জ্বলদর্চি

সাধন চট্টোপাধ্যায় /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল—

সাধন চট্টোপাধ্যায়

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

ষাটের দশকের অন্যতম সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায় (জন্ম-১৯৪৪) ৭০০-র মতো গল্প লিখেছেন। ৪০০-রও বেশি প্রবন্ধ। তিনি মনে করেন— কাহিনি বর্জিত কোনও টেক্সট হতে পারে না। শক্তিশালী আখ্যানের মধ্যে অবশ্যই বহুমাত্রিকতা এবং কাহিনি ও কাহিনিহীনতার একটি সূক্ষ্ম টানাপড়েন থাকতে বাধ্য। ভবিষ্যৎ পাঠকের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে তা পাঠান্তে উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে সক্ষম। মহৎ টেক্সট-এর মৃত্যু নেই। ‘কপালকুণ্ডলা’র উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, এই রহস্যময় শক্তিটুকুই আখ্যান অস্তিত্বে আধুনিক সাহিত্যে জরুরি হয়ে ওঠে। 

সাহিত্যিক নয়, বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলেন তিনি। বিজ্ঞানচর্চা এবং বিজ্ঞানচেতনা তাঁর গল্প-উপন্যাসেও প্রভাব ফেলেছে। একই সঙ্গে তাঁর লেখায় এসেছে পরিমিতিবোধ এবং এক বিশ্লেষণী জিজ্ঞাসা। তাঁর টেক্সটে ধরা থাকে সময় এবং আগামীসময়ের ভাষ্য। পাঠক তাঁর চেতনা এবং রুচি অনুযায়ী ডিসকোর্স থেকে নতুন নতুন ভাষ্য তুলে ধরতে পারেন। তিনি টেক্সট বলতে রচনাটাকেই বোঝান। আর প্লট বলতে কাহিনি। 

তাঁর ‘মাংসখেকো ঘোড়া’ (‘অনীক’ ১৯৯৩) গল্পের শুরুতে দ্যাখা যায় ৫০ ফুট উঁচু পাঁচ তলা বাড়ির ছাদের কংক্রিট পিলারে একটা বিশাল হোর্ডিং টাঙাচ্ছিল কয়েকজন। হোর্ডিং-এ একটা লাল ঘোড়ার ছবি। “চোখের ড্যালা, ঘাড়ের চুল পেছনের দাবনার পেলব পেশিমণ্ডলের চকিত শিহরণে একটি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ভঙ্গি। সুকুমার ঊরুর মেয়েটিকে রমণের আকাঙ্ক্ষায় দীপ্ত।” ওই ছবি দেখেই হয়তো সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল বিজু। “দানবীয় কাম-বাসনাচোখে থমকে থাকা পশুটা যেন জীবন্ত। বিজুর বারবার মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি ঘোড়া পশু হয়েও নারীসঙ্গমের ইচ্ছা পোষণ করে ?” একটা খাম্বা এসে তার কাঁধে পড়ল। আর একটা হাত কেটে বাতাসে ভাসতে ভাসতে পড়ে গেল। শুধু কনুইটা অর্ধেক অবস্থায় ঠুঁটো জেগে আছে। বিজুর সঙ্গে ছিল আরও তিনজন পঞ্চা-নীলু-যাদব। লেখক বলছেন বিজুকে আর পুরো মানুষ হিসেবে গোনা যাবে না। অর্থাৎ এখন ‘সাড়ে তিনজন’ মানুষ।

বিজুর চিকিৎসার থেকেও তাদের মনে হল হাতটা খোঁজা জরুরি— “প্রমাণ! কোম্পানি বীমা করিয়ে থাকলে, প্রথমে হাতটা চাই।” পঞ্চা হাতটা খুঁজতে গেল। যাদব অফিসে খবর দিতে। আর নিলু বিজুর পাহারায়। বিজু পাঁচ তলার ছাদে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। 

পঞ্চা খুঁজতে খুঁজতে বহু দূরে চলে গেল। “হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল, যদি খুঁজে পাওয়াও যায়, কী করবে সে ? কী কর্তব্য ? হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে প্রকাশ্যে পাঁচতলায় উঠবে, নাকি অফিসে বশের ঘরে প্রমাণ দেবে, নিছক দুর্ঘটনাতেই হাতটির বিচ্ছিন্ন হওয়া ?” 

নীলু শুয়ে শুয়ে ভাবে মৃত্যুর পরে তার সংসার কে দেখবে! “দুর্ঘটনায় জড়ালে না হয় বীমার কাছে সাক্ষী মানা যায়। কিন্তু জ্বলজ্যান্ত অকারণে মরলে কোনো বাড়তি সুবিধে নেই।” ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘন্টা দুই পরে দুজন মাতাল পুলিশ পঞ্চাকে নিয়ে পাঁচ তলার স্পটে এসে দ্যাখে— “নিঃশব্দে, নিরিবিলিতে, ফ্রেমের ঘোড়াটা লাফিয়ে নেমে এসে ঘুমন্ত নীলুর ডানহাতটি চিবিয়ে খাচ্ছে। আঙ্গুল, কব্জি, বল্টুর ঘষা জং, শিরা ত্বক—কনুই অবধি ওঠার আগেই তিনজন ছাদে পা দিয়েছে। হলদে দাঁতে সামান্য চিঁহি ভাব দেখিয়ে ঘোড়াটা সামান্য লাফ দিয়ে ফের ছবি হয়ে গেল। ঘোড়ার শরীর থেকে সুন্দর গন্ধ ছিটকে এখন বাতাস মাতিয়ে রেখেছে।” 

পরদিন লাল ঘোড়ার খবর বেরোয়। “কিন্তু কেউ বিশ্বাস করল না প্রাণীটা মনুষ্যহাত গিলে ফেলতে পারে কিনা। ঘোড়া কেবল ঘাস ও ছোলা খায়। মনুষ্য-হাত তো গলাধঃকররণ করে না ?”  

লেখক সমগ্র জীবনের উপরে একসঙ্গে আলো ফ্যালেন না। জীবনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে টেক্সটের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। চূর্ণিত হওয়ার জন্য একসঙ্গে, একই আধারে সমগ্রকে দ্যাখা যায় না। পাঠকের কাজ সেই টুকরোগুলোকে খুঁজে খুঁজে জোড়া দেওয়া। পাজ্‌ল গেমের মতোই তাঁর গল্পের আঙ্গিক এবং উপস্থাপনভঙ্গি। 

মহৎ টেক্সটের মৃত্যু হয় না। প্রায় তিন দশক পরেও গল্পটি পাঠকের মুখোমুখি হয়ে উদ্দীপনা সৃষ্টি করছে। বিশ্বায়ন-পণ্যায়নের আগ্রাসন, শ্রমিকদের কাজ চলে যাওয়া ইত্যাদির বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা এই টেক্সটে ধরা পড়েছে, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। 

পুঁজিবাদ নারীকে পণ্য ভাবে। তাই তো বিজ্ঞাপনে লাল ঘোড়ার পাশে লাস্যময়ী রমণীর ছবি ছিল। আর ‘এলাটিং বেলাটিং সই-লো’ (শ্রেষ্ঠ গল্প, করুণা প্রকাশনী, ২০১৭, পৃ- ২০০) গল্পেও এসেছে পণ্যায়নের প্রসঙ্গ। গল্পের নামকরণে মনে পড়ে ছোটোবেলায় সেই খেলার কথা। মূলত মেয়েরাই খেলাটি খেলত। এই লোকক্রীড়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লোককথা, লোকগল্পও। সেই লোকগল্পকে আজকের প্রেক্ষাপটে পুনর্নির্মাণ করেছেন লেখক। 

দরিদ্র পরিবারে বস্তিবাসী চানু একদিন দেরিতে পৌঁছল খেলার মাঠে। দেরি হওয়ায় তাকে বন্ধুরা খেলতে নিচ্ছিল না। সে খেলা দ্যাখার জন্য গাছে উঠে “একটু ব্যথায় হাতটা দ্রুত ফ্রক ও প্যান্টির ফাঁক দিয়ে সোজা গলিয়ে কিছু পর তুলে আনতেই যেন আলতার দোয়াতে আঙুলগুলো চুবিয়েছে, থমকে যায়”। বালিকা থেকে কিশোরী হতে চলেছে সে। 
হঠাৎ তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বন্ধুরা খেলতে ডাকে। ভালো করে চোখ বেঁধে হাঁটিয়ে “এলাটিং বেলাটিং সই-লো/ কী খবর আইলো/ রাজামশাই চানু নামে একটি বালিকা চাইলো/ নিয়ে যাও, নিয়ে যাও বালিকাকে” বলেই ঠেলে অপেক্ষাকৃত নির্জনতায় একাকী ছেড়ে দিয়ে যে যার অদৃশ্য হয়ে গেল। চোখ খুলে সে সামনে দেখতে পায় টিপটপ পোশাকের একজন মানুষ। সে বলে রাজামশাই চানুকে নিতে পাঠিয়েছেন। চানু দশ মিনিট বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে বললে লোকটা ভয় দেখিয়ে বলে না এলে শাস্তি পেতে হবে। লোকটি শিমুল গাছে ছোট্ট একটি আঘাত দিতে “সদ্য-ফোটা টকটকে লাল দুটো ফুল, শেষ হওয়া বিকেলে ম্লান নরম আলোয় টুপটাপ ঝরে পড়ল, চানু ভয়ে দেখে ফুল দুটো ফুলের মতো ফুটলেও, এখন তারা বুলু আর হেনা— স্পষ্ট মাটিতে পড়ে আছে—যারা দু’মাস ধরে নিখোঁজ, বেপাত্তা, বিশাল বস্তিটার দক্ষিণ অংশে ওদের চালা, এক-বিকেলে ঘর থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি, সেই থেকে বাকি মায়েরা কাজে বেরুলেই ধমকায়, মুখ ভাঙতে চায়, গু খেতে বলে, দিব্যি কাটায়।” 

চানু স্কুলের দিদিমণিকে বলেছিল লোকটার কথা। দ্যাখা গেল দিদিমণিও লোকটাকে চেনেন। তিনি বলেন— “কিছু নয়, ভয় পেয়ো না, ঈশ্বর মঙ্গল করবেন।” দিদিমণিরাও এর সঙ্গে যুক্ত। 

এই পণ্যায়নের যুগে ক্ষমতাশালী মানুষই রাজা। আর সমাজের সব স্তরের মানুষই রাজার দূত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় টানটান। ক্ষমতার শিকলে সকলকে বেঁধে ফেলতে পারে। ক্ষমতার দালালদের হাতে বাংলার কত কত মেয়ে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে। গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ—“...অথচ ফুলগুলো উঁচুতে ফুটে রইল ফুলেরই মতন, শুভ্র ভদ্রতা নিয়ে, এবং ফের চানু স্নানের পরেও নীরবে ঘামতে থাকল, কারণ লোকটার হাতের স্পর্শেও শিমূলের ডাল থেকে যে-দুটো ফুল ঝরে পড়ল, চানুর ভীষণ পরিচিত, অঞ্চল থেকে বেপাত্তা হয়েছিল।”   

রাজাই আসলে মূল খেলাটা খেলে। সেইসব রাজারা নানারূপে বিদ্যমান আজও। এখনও গ্রাম থেকে দরিদ্র বালিকারা নানা হাত ঘুরে ওই রাজাদের কাছে চলে যায়। যেতে বাধ্য হয়। রাজারাই সুকৌশলে বাধ্য করে। উল্লেখ করা যেতে পারে সাধন চট্টোপাধ্যায়ের একটি গ্রন্থের নাম ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে’ (২০১২)। সেখানে বুলবুলি একটি প্রতীক মাত্র। আলোচ্য গল্পের রাজাও তো প্রতীক। রাজারা, বুলবুলিরা সমাজ-সংসার থেকে হারিয়ে যায়নি, স্বমহিমায় বিরাজিত তারা। শুধু আলখাল্লাটাই বদলেছে! আর আমরা নাগরিকরাও ক্রমশ প্রজায় পরিণত হয়ে যাচ্ছি। রাজার নির্দেশ প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে চলতে হচ্ছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা আমাদের ব্যক্তিযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করছে।      

দুশো বছরের কলোনি চলে গিয়েছে। আমাদের চৈতন্য বদলে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কলোনিয়াল হ্যাংওভার কাটেনি। লেখক মনে করেন কলোনিয়াল শক্তি আজও বিভিন্ন এনজিও-র মাধ্যমে ক্রিয়াশীল। তারা সুকৌশলে তাদের আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। নানা ভাবে তারা শক্তি সঞ্চয় করছে। বিশ্বায়নের হাত ধরে বহু রূপে বিদেশি শক্তি প্রভাব খাটিয়ে চলেছে। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় এই কাজ চলছে। 

‘মহারাজা দীর্ঘজীবী হোন’ (শ্রেষ্ঠ গল্প, করুণা প্রকাশনী, ২০১৭, পৃ- ১২০) গল্পে দেখা যাবে স্বার্থমগ্ন মানুষ কীভাবে নিজেদের শিকড়কে, অতীতকে অস্বীকার করে। মহারাজা এখন আর বেঁচে নেই। শেষ মহারাজা দুর্মন্যনারায়ণের আমলে তাঁর রাজ্য ভারত ইউনিয়নে চলে আসে, প্রজাতন্ত্রের দু বছর পরে। মহারাজার বংশধররা ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রজাতন্ত্রের কাছ থেকে পাওয়া কয়েক লক্ষ টাকা নিয়ে বিদেশে দিনযাপন করছে। পিলখানার দামি হাতিগুলো নেপাল-মহারাজার কাছে মহারাজা স্বয়ং বিক্রি করে গিয়েছেন। শুধু “বৃদ্ধ দেবিকারানীকে সেখানে চালান করতে না পেরে ফেলে দিয়ে গেছেন। শত হলেও রাজার হাতি তো, আদর-আপ্যায়ন সরকারি আইনে পরিণত হয়েছে।” 

গল্পের কেন্দ্রে আছে এই দেবিকারানী। মহারাজার ‘অস্থাবর স্মৃতিচিহ্ন’, ‘পুরনো বাহিকা’। দরিদ্র প্রাচীন প্রজারা আজও শ্রদ্ধার চোখে দ্যাখেন দেবিকারানীকে। ছাব্বিশে জানুয়ারি এবং পনেরোই আগস্ট দুর্গম গ্রাম-গাঁ থেকে মানুষ আসেন চিড়া-মুড়ি বেঁধে। সেদিন মহকুমার কোর্টের সামনে মস্ত খেলার মাঠটায় প্রজাতন্ত্রের পতাকা উত্তোলনের পর, বিশিষ্ট সরকারি অতিথিদের দেবিকারানী সেলাম ঠোকে। 

আর অন্যদিকে মাহুত রঙ্গুয়া বর্মণ দেবিকারানীর জন্য বরাদ্দ খাবার, ওষুধ ইত্যাদি না দিয়ে কঙ্কাল করে তুলেছে। দেবিকারানীর অজুহাতে নিজের আখের গোছাচ্ছে। পিলখানার পিছনে নদীর ধার ঘেঁষে সরকারি খরচে নিজের কোয়ার্টার বানিয়ে নিচ্ছে। শুধু তার নিজের নয়, তার মেট তেলুয়া বর্মণেরও। পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ পাখুয়ার মনে হয়— “মফস্বল শহরের সরকারি বাবুদের পর, যেন ভক্তি-ভালোবাসাহীন নেমকহারাম ‘গোলামের ব্যাটারা’ মহারাজাকে সময়ের বিপাকে নির্মূল, নিঃশেষ করতে বদ্ধপরিকর।” রঙ্গুয়া অসুস্থ হাতিটিকেও ওষুধ দেয় না। তাঁর রাজ্যে তাঁকেই নির্মূল করে দিতে চাইছে। 

পাখুয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এই গল্পের। সে চাষিদের মহারাজার গল্প শোনায়। সে বলে— “মানুষ পাল্টে গেলেও পশুরা প্রভুভক্তি ভোলে না।” “মহারাজার আত্মা দেখছেন তার রাজত্বের শেষ ভক্তটি এখনও বেঁচে আছেন।” 

এস-ডি-ও সাহেব শখ মেটাতে দেবিকারানীর পিঠে মাঠ পরিক্রমা করেছেন। এ-তো শুধু হাতির উপরে ওঠা নয়। মহারাজার ঐতিহ্যের উপরেই চেপে বসা। আজকের রাজারা তার বাহনকে শ্রদ্ধা করে না। মানুষ-পশু সবার উপরে কর্তৃত্ব করতে চায়। 

গল্পের শেষ দিকে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি ও হড়কা বান আসে। অসম্পূর্ণ পিলখানার মধ্যে থেকে দেবিকারানী তা সহ্য করে। শুঁড়-মাথা-পেটে অসহ্য আঘাত খেতে খেতে চীৎকারে শিকল ছিঁড়ে ছোটে শহরের পথে। ভীষণ তৎপরতায় হাতিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রশাসনের লোকজন। “কেবল বৃদ্ধ পাখুয়ার মতো মুখে প্রশাসন উচ্চারণ করল না, মহারাজা দীর্ঘজীবী হোন।”

প্রশাসনের কাছে দেবিকারানী কেবলই একটা হাতি। আর পাখুয়াদের কাছে দেবিকারানী ঐতিহ্য, অতীত ঐশ্বর্য, বৈভবের প্রতীক। দেবিকারানীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটা মহাসময়কালেরও অবসান হবে।    

দেশকে জানতে হলে, জন্মশিকড়কে জানতে হলে আমাদের দেশজ ঐতিহ্যকেও জানা উচিত। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় বারবার এসেছে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ কখনও আঞ্চলিকতায় আটকে থাকেনি। তাঁর লেখায় একটা আর্বানিটি আছে। তিনি যখন গ্রাম বা মফস্‌সলের পটভূমিতে গল্প লেখেন সেখানেও এক ধরনের আর্বানিটি লীন হয়ে থাকে। সেটাই তাঁর গল্পের স্বতন্ত্রতা এবং আধুনিকতা।    

লেখক সমাজ-সময়ের বিকৃতিকে তুলে ধরেছেন ‘ছায়া গণ্ডার’ (‘চতুষ্কোণ’, শারদ ১৪০৮) গল্পে। একটু অন্যভাবে পণ্যায়ন-বিশ্বায়ন এসেছে এই গল্পেও। গান্ধী হত্যার পর মহাত্মার ভস্ম পূত-পবিত্র দেহাবশেষ গঙ্গার জলে সমাহিত হয়েছিল। পুণ্যময় দেশ নেতার স্মৃতি বিজড়িত গঙ্গার মনোরম ঘাটটি এখন টুরিস্ট স্পট। নিরাপত্তার কারণে সন্ধে সাতটার পর বসে থাকা যায় না। সেপাইরা ঠিক সময়ে এসে জানান দিয়ে যায়। এখানে একটু নির্জনে “প্রকাশ্য প্রকৃতিতে ভালোবাসা করছিল” দুজন। একটু নিবিড়ভাবে। পুলিশটি ধরতে গেলে অর্ধোলঙ্গ পোশাকে উঠে ছেলেটি পুলিশটিকে ঠাটিয়ে চড় মারে, “মজা ? শালা আওয়াজ দিতে পাল্লি না ?” মেয়েটিও স্মার্টলি উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তিতে বলে— “শকুন! দেবো চোখ গেলে!” থানায় কেস দিতে চাইলেও ভয় পায় না তারা। কারণ, থানায় গেলে সহজেই বেরিয়ে আসবে সুপারিশের জোরে। তারা বিন্দুমাত্র লজ্জিত নয়। বরং ছেলেটি বলে— “একটু লিবার্টি না পেলে তেল পুড়িয়ে আসব কেন ? স্রেফ হাওয়া খেতে ?” এই কিশোর-কিশোরী তাদের সংলাপ, ভাবভঙ্গি-ই চিনিয়ে দেয় সময়কে। আমরা একেই বলি স্মার্টনেস। এই স্মার্টনেস থেকেই মহাত্মার স্মৃতি প্রসঙ্গে ছেলেটি বলে— “জ্ঞান বন্ধ করুন। এ করেই গ্যাছে দেশটা। স্মৃতি-টিতি কি ?”

সাধন এই গল্পে আমাদের অসুস্থ সময়ের আর একটি বৃত্তে নিয়ে যান। সেখানে দ্যাখা যায় ছেলেটি চড় খাওয়া পাহারাদারের হাতে ৫০০ টাকার একটি গান্ধীমূর্তি গুঁজে দিয়ে বলে— “কোনও পুণ্যি-পরিস্থিতি তোমায় দেখবে না... এই কাগজটাই দেখবে ভাই... সব শালাই সুযোগ পেলে ফূত্তি করে!” গান্ধীঘাটের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব প্রশাসনের যে কর্তাদের উপর দেওয়া আছে, তারা গান্ধীমূর্তি আঁকা নোটদাতাদের দায়িত্ব পালনে অনেক স্বচ্ছন্দ। তাই পাহারাদারটি বলে— “ফের এদিকে এলে আগে একটু বলবেন... ভালো ব্যবস্থা করে দেব।” 

গল্পটি শেষ হচ্ছে— “কোনো বাধা নেই কোথাও! অদ্ভুত লিবার্ট! এই ভস্ম ও লিবার্টির জ্যান্ত চিহ্ন হিসেবে চৌকির বাইরে তখন মোটরসাইকেলটি মাটিতে বেঁটে গণ্ডারের ছায়া মেলে চুপচাপ হয়ে আছে!” 

আজকের বাঘ-সিংহ-গণ্ডার সবই ছায়া। টাকার বসে কায়াহীন হয়ে পড়েছে। সবই এখন চিহ্ন মাত্র।  

আজকের পণ্যায়নের সংস্কৃতিতে টাকার কাছে ম্লান হয়ে যায় সব—সমস্ত কিছুই। এ-তো সময়েরই এক তীব্র সংকট। সাধন মনে করেন সংকট ছাড়া সাহিত্য হয় না। তাঁর গল্পের ন্যারেটিভের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সেই সংকট। তার মানে এই নয় যে, তিনি শুধু সংকট খুঁজে বেড়ান। তার মধ্যে জীবন থাকে, প্রেম থাকে, আবেগ থাকে, ইতিহাস থাকে কিন্তু সংকট-মুক্তি থাকে না। জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে সংকট। একে অস্বীকার করতে চাননি লেখক। তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্প কোনও-না কোনও দিক থেকে সংকটেরই গল্প।   

সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে পাঠকের জন্য অনেকটা স্পেস ছাড়া থাকে। লেখকের টেক্সট এবং পাঠকের চেতনা দু-য়ে মিলে একটা ডিসকোর্স তৈরি হয়। তিনি ‘স্তব্ধ সময়ে’র কথা বলেন। ঘড়ির সময়টা আমরা গুণে তৈরি করছি। একটা গাছ তো ঘড়ির সময় ধরে চলে না। বিগ ব্যং থেকে ব্ল্যাকহোল— এই সময়টাকেই তিনি স্তব্ধ সময় বলতে চাইছেন। এই সময়ের মধ্যে জীবনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে সাহিত্যে তুলে ধরার চেষ্টা করাই লেখকের লক্ষ্য। আর তা পরবর্তীকালে পাঠকের হাত ধরে বিকশিত হয়ে চলে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পাঠকের চেতনার পরিবর্তন ঘটে। সাহিত্যের ভাষ্যেরও পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তিত ভাষ্যকে গুরুত্ব দিতে চান লেখক। কখনও-বা সময়কে স্থির রেখে স্থানটাকে বদলে গিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেন। মনে পড়ে ‘সাতপুরুষ ডট কম’ উপন্যাসে উদগ্র হয়ে উঠেছে সময়। আলাদা কালখণ্ডকে একই সঙ্গে তুলে ধরেছেন। দুই প্রজন্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। আসলে এই সময়ই তো দর্শন। সেই সময়-দর্শনই সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পকে বিশিষ্টতা দান করেছে। অতি বিশিষ্ট করেছে লেখককেও।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

4 Comments

  1. ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতার সদর্থক দিক মূর্ত হয়েছিল অন্য জিজ্ঞাসা নিয়ে। কিছুই আর আগের মতো থাকেনি। সাহিত্যের পাতায় যাঁরা এই খানখান হয়ে যাওয়া প্যারাডাইমকে ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন তাঁদেরই অন্যতমকে নিয়ে বিশ্বজিৎ পান্ডার মূল্যবান সন্দর্ভটির জন্য ধন্যবাদ অশেষ।

    ReplyDelete
  2. সাধন চট্টৌপাধ্যায় একজন অসামান্য লেখক। অমিতরূপ চক্রবরতী।

    ReplyDelete
  3. চমৎকার বিশ্লেষণ। সাধনদাকে আমাদের অগ্রজ হিসেবে পেয়ে হাজার ধারায় উপকৃত ও কৃতজ্ঞ। তাঁর লেখার ওই মধ্যিখানের স্পেস, যা কোনো ধার করা বস্তু নয়-- ওটাই পাঠককে মুগ্ধ করে৷ ঋদ্ধ করে। অহরহ।

    ReplyDelete
  4. সাধন চট্টোপাধ্যায় আমাদের বাংলা সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী লেখক, তার মজ্জায় রয়েছে বিজ্ঞান চেতনা, আর হৃদয়ে রয়েছে মানব জীবন জিজ্ঞাসা...রূপক প্রতীকের খোলস মোচন করে বিশ্বজিৎ বাবু যেভাবে আলোচনা করেছেন টা সত্যিই অভাবনীয়।

    ReplyDelete