওরা ঠিক করবে। আর সবাই চলে গেলে বাড়ি তো ফাঁকা হয়ে যাবে। তোর বাপ মা আমি কী করে থাকব এই কটা দিন? আমি বলি কি, ওরা যখন ফিরবে, তখন তুই আনতে যাস। দুদিন বেড়িয়ে ফিরিস’
ব্যস হয়ে গেল। ঠাকুমার কথার ওপর আর কারো কথা চলবে না কারো। ঠিক হয়ে গেল চারটে মেয়েই যাবে। জয়াবতী আর উমাশশী যাবে ঘোড়ার পিঠে আর পুন্যি আর পেরজাপতি পালকিতে। ঠাকমা এও বলে দিলেন জয়াবতী কিন্তু ঘোড়া ছোটাতে পারবে না জোরে, তাহলে মধুদাদা হেঁটে তাল রাখতে পারবে না। জয়াবতী এ কথাতেও রেগে উঠে বলল না ‘ঘোড়া যদি নাই ছোটাতে পারি, তবে অমন ঘোড়ায় চড়ে কাজ নেই কো’। মেয়েটার হল কী?
ঠাকমা ঝুড়ি ভর্তি ক্ষীরের ছাঁচ আর নাড়ু দিলেন বাড়ির জন্যে আর সবার জন্যে নতুন কাপড়।এত কাপড় কবে যে ঠাকমা বুনিয়ে রেখেছিলেন কে জানে। একবার ঠাকমার ভাই তার নাতনি দেখাতে এনেছিল, ছোট এইটুকু মেয়ে, এক বছরও হয়নি বয়েস, দিব্যি গুড়ের নাগরির মতো গোলগাল চেহারা, টুকটুকে রঙ, ঠাকমা তার মাথায় একটা সোনার টিকলি আর গলায় একটা লম্বা হার পরিয়ে তাকে নাচাতে নাচাতে ছড়া কাটছিল-
‘ধেই নেচেছে রাঙা পায়
ঘাগরা কিনে দেয় না মায়
আসুক তাঁতি বুনুক সুতো
ঘাগরা কিনে দেব রে পুতো’

জয়াবতীর চোখে পুণ্যির চেয়ে বড় পণ্ডিত আর কেউ নেই। সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিল ‘এই পুণ্যি, ঘাগরা কী জিনিস রে? জন্মে নাম শুনিনি তো?’
পুণ্যি গম্ভীর মুখ করে বলেছিল ‘ঘাগরা হচ্ছে মেয়েরা পরে, মুসলমানদের মেয়েরাও পরে, আবার ওই যে সেনমশাই বললেন না, পাঞ্জাব প্রদেশ, ওখানকার মেয়েরাও পরে’
‘পাজামার মতো?’
‘দূর ওরকম না, গোল মতো, যখন নাচে গোল হয়ে ঘুরতে থাকে ওই ঘাগরা’
চোখ গোলগোল হয়ে গেল জয়াবতীর। ঘাগরার কথা পুণ্যি কোন পুথিতে পড়েছে কে জানে, কিন্তু নাচের সময় কেমন লাগে, তা তো পুথি পড়া জ্ঞান বলে মনে হচ্ছে না।নিজের চোখে না দেখলে কখনো এমন বলা যায় না।
সে চেপে ধরেছিল পুণ্যিকে। ‘তুই কোত্থেকে দেখলি ঘাগরা পরে নাচ? বল শিগগির’
এই প্রশ্নে পুণ্যি একটু লাল হয়ে গেল প্রথমে। তারপর অনেক চেপে ধরার পর বলল ‘বের পর আমি মুকসুদাবাদে থাকতাম কিনা, একদিন শ্বশুরঠাকুর ওনাকে বলেন শহরটা ঘুরিয়ে দেকাতে। অনেক প্যায়দা সান্ত্রি গেছিল সঙ্গে, উনিও ছিলেন, একজায়গায় কেমন মেলা মতন হচ্ছিল, শীতের সন্ধে, দেখেছিলাম আগুন জ্বালিয়ে একদিকে মেয়েরা নাচছে। তাদের কেমন সব গয়না, সোনা দানা না, পাথরের, আর অদ্ভুত পোশাক, ওই যে রাধা কী পরত না, কাঁচুলি, আর পেটের খানিকটা বাদ দিয়ে, নিচ থেকে ঘাগরা। কী অপূর্ব লাগছিল রে গঙ্গাজল, মেয়েদের নাচ, তোকে কী বলব! আর উনি কী বলছিলেন জানিস? বলেছিলেন, আমাদের দেশেও, পুণ্য, জানো তো মেয়েরা নাচত’
আমি তো অবাক। বললাম ‘মেয়েরা নাচে? বাংলার ঘরের মেয়েরা? তাই আবার হয় নাকি? লোকে কী বলবে?
‘দূর দূর, লোকের কথা ধরতে আছে? ঘরে না খেয়ে মরে থাকলে কি লোকে দেখতে আসে? শোনো তবে, বেউলা সুন্দরী তো বাংলার ঘরেরই মেয়ে? সে যে সগগে গিয়ে মরা সোয়ামী লখিন্দরকে জিইয়ে তুলল , সে তো নাচ দেখিয়েই। শোনো পুণ্য, আমি তোমাকে অনেক পড়ালেখা শেখাতে চাই, আর নাচও করবে তুমি।
আমি কী ভাবলুম বলতো? কার হাতে এসে পড়লুম! হে ভগমান! নিজের ইস্তিরিকে বলে নাচতে! নির্ঘাত পাগল!
আমাকে অবাক করে বলল পাগল ভাবছ তো? মোটেই না। আমাদের দেশে মেয়েরা যুদ্ধ করত, লাঠি চালাত। এরকম জবুথবু ছিল না মোটেই। সব ছেড়ে দিয়েই তো পরের হাতে মার খাচ্ছি আমরা।তুমি নাচবে, নাচলে শরীর সুস্থ থাকে’
বলেই একটা ফোঁস করে দীর্ঘশবাস ফেলেছিল পুণ্যি।
আর এই প্রথম মরা সোয়ামীর জন্যে ওর দুঃখ দেখে গা জ্বলে যায়নি জয়াবতীর। তারও ভেতরটা কেমন কেমন করে  উঠেছিল। এত বড় মন ছিল ছেলেটার, এত ভাবত মেয়েদের জন্যে- সেই ছেলেটাকেই কাছে টেনে নিতে হয়? ভগবানের বিচার নেই।
পুণ্যির তারপর চোখের জল মুছে বলেছিল ‘সে এই ছড়াটাও জানত। বলেছিল, আসলে আমাদের কাপড়ের অভাবের কথাই বলা আছে এই ছড়ায়।দুদিন পরে নাকি আরো অভাবের দিন আসছে। ভাত কাপড় কিছুই থাকবে না। লালমুখো সাহেবরা সব নিয়ে নেবে’
ঠাকমা যখন ওদের সবাইকে পুজোর জন্য নতুন কাপড় দিচ্ছিলেন, তখন জয়াবতীর মনে হল শাড়ির বদলে যদি ঘাগরা দিত, তবে ঘাগরা পরা জয়াবতীকে দেখে মা কী চমকেই না উঠত। এতদিন এসেছে, মার জন্যে তেমন কিছু মন কেমন করেনি তার, বরং পুণ্যি যখন বাড়ির জন্যে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদেছে, ধমক লাগিয়েছে ওকে ছিঁচকাঁদুনিপনার জন্যে। সেই জয়াবতীই ভেতরে ভেতরে কী অস্থির হয়ে উঠেছে মধুদাদাকে দেখে। তার আর রাতটুকু থাকারও তর সইছে না। মনে হচ্ছে ছুটে চলে যায়, গিয়ে মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভাইকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয়। বাবার পিঠ ঘেঁষে দেখে তিনি নতুন কী পুথি পড়ছেন। এখন আর জয়াবতী আগের মতো মুখ্যু নয়, বাবার পুথি সে তো  গড়গড় করে পড়তে পারবেই, উপরন্তু চিকিৎসাবিদ্যার অনেক কথাই সে পিতাঠাকুরকে শেখাতে পারে। অংকার নয়, এটা সত্যই নির্যস।

ভেতরে ভেতরে অস্থির হলেও বাইরে তা প্রকাশ করল না জয়াবতী। সে টললে তার সৈন্যদলও টলে যাবে।যাওয়া তো মুখের কথা নয়। তার আগে নতুন মেয়েদুটিকে তাদের পরিবার আর গাঁ সম্পর্কে জানানো দরকার। সে গম্ভীর মুখে পুণ্যিকে বলল ‘সবাইকে খবর দে। আজ রাতে বিশেষ সভা ডেকেছি আমি। হাঁ করে দেখছিস কী? এই যে  চারটিতে যাব, তার আগে কিছু শলা দরকার, বুঝলি? আর পানু শোন, যা কতা কইব, সব একটা পাতড়িতে লিকে রাকবি বুজলি’।


উদ্ভট মা
জয়দীপ লাহিড়ি


সেবার বহরমপুর যাচ্ছি কোন একটা সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। মাঝে রাস্তা না চেনার জন্য বাধ্য হই জি পি এস এর সাহায্য নিতে। এই জি পি এস ভদ্রলোক অদ্ভুত, মানে যেকোন ভাবে আপনাকে বাধ্য করবে শর্ট রাস্তা নিতে। যাই হোক হাই স্কুল মোড় বলে একটি জায়গা থেকে নিলাম ডান দিক। তখন বেশ সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে, মোবাইলে জি পি এস বাবু দেখাচ্ছেন মাত্র ২০ কিলোমিটার কিন্তু পৌঁছানোর সময় দেখাচ্ছেন প্রায় পঞ্চাশ মিনিট। খানিক অবাক হলাম, কিন্তু ভাবলাম বোধহয় কোন ভুলভাল স্পিডে ধরে নিয়েছে। 
ও বাবা, এক কিলোমিটার যেতেই রাস্তা সরু হয়ে এল, প্রায় লোকের বাড়ির মাঝ দিয়ে একটি পিচ ওঠা এবং বাম্পার সর্বস্ব রাস্তা। গাড়ি প্রায় দশ কিলোমিটারের বেশি স্পিডে যাওয়া অসম্ভব। এই নিদারুণ অবস্থায় কিলোমিটার পাঁচেক গেছি, বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে বললাম, " নিকুচি করেছে, হয় তুই এখানে গাড়ি সাইড কর নয় পুরো স্পিডে চালা! " " দাদা কিছু করতে হবে না সামনে দেখুন..." । সামনে তাকাতেই দেখি রাস্তা জুড়ে ভিড় আর পুজোর কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ। গাড়ি তো দূরে একটা সাইকেল গলার জায়গা নেই। একদিকে ভালো হল, নেমে একটু হাত পা খেলানো যাবে, আবার আরেকদিকে মনে হল এখন আবার কী পুজো? অবশ্য গ্রামের ব্যাপার। এদিকে আকাশে অনেক তারা, মানে বেশ রাত। যাই হোক এগিয়ে গেলাম দেখতে। সামনে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। একি ভীষন মূর্তি দেখি, কী ঠাকুর? এক ভয়ালদর্শনা মাতৃমূর্তি আর তার কোলে এক ফুটফুটে ঘুমন্ত শিশু, এবং সেটি এক মেয়ে। অবাক হয়ে পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম , " ইনি কিসের দেবী? "। উনি হেসে বললেন " দেবী নন আমাদের মা উদ্ভট !" আরও অবাক হলাম, " একটু খুলে বলবেন? " উনি হেসে বললেন, " আপনার হাতে সময় আছে? তাহলে ওই চায়ের দোকানে বসে কথা বলি? পুজো একটু পরেই শেষ হয়ে যাবে আবার বৃষ্টিও আসবে। " একটু অবাক হলাম, কারণ আকাশ ভর্তি তারা, বৃষ্টি আসার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। উনি বোধহয় আমার মুখ দেখে বুঝতে পারলেন, " বাবু, এই পুজোর দিন বৃষ্টি হবেই, সে যতই তারা থাকুক। " খানিকটা সম্মোহিতের মতই চায়ের দোকানে গেলাম ওনার সাথে। উনি শুরু করলেন ...

তখন আমার বয়স বছর চার পাঁচ হবে, এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ আসে এই গ্রামে। সে ভয়ঙ্কর বাজ আর তার সাথে বৃষ্টি। তিন দিন ধরে চলে, আমাদের প্রায় যাই যাই অবস্থা। আমাদের চারটে বাড়ি পরেই থাকত রুমি আর তার বাবা মা দাদু ঠাকুমা। ঝড় জল থামলে সবাই শুনতে পাই রুমিদের বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ। গিয়ে দেখি রুমির বাবা মা দুজনেই মৃত, শরীর ঝলসে গেছে। পরে জানা যায়, বাধ্য হয়ে দুজনেই ক্ষেতে গিয়েছিল, আর সেখানেই...
যাই হোক ছোট্ট রুমি সেরকম কিছু না বুঝলেও এটা বুঝেছিল যে ওর মা বাবা কোন দুর দেশে চলে গেছে। বেচারি দাদু আর ঠাকুরমার কাছে মানুষ হতে লাগল। খুব হাসি খুশি আর ফুটফুটে মেয়ে রুমি। সারাদিন খেলে, কিন্তু সন্ধ্যা হলেই রুমির মুখ ছোটো হয়ে যায়। ঠাকুমা দাদু কত মজার গল্প বলে কিন্তু রুমি কিছুতেই হাসে না। আগে ওই রাস্তার পেছন দিকে অনেক বড় জঙ্গল আর বাঁশবাগান ছিল। একদিন রুমি কাঁদতে কাঁদতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই বাঁশবাগানে চলে যায়। বেচারি রুমির দুটি সাধ ছিল”। 
এই বলে তিনি একটু দম নিলেন, আমিও অবাক হয়ে দেখলাম আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এল। সবাই হাত মাথায় তুলে জয় উদ্ভট মা বলে চিৎকার। অজান্তেই দেখি আমার হাত মাথায় কখন উঠে গেছে। বয়স্ক লোকটি মিটিমিটি হাসলেন, " বাবু বলেছিলাম না বৃষ্টি হবেই। নিন চা খান।"  " হ্যাঁ, তারপর যা বলছিলাম..."
রুমির রাতে ঘুম আসত না, বড় ইচ্ছে করত মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমাবে, আর ইস্কুল থেকে অন্যদের মত তার বাবাও আনতে যাবে। খুব কাঁদছে, আর বলছে "ভগবান তুমি একটুও ভালো নয়, এর থেকে আমি ভূতেদের ভালবাসব। ওরা তোমার মত কক্ষণো নয়।"
বুঝতেই পারছেন গ্রামের বাঁশবাগান মানেই তেনাদের বাস। উপর থেকে কয়েক ফোঁটা চোখের জল রুমির মাথায় পড়ল। রুমি ভাবল বৃষ্টি এসে গেছে, আরও জোরে কাঁদতে শুরু করল। হঠাৎ রুমির মাথায় কে যেন হাত বুলিয়ে দিল, ঠাণ্ডা হাত। রুমি চুপ করে গেল, রুমিকে কে যেন কোলে তুলে নিল। রুমির প্রাণ জুড়িয়ে গেল, বলে উঠল " মা এলে তুমি..." এই শুনে এক নাকি সুরের গলা বলে উঠল "মা আমি যে কুৎসিত ভয়াবহ দেখতে, তুই আমার সেই রূপ সহ্য করতে পারবি না। হ্যাঁ আমিও মা খুকি, তোর কান্না দেখে আর থাকতে পারিনি।" "ও মা, মায়েদের তো মায়ের মত দেখতে, তুমিই আমার মা। আমাকে একটি বার তোমাকে আদর করতে দাও।" রুমির কাতর স্বরে ভগবান যেখানে আদ্র, ভুত তো কোন ছার। মায়ের মন, নিজের রূপে এসে গেল সেই কণ্ঠস্বর। ভয়াল দর্শন, অথচ দু চোখ দিয়ে জল। রুমি ছোট হাতে সেই মায়ের গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বলতে বলতে চোখের জল মুছলেন বৃদ্ধ।
এদিকে রুমিকে না পেয়ে গোটা গ্রাম খুঁজতে খুঁজতে সেই বাঁশবাগানে। তারা এক অদ্ভুত দৃশ্যের সামনে! এক ভয়াল দর্শন মাতৃ রূপের কোলে রুমি, হাসছে আর সেই মায়ের দুচোখ বেয়ে জলের ধারা। সবাই হাত জোর করে দাঁড়িয়ে। 

রুমি যতদিন না বিবাহযোগ্যা হল, সেই উদ্ভট মা সব দিক দিয়ে তাকে ঘিরে রেখেছিল। অদ্ভুত কথা কী জানেন, সবাই ভগবানের মন্দির করে, আমাদের এই উদ্ভট মা কোনোদিন আমাদের গ্রামের ওপর কোন বিপদ আসতে দেন নি।
নিন বাবু বৃষ্টি থেমে গেল...
অদ্ভুত ভাবে দেখলাম আকাশ ভরা তারা, আর কিছু তারাদের চোখের কোণ ভিজে নাকি আমার চোখ ভিজে বুঝতে পারলাম না।
ধীর পায়ে গাড়িতে উঠে বললাম, " ধীরে চালাস , সামনে দেখে আমার কোন তাড়া নেই।"


জলের বেলা 

রূপা চক্রবর্ত্তী 

 কালো মেঘে ছাইলো আকাশ 
 বৃষ্টি এলো ধেয়ে ,
 খেলবো মাঠে চল না যাবো 
 টাপুর তালে গেয়ে |

 থাকবে না তো হারা জেতা 
 শুধুই মজার খেলা ---
 সবাই মিলে বলনে' পায়ে 
 খেলবো জলের বেলা |
 
 কাদায় জলে লুটোপুটি 
 তুলবো একে ওকে ---
 ভাববো না মা একটিবারও 
 দেবে নাকি বকে ?

 জলের খেলায় হাসির জোয়ার 
 হই খুশিতে হারা ---
 চুপটি ঘরে থাকবে না রে  
 বন্ধ ঘরে যারা |



আমি দেখি
সোমরাজ দাস
দশম শ্রেণি, স্প্রিংডেল স্কুল, নদীয়া
 

আমার পড়ার ঘরের জানলাটা আমার বড্ড প্রিয়। অবসরে আমি চেয়ে থাকি আর দেখি এই পৃথিবীর ব‍্যস্ততা। দেখি আকাশ, মেঘ আর বয়ে চলা দিনরাত। আমার বাড়ি মেনরাস্তার উপর তাই ঘুমের ভিতরেও গাড়ির শব্দ ভেসে আসে। কোনোকোনো দিন খুব ভোরে তখনো সূর্য হামাগুড়ি দেয়নি, অন্ধকারের ভিতর জানলায় দাঁড়িয়ে দেখি মোটর ভ‍্যানে সব্জি বোঝাই করছ মানুষ ছুটছে। মা বলেন ওরা দূরের হাটে চলেছে বিক্রি করতে। ধীরে ধীরে আকাশ লাল হয়। সামনের চায়ের দোকানে কাকুটা গ‍্যাসে চা বসায়। ব্যস্ততা বাড়ে মানুষের। দৌড়াচ্ছে যেন সবাই। কেউ মোটরবাইকে, ম্যাজিকে ,টোটোতে বা বাসে। যেদিন দুপুরে বাড়ি থাকি দেখি, অলস দুপুর। রাস্তার ধারে বাক্স বাদাম গাছগুলো তে টিয়া বাসা করে। ওদের চিৎকারে মন চঞ্চল হয়। আকাশের গায়ে সাদা মেঘের ভেলা। আমার খুব পাহাড়ের কথা মনে পড়ে। বিকেলে বাচ্চারা নাচ, আঁকা শিখতে যায় মায়েদের হাত ধরে। ফুচকা, আইসক্রিম টুংটুং করতে করতে যয়। আজকাল ইডলি নিয়ে আসে এক কাকু। কত আওয়াজ শুনি সারাদিন। অথচ রাত বাড়লে দেখি ক্লান্ত মানুষেরা ফিরছে।জোম‍্যাটো, সুইগির দাদারা পিঠে বড়ো খাবারের ব‍্যাগ নিয়ে চলেছে। ওরা কি খেয়েছে কিছু কে জানে? আকাশের কালো বুকে ঝিকমিক করে কত তারা। রাতের একা রাস্তা আমায় কতকি বলে ফিসফিস করে।সে সব আমি মনে মনে শুনি।



ধারাবাহিক ভ্রমণ
হিমবাহের ঘাড়ের উপর 
পর্ব - ২
মলয় সরকার

চলেছি গ্লেন হাইওয়ে দিয়ে। এই গ্লেন হাই ওয়ের ধারে, কিছুদূরেই হল আমাদের আজকের গন্তব্য। সকালের আলোয় চারদিক ঝকঝক করছে। বেশ ফাঁকা ফাঁকা। মাঝে মাঝেই রাস্তার দুপাশে ঝোপ ঝাড় বা জঙ্গল। কখনও চলেছি উঁচু পাহাড়ের পাশ দিয়ে, কখনও নদী বা ঝরণার গা ছুঁয়ে। মানুষের বসতি প্রায় নেই।

 হঠাৎ দেখি, আমাদের চমকে দিয়ে , গাড়ির সামনেই একটু দূর দিয়ে, হেঁটে এপার থেকে ওপার যাচ্ছে, একটি কিম্ভুত কিমাকার জন্তু। প্রায় ঘোড়ার মত উঁচু, ঘন বাদামী রঙ, বেশ শক্ত সবল, পায়ে খুরওয়ালা এক প্রাণী। মুখটা লম্বাটে ঘোড়ার মত তবে কেমন ভোঁতা। মাথায় রয়েছে শিং। সেগুলোও কিন্তু অদ্ভুত ধরণের। শিংদুটো সোজা উপরের দিকে ওঠে নি, অনেকটা মাটির সঙ্গে সমান্তরাল মাথার দুপাশে। তবে অনেকটা দেখতে ছড়ানো হাতের পাতার মত। তাতে হাতের তালুর মত একটা বড় অংশ আছে, যার থেকে আঙ্গুলের মত অনেক,  শিংএর শাখা বেরিয়েছে। পুরুষদের এই শিং হয়, কিন্তু মেয়ে পশুদের হয় না।

নতুন এই জন্তুটাকে দেখে বড় ভাল লাগল। জানলাম, এর নাম মুজ। এরাই হল হরিণ প্রজাতির সব থেকে বড় প্রাণী।এগুলো এইদিকে, কানাডা বা তাজিকিস্তান ইত্যাদি ঠাণ্ডা জায়গাতেই থাকে। তবে দেখতে এত বড় হলেও স্বভাবে এরা খুব শান্ত। তার ফলে এদের প্রায়ই প্রাণ হারাতে হয় অনেক ছোট আকৃতির নেকড়ের ( wolf) বা গ্রিজলী কি কালো ভল্লুকের হাতে। 

হ্যাঁ, এখানে এই গ্রিজলী ভল্লুকও খুব পাওয়া যায়। আমি বেশ কিছু গ্রিজলী ভল্লুক দেখেছি এখানে ডেনালী পার্কের রাস্তায়।এই গ্রিজলী ভল্লুকের খুব প্রিয় খাদ্য হিসাবে এরা খুবই প্রাণ হারায় এদের হাতে। গ্রিজলী ভল্লুক ধরেছে আর তার হাত থেকে বেঁচে মুজ ফিরেছে,এমন ঘটনা প্রায় হয়ই না। গ্রিজলী ভল্লুক যদিও মাত্র ৩৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে আর মুজ হতে পারে ৫৫০ কেজি পর্যন্ত ওজনে, অর্থাৎ অনেক বড় এরা, তবু স্বচ্ছন্দেই ভল্লুকেরা মুজ শিকার করে। আসলে এই গ্রিজলী ভল্লুক ভীষণ হিংস্র ও বুদ্ধিমান। এরা এতই বুদ্ধিমান ও হিংস্র যে মানুষও একে যথেষ্ট ভয় পায়। এখানে কালো ভল্লুক বা ব্ল্যাক বিয়ারও আছে।  এখানে যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে তার বেশির ভাগ আবার এই কালো ভল্লুকের হাতে। তারাও এই মুজের মাংসে মহানন্দে ভোজ লাগায়। ফলে বছরে প্রায় ২৫০০০ মুজ বাচ্চা নাকি মারা পড়ে এই ভল্লুকের হাতে।মুজের তো ধারালো খুর ছাড়া তীক্ষ্ণ কোন অস্ত্রই নেই, আর অত বুদ্ধিও নেই।ফলে ভল্লুকের বুদ্ধি আর তীক্ষ্ণ নখের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় বেচারী মুজের দল।

আলাস্কার এই দিনরাতের অদ্ভুত সমস্যাময় জায়গায় এই সব জন্তু ছাড়াও আরও বেশ কিছু প্রাণী আছে। যেমন বাদামী ভল্লুক, মেরু ভল্লুক, কালো ভল্লুক,নেকড়ে, পাহাড়ী ছাগল, বেশ কয়েক ধরণের হরিণ,সজারু, খরগোশ, ঈগল, তিমি এইসব।


আমরা দেখতে দেখতে এসে পড়লাম আমাদের অভীষ্ট গন্তব্যের কাছে। ওখানে রাস্তাতেও অনেক আগে থেকেই নানা সংকেত দেওয়া রয়েছে, কোনদিকে যেতে হবে, কতটা যেতে হবে ইত্যাদি।গাড়ি যতই এগোচ্ছে বুকের মধ্যে ধুকপুকানিও বাড়ছে। উত্তেজনাও চরমে। কি দেখব, কি রকম দেখব সেই চিন্তায় মন আকুলিবিকুলি করছে। গতকাল থেকেই রয়েছে এই উত্তেজনা।আসলে যে কোন নতুনের সঙ্গে পরিচয়ের আগে একটা উত্তেজনা তো থাকেই। তার উপর যদি এমন একটা জিনিস হয়, যা দেখা এক সৌভাগ্যের ব্যাপার, তাহলে তো কথাই নেই। (ক্রমশ)

স্মরণীয়
(মহাশ্বেতা দেবী)
 কলমে - পীযূষ প্রতিহার


প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন ‘ যুবনাশ্ব ' ছদ্মনাম গ্রহণকারী বিশিষ্ট কবি এবং স্বনামধন্য গদ্যকার মনীশ ঘটক , মা ধরিত্রী দেবী । বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক ছিলেন মহাশ্বেতা দেবীর কাকা । ' নবান্ন ' - খ্যাত , প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর বিবাহ হয় । সাহিত্যিক - সাংবাদিক নবারুণ ভট্টাচার্য তাদের একমাত্র সন্তান ।

     রাজশাহী তে শিক্ষা শুরু করে কলকাতার আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন  । তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন । কর্মজীবনে নানাপ্রকার পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি । স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন , কলেজে অধ্যাপনা করেছেন , পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন । সাংবাদিক জীবনে তিনি যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সাহিত্যরচনাই তার একমাত্র পেশা হয়ে  দাঁড়ায় ।    মহাশ্বেতা দেবী সমাজসেবী এবং রাজনীতিবিদ হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন । বাবা ও কাকার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি যৌবন থেকেই বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন । বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তার রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামেগঞ্জে । শবর , খেড়িয়া ইত্যাদি অরণ্যচারী উপজাতির উন্নয়নে তিনি নিজেকে সঁপে দেন। ভারতের বিভিন্ন উপজাতি অধুষিত অঞ্চলে তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। তার সাহিত্যকর্মে সমাজসেবা এবং রাজনীতির এই বিপুল অভিজ্ঞতার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ।

  মহাশ্বেতা দেবীর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ইতিহাসনির্ভর জীবনী বাসীর রাণী ( ১৯৫৬ ) । তাঁর প্রথম উপন্যাস নটী ( ১৯৫৭ ) । তার অন্যান্য উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলি হল মধুর প্রেম , রুদালি , প্রেমতারা , বায়ােস্কোপের বাক্স , আঁধারমানিক , হাজার চুরাশির মা , অরণ্যের অধিকার , চোট্টি মুণ্ডা ও তার তীর , বিশ - একুশ , ব্যাধখণ্ড , গণেশ মহিমা , সিধু - কানুর ডাকে , নৈঋতে মেঘ , বীরসা মুণ্ডা , স্তন্যদায়িনী ও অন্যান্য গল্প ইত্যাদি । তিনি যেমন আদিবাসী এবং সমাজের অন্যান্য সর্বহারা মানুষের জীবনের উন্নয়নে ব্রতী হয়েছেন , তেমনই তাদের জীবনকথা নিয়েই তিনি বহু শিল্পসার্থক ছােটোগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন । মহাশ্বেতা দেবী বর্তিকা নামক একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন ।

     মহাশ্বেতা দেবী তার নিরলস সাংবাদিকতা এবং সাহিত্যসাধনার জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন । তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানপীঠ ’ , ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ’ - এ , ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার ’ - এ এবং ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মবিভূষণ' পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন । এ ছাড়াও তিনি ‘ পদ্মশ্রী ’ , ‘ দেশিকোত্তম ’ প্রভৃতি উপাধি লাভ করেছেন। তবে নিছক পুরস্কারপ্রাপ্তির মানদণ্ডেই তার কর্মময় জীবন এবং সৃজনশীল অবদানের মূল্যায়ন করা যায় না। ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই তার জীবনাবসান হয়।


পাঠ প্রতিক্রিয়া
( ছোটোবেলা ৯৩ পড়ে সুদীপ্তা আদিত্য যা লিখলেন)

নীল অঞ্জন ঘন পুঞ্জ ছায়ায় সম্বৃত অম্বর -হে গম্ভীর। গাইতে গাইতে গম্ভীরা গানের কথা মনে পড়ে গেল। গম্ভীর হলেন মহাদেব। এই গম্ভীরের নীলে নীলাম্বরী আকাশ কখন যে ঘনঘটায় উথালপাথাল তা মেঘ বাবাজীবন জানেন।নীলকন্ঠ সপলেই এ নীলাম্বরী শান্ত হবেন না।চাই বৃষ্টি। আর আমাদের ছাতা। ছাতা মাথায় দিয়েই আপাতত ছোট্ট শ্রীপর্নাদের বাড়ির ওখানে ঘুরে আসা যাক। এত মেঘের তলা দিয়ে যেতে যেতে হোঁচট না খাই। হামাগুড়ি দিয়ে চলো যাই । শুধু হাটুতে কাদা লাগবে আর কিছু না। এতো গম্ভীর শব্দের বহর দেখে ছোট অনুশ্রুতি আমাদের জন্য শিবঠাকুর এনেছেন। বৈচি ফলের মালিকা না চড়ালে বাবা রাগ করবেন তাই ফেরার পথে ওসব জোগাড় করে তারপরেই যাব মন্দিরে। এদিকে শ্রাবন মাস।পুকুরে তো জল থৈ থৈ হবেই।ছোট রুপমের বাড়িটা রঙিন আবার দোতলা । দুপুরে নাওয়া খাওয়া সেরে পুকুরের জলে ঢিল ছোঁড়ার অভ্যেস আছে! সাবধান।ব্যাঙ মামার ব্যামো হয়েছে।ওতো দূর্বল শরীরে সে ঢিলের আঘাতে কষ্ট পাবে। বৃষ্টিতে ছাতা ব্যবহার করা ভালো। আমিও তো ছাতা মাথায় দিয়ে এখন অনেকটা দূর হেঁটে এলাম।বৃষ্টির জল গায়ে লাগলেই হাঁচি কাশি সর্দি। তারমধ্যে করোনা ভীষন বাড়ছে।ব্যাঙরাও সাবধানে থেকো! হাঁটতে হাঁটতে আমি থমকে গেলাম।একটা কথা মনে পড়ল।এই বর্ষাতেই তো আমরা আমাদের মেজঠাম্মিকে হারিয়েছিলাম।আত্মা শান্তির দোহাইতে কত আয়োজনের বহর।পেটপূজো।এগুলি না কি নিয়ম!ওতো বাছবিচার না করে আমিও মেনে নিয়েছি নিয়মগুলো।বছরের পর বছর লোক মরলে এগুলোই তো পালতে হয়।তবে ছোট ছোট ওই হাতগুলো কে খাবার তুলে দিলে শান্তি লাগে অনেক।ভাবতে ভাবতেই আমি তখন পুকুরের কিনারে।এতো পুকুর বর্ষায় ডুবে গেলে কোনটা রাস্তার সীমান্ত সেটাই বোঝা যায় না।

কোলকাতা শহরে এত পুকুর কোথায়? সব বুজে গেছে। তাই ছোট প্রবাহনীলের বাড়িরf পাশের শহুরে পুকুরটা সত্যি দারুন।প্রবাহ তার নীল। সুনীল। ভাবছি হাঁটতে হাঁটতে যদি কোনো হিমবাহের সাথে দেখা হলে প্রশ্ন করব যে -গঙ্গা এত নীল কেন? তাহলে তুমি সাদা? গলে গলে পড়ে এমন, মনের মধ্যে ধাঁধা।আলাস্কা তো চাঁদের মত দূর। তাই চাঁদের পাহাড় দেখতে গেলে আমার পা জোড়া ক্ষয়ে যাবে।তার থেকে ভালো এখন একটু জিরিয়ে বসে আগে জ্বলদর্চিটা শেষ করি।খটখটে রোদ। ওই যে আকাশ রামধনু।জয়াবতী কে নিয়ে এলে ও খুব খুশি হতো। আবিস্কার করেই ফেলত বেনীআসহকলার রুপ।ও মেয়ে বড়ো বুদ্ধিমতী।লেখক মহাশয়ের কলমে আলাস্কা ।সেই সান্তা দাদুর দেশ।ছ মাস রাত আর ছ মাস দিনের মধ্যে সারাদিন কীভাবে কাটল তা শুনতে ইচ্ছে করছে তো।শেষের পাতায় ক্রমশঃ লেখাটা উদ্বেগ টাকে ছাপিয়ে গেল।

জ্বলদর্চি আস্তে আস্তে একশো বছরে পা রাখল বলে। অনেক দিন বলতে পারো অনেক সপ্তাহ বয়ে গেল আমি আর আমার রবিবার জ্বলদর্চি ছাড়া বিমর্ষে দিন গুজরান করেছি।কলেজের পরীক্ষা আর তথাকথিত জ্বর কাটিয়ে এখন ভালো লাগছে।আরো ভালো লাগলো বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় দিয়ে অনেক দিন পর রাস্তায় হাঁটলাম।তবে এ বৃষ্টিতে আর ইন্ফ্লুয়েঞ্জার ভয় নেই এটাই স্বস্তির।

আরও পড়ুন 
 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments