জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। আঠাশ /শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। আঠাশ

শুভঙ্কর দাস 

"কর্ম করি যে হাতে লয়ে কর্ম বাঁধন তারে বাঁধে
ফলের আশা শিকল হয়ে জড়িয়ে ধরে জটিল ফাঁদে
তোমার রাখী বাঁধো আঁটি,সকল বাঁধন যাবে কাটি
কর্ম তখন বীণার মতো বাজবে মধুর মূর্ছনাতে।"


কুলির কাজ করতে চাই 

কী? কুলি!

হ্যাঁ,আমার খুব টাকার দরকার, আমার বাচ্চারা না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে, এভাবে তো চলতে পারে না!

বাচ্চারা?

একটা জাতীয় বিদ্যালয় গড়েছি,সেটি আবাসিক,তার জন্য টাকা চাই,হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে করে প্রচুর লোকজন ওঠা-নামা করে,তাদের মালপত্র বহন করলে ভালো টাকা রোজগার করতে পারব,তুমি লাইসেন্সটা দাও

হাওড়া স্টেশনের রেলওয়ে অফিসে কথোপকথন হচ্ছে কুমারচন্দ্র ও শ্যামসুন্দরের।
শ্যামসুন্দর পূর্ব রেলওয়ে ট্রাফিক সুপারিন্টেন্ডেন্ট। তিনি কুমারচন্দ্রের সঙ্গে একসঙ্গে কলেজে পড়েছেন।মেধাবী এবং ধী শক্তির অধিকারী কুমারচন্দ্র বন্ধুদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিল।কুলিগিরির কথা শুনে শ্যামসুন্দর অবাক হয়ে গেলেন।

সে তো বুঝলাম,কিন্তু সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের মেধাবী ছাত্রের টাকা রোজগারের কুলিগিরি ছাড়াও তো কাজ আছে।

কী? 

ব্যবসা 

তার জন্য পুঁজি লাগে,আমার নেই, আমি কুলিগিরি করতে পারব,স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যদি অন্যের মোট মাথায় করে বইতে পারতেন,সেখানে আমি তো তুচ্ছ, 

কিন্তু বিদ্যসাগর তো লোকশিক্ষার জন্য ওরকম করেছিলেন

ঠিক লোকশিক্ষা,আমি তো সেই খান থেকেই শিক্ষা পেয়েছি, অন্যের ভালোর জন্য কোনো কাজই ছোট নয়।

কিন্তু কুলিগিরি করে যে রোজগার হবে তাতে কি বিদ্যালয় বাঁচবে! 

মানে? 

তুমি কি ভাবলে হাওড়া স্টেশনে কুলির অভাব! হাঁক পাড়লে লাইন লেগে যায় কুলির, তাদের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকাটা মুসকিল।তার চেয়ে সহজ উপায় ব্যবসা করা

কিন্তু পুঁজি

সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে,আগে শোনো না বন্ধু ব্যবসাটা কী?

বলো

কলকাতার চেয়ে বারুইপুর,যাদবপুর এইসব অঞ্চলে র কাঁচা শাকসবজির দাম বেশ কম, ঐসব অঞ্চল থেকে মাল তুলে নিয়ে এসে কলকাতায় বিক্রি করলে লাভের মুখ দেখা যাবে।আমি রেলে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেবো,কোনো চিন্তা করো না কুমার। 

আচ্ছা, এতো ভালো কথা,তাই চেষ্টা করি তাহলে, চলি এখন,পুঁজি জোগাড় করে জানাব।

আরে উঠছ কোথায়?  মুখ দেখে বুঝতে পেরেছি, সকাল থেকে কিছু পেটে পড়েনি,এই দুপুরবেলা, নিজের বন্ধুকে কিছু না খাইয়ে ছাড়ি,তাহলে জেভিয়ারদের কাছে একদিন মুখ দেখাতে পারব না! এসো, একসঙ্গে ক্যান্টিনে ভাত খাই।

তোমাকে এইভাবে বিড়ম্বনায় ফেলতে লজ্জা হয়,  সংকুচিত হয়ে বললেন কুমারচন্দ্র।

সত্যি কুমারচন্দ্র ক্ষুধার্ত। কিন্তু নিজের জন্য মুখে ফুটে কোনোদিন তিনি চাইতে শেখেননি।আর ক্ষুধার কথা,তিনি এক অদ্ভুত মানুষ,যখন খেতে পাবেন এমন ভাত খাবেন,হাঁড়ি উলটিয়ে, সামান্য একটু তরকারি বা ডাল,কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা, ব্যাস আধ সের চালের ভাত নস্যি।আবার যখন খেতে পান না,মুখে কোনো বিরক্তি বা কষ্ট নেই। চার পাঁচদিন খেলেন না!
কেউ যদি দয়া করে একমুঠো মুড়ি বা চিড়া দেয়,তাই খেয়ে শুয়ে পড়েন।অথবা খুব ক্ষিধে পেলে ঢকঢক করে তিন-চার গ্লাস জল খেয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন।কোনোদিন কাউকে একটা পয়সা ধার চাননি অথবা কাউকে খাওয়ার জন্য হাত পাতেননি! 
অথচ সেই লোক বিদ্যালয় বাঁচাবে বলে কুলিগিরি করে টাকা রোজগার করতে মরিয়া।

ভোররাতে অনন্তপুর থেকে বেরিয়ে  হেঁটে এসেছেন খেয়াঘাটে।তারপর লঞ্চ করে কলকাতায় উপস্থিত হয়েছেন।
এখানে থাকবেন কোথায়?
প্রথমে ভাবলেন বালিগঞ্জে মুরলিধর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহে গিয়ে উঠবেন।তিনি বার বার হাত ধরে বলে দিয়েছিলেন,কলকাতা গেলেই তাঁর বাড়িতে যেন অবশ্যই যান।কিন্তু কুমারচন্দ্র সংকোচ বোধ করলেন।সক্রিয়ভাবে কংগ্রেস করার ফলে তিনি যেখানেই যান,যাঁর সঙ্গে কথা বলেন,তাঁকেই ইংরেজ পুলিশ সন্দেহের চোখে দেখেন। তাই কুমারচন্দ্র মুরলিধরের গৃহ এড়িয়ে গেলেন।অকারণে তাঁর জন্য বিপদে কেউ পড়ুক,এটা তিনি চান না।
শেষে উঠলেন,৮১ নং রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের কংগ্রেসকর্মীদের আস্তানায়।
এখানে যে কেউ কংগ্রেসকর্মী কলকাতায় এসে থাকতে ও খেতে পেত।
অবশ্য তার জন্য সাধ্যমতো চাঁদা দিতে হত।কেউ কেউ তাও দিতে পারত না!
যে রুমে কুমারচন্দ্র উঠলেন,সেই রুমে থাকতেন কংগ্রেসের অন্যতম নেতা নিকুঞ্জবিহারী মাইতি।

সবই তো শুনলাম কুমার, এখন একটাই উপায়,গায়ে গতরে খেটে টাকা রোজগার করা, বললেন নিকুঞ্জবিহারী।

সে খাটতে আমার কোনো কষ্ট নেই, বলুন কী করতে হবে? উত্তরে বললেন কুমারচন্দ্র। 

তুমি তো মাস্টারি করতে, তাই করো না

না,ওখানে ঢুকলে হুটহাট করে বেরোতে পারব না,তাছাড়া আমাদের মতো কংগ্রেসকর্মীদের এমন কাজ করা উচিত,যখন ইচ্ছে তা ছাড়তে পারি,যাতে গান্ধিজি অথবা বীরেনদা ডাক দিলে তখনই সব ছেড়েছুঁড়ে পথে নামতে হবে পারি।

তা বটে 

আপনি কি করছেন?

আমি কাগজ ফেরি করি সকালে,এখন বেশ কয়েকটি পেপার বের হয়, বন্দেমাতরম, যুগান্তর এবং এই সময় একটা নতুন পেপার বেরোচ্ছে, তার নাম, আনন্দবাজার, দেড়-দুঘন্টায় বেশ রোজগার হয়,কিন্তু তিনমাস খাটার পর হাতে পয়সা আসে। তারপর চার-পাঁচটা ঘরে টিউশনি পড়াই,সে আবার মাস গেলে বেতন দেয় না, এইভাবে গুঁজেমুজে চলছে আর কি!

কিন্তু আমার নিজের চলাটায় কোনো আগ্রহ নেই, আমাকে বিদ্যালয়টা বাঁচাতে হবে, তার জন্য টাকা চাই। 

তাহলে ভোর হলেই সোজা চলে যাও হাওড়া স্টেশনে, তোমার গায়ে দারুণ শক্তি,মোট বইবে আর হাতে পাবে কাঁচা টাকা 

তাই? 

হ্যাঁ,চলে যাও, এখন তো বাসায় কিছু খাবারদাবার নেই, ঘর থেকে কিছু খেয়ে-টেয়ে বেরিয়েছিলে তো?

মৃদুস্বরে কুমার বললেন,হ্যাঁ,মানে আমার ক্ষিদে নেই 

বলেই শুয়ে পড়েছিলেন। 

সকাল হতে পায়ে হেঁটে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে কলেজ-সহপাঠী শ্যামসুন্দরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

রেল-ক্যান্টিনে পেট ভরে ভাত-ডাল-মাছ সহযোগে তৃপ্তির আহার করল কুমারচন্দ্র।
তাঁর খাওয়া দেখে শ্যামসুন্দর মনে মনে খুবই আনন্দ পেলেন।
মুখে বললেন,আমাদের রেল-ক্যান্টিনে ভালো রান্না হয় জানতাম, কিন্তু আজ তোর খাওয়া দেখে বুঝলাম,এ খাবার একেবারে অমৃত।কি বলো! বলেই হেসে উঠল শ্যামসুন্দর। 

কুমারচন্দ্রও হেসে উঠলেন।

না বন্ধু, হাসি নয়,যখনই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে,এইরকম দুপুরবেলাই আসবে,তাহলে রেল-ক্যান্টিও ধন্য হবে,এইরকম ভোজনরসিককে পেয়ে! 

বিদায়ের সময় শ্যামসুন্দর সহসা পকেট থেকে একশো টাকা বের করে কুমারচন্দ্রের হাতে গুঁজে দিলেন।

কুমারচন্দ্রের কিছুই বলার আগে শ্যামসুন্দর বলে উঠলেন,"বন্ধু, এই টাকাটা তোর জন্য দিলে আমি নিশ্চিত তুই এই টাকা মরে গেলেও নিবি না,কিন্তু আমি এটা দেশের জন্য দিলাম,আমরা তো সবাই তোর মতো পথ বেছে নিইনি,বেশ ইংরেজ রাজসরকারের পায়ের তলায় চাকরিবাকরি গুছিয়ে বহালতবিয়বে আছি,আমাদের তো তোদের দেখেও চোখ খোলে না,অথচ দেশ যদি স্বাধীন হয়, সেদিন আমিও তার আনন্দের ভাগ নেব,কিন্তু কাজের বেলায় কী করলাম,না, শূন্য!  তাই  না?

কুমারচন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন,বুঝলাম,কিন্তু আমি যে পথে নেমেছি,সেই পথ থেকেই এই অর্থ সংগ্রহ করে নেব।এভাবে নিলে বন্ধুত্বের দামটা কম হয়ে যায়।তুমি রেলে সুযোগ করে দিচ্ছ,এতেই আমি খুশি,কিন্তু টাকা নিতে পারব না
বলেই টাকাটা শ্যামসুন্দরের পকেটে রেখে দিল।

আসছি,এরপর এখানে এলে তোমার সঙ্গে দেখা করব,কারণ তুমি সত্যিকারের বন্ধু,ক'জনের ভাগ্য এমন জোটে! বলেই কুমারচন্দ্র বেরিয়ে গেলেন।

তাঁর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শ্যামসুন্দর আপন মনে বলে উঠলেন, সত্যি তো কুমারের বন্ধু, ক'জনের ভাগ্যে জোটে!

শুরু হয়ে ব্যবসা।
পূর্বতন বিদ্যালয়ের যেটুকু বকেয়া বেতন ছিল, তা সংগ্রহ করে কুমারচন্দ্র ট্রেনে করে বারুইপুর চলে গেলেন।সেখানে নেমে স্টেশনের গায়ে হোগলা-খড়ের চালা করা সব সবজি মাণ্ডি থেকে সবজি কিনে ভেন্ডারে চড়ে কলকাতায় ফিরে এসে বিক্রি করতে লাগলেন।
কয়েক মাস করার পর বুঝতে পারলেন শাক-সবজির বিক্রি করার পর লাভ কিছুই থাকছে না! বরং উল্টে মূল টাকা গচ্চা যাচ্ছে। 
কী হল ব্যপারটা? 
একদিন ভেণ্ডারে সবজির বস্তার পাশে বসে আলোচনা হচ্ছে। কুমারচন্দ্র ও নিকুঞ্জ। 

এতো চেষ্টা করছি,কিছুতেই লাভের মুখ তো দেখতে পারছি না! হতাশ গলায় বলে উঠলেন কুমারচন্দ্র।

কী করে পাবে?

কেন?

আমরা তো মাল কিনছি ভুল জায়গায় 

মানে? খোদ চাষিদের কাছ থেকে তো শাকসবজি নিচ্ছি 

না,কুমার,আমরা এতোদিন যাদের চাষি ভেবেছি, তারা আসলে ফড়ে,অতি কম দামে চাষিদের কাছ থেকে কিনে এনে আমাদের কাছে বিক্রি করে,ফলে যত লাভের গুড় ফড়েগুলো খায়,আমাদের কপালে কয়লা

সত্যি, তাই হচ্ছে?

তা আর বলছি কি!

কুমারচন্দ্রের চোখ লাল হয়ে গেল।মুখে শুধু বললেন,ঠিক আছে,কাল ভোরে দেখা যাবে।

পরেরদিন ভোর ভোর ট্রেন ধরে কুমারচন্দ্র বারুইপুর চলে গেলেন।স্টেশনের পাশে ফড়েদের কাছে না গিয়ে তিনি গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন।পথ যেখানে শেষ, সেখানে মাঠের ওপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন গ্রামের ভেতরে। একটি পুকুরের পাশে শাক-সবজির খেত দেখতে পেলেন। সেখানে একজন বৃদ্ধ লোক কাজ করছিল। লোকটির খেতবাড়িতে নানারকমের সবজি ফলে আছে।পুকুর থেকে জল এনে হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছিল।হঠাৎ জলে পিছল খেতের রাস্তার ওপর বালতিসহ পড়ে গেল।
কুমারচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে তুলে ধরলেন।

তোমার কোথায় লাগেনি তো? কাতরভাবে জিজ্ঞেস করলেন কুমারচন্দ্র।

লোকটি একটু আর্তনাদ করে উঠল।

হ্যাঁ,কোমরে হালকা ব্যথা করছে।দাঁড়াতে পারছি না গো, আল্লা একি হল!

আচ্ছা,আমি ধরছি,চিন্তা করো না, বলে কুমারচন্দ্র সেই লোকটিকে ধরে ধরে একটি গাছের ছায়ায় বসাল।

তারপর সেই লোকটিকে অবাক করে দিয়ে নিজেই পুকুর থেকে জল তুলে গাছগুলোকে জল দিতে লাগল।

কে বাবা তুমি?

আজ্ঞে, আমার নাম কুমার 

তা এখানে কী সন্ধানে? 

এই শাক-সবজির সন্ধানে। 

কোথা থেকে আসছ গো?

কলকাতা

ওহ্, তুমি তো কলকাতার বাবু, তা এইখেতিবাড়ি তো ভালোই জানো! 

তা জানব না,আমি তো চাষার ব্যাটা।মেদিনীপুরের ছেলে আমি।

আচ্ছা,এদিকে শোনো বাবা,এই সামনে আমার কুটির,একটু নিয়ে যেতে পারবে? 

কেন পারব না?

কিন্তু কাছে আসতেই লোকটি হাত দিয়ে থামিয়ে বলল,মুই হলাম ফজল,মুসলমান, তুমি কি বামুনের ব্যাটা নাকি,তাহলে মোর ঘরে গেলে তো!

কুমারচন্দ্র হেসে ফেললেন,তুমি চিন্তা করো না চাচা,আমি এই  মাটির ব্যাটা,আমার কোনো জাত যায় না!

বলে কুমারচন্দ্র সেই বৃদ্ধ চাষীকে ধরে ধরে তার কুটিরে নিয়ে গেল।পুকুরপাড়ের শেষ তার মাটি-খড়ের ঘর।

ফজল ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে বলে উঠল,ফরিদা, ফরিদা, কোথা মরলি?

কুমারচন্দ্র বৃদ্ধকে একটি সুতোর খাটিয়া শুইয়ে দিল।সেই সময় ঘরের ভিতর থেকে একটি যুবতী মেয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। প্রশ্ন করল,কী হল আব্বু?

ও কিছু নয়, তুই একে কিছু খেতে দে 

না থাক,আমার ক্ষুদা নেই, আমি একটু পরেই কলকাতা ফিরে যাবো,সেখানে কাজ আছে অনেক

সে কি!  এই বলল মাটির ব্যাটা,জাত যাবে না,তাহলে চাটি মুড়ি খেতে ভয়!

না, মানে আমি শাকসবজি তুলতে এসেছি, তারপর ট্রেন আছে দুপুরে, ঠিক সময়ে না পৌঁছাতে পারলে ব্যবসা করব কী করে?

আচ্ছা, বুঝেছি,আগে খেয়ে নাও,ফরিদা, মা রে কিছু খেতে দে,সক্কালবেলা মেহমানকে খালি মুখে ফেরাতে নেই। 

কিন্তু আব্বা, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?

না, একটু কোমরে লেগেছে, তুই খেতে দে
মুড়ি খেতে খেতে কুমারচন্দ্র তাঁর আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করল।
তা শুনে বৃদ্ধ বলে উঠল,মুই তো শাকসবজি সরাসরি বিকাইতে পারি না,মুই কেন,এ তল্লাটের কেউ নয়, কাশী,মুরাই, জগাই,ধনঞ্জয়,রফিক,আলম কেউ পারবে না।

কেন?নিজের হাতের সবজি নিজেই বিক্রি করতে পারবে না!

না,জমিদারের মানা আছে,তার ওপর আছে গোরা পুলিশের মার, মোরা বড় অসহায় 

তাহলে?

মোদের বলা হয়েছে, শাক-সবজি  সব রেডি করে রাখতে,জমিদারের লোকজন আসবে,তারাই পয়সা দিয়ে মাল নিয়ে চলে যাবে

কেমন দাম?

তারপর বৃদ্ধ যে দাম বলল,তা শুনে সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল।কলকাতার যা দাম সবজির,তার চেয়ে তিনগুন কম দাম পায় চাষি,যার পরিশ্রমে ও কষ্টে এই ফসল।এতো মারাত্মক অন্যায়।

তোমরা কি জানো? তোমাদের যে দাম দেওয়া হয়,তার চেয়ে কত কমে পয়সা দেওয়া হয়, কত ঠকানো হয়! 

আল্লা তালার মর্জি 

কিন্তু তা বলে এই ধরণের অন্যায় মেনে নেবে? নিজের মুখের রক্ত তোলা ফসল এইভাবে ঠকিয়ে নিয়ে যাবে।

বৃদ্ধ করুণ দৃষ্টিতে বলে উঠল,যার ঘরে সোমত্ত মাইয়া থাকে,তাকে সব অন্যায় মেনে লিতে হয় গো!

কুমারচন্দ্র লক্ষ্য করলেন,ফরিদা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি সহসা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,আচ্ছা চলি,একটু সেঁক নাও কোমরে,ভালো হয়ে যাবে। 
বলেই নিজের পকেট থেকে দশটাকা বের করে বৃদ্ধের হাতে গুঁজে দিলেন।

বৃদ্ধ এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল।বলে উঠল,ফরিদা,মা রে, এই বাবুকে চটে কিছু সবজি বেঁধে দেরে 

না,আমি সবজি নেব না,তবে এমন একটা দিন আসবে,সেদিন চাষিরা নিজেদের জমির ফসল জমিদারের নয়,নিজের অধিকারে থাকবে,তার ফসল, সেই ঠিক করবে কাকে বেচবে আর কাকে বেচবে না!

বৃদ্ধ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।মুখে উচ্চারণ করল,এমন দিন আসবে? 
তারপর বিড়বিড় করে বলল,হয়তো আসবে,যদি আল্লাতালার মর্জিমাফিক কেউ মোদের বাঁচাতে আসেন! 

কুমারচন্দ্র চলে যাচ্ছিলেন।সেই দিকে ফরিদা ও বৃদ্ধ ফজল এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল।

নিজের দেশের অবস্থা, দেশের সাধারণ গরীবগুর্বো চাষির অবস্থা ভেবে কুমারচন্দ্র স্থিরভাবে ঘুমোতে পারলেন না!
রাতে উঠে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন।কী করবেন খুঁজে পেলেন না! একদিকে বিদ্যালয় থেকে চিঠি লিখেছে সূর্যকান্ত।তাঁর দাদা দেবেন কিছু টাকা বিদ্যালয় চালানোর জন্য দিয়ে গেছেন,আপাততঃ সেই টাকায় কোনোরকমে চলছে।
অতি দ্রুত বিদ্যালয় কক্ষ মেরামতি ও প্রতিদিনের খাদ্য সংগ্রহের যদি একটা ব্যবস্থা হয়,তাহলে খুব  ভালো হয়।

কী হল কুমার? অত কী চিন্তা করছ? জিজ্ঞেস করলেন নিকুঞ্জ। 

কুমারচন্দ্র মৃদুস্বরে বললেন,সবজি ব্যবসা করব না,এখানে বিস্তর গণ্ডগোল। অন্য উপায় দেখতে হবে।

কী উপায়?

ভাবছি একটা স্থায়ী দোকান দেবো,তাতে স্থিরভাবে টাকা রোজগার করা যাবে

সে ঠিক আছে, তার জন্য পুঁজি চাই

তার জন্য আপনি যা করেন,তাই কাল থেকে করব

কী? খবরের কাগজ ফেরি! 

হ্যাঁ,আর দুপুরবেলা সাবান বিক্রি করব।

বেশ,সকালে খাটতে হলে,এখন ঘুমোতে হবে

আমার ঘুম আসছে না!

তা আসবে কী করে? আস্তানা জুটেছে মন্দ নয়, রাতে এসে দেখবে,ভাত-তরকারি সব শেষ, তা শুধু জল খেলে কি ঘুম আসে!

ওতে আমার কোনো কষ্ট হয় না।

আরে বুঝলে না ভায়া,অতি দ্রুত কিছু চাঁদাপত্র তুলে না দিলে এই আস্তানা ললাটে উঠবে 

ওহ্, আমার তো কিছুই দেওয়া হয়নি, কালই কিছু মেস-ম্যানেজারকে দিয়ে দেবো 

বেশ, শুয়ে পড় ভাই,কাল সূর্য ওঠার আগে পথ নামতে হবে 

সেই মতো কুমারচন্দ্র দেশি সাবান ও পেপার ফরি করে পয়সয়া রোজগার করতে লাগলেন।

বেশ কিছুদিন পরে।

কিছু টাকা জমতেই আমহার্স্ট স্ট্রিটে চায়ের দোকান দিলেন।কুমারচন্দ্র ফেরি করার সময় লক্ষ্য করেছিলেন,কলকাতার লোকেরা আর কিছু খাক না খাক চা অবশ্যই খায়।এই ব্যবসায় তাড়াতাড়ি লাভ করা যাবে।

নিকুঞ্জ বলে উঠলেন,যে নিজে এক- কাপ চাও কোনোদিন মুখে তোলেনি,সে কি চায়ের ব্যবসায় দাঁড় করাতে পারবে?

দেখা যাক,বলে কুমারচন্দ্র এগিয়ে গেলেন।একজন কংগ্রেসকর্মী একটু লক্ষ্য নজর রাখত,আর সব কাজই কুমারচন্দ্র নিজের হাতে করতেন।
একদিন একটা ঘটনা ঘটল।
চা-দোকানের সামনে কয়েকজন চা খাচ্ছিল।সেই সময় সুটবুট পরিহিত একটি যুবক এসে দাঁড়াল। সে চায়ের অর্ডার দিয়ে বেঞ্চিতে পারে তুলে বসল।সেই সময় কুমারচন্দ্র চা নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হল।
সে কুমারচন্দ্রকে দেখে চমকে উঠল,বলে উঠল,স্যর,আপনি! 

কুমারচন্দ্র তাকে চেনার চেষ্টা করলেন। 

কে বলতো?

আজ্ঞে, আমাকে চিনতে পারছেন না! আমি ঘোষ,আপনার ছাত্র, আমি একবার ক্লাসে চুরি করেছিলাম বলে,আপনি একটা ছড়া বানিয়ে বলেছিলেন,ওরে ঘোষ/ এতো দারুণ দোষ!
মারের চেয়ে আপনার ছড়া আমাকে বদলে দিয়েছে। 

বলেই ছাত্রটি কুমারচন্দ্রের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।
আশেপাশে যারা চা-পান করছিল, তারা ঘটনাটি দেখে অবাক! যিনি নিজের হাতে চা বানাচ্ছেন,বয়ে আনছেন,কাপ-প্লেট ধুচ্ছেন, তিনি মাস্টারমশাই! 

ওহ্ আচ্ছা,তা বাপ্ তোর খবর কী?

সব, বলছি,তার আগে আপনার হাতের বানানো চা-টা খেয়ে নিই

আচ্ছা, বেশ,বেশ। 

এরপর সেই ঘোষ যা শোনাল তা হল এই,সে দীর্ঘদিন কয়লার ব্যবসা করছে।তাতে তার দারুণ প্রসার ও অভিজ্ঞতা হয়েছে। রোজগারও ভালো হচ্ছে। সে সেই সঙ্গে আরও জানাল,কুমারচন্দ্র যদি তার সঙ্গে একসঙ্গে ব্যবসা করে তাহলে তার জীবনে একটি স্মরনীয় ঘটনা ঘটবে।
তারপরও আরও দারুণ খবর এই,ঝরিয়ার কোলায়ারিতে অল্প টাকা দিলে কয়লা পাওয়া যায়।ঘোষ ছাত্রটি কয়লা সরবরাহের জন্য নদীয়া ও শান্তিপুর দেখবে।কুমারচন্দ্রকে দেখতে হবে কোলাঘাট।সেই কোলাঘাটেও কুমারচন্দ্রের ছাত্ররা আছে,তাই মাঝমধ্যে তাদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিতে দেশের কাজ কর্ম করা যাবে।

এসব শুনে কুমারচন্দ্র দারুণ উৎসাহিত হলেন।তিনি বললেন,কীভাবে কাজটা হবে? লোকে জানবে কী করে?

ছাত্রটি বলল,আপনি পরিচিত মানুষ,আপনার কথা বললেই সবাই আমাদের কাছ থেকে কয়লা নিতে চাইবে।

আচ্ছা, তাহলে একটা কাজ করি,একটা হ্যাণ্ডবিল ছাপিয়ে ফেলি,একটা কোম্পানির নাম দিতে হবে

স্যর,আপনার নামেই হোক

না,নাম হবে জানা অ্যাণ্ড ঘোষ কোল মার্চেন্ট 

ঠিক আছে স্যর

বলেই ছাত্রটি আবার কুমারচন্দ্রকে প্রণাম করল।

শুরু হয়ে গেল কয়লার ব্যবসা।
গ্রাম থেকে একদিন কুমারচন্দ্রের ভাইপো গুণাকর ধান বিক্রি করে দুইশত টাকা দিয়ে গেল। সেই টাকা নিয়ে কুমারচন্দ্র ঝরিয়া চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন,কোলায়ারিতে যে ম্যানোজার,সেও পরিচিত এক ছাত্র। সেও শ্রদ্ধার সঙ্গে কুমারচন্দ্রের সবকথা শুনল।
সে এক ওয়াগন কয়লা দিয়ে দিল।
কুমারচন্দ্র তাকে আশীর্বাদ করে বিদায় নিলেন।ছাত্রটি সেই সময় জানাল,স্যর,আপনাকে আর কষ্ট করে আসার দরকার নেই, আপনার কোনো পরিচিত লোক এলেই আমি কয়লা দিয়ে দেবো।আপনি কলকাতায় একটা অফিস খুলে ব্যবসাটা দেখুন।
কুমারচন্দ্র খুব খুশি হলেন।
ফিরে এসে ১ নং সোয়ালো লেনে অফিস খুললেন।
এক বছর দারুণ ব্যবসা চলতে লাগল।
লাভের মুখ দেখতেই বেশকিছু টাকা জাতীয় বিদ্যালয়ের জন্য টাকা পাঠিয়ে দিলেন। ভাইপোর টাকা মিটিয়ে দিলেন।
বেশ চলছিল।
সহসা দেড় বছরের মাথায় ঝরিয়া থেকে একটা চিঠি এলো। যা পড়ে কুমারচন্দ্রের মাথায় হাত।
তারা জানিয়েছে,কয়লা ঠিকঠাক পাঠাচ্ছে, কিন্তু পেমেন্টের টাকা আসছে না! স্যর,একটু দেখুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটিবার এখানে আসুন।

কুমারচন্দ্র ঝরিয়া ছুটলেন।
পৌঁছে গিয়ে যা শুনলেন,সবই বিশ্বাসঘাতকর সামিল।সেই ঘোষ ছাত্রটি নিয়মিত টাকা কুমারচন্দ্রের কাছ থেকে নিয়েছে ঝরিয়ায় জমা দেবে বলে,কিন্তু কোনো টাকা জমা দেয়নি। 
সব টাকা নিজের ব্যক্তিগত কাজে খরচ করেছে।ফলে সেখানে টাকার বকেয়া দরুন তারা সেই ঘোষকে আটকে রেখে কুমারচন্দ্রকে ডেকে পাঠায়।

কুমারচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন,কত টাকা বাকি?

স্যর,প্রায় তিন হাজার টাকা,বলে উঠল,কোয়ালিরির ম্যানেজার-ছাত্রটি।

ওহ্, আমার লোক চেনাতে ভুল হয়েছে, না, না,আমরা সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি,ব্যবসাটা এতো ভালো চলছিল,তার মাঝে এই অবস্থা! 

কয়লা নিয়ে চিন্তা করবেন না স্যর,আপনি যা বলবেন তাই হবে,শুধু টাকাটা যদি

কোনো চিন্তা করো না,আমি সব দায় নিলাম

তাহলে মিঃ ঘোষকে কী করব?

ওকে ছেড়ে দাও, পরাধীন দেশে আর কত পরাধীন থাকবে এরা? 

সেই ছাত্রটি ছাড়া পেয়ে কুমারচন্দ্রের পায়ে এসে পড়ল।স্যর,আমাকে ক্ষমা করে দিন,আমি লোভী হয়ে গেছিলাম। 

কুমারচন্দ্র নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর অদ্ভুত একটা কথা বললেন,প্রচণ্ড ক্ষুধায় কখনো রাস্তার কল থেকে জল খেয়ে গৃহে ফিরে হাসিমুখে বলতে পেরেছো,যে ক্ষুধা নেই। 
এটা একটা গেল,তারপর ভেবে দেখো,অসংখ্য ক্ষুধার্ত মুখ,তুমি তাদের কথা দিয়েছো,পেট ভরে খাওয়াবে আর পড়াবে,কিন্তু তা পারছ না!
সেই যে কলের জল খেয়ে ক্ষিদে মেটানোর কষ্ট, পরেরটা তার চেয়েও শতগুণ কষ্ট বেশি,তুমি কী সেই কষ্ট পেয়েছো কোনোদিন? 

বলেই নীরবে চলতে শুরু করলেন কুমারচন্দ্র।
বিশ্বাসঘাতক ছাত্র ও বিশ্বাসী ছাত্র দু'জনেই কুমারচন্দ্রের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।হয়তো তারা বুঝতে পেরেছে অথবা পারেনি,এই মানুষটার কাছে কয়লার ব্যবসা শুধু ব্যবসা ছিল না,ছিল মনুষ্যত্বের পথ তৈরির একটি রূপরেখা মাত্র। কালো কালো কয়লায় উজ্জ্বল হীরক সন্ধানের এক অভাবনীয় কর্ম। 

কুমারচন্দ্র দাদা দেবেনের কাছ থেকে এক হাজার টাকা এবং কংগ্রেসের এক কর্মীর কাছে ধারদেনা করে টাকা শোধ করলেন।
ঠিক সেই সময় ডাক দিলেন বীরেন্দ্রনাথ শাসমল।
পড়িমরি করে কুমারচন্দ্র ছুটলেন দেখা করতে। 

একটি বারান্দায় টেবিল-চেয়ারে বসে ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ। কুমারচন্দ্র তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

কী হল কুমার, বসে পড়ো 

না,বীরেনদা,আমি ঠিক আছি

আরে বসো না ভাই,কথা আছে

কুমারচন্দ্র একটু দূরে সরে শ্বেতপাথরের মেঝেতে বসে পড়লেন। 

এ কি কুমার ওখানে কেন?

এখানে ঠিক আছি বীরেনদা,গুরুর আসনের সমতায় আমি বসতে পারি না

তাই, আচ্ছা,শিষ্য যদি গুরুর আসনে না আসতে পারে,গুরু তো শিষ্যের আসনে যেতে পারে,বলেই বীরেন্দ্রনাথ সেই মেঝেতে গিয়ে কুমারচন্দ্রের পাশে বসলেন।
একি করছেন বীরেনদা,কোথায় আপনি আর কোথায় আমি!  যে মানুষটা মানুষের জন্য নিজের গৃহ শিক্ষার জন্য ছেড়ে দেয়,কত টাকার ব্যারিস্টারি ত্যাগ করে,নিজের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে পায়ে হেঁটে জনসংযোগ করে চলে,যে মানুষটা কত মানুষের প্রেরণা, শক্তি এবং সাহস,তাঁর পায়ের কাছে বসাই তো সৌভাগ্য! 

কুমার তুমি চিত্তদার কথা শুনলে অবাক বনে যাবে!
দাঁড়াও,তার আগে একটা কাজ হয়নি
বলেই বীরেন্দ্রনাথ হাঁক পাড়লেন,ওরে কে আছিস?

বলা মাত্র মধ্যাহ্ন ভোজনের পরিপাটি ব্যবস্থা টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে গেল একজন চাকর।
এসো, আগে গুরুগৃহে আহার সমাপ্ত হোক তারপর কথা বলছি

আমি খেয়েছি,বীরেনদা,বলেই কুমারচন্দ্র একবার সুসজ্জিত খাবারের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।

আচ্ছা ঠিক আছে,আমি তো জানি কী খাওয়া হয়েছে, আর হলেও বা,আমাদের কুমারচন্দ্র যে কতবড়ো পেটুকচন্দ্র, আমি সব খবর রাখি,বলে বীরেন্দ্রনাথ হেসে ফেললেন। 

কুমারচন্দ্র কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।
তার আগেই বীরেন্দ্রনাথ ছদ্মরাগ দেখিয়ে বললেন,গুরু-আজ্ঞা লঙ্ঘন করলে কী হয় মহাভারতে পড়া আছে তো? তাই কোনো কথা নয়।

সুদীর্ঘকাল পরে কুমারচন্দ্র এতো সুস্বাদু, এতো আয়োজন ঘন সুন্দর খাবার খেতে পেলেন।তিনি বেশ আয়েশ করে খেলেন।

খাওয়ার শেষে বীরেন্দ্রনাথ বললেন,আহ্ যা শান্তি পেলাম,মনে হল, আমারই ক্ষুধা মিটে গিয়ে যেন শান্তি হল।

কুমারচন্দ্র মৃদুস্বরে বললেন,আপনি যেরকম বলবেন,আমি তাই করব,বীরেনদা, আপনি আমার কাছে আদর্শ। আপনাকে দেখে পথ চলা শিখছি..

তুমি আমার কথা বলছো,চিত্তরঞ্জন দাশের কথা শুনলে অবাক হয়ে যাবে।তিনি অসহযোগ আন্দোলনের সময় যে আইনি ব্যবসা ছেড়েছিলেন,তখন তাঁর রোজগার ছিল সত্তর হাজার টাকা,ভাবতে পারো?
দক্ষিণ কলকাতায় নিজের সুরম্য অট্টালিকা দেশের মানুষের সেবার জন্য ত্যাগ করেছেন।
জানো,তিনি লন্ডনের হাল ফ্যাসানের পোশাক পরতে অভ্যস্ত,সেই তিনি হাতে বোনা সাদা খদ্দের পরে ঘুরেন।

সত্যি, আমি অভিভূত, বললেন কুমারচন্দ্র। 

আরও শোনো,আন্দোলনের সময় একবার সপরিবারে ও সপার্ষদে ভোজন করছিলেন। হঠাৎ রান্নার ঠাকুরকে ডেকে চিত্তরঞ্জন বললেন,ঠাকুর,কাল থেকে আমার ভাতে একটু কাঁকরগুড়ো মিশিয়ে দিতে পারো?
কথাগুলো শুনে সকলে স্তম্ভিত! একি বলছেন চিত্তরঞ্জন। 
পরে নিজেই স্বগতোক্তির মতো বলে উঠলেন,মানে, শুনছিলাম যে জেলের ভাতে বড়ো কাঁকর থাকে,জেলে তো যেতেই হবে,একটু অভ্যাস করে রাখলে সুবিধা হতো।
এইরকম সাহসী অভ্যাস চাই কুমার

বুঝেছি

আরও শোনো, ইংরেজ রাজসরকার বিরুদ্ধে যেসব স্বদেশীরা জীবনপণ করেছে কলকাতায় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেবাযত্ন করার স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যাচ্ছিল না।কেউ কোনো আদর্শ খুঁজে পাচ্ছিল না! তখন চিত্তরঞ্জন কী করলেন জানো?

বলুন?

তিনি নিজের পুত্র, স্ত্রী এবং ভগিনিকে নির্দেশ দিলেন,আইন অমান্য করে পুলিশের হাত গ্রেফতার হতে।তাই সবাই হলেন,এবং শেষে নিজেও... তারপর জানো,দলে দলে কারাগার ঘিরে ফেলল সাধারণ মানুষেরা।তারা যেন এই ঘটনায় নতুন করে জেগে উঠল।

এতো আত্মবলিদানের পরাকাষ্ঠা, মুগ্ধ চিত্তে উচ্চারণ করলেন কুমারচন্দ্র।

হ্যাঁ,আমাদের উচিত, চিত্তরঞ্জন দাশের মতো পথপ্রদর্শককে সাহায্য করা,সবকিছু দিয়ে, বলো,এটাই কি সঠিক নয়?

একদম, আমি তাই করব।

এইভাবে কুমারচন্দ্রকে একটু একটু বীরেন্দ্রনাথ জাতীয় আন্দোলনের সুতোয় বেঁধে দিচ্ছিলেন,এ-ও এক নতুন মহাভারতের কাহিনি,সেই দ্রোণাচার্য এবং অর্জুনের অমৃতকথা, যা অশেষ...  অফুরন্ত... 

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments