আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে- এক
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
আমার যত্নের বন্দুক
আমাদের সময় মেয়েবেলা টা বেশ কম পাওয়ার ভেতরেও অনেক পাওয়া ছিল।যখন গোনা গুনতি করতে শিখলাম দেখলাম ছখানা জামা ও বোনের হয়তো একটু বেশি। থেবুর মা বুলার মা পুলক কাকুর বউ পুজোর বাজার দেখাদেখি চলত। কেউ ফুট কাটত "আমার মনে হচ্ছে তোমার তাঁতটার গা তত ভালো না" মা বলত রঙটা ভালোলাগল তাই নিলাম। সে যে কী উত্তেজনা চোদ্দোবার আলমারি থেকে বের করা ...নতুন গন্ধ নেওয়া।জুতো একটাই হতো। বাটার দোকানের বেলুন লজেন্স ফ্রী গিফট্। সব থেকে মজার ব্যাপার বাড়িতে ডোর বেল বাজলেই বুঝতাম ঐ তো বড়ো মামা, মেজো মামা,জ্যেঠু, কাকু মাসি সব নতুন নতুন ব্যাগ ভরা আনন্দ নিয়ে হাজির ।
শিশু হৃদয়ের নির্মল আকাশে যেন ফুলঝুরির মেলা। মাইকে সেই সব গান " ও কেন এতো সুন্দরী হলো " "তারে ভোলানো গেলনা কিছু তেই" "পাখিটার বুকে যেন তীর মেরোনা " ও বকবক বকম বকম পায়রা" ...."ও মেরি মেহেবুবা" ..."ক্যাইসে বানি ক্যাইসে বানি ফুলরি বিনা চাটনি"...এরকম হাজের খানেক গান আছে। আজকাল সব মনে করতে না পারলেও তখন বেশ সব মুখস্ত হয়েযেত খুব তাড়াতাড়ি। পাড়ার ঠাকুর একটু একটু করে তাঁর রূপ নিয়ে জেগে ওঠে।আমি অবাক বিস্ময়ে প্রতিটি ধাপের পরিবর্তন মনে মনে আঁকি।চোখ আঁকা হয়ে গেলেই বুঝতে পারি, শিউলির মোহ, রূপ,গন্ধ কেবলি বলে মা আসছেন তোমরা সাজো সবাই।প্রতিটি ঘরে ঘরে ধান সেদ্ধ করা,রাস্তায় অথবা উঠোনে শুকোতে দেওয়া হয়।,......খুব ভোরে উঠে ঢেঁকি তে ধান ভানে বাড়ির মেয়ে বউরা ...ঢেঁকুসকুর ঢেঁকুসকুর ঢেঁকি তে ধান ধান ভানে রে সুন্দরী চরণ তুইল্যা ঢেঁকিতে তাল তোলে রে .. আবছা আলো আঁধারের নরম ভোরের আলোতে গ্ৰামের দুর্গারা ভীষণ উচ্ছল তরঙ্গে নেচে ওঠে। দপুরের খাওয়ার পর শুরু হয় আরেক পর্ব,আখা বা উনুন গোবর জলে নিকিয়ে শুরু হয় নাড়ু মুড়কি নিমকি, খই, মুড়ি চালভাজা চিঁড়েভাজা.... সারা বাড়ি যেন সুগন্ধে সৌরভে মুখরিত । তবে যাই হোক আর তাই হোক আমি চুপ করে নতুন জুতো মাথার কাছে রেখে ঘুমোবোই ....ঘুম উঠে থেকে দেখছি মা কখন সরিয়ে রেখেছে।একটা বন্দুক পেলে আমার আর কিছু চাইনা।সেই মিষ্টি বারুদের গন্ধ ফট ফট ফটাস্ ... আর সেই সবে ধন নীলমণির কি যত্ন পোঁছা কেউ যাতে হাত না দেয় সে দিকে খেয়াল রাখা। গ্ৰামে বড়ো জোর দুতিনটে পুজো হতো কিন্তু সে আনন্দের পবিত্রতা ছিল অসীম। আমি শহরের পুজো বিয়ের পর থেকে দেখেই চলেছি কেবল এ বছর কলকাতা যেতে পারলাম না। নিভৃতে পান্ডব বর্জিত স্থানে পড়ে আছি .... আপাতত অতিমারী মুক্ত জীবন বিহঙ্গ কবে যে ডানা মেলবে কে জানে?
ও হ্যাঁ যা বলছিলাম, গ্ৰামে যাদের মাটির বাড়ি পুজোর সময় ওরা কেমন রঙিন আলপনায় রাঙিয়ে তুলতো ...ঐ সব রঙ কোথায় পেত কে জানে? আমাদের বাড়িতে মা সব কাজের বউদের শাড়ির সঙ্গে একবাক্স সাজার জিনিস দিত আলতা, সিঁদুর ,সেন্ট হিমানি স্নো,পাউডার , আর ওরা বলতো বাসনাতেল, মানে সুন্দর গন্ধ মাথায় মাখা তেল ।আমি ওদের সোনা রঙ আনন্দ ঝলমলে মুখ দেখেছি। বিজয়ার দিন ঠাকুর বাড়ি অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে দলে দলে লোকে প্রণাম করতে আসতো .....সবার জন্য যেন মহা ভোজের আয়োজন। কেউ ফিরিয়ে দিতে পারো আমার মাটির গভীরে শিকড়ের, প্রাণের ,আত্মার আত্মীয়তা কে? আমার ভালো লাগেনা মেকী সভ্যতা আধুনিক নিরন্তর মুখোশ পরা মানুষদের। আমি হাজার পাতা রেলগাড়ি হয়ে লিখে যেতে পারি আমার গ্ৰামের গল্প গাছা,আমার মেঠো গন্ধের গৃহ সুখ
শীতকালে দুধের সর আর ময়দা মিশিয়ে আমার দিদা মাখতো।ব্রাশ দিয়ে পায়ের গোড়ালি পরিষ্কার করত।সারা গায়ে গ্লিসারিন ওডিকোলন মাখতো।আর ছিল বসন্ত মালতী ,তুহিনা ....ঐ শিশি গুলো আমার ভারী পচ্ছন্দ ছিল। আমি বড্ড নিজের ব্যাপারে কুঁড়ে আর সময়ও পাইনা।আর একটা জিনিস আমিও বজায় রেখেছি নিভিয়া, বোরোলিন ....তবে মা বোরোলিন মাখালেই মুখ জ্বলতো কেন কে জানে? সকালে উঠেই নারকেল তেলের শিশি রোদে দিত মা।কী সুন্দর বরফের মত জমে যেত। এখন মাথায় তেল দিইনা গায়ে মাখি বডি ওয়েল। সর্ষের তেল মাখতাম আর ইটালিয়ান আলিভ ওয়েল দেখেছি তবে দাম বেশি তাই ব্যবহার বুঝে শুনে।দুপুর হলেই মায়েদের গোল হয়ে উল বোনা আর অল্প স্বল্প নিন্দেবান্দা।সারা দুপুর বাচ্চাদের খেলাধুলো চিৎকার।বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা লাইন দিয়ে টিকিট কাটা ব্যাগ ঘুছনো ...অবশ্যই ফাইনাল পরীক্ষার পর।
পিঠে পুলি পায়েস ,নলেন গুড় ... খেজুরের জিরেন রস। রোদে পিঠ দিয়ে পড়তে বসা যেখানে লেপ, বালিস রোদে সেখানেই বই খাতা,বেড়াল টাও চুপ করে বসে আছে। কাজের মাসির চিৎকার "ও বউ দি চা দাও গো শীত নাগছে যে,আইজ মেলা ঠান্ডা পড়িছে"।
ঘুম ভাঙতে চায়না চোখের পাতা জোড়া লেগে যেত কিন্তু এখন ওসব হয়না তো! নতুন সোয়েটারের বায়না ...ভুটিয়ার মেলা। কত অনুষ্ঠান,যাত্রা বিচিত্রা অনুষ্ঠান,স্কুলের স্পোর্টস ...সদলবলে পিকনিক ...গরম মাংসের ঝোল,বাঁধাকপির তরকারি চাটনি,গুড়ের রসোগোল্লা। তবে এই শীতেই ছাদে বড়ি দেওয়া হতো ,..সে এক উৎসবেরই সামিল তার যে কত নিয়ম!কমলালেবুর সুগন্ধ এই তিনমাস শুধু খাওয়া আর খাওয়া, আনন্দ মজা।
নতুন আলুর খোসা না ছাড়িয়ে মটরশুঁটি দিয়ে তরকারি আর লুচি। ধনেপাতা,টমেটো,কালোজিরে দিয়ে পাতলা মাছের ঝোল আহা! তিলের খাজা মোয়া কেউ খেয়েছেন কি জানিনা আমার খুব পচ্ছন্দ।তবে সব থেকে এখনো প্রিয় বড় দিনের ফ্রুট কেক উফফফফফ অসাধারণ। সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া মানা ছিল শুনিনি কোনো দিন । এই হল মধ্যবিত্তের সাধ আর সাধ্য । ক্রমশ......
0 Comments