জ্বলদর্চি

নাগপঞ্চমী /ভাস্করব্রত পতি


পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ২৯

নাগপঞ্চমী

ভাস্করব্রত পতি

শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী তিথিই 'নাগপঞ্চমী' নামে পরিচিত। ধর্মভীরু মানুষের বিশ্বাস যে এইদিন সাপেদের প্রিয় দিন। তবে অনেক যায়গায় 'নাগপঞ্চমী' শ্রাবণ মাসেরই শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে পালিত হয়। চৈত্রের শুক্লা পঞ্চমী কিংবা ভাদ্রের শুক্লা পঞ্চমীতেও এলাকা বিশেষে পালিত হয়। এই বাংলায় আষাঢ়, শ্রাবণ এবং ভাদ্র মাস জুড়ে সর্পদেবীর পূজার্চনা হয়ে থাকে। 

নাগপঞ্চমীতে সর্পদেবীর পূজার পাশাপাশি সর্পদেরও দেবতা হিসাবে পূজা করা হয়। শিবের গলায় থাকে বাসুকি সাপ। তাই সাপ শিবেরও খুব প্রিয়। ফলে সর্প দেবতার পূজা করলে দেবাদিদেব মহাদেবও খুশি হন বলে বিশ্বাস। কথিত আছে যে, শ্রাবণ মাসের এইদিনেই কালীয়দমন করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আর এই শ্রাবণের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতেই জন্মেঞ্জয়ের সর্প নিধন যজ্ঞ আস্তিক মুনি বন্ধ করেছিলেন বলে কথিত। সেই দিনেই পালিত হয় নাগপঞ্চমী।

কেতকাদাস ক্ষেমানন্দর 'মনসামঙ্গল' এ আছে -- "জ্যেষ্ঠ মাসে পূজা হব দশরা দিবসে। / আষাঢ়েতে হব নাগপঞ্চমীর পূজা।। / ঝাঁপান করিব যত ঝাঁপনিয়া ওঝা। / শ্রাবণ মাসেতে পূজা লবে খর তরা। / খই দধি দিয়া লোক পালিবেক চিরা। / ভাদ্র মাসেতে লোক পূজিব তোমারে। / হইব আরফা ব্রত পৃথিবী ভিতরে। / পান্ত ওদন দিয়া পূজিবেক তোমা। / আশ্বিনে অম্বিকা-পূজা দিতে নাহি সীমা। / কার্তিক মাসের পূজা কহনে না যায়। / সিজের সহিত বৃক্ষ পূজিব তোমায়। / আখণ্ড সিজের ডাল করিযা রোপনে। / নূতন সকল দ্রব্য দিয়া অগ্রহানে। / পৌষে পরমেশ্বরী পবিত্র আচরি। / মাঘ মাসে মহাপূজা লইবে কুমারী। / ফাল্গুন-চৈত্র মাসে এ চোদ্দ ভুবনে। / করিব তোমার পূজা সুর নর-গনে।।" আবার বিজয়গুপ্তর 'পদ্মাপুরাণ' এ পাই -- "এই ত আষাঢ় মাসে জগৎ হরষিত। / চৌদিকে মনসা পূজে গাইনে গাহে গীত।। / পাতিয়া বিচিত্র ঘট সমুখে গীত গায়ে। / কোন অপরাধে ঘট ঠেলে বাম পায়ে।। / চান্দোসদাগর বেটা চম্পকিয়া রাজা। / চম্পক নগরে বেটা মানা করে পূজা।। / এইত শ্রাবণ মাসে মনসা পঞ্চমী। / লুকাইয়া সনকা পূজে তথায় গেলাম আমি।।"


আষাঢ় থেকে ভাদ্র পর্যন্ত এই বাংলায় বর্ষাকাল। তাই সাপের উৎপাত বেড়ে যায়। ফলে এই সময় সর্পদেবীর পূজার চল সবচেয়ে বেশি। মূলতঃ অষ্টনাগের তথা কুলীর, অনন্ত, বাসুকি, তক্ষক, শঙ্খ, কর্কট, মহাপদ্ম এবং পদ্ম নামধারী সাপেদের পূজা করা হয়। পদ্মাপুরাণ অনুসারে -- "অষ্টনাগ যথা—অনন্তো বাসুকি: পদ্মে মহাপদ্মশ্চ তক্ষকঃ। / কুলীর: কর্কট: শঙ্খো হ্যষ্টৌ নাগাঃ প্রকীর্তিতাঃ।।" এই অষ্টনাগের মধ্যে অনন্ত ও কুলির হল ব্রাম্ভণ, বাসুকি ও শঙ্খপাল হল ক্ষত্রীয়, তক্ষক ও মহাপদ্ম হল বৈশ্য এবং কর্কট ও পদ্ম হল শূদ্র।

নানা ভাবে এবং নানা পদ্ধতিতে পূজা করা হয় দেবীর। মনসা পূজায় ধূপ জ্বালানো এবং ধুনা পোড়ানো নিষিদ্ধ। গেরস্থের বাড়ির সামনে মনসা তথা সিজ গাছের তলে আয়োজন করা হয় পূজার। যদি মনসা গাছ না থাকে সেক্ষেত্রে একটি মনসা ডাল ভেঙে এনে তুলসীতলায় এক মুঠো গোবরের বল তৈরি করে তাতে ঐ মনসার ডাল গেঁথে দেওয়া হয়। এরপর সেখানে পূজা করা হয় দেবী মনসা ও অষ্টনাগের। দেবীর ধ্যানমন্ত্র হিসেবে বলা হয় -- "দেবীমাহিনাং শশধরবদনাং চারুকান্তিং বদান্যাং, হংসারূঢ়া মুদারামরুণিতবসনাং সেবিতাং সিন্ধিকামৈঃ স্মেরাষ্যাং মণ্ডিতাঙ্গীং কনকমণিগণৈর্নাগরত্নৈরনেকৈর্বন্দেহহং সাষ্টনাগমুর কুচযুগলাং ভোগিনীং কামরূপাম্॥"

কোথাও কোথাও পদ্মপাতায় কিংবা কচুপাতায় একটি মাটির ঘট স্থাপন করা হয়। ঐ ঘটে আতপ চাল ভর্তি করা থাকে। একটা ঢাকনা দেওয়া হয় সাপের ফনার মতো। এই ঘটটি দেবাদিদেব বলে কল্পিত করা হয়। পূজোর সময় এই ঘটে নৈবেদ্য চাল কলার সাথে কচু ফুল দিতেই হবে। রাতে মনসামঙ্গলের গান গেয়ে দেবীর অধিবাস করার পর সকালে মেঝেতে আলপনা এঁকে তার ওপর পদ্মপাতা বিছিয়ে মনসার মূর্তি বসিয়ে পূজা করা হয়। মূর্তির পাশে থাকে মনসা গাছ বা সিজ গাছ। কোথাও কোথাও অষ্টনাগমূর্তিও থাকে। একটি পাত্রে অষ্টনাগের জন্য দুধ ও কলা রাখা থাকে। আর নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় বর্ষাকালে পাওয়া যায় এমন সব ধরনের ফল ও ফুল সহ হাঁসের ডিম, পদ্মফুল, চালকুমড়া, আখ, কচু ইত্যাদি। এছাড়া মনসা দেবীর নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় দুধ, কলা, চালভাজা, ছোলাভাজা, খই, নাড়ু ইত্যাদি। অঞ্চল বিশেষে ছাগল, পায়রা, হাঁস, লাউ, কুমড়ো বলি দেওয়ার রীতি রয়েছে। আসলে নাগপঞ্চমীতে নাগদেবতাকে পূজা করলে ঘরে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে বলে বিশ্বাস। কেননা, এই নাগ দেবতাকে গেরস্থের রক্ষক হিসেবেই ভাবা হয়। নাগপূজার প্রনামমন্ত্র হিসেবে বলা হয় --  "ওঁ অযোনিসম্ভবে মাতর্মহেশ্বরসুতে শুভে। পদ্মালয়ে নমোস্তুভ্যং রক্ষ মাং বৃজিনোর্ণবাৎ, আস্তীকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা, জরৎকারু মুনেঃ পত্নী মনসাদেবী নমোহস্তুতে।"


নাগপঞ্চমী পালনের শেষে থাকে ব্রতকথা শোনার নিয়ম। এই ব্রতকথা শোনানোর ভার থাকে পরিবারের কোনো বয়স্ক মহিলার। "পরের মন্দে ভালো যে করে / ভাতে পুতে সে বাড়ে। / পরের ভালোয় মন্দ যে করে, / ভস্ম হয়ে সে মরে।।"-- নাগপঞ্চমী ব্রতের ছড়ায় এটি উল্লেখ করেছিলেন পরমেশপ্রসন্ন রায় বিদ্যানন্দ। এইসময় সারাদিন নিরামিষ আহার করে থাকা বাকি ব্রতী মহিলারা একসাথে জড়ো হয়ে তা শোনেন। এর ফলে একটা সামাজিক নৈকট্য তৈরি হয় সবার মনের মধ্যে। সর্প দেবীর পূজা প্রচলনের বিষয়ে দুটি কাহিনীর খোঁজ মেলে। প্রথমটি এরকম -- "এক চাষী মাঠে হাল করার সময় হঠাৎ তাঁর লাঙলের ফলা জমির গর্তে ঢুকে যায়। সেই গর্তে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে থাকতো একটি কেউটে সাপ। লাঙলের ফলার আঘাতে বাচ্চারা সকলেই মারা যায়। সাপিনী ফিরে এসে লাঙলের ফলায় রক্তের দাগ দেখে বুঝতে পারে যে এটা ঐ চাষীর কাজ। তখন সে রেগে চাষীর বাড়ির সকলকে কামড়ে মেরে ফেলে। তবুও তাঁর রাগ কমলো না। চাষীর এক মেয়ে সেসময় শ্বশুরবাড়িতে থাকায় বেঁচে গিয়েছিল। সে তাঁকেও মেরে ফেলতে চাইলো। সাপিনী যখন সেখানেও গেল তখন চাষীর মেয়ে শেষনাগের পূজা করছিল। পূজো শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সাপিনী কুলুঙ্গিতে রাখা চন্দনের বাটি থেকে চন্দন মাখলো। সেখানে ছিল নয় নাগ কুল পরিবারের আঁকা ছবি। এতে সে খুশি হয়ে মেয়েটিকে সব ঘটনা বললো। সব রাগ গলে জল। চাষীর মেয়ে তখন করজোড়ে পরিবারের সকলের জীবন ফিরিয়ে দিতে বললো। সাপিনী তাঁকে অমৃত দিয়ে বললো এটা তাঁদের খাইয়ে দিতে। মেয়েটি  সঙ্গে সঙ্গে বাপের বাড়ির সকলকে খাওয়াতেই তাঁরা সবাই বেঁচে উঠলো। আর সেই থেকে প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের পঞ্চম দিনে হাল করা চলবে না। কোনো আনাজ কাটা চলবে না। রান্না করাও যাবে না। নাগরাজকে দুধ খাওয়াতে হবে।"

দ্বিতীয় কাহিনীটি হল -- "একসময় এক ব্রাহ্মণের ছিল সাত পুত্রবধূর মধ্যে ছোট বউ ছাড়া সকলেই বাপের বাড়ি চলে গেল। আসলে ছোট বউয়ের তিন কূলে কেউ ছিলনা। তাই সে নাগেদেরকে নিজের বলে মনে করতো। তা জানতে পেরে শেষনাগ ব্রাহ্মণের বেশে এসে বলল যে সে তাঁর ভাগ্নীকে নিতে এসেছে। এদিকে শাশুড়ীর জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ঐ অপরিচিত ব্রাহ্মণকেই মামা বলে মেনে নিল ছোট বৌ। শেষনাগ তখন ছোট বউকে একটি ইঁদুরের গর্তে নিয়ে গিয়ে তাঁর সর্পরূপ ধারণ করল। সে ছোট বউকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। কিছুদিন পরে নাগিনী বাচ্চার জন্ম দিল। তাঁরা সব জায়গায় খেলতে লাগল। ছোট বউয়ের দায়িত্ব ছিল একটা পিতলের বাতি ধরে রাখা। ঘরময় ছুটে বেড়ানো বাচ্চা সাপেদের দেখে ভয়ে ছোট বউ-এর হাতে থেকে ঐ বাতিটি পড়ে যায়। এতে বাচ্চাগুলোর লেজ কেটে যায়। তখন ছোট বউকে ফের তাঁর শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয় শেষনাগ। যথারীতি শ্রাবণ মাসের পঞ্চমীতে ছোট বউ নাগমূর্তি বানিয়ে পূজা করতে শুরু করে সেখানে। এদিকে সাপের দলবল চায় প্রতিশোধ নিতে। ছোট বউয়ের শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি লুকিয়ে থাকলো সুযোগের অপেক্ষায়। অথচ ছোটবৌ নাগ দেবতার কাছে তাঁর সাপ ভাইদের সুস্থতা কামনা করছিল। লেজকাটা বাচ্চা সাপেরা তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারলো। তখন নাগ দেবতার জন্য রাখা দুধ ও মুড়ি খেয়ে সেখানে একটি সুন্দর দামী হার রেখে চলে গেল। আর ছোট বউয়ের ভাগ্য ফিরে গেল।"

নাগপঞ্চমীতে সর্পদেবীর পূজা হলেও মোট আট ভাবে দেবী মনসার আরাধনা করা হয় এই বঙ্গে। প্রথমত জৈষ্ঠ্য মাসে দশহরাতে দশ ধরনের ফল দিয়ে হয়। ঐ মাসের সংক্রান্তি তথা স্থাপন সংক্রান্তিতে ফল, নৈবেদ্য দিয়ে পূজা হয়। আষাঢ়ে হয় ষষ্ঠীরান্না দিয়ে বিশেষ পূজা। শ্রাবণের শুক্লাপঞ্চমীতে হয় নাগপঞ্চমীর আরাধনা। শ্রাবণেই হয় গোটা রান্না। ভাদ্রে হয় ঢেরাপাল্লা। আষাঢ় ও ভাদ্রের মধ্যে হয় ইচ্ছে রান্না। ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পূজার দিন হয় বুড়ো মনসার রান্না। একে বলে বুড়ো রান্না বা যোগীরান্না (সূত্র - ড. শ্যামল বেরা)। হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থানেও নাগপঞ্চমী উদযাপিত হয়। দক্ষিণ ভারতে এই দিন ভাইদের রক্ষার জন্য বোনেরা প্রার্থনা করে।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments