জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২৯ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২৯

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

!!পল দো পল মেরি কহানি হ্যায়!!

শিরা-উপশিরা নিয়ে জীবনের আর কত বিজ্ঞাপন দিতে হবে শিমুলে পলাশেও... জানি না ।

ইতিমধ্যে একদিন ইয়াহু তে জানতে পারলাম অমর্ত সেনকে নিয়ে নর্থ আমেরিকা থেকে একটা বই প্রকাশ করবে আমেরিকার বাঙালিরা।

'যারা ইচ্ছুক তারা ওনার সম্বন্ধে এক লাইন বা দু লাইন এ কিছু লিখে পাঠান।' আমি লিখে পাঠালাম। তখন একদিন দেখি আমার অফিসের আইডি তে একজন আমেরিকার নামকরা ভদ্রলোকের নাম।

তিনি লিখেছিলেন মনে আছে যে, “কি দারুন লেখাটা । আপনি তো খুব ভালো লেখেন।”

তখন সেই ভদ্রলোক এবং আমার লেখাও সিলেক্ট হয়েছিল। ঢাকা, বাংলা ডিপার্টমেন্টের হেড, উনিও লিখেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন আমাকে। ব্যটন রুজের একজনের মারফত বাংলাদেশের হেড-ওনার সাথে আলাপ হয়। উনি লিখলেন, “বিদেশে থেকেও এত সুন্দর বাংলা চর্চা করেন, গর্বিত হচ্ছি”। মনে আছে সেই সব কথা। তবে নিজে যে কি লিখেছিলাম তা আজ পর্যন্ত মনে করতে পারছি না। অদ্ভুত লাগে।

বটীর শিবপুরের বন্ধু ছিল সেই ভদ্রলোক। তবে বটী এইবার বেশী বলে নি। একবার ধোঁকা খেয়েছিল তো। তাই নিজেকে অপরাধী ভাবত সব সময়। দিদিয়ার সাথে ওনার সব কথা হয়েছিল তখন।

সে'জদা আর দিদিয়া কার সাথে প্রায়-ই গল্প করত... বুঝতে পারতাম না। অফিসের কাজ, “ব্যটনরুজ গ্রীন -ভলান্টারি কাজ”... এইসব নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে হত।

তারপর সেই ভদ্রলোক বটির কাছে আমার সম্বন্ধে সব জানতে চাইলেন। তারপর আমার অফিসে ফোন করলেন একদিন কাজের অজুহাতে। নিজের কথা বললেন। কথায় কথায় বেশ আমরা দুপক্ষই পরিচিত হয়ে গেলাম। আমরা নানা রকম গল্প করতাম। আমি জানতাম না যে ভদ্রলোক দিদিয়া, সেজদার সাথে নিয়মিত কথা বলেন। তিনি ডিভোর্স । অবশ্যই সেই নিয়ে কোন কথা হয় নি মনে আছে।

সেই সময়ে ওনার মা ছিলেন সাথে। তারপর একদিন সে'জদা অফিস যাওয়ার সময় আমাকে বলল, “শিমুল, অফিসে একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করছিল-তুই এভেলেবল কিনা? বলেছি না-বুঝলি? ইদানিং মন্টুর(বটির) বন্ধু একজন বাঙালি ভদ্রলোকের সাথে কথা হয়েছে, মনে হল ভালো এবং সৎ।”

গাড়ি চালাচ্ছিলাম-“কিছু বলি নি”-শুনতে পাই নি এমন ভাব করলাম।

যাই হোক, একদিন বটীর সাথে উনি এলেন আমাদের বাড়ি। বুঝতে পারি নি। কথাবার্তা হল নানারকম। উনিও এনভাইরণমেন্টাল ইঞ্জিনীয়ার।

শিমুলের বাড়ির লোকজনেরা ওনার অনেককিছুই চেপে গেল।

সব শুনে হয়ত শিমুল বেঁকে বসবে কারণ সে এই ধরণের আলোচনা হলেই বলত - “যাদের ছেলে মেয়ে আছে তাদের দ্বিতীয়বার বিয়ে করাটাকে সে সাপোর্ট করে না। মা বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে বাচ্চারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

তাই সবাই ব্যাপারটাকে চেপে গেল। সবাই জানত যে, পরে শিমুল জানতে পারলেও কোনরকম অভিযোগের মধ্যে দিয়ে যাবে না। তার জীবন থাকতে আবার দাগ লাগা একটা সংসারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না ।

শনিবার দেখে সেই ভদ্রলোকের মা শিমুলের দিদিয়াকে ফোন করলেন।

ক্রিং... ক্রিং... ক্রিং!

ফোনটা ধরতে দেরী হওয়াতে ওনার মা ভাবলেন হয়ত শিমুলের ইচ্ছে নেই এই বিয়েতে। মিন্টুর চেহারা বেশ খারাপ হয়েছে। সব মেয়েরই একটু সুন্দর ছেলে পছন্দ, এইরকম নানান কুচিন্তা ওনাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। মেয়েটার ছবি কী মিষ্টি। আবার ফোন করে পেলেন।

“হ্যাঁ মা! তোমাদের ফোনটা কি খারাপ ছিল?”

“না, মাসীমা আমরা একটু বেড়িয়েছিলাম। অনেক বুঝিয়ে শিমুলকে রাজি করিয়েছি, মাসীমা। এখনও স্পষ্ট করে বলে নি অবশ্য। বড্ড চাপা মেয়ে-মুশকিল সেখানেই।
তাও আর চিন্তা নয়। আমরা তৈরী হই। দুজনকে এক যায়গায় করতে পারলে আপনি ও আমরা নিশ্চিন্ত হই।”

মাসীমার কথা শুনে মনে হল মাসীমা আনন্দাশ্রু ফেলছেন, সেকথা সেজ'দাকে দিদিয়া বলল। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে ফোন নামিয়ে রাখলেন।

আমি তো 'হ্যাঁ' বলিই নি। দিদিয়া কিভাবে বলল, “শিমুল রাজি হয়েছে?” মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করতে লাগল।

তারপর সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে ফোন পাবার পর ছলেবলে কৌশলে দিদিয়া আবার বোঝাতে শুরু করে... “বৃক্ষতলে বৃক্ষছায়া সব সময় থাকে না রে। বৌদিরা দেখছিস তো স্বয়ংকৃ্তিসার। তুই তো সেরকম মেয়ে নস যে, একা বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবি। একজন সাথি থাকলে জীবন টা এগিয়ে যায় তড়তড় করে। প্রিয়বাদিনাম মানে জানিস তো? প্রিয়ভাষী ব্যক্তির শক্রু জন্মায় না।”

“জন্মায় দিদিয়া জন্মায়। আড়ালে আবডালে জন্মায় সেই আগাছাদের মত- আমরা চিনে উঠতে পারি না। কিন্তু-এর একটা খেলা চলে আমি বুঝতে পারি। একটা গল্পের স্রোত যখন বয়ে চলে--বাধা আসে বৈকি। মাঝি তখন যদি হাল-টাকে শক্ত করে ধরে থাকে--নৌকা টলমল করলেও এগিয়ে চলে তার লক্ষ্যে।”

একটা প্রবল ধুর্ণিঝড় উঠল। সকাল থেকে তো সূর্য দাপাচ্ছিল খুব। হঠাৎ করেই আকাশে বিদ্যুৎ গলার শির ফুলিয়েই বা চিৎকার করে উঠল কেন? কেঁপে উঠলাম আবার একবার। বিদ্যুৎদের মান রাখতেই ঝমঝমে বৃষ্টিতে শান্ত হল পরিবেশ। আর আমি তখন চিন্তার খেয়ায়... ভেসে চলেছি ।

“সব বুঝি গো দিদিয়া। জীবন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে তা কি আর জোড়া লাগে। যা আছে, যদ্দিন আছে, যেমন আছে সেইরকমই থাক। দেখাই যাক না শেষে কী হয়।” শিমুল তার দিদিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করল।

“শিমুল গাছে তূলোর বীজ ফাটলে, একটা দুটো পলাতক বীজ পাখা মেলে উড়তে উড়তে জানলা দিয়ে অন্য কারুর ঘরে ঢুকে বাতাসে ভাসতে থাকে। মাঝে মাঝে এক উড়ো চিন্তা মনের ঘরে ভেসে আসে। মেয়ে বা পুরুষ একবার, দুবার তিনবার বিবাহ করতেই পারে। বিপন্তীক বা বিধবা হলেও আবার সংসার পাততে পারে, কোন বাধা নেই। অত বিধান দেখলে চলে না। আমি তা বিশ্বাস করি মনে প্রাণে।” বুঝলি শিমু।

কিন্তু আমার প্রশ্ন... “নিজের জীবন তুচ্ছ করে তুই এত কষ্ট করে আমাদের মানুষ করলি। কি পেলি? বল! ইচ্ছা হয় তুই আমি চলে যাই দূরে। যেখানে কেউ থাকবে না। তুই সারাজীবন ভাই বোন করে কী পেলি? কিছু না। মা বাবা তাদের কর্তব্য করেন কিন্তু তুই? এত শিক্ষিত হয়েও কি কিছু করতে পারলি? একটা না দু দুটো বিষয়ে এম.এ। ভাবা যায় না। শুধু দিয়েই গেলি সারাজীবন। নিজেও চাকরী করতিস, সব ভাইদের সংসারে ঢেলে দিতিস। তুই কেন এরকম ভাবে নিজের জীবন সমর্পণ করেছিলি। বলতে পারিস?”

“সেইজন্যই তো তোকে সাবধান করে দিচ্ছি। মেয়েদের জীবন বর্ণপরিচয়ের প্রথম দু অক্ষরেই পড়ে থাকে। অ আর আ। অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, আর আ-এ আমটি খাব পেড়ে। আমি কিন্তু কোন বই পড়ে তোকে বলছি না রে শিমু। ওরে তোকে যে আমি মেয়ের মতন করে মানুষ করেছি। হয়ত ঠিক মতন করে মানুষ করতে পারি নি। তাই তো বারবার করাতের শব্দ শুনি মনের ভিতরে।” দিদিয়ার গলা ধরে এলো।

“চুপ করে থাকিস না। কিছু বল! চাকরি করে খালি বড় বড় কথা বলতে শিখেছে!” দিদিয়া আদরের ধমক দিল।

“ঠিক আছে। আমি যা বলছি শোন ভালো করে। বাজে বকছিস বলে উড়িয়ে দিবি না বুঝলি দিদিয়া? তাহলে বলব না। জানিস তো কোকিলেরা বর্ষাকালে মৌণব্রত নিয়ে থাকে। এটা কিন্তু ভালো কাজ করে। কারণ তখন ভেকগণ বক্তা হয়-তাই কোকিল নীরব থাকাকেই বেচে নেয়।” এই বলে দিদিয়ার গলা জড়িয়ে ধরল শিমুল।

আর এটাও ঠিক সেইরকম, তাই না রে দিদিয়া...

“এই দেখ,আবার তুই মন খারাপ করছিস …? এ যে আমার কি অবস্থা -তা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। এখন তো আমি প্রেস্টিজিয়াস জব করি। দেখবি, এই তোর শিমু কত শক্ত হয়ে গেছে। একটুও কি বদলাইনি বল? একা একা অফিস যাচ্ছি, ছেলেদের সাথেও কথা বলছি। অফিসে কত নাম হয়েছে...সব কিছু কিন্তু তোর জন্য দিদিয়া। অনেক মা ও তাদের মেয়েকে ঠিক নৌকায় বসাতে পারে না--সেখানে তুই তো জিতে গেছিস।

দেখ মানুষ অভ্যেসের দাস। নিজে স্বাধীন থাকলে অনেক কাজ করা যায় জীবনে। আমার খুব শখ... জীবনে কিছু করি। একটু টাকা, একটু স্নেহ যাদের দরকার... তাদের জন্য কিছু করা। টাকা না থাকলে তো কিছুই করা যাবে না। এসব করার জন্য কিছু টাকা সাথে থাকা চাই। অফিসে কিছু ভালো কাজ করছি না, একদম বলব না।

আমেরিকান প্রিয় বান্ধবী ইভেটকে সিগারেট খাওয়ার বাজে অভ্যাস থেকে সুস্থ জীবনে আনতে পেরেছি, তাই তো সে সব সময় আমাকে বলে, “মরে গেলেও তোকে ভুলব না, শিমুল। তাই তো এত ভালোবাসে আমাকে। কি সুন্দর বিয়ে হয়েছে-দুটো ফুটফুটে বাচ্চার মা সে এখন। অফিসে অন্যান্য বন্ধুরাও বলত, “ইউ ডিড এ গুড জব।” এটাই আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

আর দেখলিই তো, স্কলারশীপ নিয়ে পড়লাম। কারুর কাছে হাত পাতলাম না। এটা তো তোর আমার গর্ব তাই না? 'যশো দেহি' বলে তো আমি কোনোদিন প্রার্থনা করিনি, বলেছি 'বলম দেহি'। দিদিয়া শুনে হেসে ফেলেছিল।

“পারিস বটে শিমু তুই-সময় পেলে লিখিস সোনা। আমার আশীর্বাদ রইল।” তোর আবার “নিউ রোডস, নিউ রাইটস” শুরু হোক। আমি দেখে যেতে চাই।”

“হুম! কি লিখব? ছোটবেলায় পড়তে দিয়েছিস কোনো বড়দের বই? লুকিয়ে রাখতিস। কিন্তু দিদিয়া। আজ আমি সত্যি কথাটা বলেই ফেলি। আমি তো বড় হয়ে গেছি এখন। আমি না লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম...তুই আর বৌদি যখন নেপিয়ার টাউনে বৌদির বাড়ি যেতি...”

“তাইইই? ওরে দুষ্টু মেয়ে! তাই ভাবতাম পাতাগুলো মোড়া কেন?” হি হি করে হেসে ফেলল দুজনেই।

বাবা একদিন দেখে ফেলেছিল আমাকে দেশ পড়তে। দিদিয়াকে বলেছিলেন, “ফাউ আজকাল নভেল পড়ছে, কিন্তু? একটু লক্ষ্য রেখো।”

হি হি হি আমি কি খারাপ হয়েছি? সত্যিই বল তো দিদিয়া আমার।

“অ্যা...অ্যাই! শোনো! এইবার সেই ভদ্রলোকের গল্প করো তো শুনি। না না সেই ভদ্রলোকের গল্প কিঁউ নেহি বলতা? এদিক ওদিক গল্প করতা খালি।

আচ্ছা তাকেই কি …শিমুল? পলাশ মুখ চোখ মটকে বলে ফেলল কথাগুলো।

“কোন ভদ্রলোক আবার? বাব্বা! নিজের গল্প শুনতে কি ভালোবাসে।”

এই যে প্রেম! এই প্রেমের প্রথম অনুভূতিটি পাবার জন্যে এই জীবন পর্যন্ত প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল, মশাই। একটা বীজ পুঁতলেই তক্ষুণি তো আর একটা গাছ হ্য় না। কত তমিস্রার তপস্যা করে রাত্রি প্রভাত-হিল্লোলের মুখ দেখে। ডালাসে সজল দাশের কাছে আমার সম্বন্ধে শুনেছিলে যে, আমি ব্যাটন রুজ কি রকম ছিলাম।”

“ওই দেখো আবার হিল্লোল?আমার এই নাম রাখার কথা মা ভেবেছিল। কোথায় কাজ করতেন সেই ভদ্রলোক?”

“উনি কাজ করতেন ডালাসে এনভাইরণমেন্টের ওয়াটার এনফোর্সমেণ্টে প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসাবে আর আমার বড় ভাইঝিও কলেজ পাশ করেই কাজে ঢুকেছিল সায়েন্টিস্ট হিসেবে লুইজিয়ানায় ওয়াটার এনফোর্সমেন্ট-এ । কাজেই ভাইঝি খুব ইন্টেরেস্টেড। আমেরিকায় EPA পুরো স্টেট গর্ভমেন্ট কে কন্ট্রোল করে, সেটা জানতাম না। সেই ভদ্রলোকের কাছে জানতে পারি। তখন থেকেই সেই ভদ্রলোক প্রভু আর আমি ভৃত্য। ভদ্রলোক ব্যাটন রুজ যেতেন ঠিকই তবে আমাদের অফিসে না, পরে বটী বলেছিল। ঘুরে ফিরে সেই ব্যটনরুজের LDHH(লুইজিয়ানা ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড হস্পিটালস) অফিসে যেতেন অডিট করতে।

একদিন উনি হঠাৎ দিদিয়াদের কাছে প্রস্তাব করলেন, আমার ফটো দেখতে চান।

আমি তখন ফটো কাউকে পাঠাতাম না বা দেখাতে চাইতাম না। ফটো চাওয়াতে একটু বিরক্ত হয়েছিলাম । বেশ কয়েকদিন চুপচাপ ছিলাম, তারপর উনি আমার অফিসের ই-মেল এড্রেস এ একটি মেল পাঠান। ওনার মা-এর সম্বন্ধে লিখলেন। অনেক বলাতে বাড়ী থেকে একটা ফটো পাঠাল ।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments