জ্বলদর্চি

খর্জুর বীথির ধারে--৩/মলয় সরকার

খর্জুর বীথির ধারে

মলয় সরকার

(৩য় পর্ব ) তৃতীয় পর্ব

এখানে এখনও এই পাথরের উপরে মোজাইকের কাজ করা হয়। একটি ছোট মোজাইক ফ্যাক্টরী রয়েছে যেখানে মোজাইক শিল্পীরা একমনে কাজ করে চলেছেন।শিল্পীরা বেশির ভাগই সুন্দরী মেয়েরা।অবশ্য আমার মনে পড়ে গেল, আমাদের দেশে কিছুদিন আগেও আমাদের মা মাসীমারা কি অদ্ভুত কৌশলে কাপড়ের উপরে শাড়ির ছেঁড়া পাড়ের সুতো দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন নক্সী কাঁথার কাজ। আজও শান্তিনিকেতনে মেয়েরা শাড়ির উপরে বুনে চলেছেন কাঁথা স্টিচের কাজ। এই সব সুন্দর শিল্প কলা রক্ষার তো কোন নির্দিষ্ট প্রচেষ্টা নেই। সবই হারিয়ে যাচ্ছে বা যাবে কালের প্রভাবে।যেমন হারিয়ে গেছে মসলিন শিল্প, বালুচরী বা জামদানীও আজ মৃত্যুমুখে—

পাশেই একটি প্রদর্শনী এবং বিক্রয় কেন্দ্র। নানা রকম পাথরের কাজ, মূর্তি, দেওয়ালে ঝোলানোর সুন্দর সুন্দর মোজাইকের নিখুঁত ফটো , ইত্যাদি বহু জিনিস বিক্রী হচ্ছে। দেখে মনে হয়, সবই নিয়ে নিই। কিন্তু ঐ দাম, নিয়ে যাওয়ার অসুবিধা ইত্যাদি নানা রকমের বাধায় পড়ে শেষে একটি উটপাখীর ডিমের উপর আঁকা  সুন্দর শৌখিন জিনিস নিলাম স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে।

এখানে এসে আমার সেই বাইবেলের যুগে পড়া মোজেসের কথা গুলো মনে হচ্ছিল।এই এক মানুষ মোজেস, যিনি আজকের ইসলাম, খৃষ্ট ধর্ম , ইহুদী ধর্ম ইত্যাদি নানা ধর্মেই সম্মানিত । তাঁর জীবনও বড় অদ্ভুত। চোখের উপর দেখতে পাচ্ছিলাম, দূরে জেরুজালেম, ভাসছিল বেথলেহেমের গোয়ালে শিশু যীশুর জন্ম । আমি যেন এক দু’হাজার বছর আগেকার পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছিলাম। ইতিহাস যেন আমার সামনে টাইম মেসিনে চেপে ফিরে আসছিল।  অমি দিব্য চক্ষে অনুভব করছিলাম সেদিনের সেই প্যালেস্তাইন, ইস্রায়েলের সমাজকে। রাজা হেরডের সময়ের সেই  সমস্ত জায়গা ।

চারিদিকে পরিস্কার আকাশে চকচকে রোদের আলোয় নীল চাঁদোয়ার তলায় আমরা দাঁড়িয়েছিলাম এক ঐতিহাসিক পটভূমিতে।
এখান থেকে গেলাম কাছেই মাডাবায়। মাডাবা বা মাদাবা আসলে একটি বড় শহর। আমরা মাডাবার যে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রাচীন চার্চ, সেই সেন্ট জর্জ চার্চে গেলাম। এই চার্চটি একটি গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ।এটি প্রথম সম্ভবতঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরী হয়েছিল।তার উপরে বর্তমান চার্চটি ১৮৯৬ সালে তৈরী হয়েছিল। এখানে রয়েছে এক বিশাল মোজাইক ম্যাপ।এতে নাকি প্রায় ২০ লক্ষ পাথরের টুকরো ব্যবহার হয়েছিল। এটি যদিও আগুন ইত্যাদিতে অনেকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল , পরে আবার এটি  কিছুটা পুনরুদ্ধার  করা হয়।এটির আসল মাপ ছিল ১৫.৬ মি/ ৬ মি।(৯৪ বর্গ মি), যেটির মাত্র এক চতুর্থাংশ নাকি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এটিতে তৎকালীন ঐ অঞ্চলের সমস্ত জায়গার সঠিক অবস্থান দেখানো আছে। ফলে এই ম্যাপটি ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।শুনেছি গত ২০১০ সালেও এই ম্যাপ অনুযায়ী মাটি খুঁড়ে অনেক কিছু জানা গেছে।এই ম্যাপটিই নাকি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ম্যাপ এবং ভীষণ প্রয়োজনীয় একটি তথ্য সেই যুগের সম্পর্কে।এতে সেই যুগের লেবানন থেকে নীল নদ উপত্যকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে।এটি অনেকবার ভুমিকম্প , আগুন ইত্যাদিতে নষ্ট হয়েছে এবং আবার তাকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।

চার্চের ভিতরটি বেশ সুন্দর।অসংখ্য সুন্দর সুন্দর মোজাইকের ছবি, সবই যীশুখ্রীষ্ট সম্পর্কীয় বা বাইবেলের ছবিতে চার্চটি সাজানো। একেবারে সামনেই রয়েছে কয়েকটি বেশ ঝুলন্ত  সোনালী রঙের ঝাড় লণ্ঠন। উপরে দেখা যাচ্ছে দোতলায় একট ব্যালকানি ধরণের বারান্দা, যেটি থেকে নীচের হলের ভিতরে জমায়েত মানুষদের দেখা যায়। দু পাশে ধর্মকথা শোনানোর জন্য রয়েছে দুটি মাউথপিস স্ট্যাণ্ড সমেত।গোটা চার্চটির মধ্যেই একটা ভীষণ ভাল পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।ভিতরটি বেশ ঝকঝকে ও ছবিগুলির জন্য বর্ণবহুল।

ভিতরটি এত সুন্দর হলেও চার্চটির বাইরের গঠন একটু অন্য রকম, আমাদের দেখা সাধারণ চার্চের মত নয়। এখানকার পাথর দিয়েই যেন তৈরী, দেওয়ালেও বিশেষ কোন কারুকাজ নেই, যেমনটি হয়ে থাকে অন্যান্য চার্চে। একেবারে প্লেন ঝকঝকে চৌকো চৌকো পাথরের তৈরী। বাইরের দেওয়ালের রঙ অনেকটা বেলুড় মঠের মত।

এখানে  আরও অনেক চার্চ আছে, কিন্তু আমাদের সময় একটু কম বলে আর খুব বেশি সময় এখানে দিলাম না। তবে আমরা আর একটা জায়গায় গেলাম, যেটি ছড়ানো ছিটানো একটি ‘খণ্ডহর’ এর মত হলেও, যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিন্তু ভীষণ বেশি। এই অঞ্চলটা একটা জনমানবহীন রুক্ষ পাহাড়ী মরুভূমির মত।এখানে সমস্ত বাড়ি গুলিই কেমন যেন শুধু পাথরের একটা বাক্স মনে হয় । পাহাড়ে গায়ে গায়ে এখানে ওখানে কিছু এই ধরণের বাড়ি আছে আর আছে কিছু পাইন গাছ ধরণের গাছের ঝোপ এবং শুকনো ঘাসের ছোট ছোট ঝোপ।

আমার মনে হল, যীশু খ্রীষ্ট বা হজরত মহম্মদ তো এই ধরণের মাটিতেই জন্মেছিলেন আর এই সমস্ত জায়গায় চতুর্দিকে যে দরিদ্র অশিক্ষিত রাখাল , পশুপালক এই সমস্ত উপজাতি রয়েছে তাদের মধ্যেই তো বড় হয়েছেন, কি ভাবে তাঁরা এত উন্নত মনের মানুষ হলেন, যে, আজ সারা পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ তাঁদের কথা মানছে, এত শিক্ষার অগ্রগতির পরেও! কি হৃদয়ানুভূতি ছিল তাঁদের!! কি প্রচণ্ড জ্ঞান এবং বাস্তব বোধ!! আজ কি কোন মানুষ আর জন্মাচ্ছেন সেই রকম! ধর্মগুরুরা বোধ হয় এরকমই হন, তাঁদের খুব শিক্ষিত বলে তো খুব শোনা যায় না কোথাও। বেশির ভাগই স্বশিক্ষিত, তথাকথিত অশিক্ষিত বা অর্ধ শিক্ষিত।তবু আজকের যাঁরা শিক্ষিত পণ্ডিত তাঁরা কেন এঁদের শ্রদ্ধা করেন!  আসলে এঁরা জন্মগত ভাবেই বোধ হয় হৃদয় বোধে উচ্চশিক্ষিত। এটাই আসল শিক্ষা, যা কেতাবী বিদ্যার চেয়েও অনেক উঁচুতে।

 জায়গাটাকে সম্যক উপলব্ধি করছিলাম। যাঁদের এই মরুভূমির সম্বন্ধে ধারণা নেই, তাঁরা আমার লেখা থেকে কতটা বুঝতে পারবেন জানি না। তবে যদি সব ছবি তুলে ধরতে পারতাম, তাহলে হয়ত কিছুটা ধারণা হত। এখানকার মাটি দেখলেই মনে হয়, কি কঠিন এঁদের জীবন সংগ্রাম।না কোন কাছাকাছি চাষের জমি, না কোন দোকান পত্তর, না শ্যামলিমার ছবি। এই সমস্ত অঞ্চলে মানুষ থাকে কি করে বুঝেই পাই না।

গিয়ে পৌঁছালাম শোবাক দূর্গে (Shobak Castle) । এই দুর্গটি তৈরী করেছিলেন ১১১৫ খ্রীষ্টাব্দে ক্রুশেডর রাজা প্রথম বল্ডউইন ।  তবে পরবর্তী কালে মামলুকদের হাতে এটি আসার পর এর অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়। এটি একটি পাহাড়ের মাথায় রয়েছে। এর উপর থেকে দেখলে বহুদূর পর্যন্ত উঁচু নীচু মরু পাহাড়ের বিস্তৃত রুক্ষ অঞ্চল চোখে পড়বে।
এই অঞ্চলটিকে, তথ্য বলছে তুলনামূলকভাবে উর্বরা। কিন্তু আমার, চোখে দেখে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হল।
ক্রুশেড বললেই অনেকের চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই সমস্ত, মধুযুগের সাহসী যোদ্ধাদের  কথা, যারা মুসলিমদের কাছ থেকে তাদের পবিত্র ভূমিকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধযাত্রা করত, কিংবা সেই সমস্ত নাইটদের কথা যারা শৌর্য বীর্যে এককালে খুব নাম করেছিল ইউরোপে, নারীর সম্মান রক্ষায় কিংবা বিপদাপন্নের কি আর্তের সেবায় জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করত না। আবার কারোর কারোর চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে সেই বিখ্যাত নাইট ডন কিহোতের ছবি। আর ক্রুসেড হল মধ্য যুগের ইউরোপীয়ান চার্চ গুলির নেতৃত্বে বা প্ররোচনায় যে ধর্মযুদ্ধ হয়েছিল ১০৯৫-১২৯১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করতে, সেই সমস্ত যুদ্ধ।রাজা শার্লেমেনের কথা আমরা ইতিহাসে পড়েছি।এঁরাই প্রকৃতপক্ষে খ্রীষ্ট ধর্মকে, সেই যুগে, উদ্ধার করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।এঁরা ধার্মিক খ্রীষ্টান তীর্থ যাত্রীদের পথে আপদে বিপদে রক্ষা করতেন।

ইনিও সেই রকম এক ক্রুসেডার।এই দুর্গ থেকে মোটামুটি ভাবে নজর রাখা হত এবং শাসন করা হত ইজিপ্ট থেকে সিরিয়া পর্যন্ত।শুধু তাই নয়, এখান থেকে, এ অঞ্চলের ব্যবসায়ী বা মুসলিম ধার্মিক যাঁরা তীর্থ যাত্রা করতেন মক্কা বা মদিনা তে তাঁদের উপর কর নেওয়াটাও চলত। তবে এই দুর্গও বেশ জলকষ্টে ভুগত, অনেকটা ফতেপুর সিক্রীর মত অবস্থা।সেই জন্য এখানে কিছু গোপন কুয়াও তৈরী করা হয়েছিল। মুসলিম তীর্থযাত্রীদের উপর কর নেওয়ার কথা মনে হতেই আমার মনে হল, তাহলে আমাদের দেশের হিন্দুদের উপর যে কর চাপানো হত একসময় , সেই জিজিয়া করও তাহলে বিপরীত দিকে এখানেও ছিল।এখানে খ্রীষ্টানরা কর নিত মুসলমান তীর্থযাত্রীর উপর।এটি পরে ১১৮৯ সালে মুসলিমদের হাতে চলে যায়।

 এ অঞ্চলে নাকি এরকম দুর্গ আরও ছিল। তবে এখানে এখনও খনন কার্য সম্পূর্ণ হয় নি।অনেকখানিই বাকী। 
এখানে আপাততঃ, বলে না দিলে বোঝা খুব মুস্কিল যে আরও কি কি ছিল। আমাদের রায়েধ গাইড হিসাবে যতই বড়াই করুক, বা রাস্তা সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে দিতে আসুক, ও তো আর ‘ট্রেইণ্ড গাইড’ নয়। ওর যা কিছু জ্ঞান তা কিছু শুনে, কিছু আন্দাজের অর্ধজ্ঞান। আমাদের তাই অনেক জায়গায় অন্য সাহায্য নিতেই হয়েছিল। কিছু লেখা, কিছু চোখে দেখে বোঝা , কিছু পড়া ইত্যাদি। এখানে আমরা কোন বাঁধা গাইডও পাইনি। তবে যা দেখেছি একটু বলি।

এর পর চলুন পরের পর্বে–

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments